উপন্যাস: দ্য প্রাইম মিনিস্টার [পর্ব-৮]
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২৪ নভেম্বর, ২০১৪, ০৮:৪৩:২৫ সকাল
পরদিন পত্রিকার পাতায় খবর বেরুলো, একটা লাশের খবর, একটা আবর্জনার খবর। তিনি একটি পত্রিকা নিয়ে পাতাটি খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়তে লাগলেন। চারিদিকে নানান রকম শব্দ হকারের শব্দ, ক্ষুদে ভিক্ষুকের শব্দ আর সব শব্দকে ছাড়িয়ে মানুষের কিচির মিচির। এসব শব্দের দিকে তাঁর নজর নেই, খবরটা পড়ে পত্রিকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি। একটা রিক্সাতে উঠে বসলাম আমরা। রিক্সাওয়ালা যেনো আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলো, কোথায় যেতে হবে, ভাড়া কতো কিছু জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করলো না। তিনি শুধু হাত নেড়ে চলার নির্দেশ দিলেন। বড় বড় দালান কোঠা একসময় আমার কাছে গল্পের মতো ছিলো, লোকে বলতো ঢাকা এরকম সেরকম। সেসব কথা শুনে আমি ভাবতাম ঢাকা বহুরকম। তবে ঢাকার এসব দালান-কোঠা আমার কাছে বেশ বিস্ময়ের জিনিস ছিলো সেদিন।
আমি তাঁকে বললাম, ‘গত সাত বছর কি এ শহরেই ছিলে?’
তিনি মনে হয় আমার আরেকটি প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
আমি আরেকটি সমগোত্রীয় মন্তব্য ছুঁড়ে দিলাম, ‘একবার! একবার অন্ততঃ তোমার যোগাযোগ করা উচিৎ ছিলো বাড়ির মানুষগুলোর সাথে। তুমি চিন্তা করতে পারবে না তোমার আম্মু কতো চোখের জল ফেলেছে।’
তিনি বললেন, ‘সংবিধানে ছিলো না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘সংবিধান? কোন সংবিধান? আমার তো এমন সংবিধানের কথা জানা নেই!’
তিনি তাঁর পকেট থেকে একটা ছোট ডাইরি বের করলেন।
আমার দিকে এগিয়ে এনে বললেন, ‘এটা প্রথমের দিকেই আছে। এইতো, সাত নাম্বার ধারাতেই।’
আমি দেখলাম সাত নাম্বার ধারায় স্পষ্ট লেখা আছে, ‘আগামী সাত বছর পরিচিত কারো সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা নিষেধ।’
আরো অনেক ধারা ছোট ছোট অক্ষরে তিনি লিখে রেখেছিলেন ডাইরিটাতে। তবে তিনি সেসব দেখার সুযোগ আমাকে দিলেন না। হাতটা সরিয়ে পকেটে পুরে নিলেন ডাইরিটা।
এরপর আমি অনেকবার সেই ডাইরিটার খোঁজ করেছি। কোথাও খুঁজে পায় নি। প্রায় বিশবছর ধরে ডাইরিটা খুঁজেছিলাম। খুঁজতাম তাঁর পরিকল্পনার শেষটা জানার জন্য। তৃতীয় দশকের প্রথম বছরেতো একবার আমি ভেবে বসেছিলাম ডাইরিটা আমি পেয়ে গেছি। তাঁর পকেট থেকে একরকম চুরি করেছিলাম সেটি। দেখতে অবিকল আগের ডাইরিটার মতো। কিন্তু খুলে দেখি সেখানে শুধু হিবিজিবি হিসাব নিকাশ লেখা। অনেক কষ্টে বুঝলাম তাতে লাশের হিসাব নিকাশ লেখা। একেকটা হত্যা কতটুকু অর্থনৈতিকভাবে ভালো হয়েছে সেসব হিসাব।
তেত্রিশের দিকে তিনি একবার ডাইরিটা সম্পর্কে বলেছিলেন। তখনতো তিনি দেশের একজন সম্মানিত একজন। তিনি এক সন্ধ্যায় আমার সাথে চা পান করছিলেন। কি মনে করে তিনি বলে বসলেন, ‘সংবিধান মনের সাথে গেঁথে আছে, আমার সংবিধানের সাথে কোনো সংবিধানের মিল নেই। যে সংবিধান মনের সাথে গেঁথে থাকে না সেই সংবিধান কেউ মানে না। সাধারণের সংবিধান এমন হবে যা সাধারণের মনে গেঁথে থাকবে।’
তিনি এমনই সুশৃঙ্খল মানুষ ছিলেন। এমনকি তিনি কখনো দ্বিতীয় প্রকারের সাবান ব্যবহার করতেন না। ঘুম থেকে উঠতেন সবার আগে, তবে ঘুমাতে যেতেন কখন তা আমার চাক্ষুষ জানার সৌভাগ্য হয় নি। শুনেছি তিনি ঘুমাতে যেতেন অনেক পরে। কোনো কোনো রাতে তিনি ঘুমাতেন না। আর একটা ব্যাপার তিনি গভীর রাতের চেয়ে সকালে কাজ করতে বেশি পছন্দ করতেন। এজন্য তার বন্ধুদের সকালে সজাগ থাকতে হতো। হয়তো তাদের কাউকে ছুটতে হতো সাতসকালে, কাউকে ছুটাতে হতো নলের আগায়।
সেদিন রিক্সাটা দালান-কোঠার মাঝ দিয়ে অলিতে গলিতে ঘুরঘুর করে শেষে একটা পুরাতন গোছের বাড়ির এলাকায় থামলো। আমাদের নামিয়ে রিক্সাওয়ালা চলে গেলো, ভাড়া পর্যন্ত নিলো না। দোকানের পরিচয়পত্রের বোর্ড দেখে আগেই বুঝেছি এটা পুরাতন ঢাকা। যে দালানের সামনে থামলো সেটাও অনেক পুরানো দালান। চুনের বিন্দুমাত্র নেই বিল্ডিংটায়। মনে হচ্ছিলো পূর্ব দিকে হেলে পড়বে যে কোনো সময়।
আমি বললাম, ‘এখানে থাকো?’
তিনি বললেন, ‘কি মনে হয়? তুমি অবশ্য এখানে থাকবে না।’
বাড়ির ফটক পার হতেই আমি অবাক হয়ে যায়, গোটাদশেক লোক দাঁড়িয়ে আছে তাঁর অপেক্ষায়। সবাই বেশ ভদ্র গোছের। এর ভিতর চারজন তাঁর মতোই তরুণ। দু’জন মাঝবয়সী আর চারজনের দাঁড়ি-গোফে পাক ধরেছে। সকলে একদম মার্জিত পোশাক পরে ছিলো, যেন মনে হচ্ছিলো সবার মা তাদের গোছ গাছ করিয়ে দিয়েছে।
তিনি সবার সাথে হাত মেলালেন তবে কোনো কথা বললেন না, এমনকি আমার সাথে কারো পরিচয়ও করিয়ে দিলেন না। আমি বরং তাঁর পাশে নিজেকে তখন সেক্রেটারি ভাবতে শুরু করে দিয়েছি। হাত মেলানো শেষে তিনি হাঁটতে লাগলেন। সেই দশজনও আমাদের পিছন পিছন কোন শব্দ না করেই আসতে লাগলেন। সিঁড়ি টপকে তিনতলাতে গিয়ে তিনি একটা রুমে ঢুকলেন। বাড়ির বাইরেটা পুরাতন হলেও ভিতরটা যে চকচকে ঢুকেই বুঝলাম। একটা গোল টেবিলের পাশে কনফারেন্স রুমের মতো কিছু চেয়ার পাতা ছিলো। সব চেয়ারগুলো একি রকমের, খুব একটা অভিজাত চেয়ার নয়, চামড়াতে মুড়ানো খুব সাদা-মাঠা চেয়ারগুলো। এছাড়া চারপাশে সোফা পাতা ছিলো।
তিনি সোজা গিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন। বাকি সবাই গোল টেবিলের চারপাশে বসলেন। আমি শুধু তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে, এতো দ্রুত যে আমার কাজ শুরু হয়ে যাবে আমি ভাবতেও পারি নি। এক মিনিটের ভিতর চা চলে আসলো টেবিলে, তখনো কেউ মুখ খোলেনি। সবাই চায়ের কাপে চুমুক লাগালেন।
*********************************************************************
বিষয়: সাহিত্য
১১৫৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"যে সংবিধান মনের সাথে গেঁথে থাকে না সে সংবিধান কেউ মানে না!
সাধারণের সংবিধান হবে এমন যা সাধারণের মনে গেঁথে থাকবে!"
বরাবরের মতই অসম্ভব ভাল লাগা রেখে গেলাম!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন