৪৩ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ আবু তাহের ২৫ মার্চ, ২০১৪, ০৪:৪৯:০৩ বিকাল

স্বাধীনতা! এই ‘‘স্বাধীনতা’’ শব্দটার ভিতরে কি যেন লুকিয়ে আছে। স্বাধীনতা শব্দটা শোনা মাত্রই হৃদয়ের মাঝে এক অন্য অনুভূতি জাগ্রত হয়। আর এই স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য পৃথিবীর সকলেই প্রাণপন চেষ্টায় লিপ্ত। বিশ্বে মনে হয় এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি স্বাধীনতা চান না। শুধু মানুষ নয় বরং পশু-পাখীরাও পরাধীনতার উর্ধ্বে উঠে স্বাধীন ভাবে ঘুরতে চায়। আমরা বাবুই আর চুড়ুই পাখীর সেই কবিতাটি জানি- বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়ুই
কুড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই......
পাকা হোক তবু ভাই পরেরও বাসা
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।
কষ্টে থাকলেও সেখানে যদি স্বাধীনতা থাকে তাহলে সেটাই ভাল আর মহা সুখে থেকেও যদি পরাধীন থাকা হয় তাহলে সেখানেও ভাল লাগার কথা নয়। সহজভাবে বললে বলা যায় যে, জন্মগতভাবেই মানুষ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আর এজন্যই পরাধীনতা ভাল লাগে না।
এই পরাধীনতা ভাল না লাগার কারনেই আমরা তৎকালীন বিশ্বের সর্বে সর্বা ব্রিটিশের বন্ধন মুক্ত হয়েছিলাম অনেক রক্তের বিনিময়ে। কিন্তু এরপরও নিজেদেরকে পুরোপুরি স্বাধীন বলে মনে হলো না। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী আমাদের- পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর বিভিন্নভাবে অবিচার করে আসছিল। আমাদের কোন প্রয়োজনকেই তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখছিল না। স্বভাবতই আমাদের দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ ধীরে ধীরে ফুঁসে উঠতে থাকে। শুরু হয়ে যায় সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম- মুক্তির সংগ্রাম। অনেক রক্ত আর ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পেলাম একটি লাল সবুজ পতাকার স্বাধীন সার্বভৌম দেশ-বাংলাদেশ।
কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর পরে এসেও বলতে হচ্ছে আমরা যে জন্য লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছি সেটা পুরো-পুরি পাই নাই। শাসক গোষ্ঠী শুরু থেকেই আমাদেরকে শুধু ঠকিয়েই আসছে। যারাই ক্ষমতায় যায় তারাই আমাদের জাতীয় “সম্পদ” মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের দলীয় শ্লোগানে পরিণত করে থাকেন! অথচ মুক্তিযুদ্ধ কোন ব্যক্তি বা দলের নয় বরং এটা সমগ্র জাতির সত্ত্বার সাথে মিশে আছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম একটি চেতনার ভিত্তিতে। বর্তমানে অবশ্য কেউ কেউ বলে থাকেন যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো “ধর্মনিরপেক্ষতা”, অথচ স্বাধীনতার যেই ঘোষনাপত্র পাঠ করা হয়েছিল সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ বলে একটি শব্দও নেই। যেই কারন দেখিয়ে বা দেখে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলাম কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই চেতনাকে ডিলেট করে দিয়ে আমাদের শাসক গোষ্ঠী সেখানে প্রতিস্থাপন করলেন তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা!
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষনা পত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে “বাংলাদেশের জনগনের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষনা করিলাম”। আচ্ছা দেখুনতো এই ঘোষনার কোথায় ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে? আমি হয়তো চোখে কম দেখতে পারি কিন্তু আপনিতো ভালভাবেই দেখেন-আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন? তার মানে হলো আমরা যে চেতনার ভিত্তিতে স্বাধীন হয়েছি সেটা “ধর্মনিরপেক্ষতা” নয়, বরং সেটা হলো সমাজে “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা’’। অথচ স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর পরেও আমরা সেটা ফিরে পাইনি, এখনও খুঁজে ফিরছি।
১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ প্রথম বেতার ভাষণে যে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন তার শেষাংশ উল্লেখ করছি- ‘‘আমাদের এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে এক মুহুর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না যে, এ যুদ্ধ গণ যুদ্ধ এবং সত্যিকার অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা তাদের সাহস, তাঁদের দেশপ্রেম, তাঁদের বিশ্বাস, স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাঁদের নিমগ্নপ্রাণ, তাঁদের আত্মাহুতি, তাঁদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রোচেষ্টায় ফলপ্রসু হয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখি মানুষের জন্যে রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষন করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি”। (দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা-৬০)
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনারই দেখুন যেই প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি সেটার আজ কি হাল। আজকে আমাদের দেশে বিভেদের রাজনীতি করা হচ্ছে অথচ স্বাধীনতা হয়েছে ঐক্যের জন্য। তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষ ছিল আজ তাঁদেরই সন্তানরা ১৬ কোটিতে পরিণত হয়েছে এরপরও বিভেদ কেন? বর্তমানে একটি বিশেষ দলের অন্তর্ভুক্ত না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকে না! তখন যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের চেতনায় বিশ্বাসী না হলে “পাকিস্তানী” থাকা যেত না বর্তমানে তেমনি ঐ বিশেষ দলে শামিল না হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা যায় না- যদিওবা আপনি যুদ্ধ করতে গিয়ে একটি পা হারিয়েছেন! অতএব যেহেতু আমাদের প্রতিজ্ঞার তেমন কিছুই পুরণ হয়নি তাই বলতেই হচ্ছে যে ৪৩ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।
আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে যেটাকে সবচেয়ে বেশি সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হয় সেটা হলো ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর ইসলাম যেন দুটো দুই প্রান্তের বিষয়! বর্তমানে আমাদের দেশে ইসলামকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, যারাই ইসলাম পালন করে তারাই মনে হয় সবচেয়ে বেশি খারাপ! সিনেমায় বা নাটকে যিনি সবচেয়ে খারাপ চরিত্রে অভিনয় করেন তার পড়নে পাঞ্জাবি, টুপি আর দাঁড়ি থাকতেই হবে। তার মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা কখনও দাঁড়ি রাখে না বা রাখতে পারে না আর টুপি পড়ে না বা পড়তে পারে না! আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, কুকুরের ছবিতেও টুপি পড়ানো হচ্ছে! আজকে যারাই দাড়ি রাখেন তারাই ভয়ে থাকেন, কখন যে এই দাঁড়ি রাখার অপরাধে(?) গ্রেফতার হয়ে যেতে হয় আল্লাহই মালুম। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হলো দাঁড়ি রাখা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যিনি ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূত ছিলেন সেই নূরুল কাদির তাঁর -দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা- বইয়ের ১৪৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন, “দাড়ি কামানো সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব স¤প্রতি যে উক্তি করিয়াছেন তাহা পাকিস্তান তথা সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানের জন্য অপমানজনক। একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমরা যখন আশা করিয়াছিলাম যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব নিজেই দাঁড়ি কামানো বন্ধ রাখিয়া একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে মুসলমানের জন্য অন্যতম সুন্নত পালন করিবেন, সেই সময় একজন মুসলমানকে সুন্নত পালন না করিতে উপদেশ দিয়া তিনি ইসলামিক মূলনীতিকেই অবজ্ঞা করিয়াছেন।”
পাকিস্তান যদিও ইসলামিক রাষ্ট্র নয়, বলা যায় মুসলিম রাষ্ট্র ছিল এরপরও মুক্তিযোদ্ধারা দাড়ি রাখার মত বিষয়টিকেও ছাড় দেন নি। তারা যেন কোন বাধা-প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই দাড়ি রাখতে পারেন এই জন্যই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন, আর আজকে সেই দাড়িই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হয়ে গেল! পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দাড়ির বিরুদ্ধে ছিলেন আর বর্তমান সরকারও দাড়ির বিরুদ্ধে- তাহলে আমরা যেই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম সেটা ৪৩ বছর পরেও কি পেয়েছি?
১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান হলো তখন অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে একটি অন্যতম সমস্যা হলো ভাষা নিয়ে। অনেক সংগ্রাম আর জীবনের বিনিময়ে সর্বশেষ আমরা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে পেলাম ঠিকই কিন্তু স্বাধীনতার পরেও এই ভাষাটি অবজ্ঞাই রয়ে গেল। আজকে উর্দূর জায়গায় স্থান করে নিয়েছে হিন্দি না হয় ইংলিশ। তাহলে কি আমরা উর্দূর বদলে হিন্দি আর ইংলিশের জন্য জীবন দিয়েছিলাম? আজকে আমাদের দেশের কোন ছেলে-মেয়েকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কোন ছবি তোমাকে ভাল লাগে তাহলে বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েই বলবে হিন্দি বা ইংলিশ ছবি। প্রায় বাড়িতেই আজ হিন্দির ছড়াছড়ি, আপনি যদি কাউকে বাংলায় প্রশ্ন করেন তাহলে সে বাংলায় না বলে হিন্দিতে উত্তর দেবে। বর্তমান প্রজন্মের দিকে তাকালে মনে হয় “বাংলা কোন ভাষা হলো, হিন্দিই তো মাতৃভাষা হওয়া উচিত ছিল” এরপরও এই বিষয়ে তেমন কোন উচ্চ বাচ্চ নেই। কর্তৃপক্ষের দিকে তাকালে মনে হয় তাদের অবস্থা হলো- কোন ভাষা হয় হোক উর্দুকে তো বিদায় করতে পেরেছি!
একই অবস্থা ইংলিশের ব্যাপারেও। আমরা সকল ভাষাকেই মূল্যায়ন করবো তবে অবশ্যই বাংলাকে বিষর্জন দিয়ে নয়। আজকে কোর্ট-কাচারী সহ অধিকাংশ জায়গাগুলোতে বাংলাকে পিছনে ফেলে ইংলিশ এগিয়ে, অথচ জীবন দিলাম বাংলার জন্য! এজন্যই কিছুদিন আগে ড. তুহিন মালিক একটি জাতীয় দৈনিকের কলামে লিখেছিলেন “ফাঁসির আসামী জানলোই না কোন অপরাধে তার ফাঁসি হচ্ছে”, কারন রায়টা লেখা হয় ইংলিশে অথচ সেই আসামী বেচারাতো আর ইংলিশ জানেন না। দেশ স্বাধীনের দীর্ঘ ৪৩ বছর পরেও আমাদেরকে বসে বসে সেই বিষয়টাই ভাবতে হচ্ছে!
আগেই বলেছিলাম ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনাই হলো ইসলাম। মুক্তযুদ্ধের সময় যোদ্ধাদেরকে ইসলামের কথা বলেই উজ্জিবিত করা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন কুরবান করার প্রেরনাই ছিল ইসলাম। জনাব এ্যাডভোকেট নূরুল কাদির তাঁর দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা বইয়ের ৭১ পৃষ্ঠায় খুব সুন্দর করে এই বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন- “অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষনতার সঙ্গে তাঁর অগাধ পান্ডিত্যের মাহাত্ম্যে খুবই মুনশিয়ানার সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্লেষন করেছিলেন।
ইসলামকে সকলের কাছে যথার্থরূপে তুলে ধরেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের সেই ধারাবাহিক ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ কথিকা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অত্যন্ত সময়োপযোগী ও উপকারী হয়েছিল।”
একটু খেয়াল করুন, যেই ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের সময় “ সময়োপযোগী ও উপকারী’’ হয়েছিল বলে বলা হচ্ছে সেই ইসলামকে আজ চরমভাবে অপমানিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে জঙ্গীবাদের প্রজনন কেন্দ্র নাকি মাদরাসাগুলো, অথচ স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে জঙ্গী (সন্ত্রাসী) তৈরী হচ্ছে তার একশত ভাগের একভাগও মাদ্ররাসায় হচ্ছে না। মাদরাসা ‘‘জঙ্গীবাদের প্রজনন কেন্দ্র’’ কথাটা বলার একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম যেন মাদরাসায় না যায়- ইসলাম না শেখে, আর স্কুল কলেজেতো ইসলাম নাই বললেই চলে। তাছাড়া যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড মাদরাসা তারা যত বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই ডিগ্রি নিক না কেন আর যত তুখোড় মেধাবী হোক না কেন ভাল কোন সরকারী চাকরী তাদের জুটবে না বললেই চলে। অতএব ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদেরকে মাদরাসায় পড়ার আগ্রহ দিন দিন হারিয়ে ফেলছেন। স্কুলে পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়া গেলেও মাদরাসায় পড়লে তা পাওয়া যায় না। এমন সুপরিকল্পিতভাবে মাদরাসা তথা ইসলাম শিক্ষাটাকে মানুষের কাছে “অপ্রয়োজনীয়” একটা শিক্ষা হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে! মুক্তিযুদ্ধের সময় যেই ইসলামকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে হলো সেই ইসলামই আবার স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে এতিম হয়ে ঘুরছে, তাহলে কি সেই আকাঙ্খিত স্বাধীনতা আর এই স্বাধীনতা এক হলো?
আজকে আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সরকার গঠন করবে কে এটা নির্ধারন করে দেয় নাকি অন্য কোন দেশ! যদি তাই হবে তাহলে স্বাধীন হওয়ার দরকারটা কি ছিল? আমরা তখন পারাধীন ছিলাম আর এখনও পরাধীন। তখন ছিলাম প্রত্যক্ষভাবে পরাধীন আর এখন পরোক্ষভাবে এই যা তফাৎ। একটা স্বাধীন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রন করবে অন্য কোন দেশ এটা কেমন কথা। এই জন্যই কি আমরা লক্ষ প্রানের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম? স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে না নিজস্ব কোন সংস্কৃতি চালু করতে পেরেছি আর না ধার করা গণতন্ত্রের পুরোপুরি অনুসরন করতে পেরেছি, এই হলো আমাদের প্রাণের স্বাধীনতা! আর এই কথা বলতে গেলেই আমি হয়ে যাই স্বাধীনতা বিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর আব্দুল জলিল এই কথাগুলো বলার কারনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দি হবার সৌভাগ্য(?) অর্জন করেছিলেন। সে জন্যই অত্যন্ত দুঃখ করেই লিখলেন একটি বই- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা।
পাশের দেশ ভারত আজকে আমাদের দেশের প্রায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে এটা এখন দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। বাংলাদেশ কিভাবে চলবে আর কিভাবে চালাতে হবে এটা বলে দেয়া যেন তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে! তারা আজকে অনকেটা উলঙ্গভাবেই আমাদের দেশের বিষয় নিয়ে নাক গলাচ্ছে। আর আমাদের দেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এমন মেরুদন্ডহীন যে, তাদের এমন কথাগুলোর প্রতিবাদটা পর্যন্ত করতে পারেন না! তারা আমাদের দেশের ফেলানীদেরকে হত্যা করে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখছে, সাধারণ মানুষদেরকে গুলি করে পাখির মতো হত্যা করছে আর আমাদের দেশের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলছেন, এটা তেমন কোন ব্যাপারই না এমনটা আগেও ঘটেছে, এখন ঘটছে আর ভবিষ্যতেও ঘটবে। যদি তাই হবে তাহলে আমাদের স্বাধীনতাটার কি দরকার ছিল? আমরাতো ভারতের অধীন হওয়ার জন্য পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হইনি।
কয়েকদিন আগে ক্রিকেট খেলা নিয়ে কি কান্ডটাই না ঘটাচ্ছিল ভারত। তারা এই ক্রিকেটেও আমাদেরকে গোলামের মত ব্যবহার করতে চেয়েছিল। আর আমাদের মেরুদন্ডহীন কর্তারা সেটাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগে গেলেন!
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটলো মাত্র কয়েকদিন আগে। ভারতীয়রা আমাদের দেশের স্বাধীনতাকে বিক্রিত করে “গুন্ডে” নামের একটি সিনেমা তৈরী করলো আর আমাদের দেশের সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে প্রতিবাদ করার দরকার ছিল অথচ সেভাবে এর প্রতিবাদটি পর্যন্ত কার হলো না! আমার মনে হয় পাকিস্তান বা অন্য কোন দেশ যদি এমন কোন সিনেমা তৈরী করতো তাহলে তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়তাম আমরা। এটা কেন হবে? ঠিক আছে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছিল তার মানে কি এই যে এখানে তারা এখনও নেতৃত্ব দেবে! তাদের কথায় আমাদেরকে উঠতে আর বসতে হবে?
ভারত আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছিল ঠিক তবে তা কঠিন শর্তের বিনিময়ে। আমরা যদি দুশো ছেষট্টি দিনের স্বাধীনতা বইটির ৩২৫ পৃষ্ঠাটা পড়ি তাহলে দেখতে পাব ভারত আমাদেরকে কি কি শর্তে সহযোগিতা করেছিল।
“একাত্তরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যে ৭ দফা মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেছিল, তা ছিল নিম্নরূপ-
১. যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত থাকতে পারবে। বাকীদের চাকরীচ্যুত করা হবে এবং সেই শুন্য পদ পুরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
২. বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে (কতদিন অবস্থান করবে, তার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় না)। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতি বছর এ সম্পর্কে পুনরীক্ষণের জন্য দু’দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
৩. বাংলাদেশের কোন নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না।
৪. অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে।
৫. সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে (পূর্ব পাকিস্তান-পশ্চিম পাকিস্তান নয়!) অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে।
৬. দু'দেশের বানিজ্য হবে খোলা বাজার (ওপেন মার্কেট) ভিত্তিক। তবে বানিজ্যের পরিমান হিসাব হবে বছর ওয়ারী এবং যার যা পাওনা, সেটা স্টার্লিং-এ পরিশোধ করা হবে।
৭. বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে এবং ভারত যতদূর পারে এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সাত দফা গোপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দানের পরপরই তিনি মুর্ছা যান।”
পরবর্তীতে এটাকে গোলামী চুক্তি হিসেবে অবহিত করা হয়। একটু ভেবে দেখুনতো এই চুক্তিতে বাংলাদেশের কোন স্বার্থ ছিল কি না? যদিওবা এখন এই চুক্তিটির আর কার্যকারিতা নেই কিন্তু ভারত সম্ভবত এখনও সেই চিন্তা নিয়েই বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে।
এই সকল দিক দেখেই সম্ভবত তৎকালীন ভারতীয় সেনা প্রধান একটি কঠিন মন্তব্য করেছিলেন। ১৯৮৮ সালের ২৯ এপ্রিল স্টেটসম্যান ভারতের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’ এর মন্তব্যটি প্রকাশ করে।
সেখানে তিনি বলেছেন-
“যদি বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষনা করা হয় তাহলে ভারতের আশ্চর্য হবার কিছু নেই। যেদিন আমার সৈন্যরা বাংলাদেশকে মুক্ত করে সেদিনই আমি এ কথা উপলদ্ধি করি। বাংলাদেশীদের কখনই ভারতের প্রতি তেমন ভালবাসা ছিল না। আমি জানতাম ভারতের প্রতি তাদের ভালবাসা অস্থায়ী। অনুপ্রেরণা লাভের জন্য ভারতের দিকে না তাকিয়ে তারা মক্কা ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টিপাত করবে। আমাদেরকে সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশীদের প্রতি আমরা সঠিক আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্য করা উচিত ছিল, কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেন নি। তারা বেনিয়ার মতো আচরণ করেছেন।” (দুই পলাশী দুই মীরজাফর- কে এম আমিনুল হক)
শুধু এই কয়েকটা বিষয় পর্যালোচনা করলেই এটা স্পষ্ট হয় যে, ভারতের সব কাজ আমাদেরকে ঠকানোর জন্য, সেটা যুদ্ধের সময় যেমন করেছে এখনও ঠিক তেমনই করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর পরেও আমরা সেই বেষ্টনী থেকে বের হয়ে আসতে পারি নাই! আমরাতো এমন স্বাধীনতা চাই নি। এই পর্যায়ে আমাদের এমন এক নেতৃত্ব দরকার যার মেরুদন্ড অত্যন্ত শক্ত-মজবুত। আমরা কোন দেশের গোলামী করে থাকতে চাই না। আমাদের যা আছে আমরা সেটা নিয়েই গর্ব করে বাঁচতে চাই।
প্রথমে ব্রিটিশরা আর পরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার করেছে। সেই অত্যাচার আর নির্যাতরে মুলচ্ছেদ করার জন্যই আমরা স্বাধীন হলাম অনেক রক্তের বিনিময়ে কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে এখনও আমাদের দেশের এক দল আরেক দল বা গোষ্ঠীকে নির্যাতন করেই আসছে। হত্যা আর গুমতো এখন একটা নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়ে গেছে। আপনি আমার মতের বিরোধী অতএব আপনাকে মেরে ফেলতে হবে অথবা অপনাকে অন্য কোন ভাবে নির্যাতন করা হবে। এখন কথায় কথায় গুলি চালানো হচ্ছে অথচ ইতিহাস বলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেও এমন বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়নি।
গণতন্ত্র নাই গণতন্ত্র নাই বলে তখন আমরা মুখের ফেনা বের করেছিলাম অথচ স্বাধীনতার পর পরেই সেই গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করা হলো। বলা যায় এখনও সেই গণতন্ত্র উদ্ধার হয়নি। এই কি ছিল আমাদের নিয়তি! স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও আমরা আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে পারলাম না! এই জন্যই দুঃখ করে বলতে ইচ্ছে করে ৪৩ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।
আমরা এমন একটা স্বাধীনতা চাই যেখানে থাকবে না কোন খুন-গুম, অত্যাচার-নির্যাতন, আশরাফ-আতরাফের শ্রেণী বিন্যাস, রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনের অপকৌশল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হল দখল আর মারা-মারির দৃশ্য, অশ্লীলতা-বেহায়ানা, যুলুম-অবিচার, আইনের পক্ষপাতিত্ত্ব, ভুক্ষা-নাঙার মিছিল, ডাস্টবিনের পাশে পড়ে মরার দৃশ্য। আমরা চাই একটি সুখি সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ। যদি সেটা আমরা নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে প্রিয় শিল্পী হায়দার হোসেনের মতো আমাদেরকেও করুন সুরে গেয়ে উঠতে হবে-
কি দেখার কথা কি দেখছি
কি শোনার কথা কি শুনছি
কি বলার কথা কি বলছি
কি ভাবার কথা কি ভাবছি
তিরিশ বছর পরেও আমি
স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি....।
বিষয়: বিবিধ
১৫৬৪ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর একটা বই বের করে ফেলুন!
বাংলাদেশের জম্নটাই ছিল ক্ষমতালোভীদের স্বার্থের মধ্য দিয়ে। আজ তারই পুনরাবৃত্তি।
ধন্যবাদ আপনাকে এ বিষয়ে পোস্ট দেয়ার জন্য।
সুখী দেশ প্রতাশা করলে ৭১ সালে বিরোধীতা করেছিলেন কেনো? বরং আপনি ওখানে লিখে দিন যে আমরা চাই একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সোনার পাকিস্তান ।
‘ধরা যাবে না,
ছোঁয়া যাবে না,
বলা যাবে না কথা
রক্ত দিয়ে পেলাম শালার
এমন স্বাধীনতা।’
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন