লিও থেকে আসাদ। মক্কার পথে যাত্রা।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:৩০:০৯ দুপুর
”মক্কার পথ” গ্রন্থটি দেখেছিলাম খুব ছোটবেলায়। আমার দাদা বইটি ৪-৫ কপি কিনেছিলেন। তখনও এই বইটি পড়ার বা বোঝার বয়স হয়নি। আরেকটু বড় হওয়ার পর একদিন তৎকালিন জনপ্রিয় ”নতুন ঢাকা ডাইজেষ্ট” এ বইটি ও এর লেখক সম্পর্কে পড়ে বইটি পড়তে ইচ্ছা করে। এর মধ্যে অবশ্য আমার আব্বার কাছে বইটিতে উল্লেখিত কিছু শিক্ষনিয় ঘটনা শুনেছিলাম। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রয়োজনে বইটি থেকে কিছু রেফারেন্স সংগ্রহ করি। আরো বেশ কয়েক বছর পর এসএসসি পরীক্ষার পরের অবসরে বইটি পুনরায় পড়তে নিই এবং প্রথমবারের মত আদ্যোপান্ত একনাগাড়ে পড়ি। একবার নয় বরং মাত্র সপ্তাহখানিক সময় এর মধ্যে বইটি ৩-৪ বার পড়ে ফেলি। এরপর নিজেকে জ্ঞান আর শিক্ষায় নতুন একটি বিশ্বে প্রবেশ করেছি বলে মনে হয়। এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল বইটি।
আধুনিক ইউরোপের প্রধান ইসলামি চিন্তাবিদ মুহাম্মদ আসাদ এর জন্ম ১৯০০ সালে তৎকালিন অষ্ট্রো-হাঙ্গেরি রাষ্ট্রের লেমবার্গ শহরে। নাম রাখা হয় লিউপোল্ড উইস তিনি ছিলেন এক ইহুদি রাব্বি পরিবারের সন্তান। তার পিতা যদিও বংশের ধারা ভঙ্গ করে আইনজিবির পেশা গ্রহন করেন তথাপি তাদের পরিবার ছিল রক্ষনশিল গোড়া ইহুদি। পরিবারের তত্বাবধানে হিব্র ও আরমাইক ভাষা শিক্ষা এবং ইহুদি ধর্মিয় পদ্ধতিতেই শিক্ষা লাভ করেন। তবে তিনি সবসময় ছিলেন চঞ্চল এবং অনুসন্ধিৎসু। তার কৈশোরে ইউরোপে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৪ বছর বয়সে তিনি বাড়িয়ে থেকে পালিয়ে যান যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার পিতা তাকে খুজে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। ১৬ বছর বয়সে বাধ্যতামুলক সামরিক সার্ভিসে যোগ দেন তিনি। তবে তিনি সেনাবাহিনিতে যোগ দেওয়ার অল্পদিন পরেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। লিউপোল্ড উচ্চ শিক্ষার জন্য অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন ও শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে পড়া শুরু করেন। বোহেমিয়ান মনের অধিকারি এই মেধাবি ব্যাক্তি অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় এর কোর্স সমাপ্ত করেননি। তিনি এরপর ছায়াছবির সহকারি পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করেন এবং এক পর্যায়ে একটি নিউজ এজেন্সিতে প্রথমে টেলিফোন অপারেটর এবং পরে রিপোর্টার হিসেবে কাজ নেন।
১৯২২ সালে তিনি প্রথমবারের মত ইউরোপ ছেড়ে তৎকালিন বৃটিশ ম্যান্ডেট ভুক্ত ফিলিস্তিন এ তার মামার কাছে আসেন। ঐতিহাসিক জেরুসালেম শহরে প্রথমবারের মত তিনি পরিচিত হন মুসলিম সমাজ এর সাথে। এখানে তিনি যায়োনিস্ট আন্দোলন এর সাথেও পরিচিত হন এবং ইহুদি হলেও এই আন্দোলন এর প্রথম থেকেই বিরোধিতা করেন। মুসলিম সমাজের সাথে পরিচিত হওয়া ছাড়াও তিনি এই সময় আল-কুরআন অধ্যয়ন ও শুরু করেন। জার্মানির বিখ্যাত সংবাদপত্র ”ফ্রান্কফুর্টার যাইটুং” এর সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯২৫ সালে তিনি জার্মানি ফিরে যান এবং একটি বই লিখেন। যে বইতে কল্পনা ও মিথ্যার পরিবর্তে প্রথমবারের মত প্রাচ্যের প্রকৃত অবস্থা বর্ননা করেন তিনি। ইউরোপে ফিরে গিয়ে তিনি তৎকালিন ইরোপের নৈতিক ও ধর্মিয় অবস্থা দেখে বিতঃশ্রদ্ধ হন। ১৯২৬ সালে কুরআন অধ্যয়ন এর মাধ্যমে তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। এসময় তিনি এবং তার স্ত্রি এলসা বার্লিন এর ছোট্ট প্রধানত ভারতিয় মুসলিম দের নিয়ে গঠিত সমাজের সাথে পরিচিত হন। তাদের কাছেই তিনি ইসলাম গ্রহন করেন।
১৯২৭ সালে তিনি হজ্জ ও ইসলামি বিশ্বেও সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছায় পুনরায় মধ্যপ্রাচ্যে আগমন করেন। এসময় তিনি কয়েকটি ইউরোপিয় পত্রিকার সাংবাদিক ও ছিলেন। মক্কার এক লাইব্রেরিতে তৎকালির প্রিন্স ফয়সাল তথা বাদশাহ ফয়সাল এর সাথে তার পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে তৎকালিন বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সেীদ এর সাথে তার হৃদ্যতা গড়ে উঠে। বাদশাহ এর অনুমতিতে তিনি উটের পিঠে চড়ে সৈীদি আরবের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমন করেন এবং ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে ধারনা লাভ করেন। পরবর্তিতে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ” রোড টু মক্কা” তে তার এই ভ্রমন এর বিবরন কে কেন্দ্র করেই তার জিবন আলোচনা করেন। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত তিনি সৈীদি আরবে থাকেন। স্বাধিন সাংবাদিকতা ছাড়াও সেীদি বাদশাহর বন্ধু ও প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কয়েকটি বিপদজনক অভিযানেও যান। যার মধ্যে সৈীদি ইখওয়ান বিদ্রোহ (সেীদি ইখওয়ান ও মিসরের ইখওয়ান উল মুসলিমিন সম্পুর্ন আলাদা দুটি সংস্থা) যারা আচরনে ছিল বর্তমান আইএস এর মত অতি উগ্র তাদের সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়ে উদঘাটন করেন যে এই অতি ধার্মিক(!) দের পিছনে মদদ দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদি বৃটিশ শক্তি! আরেকটি অভিযান ছিল তৎকালিন লিবিয়া অঞ্চলে সেনুসি আন্দোলন এর নেতা উমর বিন মুখতার কে সামরিক সাহাজ্য প্রেরন এর বিষয়ে সহায়তা করা। সাংবাদিক হিসেবেও তিনি ইউরোপে এই ষড়যন্ত্র এবং ইহুদিবাদিদের সরুপ উদঘাটন করেন। আরবে থাকতে তার প্রথমা স্ত্রি এলসার মৃত্যু হয় এবং তিনি মুনিরা নামক এক আরব মহিলা কে বিবাহ করেন। তার গর্ভেই তার একমাত্র সন্তান তালাল আসাদ এর জন্ম হয়।
১৯৩২ সালে তিনি মুসলিম জাহান ভ্রমন এর উদ্দেশ্যে আগমন করেন তৎকালিন ভারতে এবং পরিচিত হন মহান দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল এর সাথে। কবির অনুরোধে তিনি ইন্দোনেশিয়া সফর বাতিল করে ইসলামি সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষনার জন্য ভারতেই অবস্থান শুরু করেন। তিনি চেীধুরি নিয়ায আলি খান এর প্রতিষ্ঠিত পাঠানকোট এর দারুল ইসলাম এ বসবাস শুরু করেন। উল্লেখযোগ্য একই সময় মাওলানা মওদুদিও সেখানেই ছিলেন। উভয়ই চেীধুরি নিয়ায আলি খান এর প্রতিষ্ঠিত দারুল ইসলাম ট্রাষ্ট এর সদস্য ছিলেন। এই সময় আল্লামা ইকবাল এর অনুরোধে তিনি সহিহ আল বুখারির ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেন । ১৯৩৪ সালে তার সারা জাগান গ্রন্থ ”ইসলাম এট দি ক্রস রোড” প্রকাশিত হয়। তিনি পাকিস্তান আন্দোলন এর সাথেও জড়িত হন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জন্মগত জার্মান হওয়ায় দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার দ্বিতিয় দিনেই তিনি পরিবার সহ গ্রেফতার হন। পরে তার স্ত্রি ও সন্তান কে মুক্তি দেওয়া হলেও দ্বিতিয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে তিনি মুক্তি পাননি। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে তার বাবা-মা এবং বোন এই সময় জার্মান কারাগারে মৃত্যুবরন করেন।
পাকিস্তান স্বাধিন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে যোগ দেন এবং মন্ত্রির পদমর্যাদায় জাতিসংঘে প্রেরিত হন। কয়েকবছর পর তিনি পোলা হামিদা নামে একজন পোলিশ বংশদ্ভুত মার্কিন মহিলাকে বিয়ে করলে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এর আইনের ফাঁকে চাকরি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর তিনি পুনরায় ইউরোপে ফেরত জান এবং সেখানেই তার অমর গ্রন্থ ”রোড টু মক্কা” লিখা শুরু করেন। ইউরোপ থেকে তিনি লিবিয়া ও মরোক্কর তাঞ্জিয়ার এ বসবাস শুরু করেন এবং ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষনা ও লিখালিখি করেন। শেষ জিবনে তিনি স্পেন এ বসবাস শুরু করেন এবং ১৯৯২ সালে গ্রানাডাতে ইন্তেকাল করেন।
আল্লামা মুহাম্মদ আসাদ তার ”মক্কার পথ” গ্রন্থটির পটভুমি বর্ননা করতে গিয়ে বলেছেন যে যখন তিনি পাকিস্তান এর প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘে যান তখন ইউরোপিয় ও আমেরিকান রা মনে করেছিল যে তিনি স্রেফ চাকুরি করার উদ্দেশ্যেই এই পদ গ্রহন করেছেন। কিন্তু তারা যখন দেখে যে দর্শন এবং মানসিক দিক দিয়েও তিনি সম্পুর্নভাবে মুসলিম দেও সাথে একাত্ম তখন তারা অবাক হয়ে যায়। তাদের কে একজন শিক্ষিত ইউরোপিয়ান হয়েও এই পরিবর্তন এর কারন ব্যাখ্যা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই বইটি তিনি রচনা করেন। ইসলামে সর্বদেশকালে গ্রহনযোগ্যতা এবং তথাকথিত পাশ্চাত্য সভ্যতার অসড়তা ও ভন্ডামিকে অত্যন্ত যুক্তির সাথে তুলে ধরেছেন লেখক। সেই সঙ্গে মুসলিম দেশগুলির ভুল ও দুর্বলতাও এখানে দেখান হয়েছে। আধুনিক ইসলামের ইতিহাস এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সরুপ জানতে বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন। একজন উচ্চ শিক্ষিত ইহুদি কিভাবে ইসলামের ছায়ায় এসেছেন সেটা জানার সাথে ইসলামের প্রকৃত সরুপ ও পাঠক এর সামনে উন্মোচিত হয়।
”মক্কার পথ” ছাড়াও আরো কয়েকটি গুরুত্বপুর্ন বই তিনি রচনা করেন। বইগুলো
১. দি আনরোমান্টিক ওরিয়েন্ট।( ইসলাম গ্রহন এর পূর্বে রচনা)
২. ইসলাম এট দি ক্রস রোডস।
৩. প্রিন্সিপলস অফ স্টেট এন্ড গভরমেন্ট ইন ইসলাম। (ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর একটি অতি গুরুত্বপুর্ন বই)।
৪. দিজ ল অফ আওয়ারস। (ইসলামি আইনের যুক্তিপুর্ন ব্যখ্যা। এই আমাদেও আইন নামে বাংলায় অনূদিত।
৫. দি মেসেজ অফ কুরআন। (আল কুরআন এর ইংরেজি অনুবাদ ও তাফসির।
এছাড়াও সহিহ বুখারির অনুবাদ সহ আরো কিছু প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছেন। তার লিখা বইগুলি অত্যন্ত জরুরি এবং শিক্ষনিয়। তার লিখা পড়া উচিত। যা আমাদেরই উপকারে আসবে।
বিষয়: বিবিধ
২১৩৪ বার পঠিত, ৩৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক জানা হল। "মক্কার পথ" বইটি কোথায় পেতে পারি! জানাবেন জাযাকাল্লাহ খাইর
"মক্কার পথ" বই টি অনুবাদ করেছেন বিশিষ্ট কথাশিল্পি মরহুম অধ্যাপক শাহেদ আলি। এটা প্রথমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বের হয়েছিল। তাদের বিক্রয় কেন্দ্র খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
চিন্তা জগতে আলোড়ন ঘটনার মত বই। তা বুঝেই যখন ফেলেছিলেন তখন নিজেই পোষ্ট দিলেন না কেন??????????
"রতনে রতন চেনে..."
আমাকে বইটি সংগ্রহ করে দিবেন ।
ধন্যবাদ আপনাকে।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর পোস্টের জন্য। স্টীকি হোক
উপরে সম্ভাব্য প্রাপ্তিস্থান দিয়েছি।
ধন্যবাদ মন্তব্যটির জন্য।
যা্ক আল্লাহ আপনার প্রচেষ্টাকে গ্রহণ করুন। আরো লিখতে থাকুন, আবারো ধন্যবাদ।
আমি খুব বেশি বই পড়িনি!! বিশেষ করে ইসলামীক বই। আমি যে কটি বই পড়েছি তা আমার গ্রামের একজন দাদার কারনে তিনি বই পড়তে উৎসাহিত করতেন।
তবে তিনি ইসলামীক বই পড়তেন কিনা জানিনা.... ওনার সংগ্রহিত বই থেকে যা পড়েছি তা হুমায়ূন আহমেদ এর ভূতের গল্প!!!!
বই পড়ার জন্য পরিবেশ খুজতে গেলে জিবনে আর বই পড়কে পারবেন না। আসলে এই সব খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে আমরা জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত হতে চাই।
যেখানে আমার পাঠ্যবই কেনতে হাসঁফাস করতে হয়!!!
অনেক দূর যাওয়া যেতো..... যাওয়ার জন্য যদি বই পড়ার নেশাটা তৈরি হতো নেশা তৈরি হবার মত পরিবেশ পাইনি।
বইটি পড়ুন তাহলে লেখক সম্পর্কেও জানতে পারবেন।
তবে শাস্তি সরুপ আমাকে ১ টা বই দিবেন!!
আমার প্রিয় বই দেবো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন