ছোট্ট যোদ্ধা (শিশুতোষ নাটিকা)
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১২:৫৬:৫৯ রাত
প্রত্যেক ঈদেই আমাদের ছোট্ট সোনামণিদের জন্য বিনোদনমূলক কিছু না কিছুর আয়োজন করা হয়। ঈদ যে আমাদের জন্য খুব স্পেশাল একটা দিন সেটা বাচ্চাদের সামনে তুলে ধরাটাই উদ্দেশ্যে। এবার ঈদে বিশেষ কি আয়োজন করা যায় সেই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য বাচ্চাদের সবাইকে নিয়ে বসা হয়েছিলো। অনেক শলা পরামর্শের পর শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তে একমত হলো যে, এবার ঈদে শিশুতোষ নাটিকা করা হবে। প্রথম দু’তিন দিন তো নাটিকাটি কি হবে সেই চিন্তা-গবেষণাতেই কেটে গেলো। তবে সবচেয়ে বড় ঝামেলা লাগলো অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকে নিয়ে। আমাদের তিন থেকে ছয় বছর বয়সি যে কয়েকজন সোনামণি আছে তারা প্রত্যেকেই নায়ক হতে চায়। একজন বলল, আমাকে নায়ক না বানালে আমি নাটকই করবো না। তার সুরে কণ্ঠ মিলালো বাকিরাও। আরেকজন তো বলল, আমাকে নায়ক না বানালে আমি নাটকই হতে দেবো না। সে অবশ্য তার স্বৈরাচারী মনোভাবের সাথী হিসেবে পেলো না কাউকে। এই সব ঝগড়াঝাটির অবসানের জন্য লটারি করে প্রত্যেকের চরিত্র নির্ধারন করা হলো।
আগামী কাল থেকে রিহার্সেল শুরু হবে নাটিকার। যদিও কে কোন চরিত্র করবে জানার পর থেকেই কয়েকজন ব্যক্তিগত রিহার্সেল শুরু করে দিয়েছে। সকালে বাগানের দিকে চোখ পড়তেই দেখি ছোট ভাইয়ার সাড়ে চার বছর বয়সি কন্যা লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং আস্তে আস্তে সামনের দিকে ঝুকে যাচ্ছে। আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে আবারো ঝুকছে। এমন করছো কেন জানতে চাইলে জবাব দিলো, আমি নাটকে ‘বাঁশ’ তো সেই রিহার্সেল করছি। বাতাস এলে ঝুঁকে পড়ি, বাতাস চলে গেলে আবার উঠে দাঁড়াই। মামনি এখন কথা বলো নাতো আমাকে রিহার্সেল করতে দাও। আরেকজন কিছুক্ষণ পর পরই গর্জন করে উঠছে। কারণ জানতে চাইলে গর্জন দিয়েই বলল, আমি ড্রাগন। কাছে এসো না তোমাকে তাহলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবো। গররররররররররররররররর......! ড্রাগনের গর্জনে ভয় পেয়ে আমি এসে লিখতে বসেছি। শিশুদেরকে আনন্দ করতে বা পেতে দেখে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক রকমের প্রশান্তি ছেয়ে যায়। ভাবি কত অল্পেই না খুশি হয় শিশুরা! আনন্দে মেতে ওঠে ওদের ছোট্ট ভুবনে।
নাটিকার কাহিনীটা আমরা নিয়েছি ছোটদের একটা গল্পের বই থেকে। আমার নিজের কাছেও অসম্ভব ভালো লেগেছিল গল্পটা। ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলেকে কেন্দ্র করে গল্পটি। ছেলেটির নাম নাগা। নাগার জীবনের স্বপ্ন ছিল একজন সাহসী যোদ্ধা হওয়া। পরামর্শ নেবার জন্য যে গ্রামের বিখ্যাত চিত্রকরের কাছে গেলো। চিত্রকর তাকে বললেন, শুধু মারামারি জানলেই হবে না, ভালো যোদ্ধা হতে হলে তোমার মধ্যে অবশ্যই সৌন্দর্যকে দেখার ও বোঝার ক্ষমতা থাকতে হবে। চরিত্রের মধ্যে সৌন্দর্য ও ধার্মিকতার সংমিশ্রণ থাকলেই কেবল একজন যোদ্ধা সত্য ও ন্যায়ে জন্য লড়তে পারে। সৌন্দর্য কোথায় পাবে? নাগার এই প্রশ্নের জবাবে চিত্রকর বললেন, যদি তোমার দেখার মত চোখ থাকে তাহলে সৌন্দর্যকে তুমি চারপাশের সবকিছুর মধ্যেই খুঁজে পাবে। চিত্রকরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নাগা তখন সৌন্দর্যের সন্ধানে বের হলো।
গ্রামের পথে চলতে চলতে নাগার দেখা হল ছোট্ট একটি ইঁদুরের সাথে। ছুটে পালিয়ে যেতে চাইলে নাগা ইঁদুরকে বলল, পালিয়ো না আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না। আমি শুধু তোমাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আচ্ছা আমার জন্য শিক্ষণীয় এমন কিছু কি তোমার মধ্যে আছে? ইঁদুর জবাব দিলো, হ্যা আছে। ‘দুরদর্শিতা’ এটাই আমার সর্বশ্রেষ্ঠ গুনাবলী বা সদগুণ। ইঁদুরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবারো পথ চলতে শুরু করলো নাগা। চলতে চলতে সমুদ্রের কাছে পৌছে সে এক কচ্ছপকে দেখতে পেলো। কচ্ছপের কাছেও একই প্রশ্ন জানতে চাইলো নাগা, আচ্ছা আমার জন্য শিক্ষণীয় এমন কিছু কি তোমার মধ্যে আছে? জবাবে কচ্ছপ বলল, আমার আছে অসীম ধৈর্য্যশক্তি। আর এই ধৈর্যশক্তি অর্জন করতে তোমাকে হতে হবে ধীর-স্থির। মনে রাখতে হবে জীবনে আসলে তাই ঘটে যা ঘটার থাকে। কচ্ছপের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার চলতে শুরু করলো নাগা।
এবার তার দেখা হল এক ড্রাগনের সাথে। নাগা বলল, ড্রাগন তুমি তো ভীষণ শক্তিশালী। আমি যোদ্ধা হতে চাই, তুমি কি আমাকে তোমার কাছ থেকে একটু শক্তি দেবে? ড্রাগন বলল, শারীরিক শক্তির কথা যদি বল তাহলে সেটা আমি তোমাকে দিতে পারব না। এটা তোমাকেই অর্জন করে নিতে হবে ব্যায়াম ইত্যাদির মাধ্যমে। আমি তোমাকে মনোবল বা আত্মিক শক্তি দিতে পারি আর এটিই সবচেয়ে বেশি জরুরী একজন যোদ্ধার। এরপর নাগার দেখা হল ঈগলের সাথে। নাগা বলল, হে আকাশের রাজা ঈগল আমার জন্য শিক্ষণীয় এমন কিছু কি তোমার মধ্যে আছে? ঈগল জবাব দিলো, আমার আছে অহঙ্কার ও দাম্ভিকতা মুক্ত আত্মমর্যাদাবোধ। আমি আকাশে সবার চেয়ে উচ্চতায় উড়ি কিন্তু কাউকে আমি ছোট বা ঘৃণার চোখে দেখি না। এমনকি যে সাপ ও ইঁদুরকে আমি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি তাদেরকেও না। ঈগলকে ধন্যবাদ দিয়ে আবারো এগিয়ে চলল নাগা।
কিছুদূর চলার পর নাগার দেখা হল এক যোদ্ধার সাথে। উদ্বেলিত চিত্তে নাগা জানতে চাইল, হে বীর আমি কিভাবে আপনার মত হতে পারবো? শত্রুদের সাথে জয়ী হতে আমাকে কি করতে হবে। যোদ্ধা জবাব দিলেন, একজন যোদ্ধার শুধু মাত্র একটাই শত্রু। আর সেটা হচ্ছে ‘ভয়’। যদি তুমি তোমার ভয়কে জয় করতে পারো তাহলে সবকিছুকে তোমার বশীভূত করতে পারবে। আবারো পথ চলতে চলতে নাগা গিয়ে পৌছুলো এক বাঁশ ঝাড়ের কাছে। বাঁশরা নাগাকে বলল, আমাদের কাছ থেকে তোমার অনেককিছু শিক্ষণীয় আছে। তবে তোমাকে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন জিনিসটা বলি, সেটি হচ্ছে নমনীয়তা। যখন ঝড়ো হাওয়া বয় আমরা তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা না করে সে যেদিকে চায় ঝুকে পড়ি। যখন বাতাস চলে যায় আবার আমরা স্বস্থানে উঠে দাঁড়াই। একজন যোদ্ধার মধ্যেও সব অবস্থায় সাথে খাপ খাইয়ে চলার ক্ষমতা থাকা উচিত।
এরপর নাগার দেখা হল ছোট্ট নাইটিংগেল পাখীর সাথে। নাগা জানতে চাইল তার জন্য শিক্ষণীয় কিছু আছে কিনা? নাইটিংগেল পাখী জবাবে বলল, আমার আছে আবেগপ্রবনতা। আবেগপ্রবনতা হচ্ছে ছোট থেকে ছোট ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র জিনিসের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করা। আর শক্তিশালী কেউ যখন তার চেয়ে দুর্বল ও ভঙ্গুর কাউকে ভালোবাসে, সাহায্য করে এরচেয়ে মহৎ আর কি হতে পারে! এভাবে একে একে নাগা বিড়ালের কাছ থেকে শিখলো বিচক্ষণতা, শিয়ালের কাছ থেকে বুদ্ধিদীপ্ততা, বানরের কাছ থেকে দ্রুততা। জানলো এসব ছাড়া একজন যোদ্ধা যতই শক্তিশালী হোক না কেন সফলতা অর্জন করতে পারে না। সবশেষে নাগা গিয়ে হাজির হল গ্রামের বৃদ্ধ যোদ্ধার কাছে। পথে আসতে আসতে কি কি শিক্ষা অর্জন করেছে জানালো নাগা বৃদ্ধ যোদ্ধাকে। নিজের অর্জন নিয়ে নাগা খুবই আনন্দিত ও তৃপ্ত ছিল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপ করে থেকে বৃদ্ধ যোদ্ধা বললেন, অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস তুমি শিখেছো কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন জিনিসটিই বাদ রয়ে গিয়েছে। নাগা অবাক হয়ে জানতে চাইলো কি সেই জিনিস? বৃদ্ধ জবাব দিলেন, উষ্ণতা। কোথায় পাবো উষ্ণতা? নাগার প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধ বলল, ঘাস, লতা-পাতা, বৃক্ষের কাছে। এদের চেয়ে বেশি উষ্ণতা আর কারো কাছে নেই। আর তারচেয়েও বড় কথা হল এদের ছাড়া বেঁচে থাকাই অসম্ভব।
বৃক্ষের ছায়ায় নাগাকে নিয়ে বসে তিনি বললেন, অনেক মূল্যবান ও গুরুত্বপুর্ণ জিনিস শিখেছ তুমি। তোমাকে আমি কিছু পরামর্শ দিতে চাই, যে মূল্যবান সম্পদ তুমি অর্জন করেছো এগুলোকে গুপ্তধন মনেকরে শুধুমাত্র নিজের জন্য তুলে রেখো না। তোমার এসব অর্জনকে ছড়িয়ে দিও সবার মাঝে। অন্যদেরকে সাহায্য করো এসব অর্জন করতে। তাহলেই কেবল তোমার এসব অর্জন সার্থক হবে। নাগা প্রশ্ন করলো, আমি কিভাবে এটা করবো? বৃদ্ধ জবাব দিলেন, আমি তোমাকে লিখতে ও পড়তে শিখিয়ে দেবো। তুমি তোমার এসব অর্জন ও তোমার মনের সব কথা লিখে রাখবে। আর এভাবেই তুমি পরিণত হবে একজোর্টলেখক, একজন কবি, একজন শিক্ষককে। আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি এভাবে তোমার জীবন অনেক বেশি সুন্দর ও উৎকর্ষ হবে, শুধু যোদ্ধা হয়ে যুদ্ধ করার চেয়ে। গল্পের শেষে বৃদ্ধের পরামর্শ মতো নাগা জ্ঞানার্জন ও জ্ঞান বিতরণকে নিজের জীবনের মিশন হিসেবে গ্রহন করে।
চমৎকার এই গল্পটি শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় উপকরণে ভর্তি। চারপাশের প্রতিটা জিনিসের মধ্যেই যে শিক্ষা লুকানো আছে এই বিষয়টা খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গল্পটিতে। জ্ঞানের আলোতেই যে একজন মানুষ সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয় এই উপলব্ধিটিকেই গল্পের মোড়াল হিসেবে দেখানো হয়েছে। বাচ্চাদেরকে ওদের ভাষায় যদি গল্পটি বিশ্লেষণ করে বোঝানো যায়, তাহলে জ্ঞানার্জন ও জ্ঞান বিতরণের প্রয়োজনীয়তা খুব সহজেই বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব।
বিষয়: বিবিধ
৩৬৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন