বল বীর-চির উন্নত মম শির
লিখেছেন লিখেছেন প্রেসিডেন্ট ২৫ মে, ২০১৪, ০১:০২:৪৫ দুপুর
‘মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণ-ভূমে রণিবে না’
মহাগর্জনে এমন বিদ্রোহী সুর উচ্চারণের হিম্মত আর কয়জনের আছে?
আর কার আছে এমন বুকের পাঠা যে অত্যাচারী ফ্যাসিস্ট শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে উচ্চারণ করে?
‘কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙ্গে ফেল্ কর রে লোপাট রক্ত-জমাট..
.......................
লাথি মার, ভাঙরে তালা! যত সব বন্দী-শালায়-
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি ॥’
শির উঁচু করে আর কয়জন বলেছে?
“বল বীর- বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী' আমারি নতশির
ওই শিখর হিমাদ্রীর!”
হ্যা, যার কন্ঠে বেজেছে এমন শ্বাশত বিদ্রোহের সুর তিনি আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম। না শুধু কবি হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয় এ অসাধারণ প্রতিভার পরিচয়। প্রেম, দ্রোহ ও মানবতামুক্তির মন্ত্র আওড়ে গেছেন কবিতা, গানে, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ ও চিঠিতে। শুধু সাহিত্যেও সীমাবদ্ধ নয় এ ক্ষণজন্মা প্রতিভাবান এর অবদান। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ও দার্শনিক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত হয়েছেন কারার অন্ধপ্রকোষ্ঠে।
সৈনিক নজরুল
অসংখ্য কালজয়ী সৃষ্টিতে অমর হয়ে আছেন এ বিদ্রোহী নজরুল।
শিশুদের জন্যও তিনি লিখেছেন প্রচুর।
"আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি।
সুয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন', মা বলবেন রেগে......” এখনও শিশুদের মুখে মুখে।
কিংবা
“কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?-- - “
অসংখ্য মনোমুগ্ধকর সুরে বাংলাগান ও গজলকে তিনি করেছেন সমৃদ্ধ। যেখান কবির উঁচুমাত্রার দার্শনিক সত্ত্বার প্রকাশও ঘটেছে চরমভাবে।
“আমার গানের মালা
আমি করব কারে দান
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে
করুণ অভিমান
মালা করব কারে দান
চোখে মলিন কাজল রেখা
কন্ঠে কাঁদে কুহু কেকা
কপোলে যার অশ্রু রেখা
একা যাহার প্রান
শাঁখায় ছিল কাঁটার বেদন
মালায় শুচির জ্বালা
কন্ঠে দিতে সাহস না পাই
অভিশাপের মালা
বিরহে যার প্রেম- আরতি
আঁধার লোকের অরুন্ধতি
নাম না জানা সেই তপোতী
তার তরে এই গান
মালা করব তারে দান ।।”
“হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে
কুড়ায়ে ঝরা ফুল একেলা আমি
তুমি কেন হায় আসিলে হেথায়
সুখের স্বরগ হইতে নামি ।
চারিদিকে মোর উড়িছে কেবল
শুকানো পাতা মলীণ ফুলদ্বয়
বৃথাই সেথা হায় তব আঁখিজল
ছিটাও অবিরল দিবসযামী ।
এলে অবেলায় পথিক বেভুল
বিদিছে কাটা নাহি পাবে ফুল
কি দিয়ে বরণ করি ও চরণ
নিভিছে জীবন জীবনস্বামী ।”
“নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল
ফুল নেব না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল।।
ফুল যদি নিই তোমার হাতে
জল রবে গো নয়ন পাতে
অশ্রু নিলে ফুটবে না আর প্রেমের মুকুল।।
মালা যখন গাঁথ তখন পাওয়ার সাধ যে জাগে
মোর বিরহে কাঁদ যখন আরও ভালো লাগে।
পেয়ে তোমায় যদি হারাই
দূরে দূরে থাকি গো তাই
ফুল ফোটায়ে যায় গো চলে চঞ্চল বুলবুল।।”
‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী
দেব খোঁপায় তারার ফুল.......’
‘আমায় নহেগো ভালবাস শুধু ভালবাস মোর গান.......’
‘শাওনো রাতে যদি স্মরনে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে......’
নজরুল এর কিছু অসাধারণ সাহিত্যকর্ম
কবিতা:
অগ্নিবীণা (১৯২২) • সঞ্চিতা (১৯২৫) • ফনীমনসা (১৯২৭) • চক্রবাক (১৯২৯) • সাতভাই চম্পা (১৯৩৩) • নির্ঝর (১৯৩৯) • নতুন চাঁদ (১৯৩৯) • মরুভাস্কর (১৯৫১) • সঞ্চয়ন (১৯৫৫) • নজরুল ইসলাম: ইসলামী কবিতা (১৯৮২)
কবিতা ও সংগীত:
দোলন-চাঁপা (১৯২৩) • বিষের বাঁশি (১৯২৪) • ভাঙ্গার গান (১৯২৪) • ছায়ানট (১৯২৫) • চিত্তনামা (১৯২৫) • সাম্যবাদী (১৯২৬) • পুবের হাওয়া (১৯২৬) • সর্বহারা (১৯২৬) • সিন্ধু হিন্দোল (১৯২৭) • জিঞ্জীর (১৯২৮) • প্রলয় শিখা (১৯৩০) • শেষ সওগাত (১৯৫৮) •
সংগীত:
বুলবুল (১৯২৮) • সন্ধ্যা (১৯২৯) • চোখের চাতক (১৯২৯) • নজরুল গীতিকা (১৯৩০) • নজরুল স্বরলিপি (১৯৩১) • চন্দ্রবিন্দু (১৯৩১) • সুরসাকী (১৯৩২) • বনগীতি (১৯৩১) • জুলফিকার (১৯৩১) • গুল বাগিচা (১৯৩৩) • গীতি শতদল (১৯৩৪) • সুর মুকুর (১৯৩৪) • গানের মালা (১৯৩৪) • স্বরলিপি (১৯৪৯) • বুলবুল দ্বিতীয় ভাগ (১৯৫২) • রাঙ্গা জবা (১৯৬৬) •
ছোট গল্প:
ব্যাথার দান (১৯২২) • রিক্তের বেদন (১৯২৫) • শিউলি মালা (১৯৩১) •
উপন্যাস:
বাঁধন হারা (১৯২৭) • মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০) • কুহেলিকা (১৯৩১) •
নাটক:
ঝিলিমিলি (১৯৩০) • আলেয়া (১৯৩১) • পুতুলের বিয়ে (১৯৩৩) • মধুমালা (১৯৬০) • ঝড় (১৯৬০) • পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে (১৯৬৪) •
প্রবন্ধ এবং নিবন্ধ:
যুগবানী (১৯২৬) • ঝিঙ্গে ফুল (১৯২৬) • দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬) • রুদ্র মঙ্গল (১৯২৭) • ধুমকেতু (১৯৬১) •
অনুবাদ এবং বিবিধ:
রাজবন্দীর জবানবন্দী (১৯২৩) • দিওয়ানে হাফিজ (১৯৩০) • কাব্যে আমপারা (১৯৩৩) • মক্তব সাহিত্য (১৯৩৫) • রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম (১৯৫৮) • নজরুল রচনাবলী ১-৪ খন্ড (১৯৯৩) •
শহীদি ঈদ -
কাজী নজরুল ইসলাম
....................................
চাহি না ক গাভী দুম্বা উট,
কতটুকু দান? ও দান ঝুট।
চাই কোরবানি, চাই না দান।
রাখিতে ইজ্জত ইসলামের
শির চাই তোর, তোর ছেলের,
দেবে কি? কে আছ মুসলমান?
ওরে ফাঁকিবাজ, ফেরেব-বাজ,
আপনারে আর দিস্নে লাজ,-
গরু ঘুষ দিয়ে চাস্ সওয়াব?
যদিই রে তুই গরুর সাথ
পার হয়ে যাস পুলসেরাত,
কি দিবি মোহাম্মদে জওয়াব!
গরুরে করিলে সেরাত পার,
সন্তানে দিলে নরক নার
মায়া দোষে ছেয়ে গেল দোজখ।
কোরবানী দিলি গরু ছাগল
তাদেরই জীবন হ'ল সফল
পেয়েছে তারা বেহেশতলোক।
শুধু আপনারে বাঁচায় যে,
মুসলিম নহে, ভন্ড সে!
ইসলাম বলে - বাঁচ সবাই!
দাও কোরবানি জান্ ও মাল,
বেহেশ্ত তোমার কর হালাল।
স্বার্থপরের বেহেশ্ত নাই।
খেয়ে খেয়ে গোশ্ত রুটি তো খুব
হয়েছ খোদার খাসি বেকুব,
নিজেদের দাও কোরবানি।”
তিনি লিখেছেন,
'' ধর্মের পথে শহীদ যাহারা ,
আমরা সেই সে জাতি ।
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা ,
বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি ,
আমরা সেই সে জাতি ।”
'' বাজিছে দামামা , বাঁধরে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান ।
দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার
ভাঙ্গা কিল্লায় ওড়ে নিশান ।''
এমন অসংখ্য কালজয়ী সৃষ্টিতে অমর হয়ে আছেন অগ্নি বীনার স্রষ্টা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ এ দিনে মহান আল্লাহর কাছে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
বিষয়: সাহিত্য
২৯১৬ বার পঠিত, ৬১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খুব ভালো লাগ্লো...
নজরুল না হলে বাংলাদেশ ইসলামী সংগীতের ধারা চালু হতোনা--আমরা-মল্লিক্ক ভাইরাও লিখতাম না।
আল্লাহ তুমি তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে উপযুক্ত সম্মান দাও। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। কবি নজরুল ইসলাম আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত।
রাষ্ট্রীয়ভাবে হেয় করা হচ্ছে । একদম ঠিক কথা । তবে যা একটু-আদটু সম্মান দেয়া হয় একান্তই পঁচানি ছাড়া আর কিছু না।
আর কার আছে এমন বুকের পাঠা যে অত্যাচারী ফ্যাসিস্ট শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে উচ্চারণ করে?
‘কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙ্গে ফেল্ কর রে লোপাট রক্ত-জমাট..
লাথি মার, ভাঙরে তালা! যত সব বন্দী-শালায়-
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি ॥’
আর কে আছে এমন শতযুবকের প্রাণশক্তিতের ভরপুর নওজোয়ান?
চেতনার এ কবিকে নিয়ে পোস্ট দেয়ার জন্য এ ব্লগের মহামান্য প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ।
......
ঘুমিয়ে ক্বাজা করেছো ফজর
তখনও জাগনি যখন জোহর
হেলায় খেলায় কেটেছে আসর
মাগরিবের ঐ শুনি আজান
জামাতে শামীল হওরে এশাতে
এখনও জামাতে আছে স্থান ।
এই হৃদয়স্পর্শী কথামালা যিনি সাজিয়েছেন আজকে তাঁর জন্মদিন । হে আল্লাহ, প্রিয় নজরুলকে তুমি জান্নাতের বাগানের পাঁখি বানিয়ে দাও ।
'ধর্মের পথে শহীদ যাহারা
আমরা সেই সে জাতি.....'
প্রিয়কবিকে নিয়ে লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ভাল লাগ্লো ।
স্টিকি পোস্টের জন্যি অভিনন্দন ।
এই আঁতেলদের শত চেষ্টাতেও নজরুল কখনই মুছে যাবেননা সাধারন মানুষের হৃদয় থেকে। তাকে স্মরন রাখার জন্য তার "রমজানের ওই রোজার শেষে" ই যথেষ্ট।
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া
নজরুলকে সবার কাছে আরো ভালোভাবে পৌছিয়ে দিতে হবে
ধন্যবাদ।
আমাকে ভীষন নাড়া দেয়।
...............
.........
যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়ত বা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে। দেশপ্রেমী,ত্যাগী,বীর,বিদ্রোহী- বিশেষনের পর বিশেষন। টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পর মেরে। বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রার্থ্য দিনে বন্ধু তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ কোর। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বোল বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি।
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করে সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।
নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।
জাযাকাল্লাহ...
আমি সেইদিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণ-ভূমে রণিবে না’
মহাগর্জনে এমন বিদ্রোহী সুর উচ্চারণের হিম্মত আর কয়জনের আছে?
মন্তব্য করতে লগইন করুন