...মাতৃত্বের উপলব্ধি...
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০২ নভেম্বর, ২০১৩, ০৬:৪৪:০১ সন্ধ্যা

মাতৃত্বের উপলব্ধি কি? প্রশ্নটির জবাবে বলেছিলাম, মামণির যে কথা কাজ ও আচরনগুলো বিরক্তির সূচনা করতো সেগুলোকেই এখন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ মনেহয়। খাবার নিয়ে মামণির পেছন পেছন ঘোরা, রাত জাগা নিয়ে আপত্তি করা, মাঝরাতে একবার উঠে এসে দেখে যাওয়া, কলেজ থেকে বাসায় ফিরতে দেরী হয়ে অস্থির হয়ে ফোন করা ইত্যাদির পেছনে যে মার সদা কল্যাণকামী সত্ত্বাই কাজ করে সেটা এখন বুঝি। কারণ আমিও নিজেও যে এখন মা...আমার সন্তানকে ঘিরে আমার মনেও যে খেলা করে নানারঙের অনুভূতি। ছোটবেলায় মাকে নিয়ে কত ছড়া-কবিতা-গল্প-গান পড়েছি, শুনেছি, লিখেছিও সামান্য কিছু। কিন্তু নিজে মা হবার পরই মনেহয় সত্যিকার ও প্রকৃত অর্থে মাতৃত্বকে উপলব্ধি করেছি। চোখ বন্ধ করে আরেকবার নিজের মা হবার সফরটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হলো।
অপারেশন শেষ করে যখন ডাক্তার আমার কোলে দিয়েছিলেন আমার ছেলেকে...! সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে যে ক্লান্তি মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল তা উবে গিয়ে ঝিলমিলিয়ে উঠেছিল পূর্ণিমা রাতের স্নিগ্ধ সজিব চন্দ্রিমা। নাহ! কোন উপমা দিয়েই সেই মুহুর্তকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না। মাতৃত্বের প্রথম স্পর্শ ঘেরা সেই ক্ষণ এতটাই দুর্লভ যে শব্দে ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই! ওর কান্নার ধ্বনি মনের থরথরে ভীতু অনুভূতিকে রূপান্তরিত করেছিলো চরম প্রাপ্তির আনন্দাশ্রুতে। মাত্র একমিনিট পরই কোল থেকে নিয়ে গিয়েছিলো বেবীকে। কিন্তু সেই একমিনিটের ক্ষমতা কতটাই না বিস্ময়কর ছিল, দূর করে দিয়েছিল সমস্ত ভীতি, ব্যথা, দুর্বলতা।
আমার শারীরিক অপরাগতার কারণে যখন খাবারের অভাবে ক্ষুধায় কান্না করছিলো ছোট্ট বাবাটা হাত-পা ছুঁড়ে, অশ্রুর ঢল নেমে এসেছিলো আমার চোখেও। ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখে খাবার তুলে না দিতে পারার কষ্টের প্রচণ্ডতা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করেছিলাম সেদিন। এই উপলব্ধিটা আমার জীবন ভান্ডারের অমূল্য এক রত্ন। যা এখনো আমাকে প্রেরণা যুগিয়ে যায় অনেক কাজের...
সেই যে শুরু হলো মাতৃত্বের সফর তারপর থেকে চলছি তো চলছিই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হয়তো এমনি করেই চলতে হবে। তবে এই পথ চলার প্রতি মুহুর্তে আমি শিখছি কিছু না কিছু। যে শিক্ষা আমাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করছে মাতৃত্বকে, মায়েদের অনুভূতিকে। সন্তানের জন্য মায়ের মনের আকুতির রঙ এখন তাই আমি চিনি।
পড়াশোনা ব্যাপারে মার বারবার তাগাদা দেয়া খুব বিরক্ত করে সন্তানদেরকে। কিন্তু সন্তানরা কি জানে তাদের সাফল্য কত বড় অর্জন মায়ের জন্য? যখন শিক্ষকরা মার কাছে এসে প্রশংসা করেন তাঁর সন্তানের, প্রশান্তির কেমনতর হাওয়া বয়ে যায় মার অন্তর জুড়ে? প্রতিটা মায়ের কাছে তার সন্তান সবচেয়ে স্পেশাল, তাই হয়তো তিনি চান সবাই তাঁর সন্তানকে সেভাবেই দেখুক, ভাবুক।
মা তো আমাদের জীবনে এমন একজন যিনি মনে উৎসাহের দিয়া জ্বেলে তাতে নিরবধি অনুপ্রেরণা দেবার কাজটি করে যান খুব যত্নের সাথে। নানারকম ব্যর্থতা- হতাশায় আমরা যখন থমকে দাঁড়িয়ে যাই, শক্তি হারিয়ে ফেলি উঠে দাঁড়ানোর, জীবনটাকে মনেহয় তপ্ত দাহ! তখন হাজির হয় এক টুকরো ছায়াদানকারী মেঘ হয়ে। যার সুশীতল কণ্ঠ বাতাস ও আলো সঞ্চার করে মনের শুকিয়ে যাওয়া পল্লবগুলোতে।
কখনো বৃষ্টি, কখনো রোদ, কখনো দক্ষিণা হাওয়া, কখনো বসন্ত হয়ে দোলা দিয়ে যায় প্রাণে। দুর্বল মুহুর্তগুলোতে ভাবব্যক্তির দ্বারা শক্তি ও প্রাণ সঞ্চার করে মনেতে। অন্বেষণ করতে শেখায় জীবনের চাঞ্চল্য ও বৈচিত্র্যেকে। এঁকে দেয় জীবনকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করার নীল নকশা।নানা রকম বৈচিত্র্যটায় ভরপুর জীবন যখন মনে ক্লান্তির সুর বেজে উঠে! এরা মনে করিয়ে দেয় আমরা নিজেরাই নিজের মনের মিউজিক ডিরেক্টর! জীবন বীণার তন্ত্রীতে প্রশান্তির সুর তোলার দায়িত্বও তাই নিজেকেই নিতে হবে!
উপমা দিয়ে আসলে জীবনে এই মায়ের স্থান, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বোঝানো সম্ভব নয়। আসলে সব মানুষের ভেতরেই কম বা বেশি কিন্তু হিলিং ক্ষমতা আছে। কিন্তু সবাই সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারে না কিংবা জানে না। কিন্তু মায়েরা এটা এতটাই চমৎকার পারেন যে, জীবনের নানা অপুর্ণতায় সৃষ্ট ক্ষতগুলোকে পূরণ করে দেন শব্দের কারুকার্যে।
আমার মামণি তো এমন একজন মানুষ আমার জন্য যে, যখনই অসহায়ত্ব মনকে আঁকড়ে ধরে... মনেহয় শূন্যতায় ভাসছি...বাতাসের হালকা পরশই যথেষ্ট গভীর সমুদ্রে পতিত করার জন্য! গ্লানিময়- ক্লান্তিকর পরিস্থিতি যখন মনের কোমল অনুভূতিগুলো কেড়ে নিতে চায়! জোনাকির মত ছোট ছোট আশার আলো জ্বেলে মনের ভুবনকে করে তোলেন স্বপ্নিল! আকুলতা বিহীন উদ্যমহীন মেঘে ঢাকা মনের আকাশে বৃষ্টি ও রোদের সংমিশ্রনে সাজিয়ে যান রংধনু! আমাকে সর্বদা মনে করিয়ে দেন গোধূলির আবছা আলোছায়ার সূর্য ডুবে গেলেও, পরদিন ঠিকই এক বুক আলো নিয়ে আবার ফিরে আসে পৃথিবীর বুকে......
জানি না আমি কতটুকু ভালো সন্তান হতে পেরেছি মামণির কাছে। কিন্তু মনেহয় এই উপলব্ধিগুলো যদি পাথেয় থাকতো হয়তো অনেক বেশি ভালো সন্তান হতে পারতাম। কোথায় যেন পড়েছিলাম-“ তাত্ত্বিক জ্ঞান এক বছরে যা শেখায়, ব্যবহারিক জ্ঞান একদিনে তারচেয়ে বেশি শেখায় মানুষকে। সত্যিই মাকে নিয়ে পড়া অসংখ্য সাহিত্যের তুলনায়, আমার সন্তানের সাথে কাটানো একটি মুহুর্তকে অনেক বেশি ভারী মনেহয় আমার কাছে। যা সমৃদ্ধ করে তুলছে আমার মাতৃত্বকে এবং উপলব্ধি করতে সহায়তা করছে মায়ের মহত্ত্বকে।
হাদিসে বলা হয়েছে—‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’। এই হাদিসে যেমন সুসংবাদ রয়েছে সন্তানদের জন্য, তেমনি দুঃসংবাদও রয়েছে তাদের জন্য। কেননা মাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে বেহেশতে প্রবেশ করা সম্ভব হবে। কিন্তু তিনি অসন্তুষ্ট হলে রুদ্ধ হবে বেহেশতের দ্বার। তাই মায়ের সন্তুষ্টি অর্জন একজন সন্তানের অপরিহার্য দায়িত্ব।
কুরআনে আল্লাহ বলেছেন- “তোমার রব আদেশ করছেন, তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারও ইবাদত করো না এবং তোমরা (তোমাদের) পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করো; তাদের একজন কিংবা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তাদের সঙ্গে বিরুক্তিসূচক কিছু বলো না এবং কখনও তাদের ধমক দিও না, তাদের সঙ্গে সম্মানজনক ভদ্রজনোচিত কথা বলো। অনুকম্পায় তুমি তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বলো, হে আমার রব! তাদের ওপর তুমি (ঠিক সেভাবেই) দয়া করো, যেমনিভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছিলেন।” (সূরা বনী ইসরাইল ২৩-২৪)
বিষয়: বিবিধ
১৫৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন