চলে গেলেন প্রিয় মা' জননী

লিখেছেন লিখেছেন মাই নেম ইজ খান ২১ জুন, ২০১৩, ০৯:২০:১০ রাত



টানা ৫ মাস বার্ধক্যজনিত দূর্বলতা, ছোট-খাট অসুস্থতা শেষে গত এক সপ্তাহের কষ্ট শেষে গত রাত ১.২৫ মিনিটে দুনিয়ার সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে চিরস্থায়ী সেই পরকালের সফরে মহান আল্লাহর কাছে চলে গেছেন (ইন্তেকাল করেছেন) ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

গত ১৮ তারিখে আম্মা ব্রেণষ্ট্রোক করেছিলেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে পরদিনই আমরা মা'কে 'ন্যাশনাল ইনষ্টিটিউট অফ নিউরো সায়েন্সেস' আগারগাঁও, মিরপুর, ঢাকা -তে ভর্তি করি। সকল প্রকার চিকিৎসা, দুই দিনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সব ব্যর্থ করে দিয়ে মহান রবের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত অনুসারে আমাদের প্রিয় মা'জননী রাত ১.২৫ মিনিটে চলে গেছেন আমাদের সকলকে ছেড়ে।

আজ ফজরের পর মা'কে তাঁর আলেমা পুত্রবধূগণ গোসল দিয়েছেন। তাঁর তিন আলেম সন্তান তার লাশ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। মিরপুর ১১ নং এর ভেতরস্থ আদর্শনগর মসজিদ সংলগ্ন ঈদগাহতে এখানকার কয়েক যুগের ইমাম, খতীব নিজ বড় ছেলে, আমাদের বড় ভাই মাওলানা রুহুল আমীন আম্মার জানাযা পড়িয়েছেন। আমরা আব্বাকে মা'র জানাযা পড়াবার অনুরোধ করেছিলাম। কারণ বয়স, ইলম এবং অভিজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাঁর মতো এমন দ্বিতীয় একজনের সন্ধান আমাদের জানা নেই। ঢাকার অনেক মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার পেছনে আব্বার সীমাহীন অবদান মহান আল্লাহর কাছে রক্ষিত আছে। বাবা সম্পর্কে আরেকদিন লিখার ইচ্ছা আছে।

আব্বা জানাযার আগে দেরীতে দাফন-কাফন ও জানাযা সংক্রান্ত সমাজে প্রচলিত কিছু ভ্রান্তি ও সুন্নাহর সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে বড় ভাইকে ইমামতি করতে বলেন।

মৃতকে সর্বাধিক দ্রুততায় গোসল, কাফন ও জানাযা সম্পন্ন করে সর্ব নিকটস্থ স্থানে দাফনের ইসলামী বিধানের কারণে আমরা সামান্যতমও দেরি করিনি। সর্বোচ্চ দ্রুততায় সকাল ১০.২৫ মিনিটে জানাযা শেষে আমরা মা'কে নিকটস্থ কালসী কবরস্থানে দাফন করে আসি। জীবদ্দশায় মা' আমাদের সবার উপর খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। আমরা তাঁর জন্য তেমন কিছু করতে না পারলেও তিনি কখনো অনুযোগ করতেন না। বরং সব সময় তিনি নিজের কষ্ট ভুলে, সমস্য আড়াল করে আমাদের ভালোর জন্যই সর্বাত্মক চেষ্টা করে যেতেন।

মা' জীবনের শেষ আড়াই মাসের দু'মাস আমার বাসাতেই ছিলেন। এরপর মেজো ভাই জোরা-জোরি করে মা'কে তাঁর বাসায় কিছুদিনের জন্য নিয়ে যান। ১৭ তারিখ অসুস্থতার তীব্রতা একটু বেড়ে গেলে আমি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিন অবশ্য তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। শুধু কিছু শব্দ করে নিজের কথা প্রকাশ করছিলেন। তাঁকে একটু বিমর্ষ ও চিন্তিত দেখে আমি একটু সময় নিয়ে তাকে স্যলাইন ও মাল্টার জুস করে খাইয়ে ছিলাম। সাথে সাথে তাঁর বিমর্ষতা কাটানোর জন্য সূরায়ে ফুসসিলাত এর কিছু আয়াত ও তাঁর অর্থ পড়ে শোনাচ্ছিলাম-

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلائِكَةُ أَلا تَخَافُوا وَلا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ (30) نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآَخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ (31) نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ (32)

অর্থ: "নিশ্চয়ই যারা তাদের জীবদ্দশাতে বলে যে আমাদের প্রভূ হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। অতঃপর তারা তাঁদের এই অঙ্গীকার ও স্বীকারোক্তির উপর মৃত্যু পর্যন্ত অটল থাকে তাঁদের মৃত্যুর সময় মহান আল্লাহর রহমতের ফেরেশতগণ তাঁদের কাছে আগমন করেন। ফিরিশতাগণ তাদেরকে এই সুসংবাদ দিতে থাকেন যে, তোমরা ভয় পেয়োনা, চিন্তিতও হয়ো না, বরং তোমরা সেই জান্নাতের সুসংবদ গ্রহণ করো -সারা জীবন তোমাদেরকে যেই জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলো। আমরা তো দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু ছিলাম আখেরাতের জীবনেও বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে আমরা আছি তোমার পাশে। (দুনিয়াতে তো সব নিয়ামত দেয়া সম্ভব ছিলো না কিন্তু) আখেরাতে তোমার জন্য সব নেয়ামত উপস্থিত থাকবে, তোমার মন যা যা চাইবে সবই তুমি সেখানে পাবে। আর তুমি যা যা দাবী করবে তাও সেখানে পূর্ণ করা হবে। এটা পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য আপ্যায়ন স্বরূপ।" (সূরা ফুসসিলাত, আয়াত ৩০-৩২) আমার এই তিলাওয়াত, তরজমা ও তাফসীর শুনে মা' সেদিন প্রশান্তির নিশ্বাস রেখেছিলেন আর আল্লাহ আল্লাহ স্মরণে নাড়ছিলেন নিজ জিহ্বাটি।

জীবনের শেষ সময়ে এসে তার মাঝে কুরআন পড়ার এমন একটি তীব্র আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিলো যে, তিনি আমাদের তিন ভাইয়ের কারো বাসাতেই না থেকে পার্শ্ববর্তী আমাদেরই এক মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন। মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল আমার উস্তাদ ছিলেন। তার স্ত্রী আমার বড় ভাবীর ক্লাসমেট। যার কারণে আমার আম্মা অনেক দিন সেই মাদ্রসার প্রিন্সিপ্যালের ঘরে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার সাথে অবস্থান করে কুরআন শিক্ষার প্রাথমিক স্তর কায়দা পড়া শেষ করেন। আমপাড়ার অনেক গুলো সূরাও তিনি শেষ করেছিলেন। আর কিছুদিন সুস্থ্য জীবন পেলে হয়তে পুরো কুরআনই পড়ার সুযোগ পেতেন। মহান আল্লাহ যেনো নিজ জিম্মাদারীতে মা'র এই অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করার তাওফীক দেন।

নেককার ও বদকার ব্যক্তির মৃত্যুর সময়টি প্রকাশ্য পার্থক্য সৃষ্টি করে। নেককার ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ তার নিজ রহম ও করমে মৃত্যুর সকল কষ্ট-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেন। ফলে মৃত্যুর পর তার মুখে ফুটে থাকে প্রশান্তির হাসি। যেনো এই মাত্র আরামে ঘুমিয়েছেন। কষ্টের লেশমাত্রও তাঁর চেহারায় অবশিষ্ট্য থাকে না। কিন্তু বদকারের বিষয়টি হয় সম্পূর্ণ উল্টো।

আম্মার মৃত্যু পরবর্তী যেই চেহারা আমি দেখেছি তাতে আমি নিশ্চিত যে আল্লাহ আমার মা'কে মাফ করে দিয়েছেন। কারণ কুরআন ও সুন্নাহ -তে বর্ণিত আলামত ভেসে ছিলো তার শুকনো মুখটির প্রতিটি রেখায়। এতোদিন কষ্টের পর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে (শুক্রবার সূচনাতে) মৃত্যু হওয়াটিও একটি ভালো লক্ষণ।

আমি, আমার মেজো ভাই আমার মা'য়ের কবরে নেমেছিলাম। সাথে ভাতিজা নিয়ে তিনজনে মিলে মা'কে তার কবরে রেখেছি। নিজ হাতে চাটাই এর উপর বাঁশের মোটা কঞ্চি গুলো সাজিয়ে তারপর সবাই মাটি দিয়েছি। আর ভেবেছি ও বলেছি, হে মাটি! আমরাও তো এভাবেই দু'দিন আগে বা পরে সবাই চলে আসবো তোমার মাঝে!

আলহামদুলিল্লাহ জানাযায় অনেক আলেম, হাফেজ, দীনদার ব্যক্তিগণ অংশগ্রহণ করেছেন। বহু দূর থেকেও এসেছেন অনেকে। মহান আল্লাহ সকলকে সর্বোত্তম প্রতিদান দিন, আমীন।

আয় আল্লাহ!

যারা আমাকে, আমার আম্মাকে সামান্য চিনে বা না চিনেও তাঁর জন্য দোয়া করছেন -তুমি তাঁদের সকলকে সর্বোত্তম প্রতিদান দাও। তাদের সকলের জীবিত আত্মীয়দেরকে হায়াতে তাইয়্যিবা এবং মৃত আত্মীয়দেরকে জান্নাত দান করো। আমীন।

বিষয়: বিবিধ

৩৪১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File