::অনামিকা সমাচার:: [[[ছোটগল্প]]]
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২৯ জুলাই, ২০১৩, ০২:০৩:০০ দুপুর

অনেকদিন দেখা সাক্ষাত নেই। মোবাইলটাও বন্ধ রাখে বছর সাতেক থেকে। খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি বাড়িতেও নাকি আর আসে না। ও আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। যদিও আমি মেয়ে তবু আমাদের বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ় হয়েছিল। যে কারণে গাঢ় হয়েছিল ঠিক সেই কারণেই আজ সে বিচ্ছিন্ন। শুনেছি তার কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। মাঝে মাঝে বাড়িতে চিঠি পাঠায়। সেই সব চিঠির স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকে তার বাবা-মা। খোঁজা-খুঁজির কোন প্রকার চেষ্টাও করে না, কেননা তাতে তার ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী। হঠাৎ করেই সে আমার বাড়িতে এসেছিল সেদিন। আমি তো তাকে চিনতেই পারি নি। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, অযত্ন অবহেলার মলিন মুখ আর পুরনো পোশাকই তার বৈশিষ্ট্য। আমি ওকে একদমই চিনেছিলাম না। সেদিন আমার স্বামী বাইরে যাবার পর থেকেই ঘরের দরজাটা বন্ধ ছিল। কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলেই দেখি সেই মূর্তি। তেমনভাবে ভ্রুক্ষেপ না করেই বললাম, ‘কি চাই?’
সেই অদ্ভুত লোকটা বলল, ‘আমি তো কিছু চাই না।’
তারপর একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হাব-ভাব দেখে ভাবলাম রাস্তার কোন পাগল-টাগল হবে হয়তো। তাই দরজা বন্ধ করলাম। পরদিন ঠিক একই সময় আবার এসেছিল লোকটা।
আমি বললাম, ‘কে আপনি?’
নির্লিপ্ত উত্তর তার, ‘আমিতো কেউ নই। অনেকদিন পরিচয়টা ব্যবহার করা হয় না তো, তাই জং ধরে গেছে।’
এরকম পাগলের প্রলাপ শোনার মত সময় আমার ছিল না। সুতরাং দরজা বন্ধ করে রাসেলকে পড়াতে বসলাম। পনের-বিশ মিনিট হবে হয়তো, তারপর আবারও কলিংবেল বেজে উঠলো। আহঃ! কি বিরক্তির বিষয়।
দরজা খুলেই লোকটার দিকে রাগত সুরে বললাম, ‘আর একবারও যদি যদি কলিং বেল বাজান তাহলে হয়তো বিপদে পড়বেন। আপনি জানেন না আমি কে?’
‘আমি জানি।’
‘তাহলে এভাবে বিরক্ত করাটা কতটা বাজে পরিণতির কারণ হবে সেটাও হয়তো জানেন?’
‘কেন, আমি তো তোমাকে খারাপ কিছু বলি নি।’
‘বলেন নি কিন্তু আপনি এখন আমাকে তুমি সম্বোধনের অধিকার কোথায় পেলেন?’
‘সরি ম্যাডাম, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। আমাকে কি ক্ষমা করা যাবে না?’
‘কিসের ক্ষমা? দয়া করে আপনি আর কোন ভনিতা করবেন না। আপনি এখন যান।’ এটুকু বলেই দরজা বন্ধ করে দিলাম লোকটার মুখের উপর। দশ মিনিটও হয় নি আবারও কলিং বেলের আওয়াজ। বিরক্তিতে আমার রাগ বেড়ে গেল। থানাতে একটা ফোন করেই দরজা খুললাম। দেখলাম লোকটা রুক্ষ হাসি হাসছে। আমার কিছু বলার আগেই বলল, ‘ওরা আসবে না।’
‘কারা আসবে না?’
‘ঐ তো যাদের ডাকলেন!’
‘আপনি জানেন কিভাবে?’
‘জানি, একটা কথা বললে রাখবেন?’ উদাসীনভাবে লোকটা বলল।
‘আশ্চর্য! কি কথা?’
‘আমি আপনার সাথে দাবা খেলতে চাই।’
কথাটা আমাকে স্তব্ধ করে দেয়, কেননা আমি যে দাবা খেলতে পারি সেটা এ লোক জানলো কিভাবে। আমি আমার স্বর খাদে নামিয়ে বললাম, ‘আপনি কে?’
‘বলেছিতো কেউ নই।’
‘কিভাবে জানেন আমি দাবা খেলতে পারি?’
‘আমি জানি।’
‘জানেন কিন্তু কিভাবে?’
‘ঠিক মনে পড়ছে না।’ কপালে ভাঁজ এনে ইতস্ততঃ হয়ে বলল, ‘ও হ্যাঁ আমি এখন আসি তাহলে। অন্য একদিন দেখা হবে।’
কি ঘটছে কিছুই বুঝলাম না।
একঘন্টা হয়ে এল তবু সত্যিই কোন পুলিশ আসল না। রাতে স্বামীর সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা হল। তিনি নির্দেশ দিলেন পরবর্তীতে যেন আর আপরিচিতদের সাথে কথা না বলি।
বেশ ক’দিন পার হয়ে এল। পাগলা কিসিমের লোকটা আর আসে নি। তবে আজ সকালেই একটা ঠিকানা বিহীন চিঠি এসেছে। তা লেখা হয়েছিল একদম নিয়ম বহির্ভূত ভাবে। কাউকে প্রথমে সম্বোধন করা হয় নি। শুধু সংখেপে কয়েকটা কথা লেখা ছিল।
‘বন্ধু, ভালো থেকো। আমি এসেছিলাম আবার চলেও যাচ্ছি প্রিয় শহরটা ছেড়ে। তুমি খুব ভালো ছিলে। জানিনে সে কেমন আছে, যদি আমাকে চিনতে......। আসলেই মনে থাকার কথাও না। আমি ভালো আছি। ভালো থেকো কিন্তু।’
চিঠিটা পড়ে শেষ করেছি, আমার হাত কাঁপছে থর থর করে, এয়ার কন্ডিশনেও ঘাম ঝরছে অবিরাম। ঘোর ভাঙলো অনামিকার ফনে।
‘হ্যালো, কেমন আছিস?’
‘ভালো, তবে একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’
‘কি ঘটেছে?’
‘ছেলেটা এসেছিল অথচ আমি চিনতে পারি নি। সত্যিই বড্ড বোকা আমি।’
অনেকক্ষণ পর অনামিকা মুখ খোলে, ‘সে কেমন আছে?’
আমি শুধু বললাম, ‘খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর সেই মলিন মুখ। আমি তোকে বলেছিলাম না ও কখনোই মিথ্যা বলে না। অথচ তোর কাছে এটা কি একটা খেলা ছিল?’
কি হল জানি না। অনামিকা আর একটা কথাও বলল না। তারপর অনেকবার চেষ্টা করেছি তাকে ফোনে পাবার, তবু পাই নি।
বছর খানেক পর শুনলাম অনামিকা পাগলা গারদে। অতীত স্মৃতির তাড়নায় স্থানীয় কর্তব্য ফেলে দেখতে গেলাম তাকে। অনামিকা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শুধু। ওর আমার দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে আমার আত্মাটা নাড়া দিয়ে ওঠে। কি দুর্ভাগ্যের ভিতরেই না তার জীবনটা কেটেছে।
আভিজাত্যের মোড়কে ঢাকা আমাদের অনামিকা ছোট একটি ভুল করে ফেলে কৈশোরে। সেই ভুলের মাশুল তাকে আজ অবধি দিতে হচ্ছে। অথচ সেটা তো নিছক ভুলই ছিল, তবুও কেন যে সহজ ভুলটাকে জটিল মনে করত সবাই বুঝতাম না। তবু তার মত হাসি-খুশি মুখ আর মুক্তমনা বায়না আর কারো মাঝে দেখি নি। পারিবারিক চাপে তিক্ত হওয়া জীবনটাকে কিভাবে মানিয়ে নিতে হয় তাও সে জানত। কিন্তু অবশেষে যখন ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে থাকত, একেবারে অন্যরকম মুহূর্ত ছিল সেটা। অনামিকা তাকে গ্রহণও করে নি, বর্জনও করে নি। আসলে সে তাকে আবিষ্ট করে ফেলেছিল। তারপরও আমরা কিছুই বুঝতাম না ওদের ব্যাপার-স্যাপার। মাঝে মাঝে শুনতাম ওরা নাকি কথা বলে। কখন কিভাবে তা অবশ্য জানি নি। এরই মাঝে আমার সাথে বন্ধুত্ব হয় ছেলেটার। অবাক করার মত একজন সে। কখনো দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাত না, দোষ করলে ক্ষমা চাইত আর কথার মাঝে কি যেন একটা ছিল, কিন্তু সেটাকে মোহ বলা যায় না। তারপর কয়েকদিনের ভিতর ঘটে গেল কতগুলো ঘটনা। এতেই সব নিশ্চুপ। আর কখনোই ছেলেটাকে স্বাভাবিক হতে দেখি নি। নিরস ভাষায় কথা বলত আমাদের সাথে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম সবাই। তার মাস তিন পরই বিয়ে হল অনামিকার। আমরা সেদিন দেখেছিলাম তাতে কোন রকম মত ছিল না অনামিকার। কেন ছিল না সেটা একটুও বুঝতে পারি নি। বিয়ের পরদিন শুনলাম বরযাত্রীর কারের সাথে বাসের ধাক্কায় বর নিহত। অনামিকাকে সান্ত্বনা দিতে গেলাম। তারপর থেকে আর তেমনভাবে মেশার সুযোগ পাইনি অনামিকার সাথে। তাই কি ঘটেছে তারপর তাও জানি না।
যাই হোক, তিনদিন আমি তার সাথে ছিলাম। তিন দিনে একটা কথাও উচ্চারণ করে নি অনামিকা। পাগলা গারদ আমার নয়, তাই ঠিক করলাম বাড়ি ফিরে আসব। বাড়ি ফেরার জন্য হাসপাতালের গেট পেরিয়ে সামনে তাকালাম, দৃষ্টি থেমে গেল। দেখলাম সে পাগলটা রিক্সা থেকে নামছে। কাছে গিয়ে বললাম, ‘তুমি?’
ও বলল, ‘হয়তো।’
বলেই গেট পেরিয়ে জোরে হাঁটতে লাগল। আমিও ওর পিছু নিলাম। অনামিকার কেবিনে ঢুকে নার্স-ডাক্তার আর অনামিকার মাকে বের করে ভিতর থেকে দরজা আটকে দিল ছেলেটা।
সবাই দরজায় হাত দিয়ে আঘাত করতে লাগল। আমি গিয়ে ওদের থামালাম। তারপর অনামিকার মাকে সব খুলে বললাম। অতঃপর অপেক্ষা করতে লাগলাম বাইরে থেকে। মাঝে মাঝে দু’একটা কথার শব্দ শোনা গেল, তবে বেশীর ভাগ সময় নিশ্চুপ ছিল সব। আধা ঘন্টা মত পর কেবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে আসল অনামিকা।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা আমি এখানে কেন?’ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই কেমন আছিস?’
মুখে কথা শুনে হ্যাঁ বনে গেল ডাক্তার নার্সরাও। আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে কেবিনের ভিতর ঢুকলাম ছেলেটার সাথে কথা বলার জন্য। তবে কোথায় সে? তন্ন তন্ন করে কোথাও তাকে পেলাম না আমরা। অনামিকাকে সব বললাম, ও একটা কথাও বলল না এ বিষয়ে। শুধু মাথা নিচু করে রইল। অনামিকার রিলিজ হতে আরো দু’দিন সময় লাগল।
বাড়ি ফেরার জন্য বাসে উঠলাম আমরা। কিছুক্ষণ পর বাসের হেলপার অনামিকাকে বলল, আপনার একটা চিঠি আছে আমার কাছে। অনামিকা হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল। বিস্ময় ভরা চোখে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর আমার হাতে চিঠিটা দিল। আমি দেখলাম মাত্র তিনটি শব্দে শেষ করা লাইনটা, ‘ভালো থেকো সবসময়।’
বাস চলতে শুরু করল। অনামিকা চিঠিটার দিকে চেয়ে আছে, তার মুখাবয়বে রহস্যময় ক্ষীণ হাসির রেখা।
তার সেই হাসির কারণ আমি আজো বের করতে পারি নি।
বিষয়: সাহিত্য
১৯০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন