ছাত্রজীবনের টুকিটাকি- ৫
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ লোকমান ২৫ মে, ২০১৫, ০৮:৪৪:৩৩ রাত
টর্নেডো! হ্যাঁ, টর্নেডোই। একদিন বাজারে গিয়ে ফেরার পথে রাস্তার পাশে বানরের খেলা নাকি জাদু দেখার কারণে ফিরতে দেরী হয়েছিল। ঘরে এসে লক্ষ্য করলাম বাবার মেজাজ কেমন যেন। হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলেন। আমার প্রতি এমন নির্দয় এবং নিষ্ঠুর আচরণ বাবার এটিই প্রথম। বেশী ব্যাখ্যা না দিয়ে এটিকে টর্নেডোর সাথে তুলনা করাই যথার্থ হবে। এমন কোন দরদী ছিলেন না, যে আমাকে বাবার হাত থেকে রক্ষা করবেন। নিজের গায়ে দুয়েক ঘা পড়ার ভয়ে কাছে আসার সাহস করেননি.....।মারার যন্ত্রটা যতক্ষণ অক্ষত ছিল ততক্ষণ মেরেছেন।
এভাবে আর চলতে পারে না, সিদ্ধান্ত নিলাম ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে কোথাও কাজ করবো এবং সাথে লেখাপড়া করারও চেষ্টা করবো। ইতোপূবে কবি পরিচিতি পড়ার সময় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ইতিহাস কিছুটা স্মরণে ছিল।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। কাপড়ের সাথে বাংলা আর ইসলাম শিক্ষা বইটিও নিলাম। একেবারে শুণ্য হাতে সমস্যায় পড়তে পারি। তাই ভাবলাম ফুফুর বাড়ীতে গিয়ে তাঁর নিকট থেকে কিছু টাকা চেয়ে নিয়ে তারপর কি করা যায় দেখব। ফুফুর বাড়ী যাওয়ার পর আমার কথা শুনে ফুফুর সে কি কান্না। তিনি বললেন কোথাও যেতে হবে না, এখানেই থাক।
এদিকে বাবা আমাকে অনেক খোঁজা খুঁজির পর না পেয়ে পরের দিন সকালে ফুফুর বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছলেন। বাবাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে ফুফু আমাকে এক রুমে লুকিয়ে রেখে বাবার জিজ্ঞাসার জাবাবে বললেন, সে তো এখানে আসেনি। বাবা তখন ফুফিয়ে কান্না করতে লাগলেন। আড়াল থেকে বাবার কান্না দেখে আমিও কাঁদছি। বাবা আর দেরী না করে আমাকে খোঁজ করার জন্য তাড়াহুড়া করে উঠতে চাইলে ফুফু বাধা দিয়ে বললেন থাম, আর খুঁজতে হবে না। তিনি বাবাকে অনেক বকাবকি করলেন আমাকে স্কুলে ভর্তি না করা এবং নির্দয়ভাবে মারার কারণে। বাবা ফুফুর কাছে নিজের ভুল স্বীকার করলেন এবং আমাকে দেখতে চাইলেন। আমি বাবার সামনে আসার পর আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আরো কাঁদলেন।
দুপুরা খাওয়া দাওয়া করার পর আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলে আমি বললাম, ‘আমাকে স্কুলে ভার্তি করতে হবে অথবা কোন কাজ শিখতে দিতে হবে, তাহলে আমি যাব, না হলে আমি আমার চেষ্টা করব’। এতদিন এভাবে বলার সাহস ছিলনা। যেকোন মূল্যের বিনিময়ে আমাকে স্কুলে ভর্তি করার পাক্কা ওয়াদা করার পর বাবার সাথে আবারো ঘরে ফিরে আসলাম।
বেশ কয়েকটি স্কুলে চেষ্টা করা হলো, বছরের মাঝখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেলনা। তখন বর্তমান সময়ের মতো প্রাইভেট স্কুলের ছাড়াছড়ি ছিল না। পরের বছরের শুরুতে ভর্তি হওয়ার আশায় অপেক্ষা করতে থাকলাম।
এর মধ্যে কিছু ভালো ভালো ঘটনা ঘটতে লাগলো :- ১. আমার প্রতি বাবার আচরণ বেশ বদলে গেলো, আগের মতো কথায় কথায় বকা-ঝকা আর করছেন না। ২. বাবার এক বন্ধু ঢাকায় একটি বড় হোটেলের ম্যানেজার ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে এসে একটি রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় শুরু করেছিলেন। ঢাকায় ভালো বেতনে ডাক পেয়ে রেস্টুরেন্টটি বাবাকে কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের চুক্তিতে দিয়ে যান।(অনভিজ্ঞতার কারণে সেটি পরে বিক্রয় করে দিতে হয়েছিল) ৩. বাবা চট্টগ্রাম ওয়াসার অধীনে কিছু কাজ পেয়েছেন, যার পেমেন্ট ভালো ছিল। ৪. চকবাজার ওয়ার্ডের পৌর-কমিশনার ছিলেন জনাব সৈয়দ আহমদ খাঁন। বাবার সাথে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ওনাদের বাসায় যাওয়ার সময় বাবা প্রায় সময় আমাকেও নিয়ে যেতেন। তাঁর নিঃসন্তান দ্বিতীয় স্ত্রী আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তারাও কিভাবে জেনে গেছেন আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার সংবাদ। খাঁন পরিবার এলাকার জমিদার। চকবাজারের উত্তর পাশ্বে হাসমত উল্লাহ মুন্সেফ লেনে তাদের বেশ কিছু যায়গা পড়ে আছে। ওসব খালী যায়গায় বেশ কয়েকটি দোকানঘর তৈরী করে নিলেন বাবার মাধ্যমে। এবং সেখান থেকে একটি দোকান নামমাত্র ভাড়া ধার্য্য করে আমার নামে এগ্রিমেন্ট করে দিলেন, আমার লেখাপড়ার খরচ ওখান থেকে বের করার জন্য। বাবার নামেও আরো দু’টি দোকান নিলেন।
আমার দোকানটাতে বাবা ‘খাজা স্টোর’ নাম দিয়ে একটি মনোহারী পণ্যের দোকান খুলে দিলেন। পরবর্তীতে লেখাপড়ার সাথে সাথে ব্যবসায়ও করেছি।
চলবে......
বিষয়: বিবিধ
১০০৪ বার পঠিত, ২৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার কষ্টময় অভিজ্ঞতার অনুভূতি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
সেটা আপনার জীবনী পড়ে আবার নতুন করে বুঝতে পারছি।
সংগ্রাম প্রতিটি মানুষকেই করতে হয়। ধরণ এবং পদ্ধতি হয় ভিন্ন ভিন্ন।
আপনাদের জন্যও রইলো অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এক কথায় চমতকার হয়েছে। মা’ বাপ সন্তানের সবচেয়ে বড় এবং চুড়ান্ত কল্যাণকামী।
ভাই,আপনার জীবনের অনেক কিছু যানলাম।আর পড়তে পড়তে চোখে পানি চলে আসলো।
ভালো থাকবেন।
পড়তে গিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম মনে হলো এই দৃশ্যটুকু! জীবনের একটু খানি মোড় জীবনটাকেই বদলে দেয়!
পরের পর্বের অপেক্ষায়!
ঠিক বলেছেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন