তোমরা ভুলেই গেছ কায়কোবাদের নাম
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ ওহিদুল ইসলাম ২৩ আগস্ট, ২০১৫, ০৯:৩৪:৫৯ সকাল
কে ঐ শোনাল মোরে
আযানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর!
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।।
কি মধুর আযানের ধ্বনি!
আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে,
কি যে এক আকর্ষণে, ছুটে যাই মুগ্ধমনে
কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে।
হৃদয়ের তারে তারে, প্রাণের শোণিত-ধারে,
কি যে এক ঢেউ উঠে ভক্তির তুফানে-
কত সুধা আছে সেই মধুর আযানে।
নদী ও পাখির গানে তারই প্রতিধ্বনি।
হৃদয়ের তন্ত্রীতে সুর তোলা এই অসাধারণ কাব্যের স্রষ্টা মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী, মহাকবি কায়কোবাদ নামেই যিনি সমধিক পরিচিত। তোমরা কি জান এই মহাকবি সম্পর্কে? আজানের ধ্বনিতে কি তোমাদের মনপ্রাণ আকুলিয়ে উঠে, নেচে উঠে ধমনী? তোমাদের সেই সময় কোথায় বল! রাত এগারোটায় স্টার জলসার শেষ ডেইলী সোপ দেখে, স্টার প্লাস এ রাতজেগে সিনেমা দেখে ভোর চারটা, পাঁচটায় ফজরের আজানের ধ্বনি শুনতে তোমাদের বয়েই গেছে। তোমাদেরই বা আর দোষ দিই কি করে? অপসংস্কৃতি, অপসাহিত্য আর ভুল ইতিহাসের জোয়ারে ধামাচাপা পড়ে গেছে মহাকবি কায়কোবাদের মত সাহিত্যিকরা ও তাদের সাহিত্যকর্ম।
বাংলাসাহিত্যের সর্ববৃহৎ মহাকাব্য “মহাশ্মশান” মহাকবি কায়কোবাদের অমর সৃষ্টি। ঐতিহাসিক পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ নিয়ে রচিত ৭৮০ পৃষ্ঠার বিশাল এই মহাকাব্য রচনায় সময় লেগেছিল ১০ বছর। উল্লেখ্য যে, বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মহাকাব্য ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য। এছাড়া হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ও ইসলামী রেঁনেসার কবি ফররুখ আহমদও মহাকাব্য রচনা করেন। তবেতবে ইতিহাস নিয়ে রচিত এটিই প্রথম মহাকাব্য এবং এর প্রকাশকাল ছিল ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ। কোলকাতায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে দেখা হওয়ার পর বিদ্রোহী কবি সালাম দিয়ে উপস্থিত সবার সাথে মহাকবিকে এই বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ইনিই মহাকবি কায়কোবাদ, মহাশ্মশান অমর কাব্যের স্রষ্টা-আমাদের অগ্রপথিক।’ এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ, কায়কোবাদ কত বড় কবি ছিলেন!
এ মহাকাব্য সম্বন্ধে আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেন, “মহাশ্মশান কাব্য বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে একটি উজ্জ্বল রত্ন। মহাশ্মশানের ন্যায় বৃহদাকার কাব্য বোধহয় বঙ্গ সাহিত্যে আর নেই।”
এই কাব্যের মাধ্যমে কবি মুসলমানদের জাগরণের বাণী শুনিয়েছেন-
“পড়ে নাকি মনে সেই অতীত গৌরব?
সুদূর আরব ভূমে যে বীর জাতি
মধ্যাহ্ন মার্তন্ড প্রায় প্রচন্ড বিক্রমে
যাইত ছুটিয়া কত দেশ দেশান্তরে
আফ্রিকার মরুভূমে বালুকা প্রান্তরে
বিসর্জিয়া আত্মপ্রাণ কেমন বিক্রমে
স্থাপিয়াছে ধর্মরাজ্য ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ রবে
আজিও ধ্বনিত সেই নীলনদ তীরে।”
বাংলা মহাকাব্যের অস্তোন্মুখ এবং গীতিকবিতার স্বর্ণযুগে মহাকবি কায়কোবাদ মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস থেকে কাহিনী নিয়ে ‘মহাশ্মশান’ মহাকাব্য রচনা করে যে দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন তা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় আসনে স্থান করে দিয়েছে (নুরুল আমিন রোকন, সাপ্তাহিক মানচিত্র)। সেই গৌরবের প্রকাশে ১৯৩২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কবি কায়কোবাদ। তিনি বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রথম সনেট রচয়িতা। তিনি আধুনিক বাংলাসাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি।
ছাত্র জীবনেই ‘কুসুম কানন’ ও ‘বিরহ গোলাপ’ নামে কবির দুটি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ কাব্য গ্রন্থ দুটির জন্য কবি কাশিম বাজারের মহারাণী কর্তৃক পুরস্কৃত হন। স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাটি ছিল কবিকে কাব্যচর্চায় উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
১৩০২ বঙ্গাব্দে ময়মনসিংহের জামুরকী পোস্ট অফিসে কর্মরত থাকাকালীন ঢাকা হতে সৈয়দ এমদাদ আলীর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় কবির একটি খন্ড কাব্যগ্রন্থ - ‘অশ্রু মালা’। মূলত এই অশ্রুমালা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই কায়কোবাদের কবি খ্যাতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ঐ সময়কার সেরা কবি নবীনচন্দ্র সেন আলিপুর হতে কবিকে লিখে পাঠান-
‘মুসলমান যে বাংলা ভাষায় এমন সুন্দর কবিতা লিখতে পারে, আমি আপনার উপহার না পাইলে বিশ্বাস করিতাম না। অল্প সুশিক্ষিত হিন্দুরই বাংলা কবিতার উপর এরূপ অধিকার আছে।”
ভাওয়াল এলাকার মুসলমান জমিদার নুরুউদ্দিন হায়দারের একমাত্র পুত্র আলাউদ্দীন হায়দরকে তারই দেওয়ান সুধীর চন্দ্র জমিদারীর লোভে কূপে ফেলে হত্যা করে এবং এই কূপের উপর নির্মাণ করে শিবমন্দির। এই অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৩২৮ বংগাব্দে (১৯২১ খৃস্টাব্দে) প্রকাশিত হয় তাঁর ‘বিশ্বমন্দির’ কাব্য।
১ ফাল্গুন ১৩২৯ বংগাব্দে প্রকাশিত হয় ‘অমিয় ধারা’ খন্ড কাব্য। মহাকবির অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা ‘আজান’ এই খন্ডকাব্যেরই অংশ। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে (ইংরেজী ১৯৩২ সালে) প্রকাশিত হয় কায়কোবাদের আরেকখানি মহাকাব্য ‘মহরম শরীফ’। কারবালার যুদ্ধের কারণ ও ইতিহাস বিবৃত হয়েছে এ কাব্যে। ৩ খন্ডে সমাপ্ত এ কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা ‘শ্মশান ভস্ম’ কাব্য উপন্যাসখানি ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। কায়কোবাদের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় –প্রেম পারিজাত, প্রেমের ফুল, প্রেমের রাণী, মন্দাকিণী ধারা প্রভৃতি কাব্য।
মহাকবি কায়কোবাদের সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় প্রতিভাত হয়ে উঠে, কবির অধিকাংশ রচনাই ছিল ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে এবং আধমরা জাতিকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস।
এতক্ষণ কবির সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে তোমাদের মাঝে খানিকটা পরিচয় করিয়ে দেয়া হল। এবার মহাকবির #জন্ম ও #জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে কিছুটা জানা যাক।
মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহের বছর ১৮৫৭ খৃস্টাব্দে ঢাকা জেলার নওয়াবগঞ্জ থানার আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম জরিফউন্নেছা খাতুন। কায়কোবাদ ছিলেন বাবা মায়ের প্রথম পুত্র। তাঁর অন্য দু’জন ভাই হলেক আবদুল খালেক ও আবদুল বারী যারা যথাক্রমে সাবডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের সার্জন ছিলেন।
জানা যায়, হাফিজ উল্লাহ আল কোরেশী নামে তাঁর জনৈক পূর্ব পুরুষ বাদশাহ শাহাজানের সময়ে বাগদাদ নগরীর নিকটবর্তী কোন স্থান থেকে দিল্লীতে এসে বসতি স্থাপন করেন। হাফিজ উল্লাহ আল কোরেশী ছিলেন আরবী ও ফারসী ভাষায় সুপন্ডিত। যে কারণে তিনি সহজেই বাদশাহ শাহজাহানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। বাদশাহ তাঁর গুণে মুগ্ধ হয়ে দিল্লী জামে মসজিদের সহকারী ইমামের পদে তাঁকে নিয়োগ দেন। এই হাফিজ উল্লাহ আল কোরেশীর প্রপৌত্র মাহবুব উল্লাহ আল কোরেশী দিল্লী হতে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং ফরিদপুর জেলার গোড়াইল গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। মহাকবি কায়কোবাদ এই মাহবুব উল্লাহ আল কোরেশীর প্রপৌত্র। তাঁর দাদার নাম নেয়ামত উল্লাহ আল কোরেশী এবং আব্বার নাম শাহমত উল্লাহ আল কোরেশী ওরফে এমদাদ আলী।
কায়কোবাদের লেখাপড়া শুরু হয় পিতা শাহমত উল্লাহর কর্মস্থল ঢাকাতে। তিনি ঢাকার পগোজ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। অবশ্য ১১ বছর বয়সে মা এবং ১২ বছর বয়সে আব্বা মারা যাওয়ায় ইয়াতিম কবি নানাবাড়ি আগলাপাড়া গ্রামে ফিরে যান এবং সেখানে এক বছর সময় কাটান। পরে তিনি পুনরায় ঢাকাতে ফিরে এসে ঢাকা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এ সময়ে মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু রাজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দীর পিতা মওলবী ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী। অপরদিকে কবির সহপাঠী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পিতা জাস্টিস জাহিদ সোহরাওয়ার্দী। ঢাকা মাদ্রাসায় কায়কোবাদ এন্ট্রাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। মাদ্রাসার শিক্ষা জীবন শেষ হলে তিনি ১৮৮৭ সালে ডাক বিভাগে চাকুরি নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন এবং ১৯১৯ সালে চাকুরী জীবন হতে অবসর গ্রহণ করেন।
কর্মজীবনে প্রবেশ করার আগেই তিনি অভিভাবকদের মতানুযায়ী মামা হেদায়াত আলী সাহেবের বড় মেয়ে তাহেরউন্নেছা খাতুনকে বিয়ে করেন।
২ সেপ্টেম্বর ১৯২৫ খৃস্টাব্দে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ কায়কোবাদকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’ ও ‘সাহিত্য রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁকে ‘মাইকেল দি সেকেন্ড’ ও বলা হতো।
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্ত্বে ১৩৫২ বঙ্গাব্দের ২রা বৈশাখ কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ হলে কায়কোবাদকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
ব্রঙ্কো নিউমেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২১ জুলাই ১৯৫১ খৃষ্টাব্দে ৯৪ বছর বয়সে মহাকবি কায়কোবাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।
তথ্যসূত্রঃ
১। ঢাকা টাইমস২৪ ডটকম
২। নুরুল আমিন রোকন, কায়কোবাদ: ইতিহাস সচেতন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কবি, সাপ্তাহিক মানচিত্র
৩। উইকিপিডিয়া
৪। কবি নাসির হেলাল, সেরা মুসলিম মনীষিদের জীবনকথা।
বিষয়: সাহিত্য
৩০৩৬ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খুবই ভালো লাগলো
তথ্য বহুল লিখাটি পড়ে।
শুকরিয়ানিন।ভাইজান
মন্তব্য করতে লগইন করুন