শুদ্র দ্য গংরিড: শিয়ালের পাঠশালা
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২৭ অক্টোবর, ২০১৪, ০২:২৭:২২ রাত
বনের মাঝে শিয়াল পন্ডিতের পাঠশালা। বনের প্রাণীদের বাচ্চারা শিয়াল পন্ডিতের কাছে পড়ার জন্য মরিয়া, যদিও শিয়াল পন্ডিত সবাইকে পড়াতে পারে না। আবার কেউ কেউ শিয়াল পন্ডিতকে ভয় পায়, কেননা কুমিরছানাদের দশার কথা জানে। অবশ্য শিয়াল পন্ডিত চেষ্টা করে নিজের লোভ সংবরণ করতে। তবে মাঝে মাঝে দু’একটা বিপত্তি হতেই পারে। আর বনের প্রাণীদের কোন উপায় নেই, বনে পন্ডিত বলতে এই এক শিয়াল পন্ডিত। কয়েকদিন আগেও এক বানর এসে, শিয়াল পন্ডিতের কাকুতি মিনুতি করে বলে, ‘পন্ডিত মশাই, আমার ছেলেটাকে শিক্ষা দাও। তুমি তো জানো, শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়া এখন বনে টিকে থাকা কঠিন।’
শিয়াল পন্ডিত বলে, ‘তুমি হলে আমার বন্ধু, তবে বলি কি, এত শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে আবার কি হবে? বরং ওকে তুমিই ভালো শিক্ষা দিতে পারবে।’
বানর বলে, ‘না, তোমার শিক্ষার কি জুড়ি আছে। বনের সব জ্ঞান তো তোমার মাথায় গিজ গিজ করছে। বনের প্রতি পরতের কথা তুমি জানো। দেশ-বিদেশের খবর তোমার মাথায়।’
শিয়াল পন্ডিত বলে, ‘এত সুনাম করতে হবে না। যা সকালে পাঠিয়ে দিস পাঠশালায়।’
শিয়াল পন্ডিতের পাঠশালার কদর এমনই। শিয়াল পন্ডিত হিংস্র প্রাণীদের সাধারনত পাঠদান করায় না, কেননা এদের বিশ্বাস নেই। বাঘের আদেশে একমাত্র কুমিরের বাচ্চাদেরই পড়াতে বাধ্য হয়। শিয়ালের বাচ্চা খাওয়ায় এটা শিয়ালের সাজা।
পরদিন সকালে শিয়াল পন্ডিত হরিণদের শিক্ষা দেয়, ‘বাঘ যখন তোমাদের ধরতে আসে তখন কিন্তু বাঘ তোমাদের মাঝে একজনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে থাকে। ঐ একজন যদি ব্যাপারটা বুঝতে পারে তবেই জীবনটা বেঁচে যাবে।’
এছাড়া মানুষেরা কেমন হয়, কি কি করে, সেসব শিক্ষা দেয়। মানুষদের গল্প শুনতে বনের প্রাণীরা খুব উৎসাহী হয়ে থাকে। যেদিন শিয়াল পন্ডিত মানুষদের কথা বলতে থাকে, বাচ্চারা চুপ করে শোনে, আর মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে।
শিয়াল পন্ডিত বলে, ‘মানুষেরা দুই প্রকারের। এক- খারাপ। দুই-ভালো। খারাপ মানুষেরা এতটা খারাপ যে তারা অকারণে মানুষ হত্যা করে। এতে তাদের ক্ষুধা মেটে না। আর আমরা বনের প্রাণীরা প্রাণী হত্যা করি ক্ষুধা নিবারণের জন্য। তাই খারাপ মানুষেরা আমাদের চেয়ে খারাপ। কিন্তু যারা ভালো তারা আমাদের চেয়েও ভালো।’
সে যাই হোক, দু’বছর ধরে সফল সমুদ্রাভিজান শেষে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসলো শুদ্র। সমুদ্রাভিজানের পর শুদ্র মানসিকভাবে দৃঢ় এবং আচরণে বিনয়ী হয়ে উঠলো। রাজা আজাকা সফল সমুদ্রাভিজানের জন্য এক নৈশভোজের আয়োজন করলো যেখানে রাজা সবার সাথে শুদ্রকে পরিচয় করিয়ে দিল। এটা ছিল শুদ্রের জীবনের একটা বিশেষ মূহুর্ত। সেই অনুষ্ঠানে রাজকুমারী ইলি তার দিকে আড়চোখে তাকায়, শুদ্র দৌড়ে যেয়ে রাজকুমারী ইলিকে বলে, ‘কেমন আছো ইলি?’
রাজকুমারী ইলি বলে, ‘তোমার সাথে আড়ি, তুমি সেই কখন এসেছ কিন্তু আমার সাথে দেখা করো নি। এখন বলো, আমার সেই চাকতি তোমার কাজে এসেছে?’
শুদ্র বলে, ‘চাকতি, তোমার চাকতিই আমার জীবন রক্ষা করেছে।’, পকেট থেকে চাকতিটা বের করে বলে, ‘এই নাও তোমার চাকতি।’
ইলি বলে, ‘এরকম চাকতি আরেকটি আমার আছে, তুমি ওটা রেখে দাও। ঘুরেতো বেড়াও বনে জঙ্গলে।’
কথাটা শুনেই শুদ্র ইলিকে বলে, ‘মহাশয়া আপনি থাকুন। কালকে সকালে দেখা হবে আপনার সাথে।’
ভোজসভা থেকে সিদুকে ডেকে পাশে নিয়ে যায়, বলে, ‘সিদু, আমি এখন একজায়গায় যাবো, তুমি রেখে আসো।’
সিদু বলে, ‘কোথায়?’
শুদ্র বলে, ‘বনে।’
সিদু বলে, ‘বনে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে শুদ্র। এত রাতে? আমি যেতে পারবো না। সকালে নিয়ে যাবো তোমাকে।’
শুদ্র বলে, ‘প্লিজ সিদু।’
সিদু তার কথা না শুনে ভোজসভায় যোগ দেয়। শুদ্র ভোজসভা থেকে বেরিয়ে আস্তাবলের দিকে যায়। আস্তাবল একটা ঘোড়া ছাড়িয়ে পিঠে উঠে বসে। যে ঘোড়াটার পিঠে সে উঠেছিল সেটা ছিল একটা বেয়াড়া ঘোড়া, যেটাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না। তাই শুদ্র বিপাকে পড়লো, এমনিতেই এটা ছিল তার প্রথম ঘোড়া চালানো। ঘোড়া চলে গেল ভোজসভার দিকে। ভোজসভায় একটা হট্টগোল বাঁধিয়ে দিল শুদ্র। অনেক কিছু ভেঙে চুরমার করে ফেলল ঘোড়াটা, হঠাৎ এমন ঘটনায় ঘোড়াটাকে আটকানোর নির্দেশ দিলেন রাজা। তবে ঘোড়াটা থামলো না, তীব্র গতিতে চলতে লাগলো জঙ্গলের দিকে। কিছু সময় পর ঘোড়াটাকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলো শুদ্র। রাজা সিদুর কাছে জানতে পারলো, শুদ্র জঙ্গলে গেছে। তবে রাজা নির্দেশ দিলেন, ফিরে আসলে শুদ্রকে তার কাছে পাঠাতে।
শুদ্র ঘোড়া ছুটিয়ে বনে চলে গেল। বনের সব প্রাণীকে একে একে ডাকতে লাগলো শুদ্র। বনের প্রাণীরা জেগে উঠলো। শুদ্রের আগমনে তারা উল্লসিত হয়ে উঠলো। তারা আরো অবাক হলো এটা জেনে যে শুদ্র তাদের ভাষায় কথা বলছে। শুদ্রের আগমনে বনে সাড়া পড়ে গেল একরকম। জোনাকিরা তাদের আলো দিয়ে বনকে আলোকিত করে তুললো। ব্যাঙেরা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ গান জুড়ে দিল। হরিণেরা নাচ শুরু করে দিলো। কুমিরেরা মাথা তুলে শুদ্রকে অভিনন্দন জানালো। হাতিরা ডেকে উঠলো শুদ্রকে স্বাগত জানাতে। এভাবে সারারাত কেটে গেলো।
রাজা আজাকার ডাকে পরদিন রাজ দরবারে উপস্থিত হলো শুদ্র। রাজা আজাকা শুদ্রকে বলে, ‘গতরাতের ঘটনায় আমি বিরক্ত। তোমার এরকম আচরণ আমি আশা করি নি। তোমাকে কি করতে হবে তা সোমান্দ্রদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে জেনে গেছো নিশ্চয়।’
শুদ্র বলে, ‘জেনেছি রাজামশাই।’
রাজামশাই শুদ্রকে আরো উপদেশ দেয়। বলে, ‘এই রাজ্য তোমার আমার সবার। রাজ্যের ভালোর জন্য অনেক কঠিন কাজটি করতে হবে তোমাকে।’
শুদ্র বলে, ‘আমি আমার প্রাণপণ চেষ্টা করবো রাজামশাই।’
সমুদ্রাভিজানের পর আরো নিবিড়ভাবে বনের সাথে মিশে গেল শুদ্র। বনের প্রাণীদের সাথে কথা বলতো শুদ্র। তাদের সুখ দুঃখের কথা শুনতো। কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করতো। যেমন একবার একটা লতায় একটা হরিণছানার পা আটকে গেল। কেউ সেই পা ছাড়াতে পারছিল না। হরিণছানার মাতো বাঘের কাছেও যেতে পারে না এই ভয়ে যে, বাঘ আবার তার ছানাকে না খেয়ে ফেলে। শেষে শুদ্র যেয়ে হরিণছানাকে রক্ষা করে।
একদিন বিকালে বনে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ শুদ্র দেখে শিয়াল পন্ডিত অনেক প্রাণীদের বাচ্চাদের নিয়ে কি যেন করছে। এর আগেও শিয়াল পন্ডিতকে এ অবস্থায় দেখেছে শুদ্র তবে ব্যাপারখানা বুঝতে পারে নি। কাছে গিয়ে দেখে অবাক ব্যাপার, শিয়াল পন্ডিত সর্ব প্রকার প্রাণীর বাচ্চাদেরকে নানান শিক্ষা দিচ্ছে।
শিয়াল পন্ডিত শুদ্রকে আসতে দেখে বলে, ‘শুদ্র, এটা হলো আমার পাঠশালা, দেখেছো কত ছাত্র। তুমিও বসে পড়ো। তোমার এখনো অনেক কিছু শেখার বাকী।’
শিয়াল পন্ডিতের কথা মতো শুদ্র বসে পড়লো শিয়ালের পাঠশালায়। শিয়াল পন্ডিত তার ছাত্রদের একটা গল্প বলতে লাগলো, ‘এক যে ছিল বন। যে বন ধারেতে বাস বাঁধিল এক বিরাট রাক্ষস। বনের যত প্রাণিকুল ভয়ে হলো শেষ। ভাবলো তারা এবার বুঝি ছাড়তে হবে দেশ। শেষ কালেতে হলো কি? হলো কি?’
সবাই বলে উঠলো, ‘হলো কি? হলো কি?’
শিয়াল বলে, ‘সেই বনেরই একটা বীর বাঘ যার নাম, থাবা উঠিয়ে বলল ধীরে, তোরা সবাই থাম। আসতে দে রাক্ষসরে আমি আছি সামনে, তোরা সব পিছনে থাক দেখি রাক্ষস আসে কেমনে। তারপরেতে রাক্ষস যেই এসেছে বাঘের সামনে, বাঘ হালুম যেই রাক্ষস থাকে কেমনে। পরদিনেতেই রাক্ষস হলো পগার পার, রাজ আসন সেদিন থেকে বাঘ পেলো উপহার।’
শিয়ালের গল্প শুনে শুদ্রতো শিয়ালের ভক্ত হয়ে গেলো। এছাড়া অনেক কথ সে শিয়ালের কাছে শুনলো যা রাজ পাঠশালায় কখনো শোনে নি। তাই পরদিন থেকে প্রতিদিন শিয়াল পন্ডিতের পাঠশালায় আসতে লাগলো শিয়াল পন্ডিত। এভাবেই সে শিয়ালের পাঠশালা থেকে কিছু বন্ধু বানিয়ে ফেললো। একটা বানরতো তার অনেক ভালো বন্ধু হয়ে গেল, এছাড়া কুমির ছানাদের সাথেও তার ভাব জমে উঠলো কয়েকদিনেই। একটা টিয়াতো সব সময় তার সাথে সাথেই ঘুরে বেড়াতে লাগলো সবসময়। শুদ্র টিয়াটির নাম দিলো পিরু। পিরু আর বনের সব প্রাণীদের সাথে দেখা করতো। কিন্তু কচ্ছপের ধারের কাছে ভিড়তো না শুদ্র। এই প্রাণীটাকে কেমন আজব ধরনের লাগে শুদ্রের কাছে। কেমন জানি গম্ভীর রকমের। তাই শুদ্র সবসময় কচ্ছপকে এড়িয়ে চলতো। আর পুরাণের সব কথা কচ্ছপের কাছে থাকায়, অন্য প্রাণীরাও কচ্ছপকে পবিত্র পবিত্র ভাবতো। তবে শুদ্রের কাজই পুরাণের কথা রাজার কাছে পৌঁছে দেওয়া।
**************************************
বিষয়: সাহিত্য
১৫৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন