একটা শহর পার হওয়া ও দুটো অদেখা যুদ্ধের স্মৃতি।

লিখেছেন লিখেছেন আবূসামীহা ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:৫১:৫৫ সকাল

আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে যাওয়া হয় দরকারী কাজে। ফলে কোথাও থেমে ভাল করে দেখার সুযোগ থাকে না। গেল সপ্তাহান্তে গেলাম জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা। তিন বছর আগেও একবার যাওয়া হয়েছিল ওখানে। কিন্তু শহরটা দেখা হয় নি। বিমান বন্দরে যাঁরা নিতে এসেছিলেন তাঁরা শহরের মাঝখান দিয়েই গিয়েছেন, আবার যখন বিমান বন্দরে নামিয়ে দিয়ে গেলেন তখনও শহরের মাঝ দিয়ে তারা গাড়ী চালিয়ে গেছেন। কিন্তু নেমে শহরটা দেখার সুযোগ আমার এবারও হয় নি। আটলান্টাতে রয়েছে CNN এর হেড কোয়ার্টার। কিন্তু আটলান্টা আমার কাছে অন্য কারণে আকর্ষনীয়।

১৮৬১-১৮৬৫ আমেরিকার অস্তিত্ব সংকটে পড়া গৃহুযুদ্ধের বছরগুলো। দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলো "কনফেডারেটেড স্টেটস অফ আমেরিকা" নামে নতুন রাষ্ট্র বানিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছে। কেন্দ্রের সাবেক এক সিনেটর জেফারজন ডেভিসকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে নতুন রাষ্ট্রের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছিল তারা ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডকে রাজধানী বানিয়ে। দক্ষিণ ক্যারোলাইনার চার্লসটন হার্বারে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের এক সেনানিবাস "ফোর্ট সামটার" এ আক্রমনের মাধ্যমে কনফেডারেসী কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাদের তথাকথিত স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করে।

লিঙ্কন তখন কেন্দ্রের প্রেসিডেন্ট। লিঙ্কন আক্রমনের জবাব দিলে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে আটলান্টাকে পুরোপুরি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন কেন্দ্রের এক জেনারেল টেকুমসেহ শেরম্যান। শেরম্যান বিশ্বাস করতেন "টোটাল ওয়ার" নামক স্ট্র্যাটেজীতে। শেরম্যান মিসিসিপি থেকে জর্জিয়ার সাভানা পর্যন্ত প্রত্যেকটা জনপদকে বিরানভূমিতে পরিণত করে দিয়েছিলেন। তিনি মানুষের ঘরবাড়ি, শস্যক্ষেত ও গবাদি পশু সহ জীবন-যাপনের সব উপকরণ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তার কথা ছিলঃ দক্ষিণের লোকেরা যুদ্ধ শুরু করেছে; সুতরাং তাদেরকে তার খেসারত দিতে হবে। তিনি বলতেন, "আমি দক্ষিণের লোকদেরকে যুদ্ধের এমন স্বাদ আস্বাদন করাব যে তাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম আর যুদ্ধের নামও মুখে আনবে না।"

আমার কাছে এটার আকর্ষণ কী? আমার কাছে এ ঘটনা ১৯৭১ এ পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দুটো যুদ্ধের মিল আছে এক জায়গায়। সেটা হল একটা স্বাধীন দেশের একটা অংশ বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। অমিল হল আমেরিকার যুদ্ধটায় স্বাধীনতাকামী দক্ষিনী কনফেডারেসীকে পরাজিত করা হয়েছে ভয়াবহ যুদ্ধের মাধ্যমে। আটলান্টা শহর পুরোটা জ্বালিয়ে দেয়া সে ভয়াবহতার একটা দিক মাত্র। তাদের স্বাধীনতা ঘোষণাকে ৫ বছরের যুদ্ধ শেষে বাতিল করিয়ে পুনরায় কেন্দ্রের অধীন আনা হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে পাকিস্তান তার একটা অঙ্গ হারিয়েছে আর বাংলাদেশ নামে আরেকটা স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে।

পাকিস্তানের সেই গৃহযুদ্ধেও একজন জেনারেল "টোটাল ওয়ার" এ বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তিনি তাঁর সে ওয়ার পলিসি প্রয়োগ করতে পারেন নি। বরং জেনারেল টিক্কা খানকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে জেনারেল নিয়াজীর মত এক ভদ্রলোককে এখানে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নিয়াজী শেরম্যানের মত ক্রুর হতে পারেন নি।

যুদ্ধ দুটোর আরেকটা অমিল হলঃ আমেরিকার দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলো স্বাধীনতার যুদ্ধে ব্রিটিশদের সাহায্যের আশা করলেও শেষ পর্যন্ত বৃটিশ নিরপেক্ষ থেকেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে স্বাধীনতাকামীদেরকে শুরু থেকেই অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ এবং আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে ভারত ও রাশিয়া।

আটলান্টার বাসিন্দাদের অনেকেই এখন জানে না যে জেনারেল শেরম্যান পুরো শহরটা ভস্মীভূত করে দিয়েছিলেন। তারা যুদ্ধের ক্ষত ভুলে এক হয়েছে। দেশটা "The United States are" থেকে "The United States is" হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে আমরা চেতনার আগুন জ্বালাইয়া রাখছি যাতে আমাদের মুক্তির স্বপ্নেরা ভস্মীভূত হতেই থাকে।

বিষয়: বিবিধ

১২৫০ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

340587
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ১০:৩৬
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ভালো লাগল ভাই
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:১৪
282089
আবূসামীহা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
340594
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ১০:৫৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : শ্যেরম্যান উত্তরকে গুরুত্বপূর্ন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্কিন স্বাধিনতা যুদ্ধে কিন্তু জেনারেল ইউলিসিস গ্রান্ট কেই যুদ্ধের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। মজার বিষয়টা হচ্ছে এই যুদ্ধের অন্যতম কারন যেটা সেই দাসপ্রথা বিলুপ্তির পক্ষে কিন্তু শ্যেরম্যান ছিলেন না!! বর্ণবাদি ও ছিলেন তিনি। অন্যদিকে কনফেডারেট দের প্রধান সেনাসায়ক জেনারেল লি কিন্তু দাসপ্রথা বিরোধি ছিলেন। এত কিছুর পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার যতটুক প্রাপ্য সন্মান দিয়েছে এবং সেই জন্যই এখনও একক রাষ্ট্র হয়ে থাকতে পারছে।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:১৮
282092
আবূসামীহা লিখেছেন : গ্রান্ট ছিলেন উত্তরের প্রধান সেনাপতি। শেরম্যান তাঁর ডেপুটি ছিলেন। যুদ্ধটা আসলে দাসপ্রথা নিয়ে হয় নি, যদিও এমনটা বলা হয়ে থাকে। দক্ষিণের লোকদের মূল অভিযোগ ছিল যে উত্তরের লোকেরা তাদের জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে এবং তাদেরকে তাদের অধিকার বঞ্চিত করছে, যেমনটা তৎকালীন পাকিস্তানের ক্ষেত্রে পূর্বের লোকেরা বলত।
হ্যাঁ তারা যার যা সম্মান তাকে তা দিয়েছে এমনকি যুদ্ধে পরাজিতদেরকেও। আমেরিকানরা এখনও বলে থাকে "বব লী" এ যাবৎকাল পর্যন্ত আমেরিকার সবচেয়ে সেরা জেনারেল, যদিও তিনি আমেরিকার ঐক্য ধ্বংসের যুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষে ছিলেন।
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
340625
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:১৯
ফজলে এলাহি মুজাহিদ লিখেছেন : ভ্রমণের সাথে পর্যালোচনার স্বাদ; দারুন লাগলো।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:১৮
282093
আবূসামীহা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ভাই।
340765
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ১২:৩০
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ১২:৪০
282591
আবূসামীহা লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File