সূরা দুহা বা প্রভাতের সুন্দর আলো
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ১০ এপ্রিল, ২০১৫, ০২:০৮:২৪ রাত
১। প্রভাতের সুন্দর আলোর শপথ
২।এবং শান্ত নিস্তব্ধ রাত্রির শপথ
৩। তোমার প্রতিপালক প্রভু তোমাকে পরিত্যাগ করেন নাই এবং অসন্তুষ্টও হন নাই।
৪। নিশ্চয় ইহকাল অপেক্ষা পরকাল তোমার জন্য অধিক মঙ্গলময় হবে
৫। আর শীঘ্রই তোমার প্রতিপালক প্রভু তোমাকে এমন অনুগ্রহ দান করবেন, যাতে তুমি অবশ্যই খুশী হবে
৬। তিনি কি তোমাকে এতিম অবস্থায় পান নাই এবং তোমাকে আশ্রয় [ ও ভালোবাসা ] দেন নাই
৭। এবং তিনি তোমাকে পথহারা অবস্থায় দেখেন ও পথ -নির্দ্দেশ দান করেন
৮। তিনি তোমাকে দরিদ্র অবস্থায় দেখেন এবং তোমাকে [ দারিদ্র ] মুক্ত করেন
৯। সুতারাং এতিমদের সাথে কখনও দুর্ব্যবহার করো না
১০। প্রার্থীর আবেদন [ না শুনে ] তাড়িয়ে দিও না
১১। তুমি তোমার প্রভুর অনুগ্রহের কথা আবৃত্তি ও ঘোষণা কর ।
আলোকজ্জ্বল প্রভাতের শপথ করা হয়েছে। রাত্রির অন্ধকারকে বিদূরিত করে যখন ধীরে ধীরে প্রভাতের সুর্য পূর্ব দিগন্তের নীল আকাশে উদিয় হতে থাকে; তখন রাত্রির অন্ধকারের পটভূমিতে আলোর তীব্রতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।সূর্যদয় থেকে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত আলোর তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে যার পটভূমি হচ্ছে নিশিত রাত্রির অন্ধকারের নিরবতা। ঠিক সেরূপ হচ্ছে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন। নিশিত রাত্রির নিরবতার ন্যায় আধ্যাত্মিক জগতকেও জাগতিক কর্মজগত থেকে সাময়িক বিরতিদান প্রয়োজন তাহলেই আধ্যাত্মিক জগতে প্রভাতের সূর্যের ন্যায় আল্লাহ্র হেদায়েতের আলোর উন্মেষ ঘটবে এবং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। পৃথিবীর কর্মজগতের সকল চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে আল্লাহ্র ধ্যানে নিমগ্ন হওয়ার প্রকৃষ্ট সময় নিশিত রাত্রির নিরবতা। এটাই হচ্ছে আত্মিক বিকাশের প্রকৃষ্ট সময়। এ কথা ভাবার অবকাশ নাই যে রাত্রির নিরবতা বা শান্ত অবস্থা বৃথা অপচয় ঘটে, অথবা তা আধ্যাত্মিক জগতের জন্য প্রয়োজন নাই। এই নীরবতা জীবনকে পার্থিব কোলাহলমুক্ত করে আত্মাকে আল্লাহ্র অনুগ্রহের উপযুক্ত করে তোলে। মানুষ সে সময়ে একা নয়, আল্লাহ্ তাঁকে ত্যাগ করেন না। যদিও রাত্রির এই ধ্যানমগ্নতার প্রভাব বা ফলাফল তাৎক্ষণিক ভাবে লক্ষ্য করা যায় না, তাই বলে এ কথা ভাবার অবকাশ নাই যে, আল্লাহ্ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। রাত্রির এই নীরব নিথর ধ্যান মগ্নতাই, আধ্যাত্মিক জীবনের ঊষালগ্নের সূচনা করে। যেমন নিরব নিথর রাত্রি শেষ পূর্ব দিগন্তে প্রভাতের সূর্যের উদয় ঘটে। অপূর্ব রূপক বর্ণনা ও রাসুলের জীবনের উদাহরণের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষের কাছে এই সার্বজনীন সত্যের রূপকে তুলে ধরা হয়েছে।
সাধারণ ভাবে রাত্রির অন্ধকারের অনগুন্ঠন পৃথিবীকে সুপ্তির কোলে টেনে নেয়। সেই অবগুণ্ঠন সরিয়ে প্রভাতের সূর্যের আগমন ঘটে আলোর বন্যা নিয়ে। দিনের আরম্ভের পূর্বে থাকে রাত্রির অন্ধকারের অবগুন্ঠন। এই সূরাতে বিপরীত ভাবে যুক্তির উপস্থাপন করা হয়েছে।প্রভাতের সূর্যের ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বলতা লাভ করাই হচ্ছে এখানের প্রধান বিষয়বস্তু।
আল্লাহ্ রাসুলকে (সা) নির্দ্দিষ্ট বিষয়ের প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেছেন যা সার্বজনীন, যুগ কাল উত্তীর্ণ। দেখুন সূরাটির ভূমিকা। কোরাণ অবতরণের প্রথম ভাগে 'ওহী' অবতরণে বিলম্ব হয়। সময়ের এই ব্যবধানে হযরতের মনে নিঃসঙ্গতার সৃষ্টি হয়, তিনি চিন্তাযুক্ত হন। আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের জন্য তিনি ব্যকুল হয়ে পড়েন। তদুপরি মক্কার কোরাইশরা তাঁর প্রতি ঠাট্টা বিদ্রূপের ও ভয় ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে তখন তাকে সান্তনা দিয়ে এই সূরাটি অবতীর্ণ হয়। শুধু রাসুলকেই (সা) নয় সেই সাথে তার অনুসারীদেরও কোরাইশরা অত্যাচার ও নির্যাতন করতে থাকে। কিন্তু কোরাইশাদের কোন বিদ্রূপ বা অত্যাচার রাসুলের (সা) হৃদয়কে সত্যের প্রতি বিশ্বাস থেকে এতটুকু বিচলিত করতে পারে নাই ; কোরাইশরা যত ভাবেই বিদ্রূপাচ্ছলে বলুক না কেন যে, " আল্লাহ্ রাসুলের (সা) উপরে রাগ করেছেন " রাসুল (সা) ছিলেন বিশ্বাসে ও নির্ভরশীলতায় অবিচল যা বিশ্ব মানবের জন্য সর্ব কালের উদাহরণ।
বলা হয়েছে " পরকাল ইহকালের সময় অপেক্ষা শ্রেয়।" এই উত্তরণ হবে ইহলোকে এবং পরলোকের জীবনের জন্য। পৃথিবীর পার্থিব মানদন্ডে অনেক সময়ে এ সব পূণ্যাত্মাদের জীবনকে সুউচ্চ বা মাননীয় ও সম্মানীয় মনে হতে না পারে। কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবনে হৃদয় ও অন্তর এদের হবে তীব্র প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ। এই প্রশান্তির পরিমাণ প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে - প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে তার হৃদয় হবে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর।
রাসুল (সা) কে সম্বোধন করে বিশ্ব মানবকে আল্লাহ্ বলছেন, যে আল্লাহ্র রাস্তায় কাজ করে অবশ্যই সে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন করবে। যদি আমরা আমাদের ইচ্ছা ; চাওয়া-পাওয়া ও আবেগ, অনুভূতিকে সেই বিশ্বস্রষ্টার বিশ্বজনীন ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হই,তবে আল্লাহ্ আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, আমাদের সকল দ্বিধা -দ্বন্দ, ভয়, আশঙ্কা, ইত্যাদি সব কিছু হৃদয় থেকে দূর হয়ে যাবে এবং আমাদের হৃদয় আত্মপ্রসাদ, সন্তুষ্টি এবং আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। আল্লাহ্ আশ্বাস দিয়েছেন," তুমি অবশ্যই খুশী হবে।"
যিনি হবেন বিশ্ব নবী, আল্লাহ্ তাঁকে 'এতিম ' করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।আল্লাহ্ বলেছেন যে, মানুষ যখন এতিমের ন্যায় অসহায় হয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ্র ভালোবাসা তাকে আশ্রয় দান করে। আধ্যাত্মিক জগতে আমাদের কোনও পিতা-মাতা নাই। সে জগতের আশ্রয়দাতা, প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ্। আল্লাহ্র করুণাই একমাত্র ভরসা।
মহানবী যখন পৃথিবীতে আগমন করেন, তখন সমগ্র আরব পৌত্তলিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো ,আল্লাহ্ তাঁকে সঠিক পথের নির্দ্দেশ দান করেন। নবুয়ত লাভের পূর্ব থেকেই রাসুলুল্লাহ্ (সা) মানুষের নৈতিক অধঃপতন দেখে বিচলিত হতেন, মানুষকে রক্ষার উপায় খুঁজতেন ।আল্লাহ্ তাঁকে সঠিক পথের নির্দ্দেশ দান করেন।
পৃথিবীর জীবনে আমরা অনেক সময়েই ভালো কাজে বাঁধা প্রাপ্ত হই বা অর্থের বা লোকবলের অভাব অনুভব করি। কিন্তু যদি আমাদের কাজের উদ্দেশ্য মহৎ হয় এবং আমরা আমাদের কাজের প্রতি আন্তরিক ও বিশ্বস্ত থাকি তবে আল্লাহ্র সাহায্য অবশ্যাম্ভবী। বিশেষ ভাবে যদি সে পথ হয় আধ্যাত্মিক জগতের পথ ; তবে সেই খাড়া বন্ধুর পথে আরোহণ অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। যদি কেউ সে পথ খুঁজে পায় এবং দুরূহ পথকে অতিক্রম করতে চায় ধৈর্য্য, অধ্যাবসায় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে,তবে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ভালোবাসাতে তাঁর অন্তর পূর্ণ করে দেবেন। আল্লাহ্ তাকে আধ্যাত্মিক ভাবে অভাব মুক্ত করবেন।
মানুষ অপরের অসহায়ত্বের সুযোগ গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর। সেক্ষেত্রে আল্লাহ্র হুকুম হবে অসহায়, যারা অন্যের উপরে নির্ভরশীল, তারা হচ্ছে সম্পদশালী ও প্রভাব প্রতিপত্তিশালীদের জন্য পবিত্র আমানত স্বরূপ। এই অসহায়ত্ব হতে পারে এতিম হওয়ার কারণে বা অন্যের উপরে নির্ভরশীলতার কারণে। আল্লাহ্র হুকুম হচ্ছে এই অসহায়দের প্রতি অনুভূতিশীল দয়ার্দ্র হওয়া।
সাহায্য প্রার্থীর প্রতিটি দরখাস্ত তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহানুভূতি ও দয়ার সাথে বিবেচনা করতে হবে।
আল্লাহ্র নেয়ামত বা দানকে অন্যের সাথে অংশদারিত্ব ভোগ করতে হয়। রাসুলের জীবনীর মাধ্যমে এই শিক্ষাকে তুলে ধরা হয়েছে। রাসুল (সা) তাঁর প্রতি অর্পিত নবুয়তের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে কথায় ও কাজে পালন করেছেন। আমরা সকলেই আল্লাহ্র কোন না কোন অনুগ্রহে ধন্য। আমাদের সকলেরই উপরে ঐশ্বরিক হুকুম হচ্ছে, আমাদের সকল মানুষ ভাই এর জন্য আল্লাহ্র নেয়ামতকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভোগ করা। তাহলেই সে হবে আল্লাহ্র যোগ্য প্রতিনিধি।
(তাফসির -কোরআন এন্ড তাফসির থেকে)
বিষয়: বিবিধ
১৩৪৮ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
,,,,,,,
সূরা দোহা
১। প্রভাতের সুন্দর আলোর শপথ
২।এবং শান্ত নিস্তব্ধ রাত্রির শপথ
৩। তোমার প্রতিপালক প্রভু তোমাকে পরিত্যাগ করেন নাই এবং অসন্তুষ্টও হন নাই।
৪। নিশ্চয় ইহকাল অপেক্ষা পরকাল তোমার জন্য অধিক মঙ্গলময় হবে
৫। আর শীঘ্রই তোমার প্রতিপালক প্রভু তোমাকে এমন অনুগ্রহ দান করবেন, যাতে তুমি অবশ্যই খুশী হবে
৬। তিনি কি তোমাকে এতিম অবস্থায় পান নাই এবং তোমাকে আশ্রয় [ ও ভালোবাসা ] দেন নাই
৭। এবং তিনি তোমাকে পথহারা অবস্থায় দেখেন ও পথ -নির্দ্দেশ দান করেন
৮। তিনি তোমাকে দরিদ্র অবস্থায় দেখেন এবং তোমাকে [ দারিদ্র ] মুক্ত করেন
৯। সুতারাং এতিমদের সাথে কখনও দুর্ব্যবহার করো না।
লেখাটি অত্যন্ত ভালো লেগেছে ধন্যবাদ। সাথে ইউটিউব লিংক শেয়ার করলাম।
https://youtu.be/_BtXmEPPP74
আল্লাহর অপার করুণ যে, তিনি মানব জীবনের জন্যে পুর্ণাংগ সংবিধান রুপে কোরআন কারীম কে প্রদান করেছেন! যার প্রতিটি শব্দে চির কল্যাণের বার্তা নিহিত রয়েছে!
কোরআনিক আলোচনার যত প্রসার ঘটবে বিশ্ব মানবতার মুক্তি ততই সন্নিকটে আসবে!
সুন্দর সাবলীল তাফসীর আলোচনায় জাযাকিল্লাহু খাইরান হে শ্রদ্ধেয়া আপুজ্বী!!
কোরআনিক আলোচনার যত প্রসার ঘটবে বিশ্ব মানবতার মুক্তি ততই সন্নিকটে আসবে! সঠিক বলেছেন!
পড়ার জন্য এবং চমৎকার অভিমত প্রকাশের জন্য শুকরিয়া। জাযাকাল্লাহু খাইর
চমৎকার দোআয় আমিন! কোরআনিক আলোচনার যত প্রসার ঘটবে বিশ্ব মানবতার মুক্তি ততই সন্নিকটে আসবে!পড়ার জন্য শুকরিয়া। জাযাকিল্লাহু খাইর!
মহান আল্লাহতায়লাই একমাত্র আশ্রয়দাতা।
আসসালামুআলাইকুম শ্রদ্ধেয় ভাইয়া ।
কোরআনিক আলোচনার যত প্রসার ঘটবে বিশ্ব মানবতার মুক্তি ততই সন্নিকটে আসবে!পড়ার জন্য শুকরিয়া। জাযাকাল্লাহু খাইর!
৬। তিনি কি তোমাকে এতিম অবস্থায় পান নাই অতঃপর তোমাকে আশ্রয় দেন নাই?
৭। ও তিনি কি তোমাকে পথহারা অবস্থানে পেয়ে পথের দিশা দান করেন নাই?
৮। তিনি কি তোমাকে দারিদ্র অবস্থায় পেয়ে তোমাকে দারিদ্রমুক্ত করেন নাই?
এখানে আল্লাহ তায়ালার তিনটি অনুগ্রহের কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে শুকয়িরা স্বরুপ নিচের তিনটি কাজ করতে বলেছেনঃ
৯। সুতারাং এতিমদের সাথে কখনও দুর্ব্যবহার করো না
১০। প্রার্থীর আবেদন না শুনে তাড়িয়ে দিও না
১১। তুমি তোমার প্রভুর অনুগ্রহের কথা আবৃত্তি ও ঘোষণা কর ।
অনেক সুন্দর হয়েছে আপু, জাযাকিল্লাহ খাইরান
আপনার উপস্থিতি, পড়া এবং অভিমত প্রকাশের জন্য আন্তরিক শুকরিয়া! বারাকাল্লাহু ফিক!
শ্রদ্ধেয় ভাইয়া, আপনাকে অনেক অনেক শুকরিয়া কবি নজরুলের চমৎকার ছন্দে জবাব দেয়ার জন্য!
বিশেষ দোআর অনুরোধ রইলো! মনটা খুব খারাপ লাগছে! আমাদের লিখাগুলো আমাদের বিপরীতে যেনো সাক্ষ্য না দেয়! আমীন!
এখন কি অবস্থা তোমার আপু? ভালো তো?
মন্তব্য করতে লগইন করুন