চিঠি-৪ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৮ এপ্রিল, ২০১৬, ১১:১৭:১৩ সকাল
জ্যৈষ্ঠ মাস। চারদিকে আম জাম কাঁঠাল লিচু আনারস বিভিন্ন মৌসুমি ফলের মৌ মৌ গন্ধ। সর্বত্র হরেক রকম ফলের সমারোহ। মুনীরাদের বাসার আশ পাশের বাসাগুলিতে তাদের গ্রামের আত্মীয় স্বজন বেড়াতে আসে। বস্তা ভর্তি আম জাম কাঁঠাল নিয়ে আসে। ছেলে মেয়েরা খায় মুনীরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এসব দেখে তার মাকে সর্বক্ষন জ্বালাতন করে, মা আব্বু কখন আসবে। আম নিয়ে আসবে তো, নিশ্চয়ই কাকারা আম নিয়ে আসতেছে ইত্যাদি বারংবার একই জাতীয় প্রশ্ন করে মাকে অস্থির করে তোলে। এ জন্যই মেয়ের যন্ত্রনা থেকে বাঁচতে তাকে বাইরে পাঠিয়ে দেয় যাতে অন্যান্য শিশুদের সাথে খেলা ধূলা করে বাপের কথা ভুলে থাকতে পারে। আজ সকাল থেকে শুরু করেছে, সে আম খাবে তার আব্বু এখনো আম নিয়ে আসে না কেন? কখন আসবে ইত্যাদি প্রশ্নে অসহ্য হয়ে মা তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন।
কিছুক্ষণ পড়ে সে দু’হাতে দু’টি আম নিয়ে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল, খুশিতে তার মুখটা ঝলমল করছে। তার মাকে দিয়ে বলল, আম্মু কেটে দাও খাব। তার মা জিজ্ঞেস করল আম কোথায় পেলি? মুনীরা উত্তর দিল, কেন, ঐযে যিনাতরা আম কাঁঠালের বন্ধে তাদের দাদু বাড়ি গেছিল, তারা আসছে। আম্মু জানো যিনাতের আব্বু না ইয়া বড় বস্তা দিয়ে এক বস্থা আম এক বস্তা কাঁঠাল, এক ট্যাংকি দুধ আরো কত কিছু আনছে। যিনাত বলেছে তাদের দাদু বাড়িতে আম, কাঁঠাল, লিচু আরো রাজ্যির ফল ফলাদির অনেক গাছ। পাড়ার লোকেরা তাদের গাছের আম কাঁঠাল খায়। গাছের নিচে অনেক আম পড়ে থাকে, পচে নষ্ট হয় কেউ নেয় না। তার আম কাঁঠাল খাইতে খাইতে এখন আর ভাল লাগে না। যিনাতের আম্মু বস্তাটা ঢালতেই দেখি লাল টুক টুকে বড় মাঝারি অনেক জাতের আম। আমাকে ছোট দু’টি আম দিয়ে বলল, যাও ঘরে গিয়ে খাও।
আচ্ছা আম্মু, তুমি না বল আমার দাদু বাড়ি অনেক আম কাঁঠালের গাছ। তাহলে আব্বু আমার জন্য আম নিয়ে আসে না কেন, কবে আসবে? তার মা কোন কিছু না বলে দা এনে আম দু’টি কেটে দুই বাচ্চাকে দিল। ছোট্ট একটি আম খেয়ে মুনীরার মুখে সবে মাত্র রুচি ধরল। সে আরো আম খাওয়ার জন্য জেদ ধরল। আমারে আরো আম দে, আরো আম দে, বলে কাঁদতে লাগল। তার মা অসহায় হয়ে দম বন্ধ করে বসে থাকল। মেয়েটি উঠে তার মায়ের পিঠে ও মাথায় দুই হাত মারতে লাগল আর বলতে লাগল আমারে আরো আম দে, আম দে, আব্বুকে বল আমার জন্য আম নিয়ে আসতে, আব্বুকে বল...। কিছুক্ষণ পরে তার মা উঠে রাগে মুনীরার মুখে ও পিঠে কয়েকটি চড় মেরে বলতে লাগল আহ আমার আদুরি মেয়েটা, আব্বু ওয়ালী, এত আব্বু ওয়ালা- কই বাপ তো তোকে দেখতেও আসে না, একটা কিছু পাঠায় না। আমার কাছে আম চাস কেন, তোর আদুরে বাপের কাছে গিয়ে চা যা। বলতে বলতে হন হন করে ছোট মেয়েটাকে কোলে নিয়ে চলে গেল। মুনীরা দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর বাইরে গেল দেখতে তার আব্বু তার জন্য আম নিয়ে আসে কিনা। অনেকক্ষণ পথের পানে তাকিয়ে থাকল। অবশেষে অসহায় হয়ে ব্যথা ভারাক্লান্ত, থমথমে মুখে ঘরে ঢুকল এবং খাতা কলম নিয়ে লিখতে বসল।
বাবার প্রতি।
আব্বু তুমি তো এলে না। আচ্ছা, আব্বু বলতো আম্মু খালি আমাকে মারে কেন? আমি তো বেশি কিছু চাইনি। একটু আম চেয়েছিলাম। এ জন্য আম্মু আমাকে মেরেছে। সেদিনও মেরেছিল। আমি যিনাতদের বাসায় খেলা করছিলাম। তখন তার কাকা বাড়ি থেকে এক বস্তা আম আনল। যিনাত, মাহিন দৌড়ে গিয়ে তার কাকার কোলে উঠল। তারপর তার কাকা এত্তোগুলি আম বস্তা থেকে ঢালল আর যিনাতের আম্মু তাদের সবাইকে আম কেটে দিল। তাদেরকে দেখে আমারও আম খাওয়ার ভীষণ মন চাইল। তখন আমি ঘরে এসে আম্মুকে আম দিতে বললাম। আম্মু কোন কথা বলল না। আমি আম্মুর পিছনে পিছনে ঘোরলাম আর কাঁদলাম। তারপর হঠাৎ আমাকে মারতে শুরু করল। আমার পিঠে, মুখে, মাথায় আম্মু হাত দিয়ে অনেক মেরেছিল। আব্বু জান আমি না খুব ব্যথা পেয়েছিলাম। মাঝে মাঝে আম্মুর দিকে তাকিয়ে দেখেছি বারান্দার এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুচছে। সেই থেকে আম্মুকে আর আমের কথা কিছু বলি না, যদি আবার মারে। কিন্তু আজ মনে ছিল না, একটু খেয়ে আরো আম খেতে মন চাইছিল তো তাই ভুলে আম্মুর কাছে আম চেয়েছিলাম। এজন্য মেরেছে।
আব্বু জান, সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম। তারপর রাত্রে আম্মু আমাকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করেছিল আর বলেছিল, আমার দাদুবাড়িতে নাকি অনেক আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা আরো কত্ত কিছু রাজ্যির ফলের গাছ। আমার দাদুরা অনেক বড়লোক। এত্তসব ফল খেয়ে শেষ করতে পারে না, এলাকার সবাই নিয়ে নিয়ে খায়। আম্মু বলেছে তোমার আব্বু, তোমার কাকারা তোমার জন্য অনেক আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু নিয়ে আসবে। তারা তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে, অনেক আম লিচু খাওয়াবে, খাইতে খাইতে তুমি খাবে না, জোর করে খাওয়াবে। তুমি দৌড়ে চলে যাবে, তখন তোমাকে ধরে এনে মুখে তুলে খাওয়াবে। আম্মু আরো কত মজার মজার গল্প বলেছে। সেদিন থেকে আমি তোমার পথের পানে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি এই বুঝি তুমি আম নিয়ে এসে পড়েছ। কিন্তু কই, তুমি আস না তো।
আচ্ছা আব্বু, আমার দাদুবাড়ি বুঝি অনেক আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু তাই না? পাড়ার সবাই সেখান থেকে খায় তাই না? আমার কাকারা, তাদের বাবুরা খেতে খেতে আর খায় না, ফেলে দেয় তাই না ? কিন্তু আমি কেন পাই না বাবা, বল আমি কেন পাই না? একটি আম, একটু কাঁঠালের জন্য মানুষের ঘরে গিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখি কিন্তু কেউ আমাকে দেয় না। আর লিচু তো শুধু চোখেই দেখি কোন দিন খেতে পাইনি। আমার দাদু বাড়ির জিনিস তো আমারও, তাই না আব্বু। তাহলে আমার জিনিস রাজ্যির লোকে খায় কিন্তু আমি কেন পাই না আব্বু, কেন পাই না? এমন কেন হচ্ছে বাবা, কেন এমন হচ্ছে। আমার মনে খুব কষ্ট বাবা, খুব কষ্ট।
আমি শুধু পথের পানে তাকিয়ে থাকি, তুমি আসবে, আমার কাকারা আসবে, আমার জন্য অনেক আম, কাঁঠাল, লিচু নিয়ে আসবে। আমাকে দাদুবাড়ি নিয়ে যাবে। আমি খেতে খেতে আর খাব না। তখন আমাকে ধরে কোলে নিয়ে মুখে তুলে জোর করে খাওয়াবে। কবে এমন হবে বাবা ?
আব্বা গো, তোমার কথা মনে হলে আমি যেন কেমন হয়ে যাই। আমি যে আর সইতে পারি না। তুমি আস, খুব তাড়াতাড়ি আস। আমার জন্য অনেক আম, কাঁঠাল আর লিচু নিয়ে আসবে। তারপর আমাকে নিয়ে দাদুবাড়ি যাবে। তখন আমি লাল টুকটুকে আমগুলি দেখিয়ে দিব তুমি কোটা দিয়ে পাড়বে আর আমি খাব। তারপর অনেক আম জড়ো করে বাড়িতে নিয়ে আসব। তখনতো আমি আম আর লিচু খেতে খেতে আর খাব না। খাব না খাব না বলে দৌড়ে চলে যাব। তখন তুমিও দৌড়ে গিয়ে আমাকে ধরে এনে রবিনের আম্মুর মত বলে বলে আমাকে খাওয়াবে।
ঐ যে ঐ দিন, যে দিন তার আব্বু তাদের দাদু বাড়ি থেকে অনেক আম এনেছিল। তার আম্মু এক ডিশ আম কেটে চিনি ও লবণ মরিচ দিয়ে মাখিয়ে দিল। সে একটু খেয়ে আর খাবে না বলে চলে গেল। কিন্তু তার আম্মু তাকে ধরে এনে বলল আমের মধ্যে বি, সি, ডি, আর ভিটামিন আছে, এগুলো না খেলে বড় হওয়া যায় না। তারপর এক টুকরা আম নিয়ে বলল, এটা বি ভিটামিন, এটা খাও। সে বলল বি ভিটামিন কি ? তার আম্মু বলল, বি মানে বাদশাহ। এটা খেলে তুমি বড় হয়ে বাদশাহ হবে। তারপর আরেক টুকরা নিয়ে বলল, এটা সি ভিটামিন, সি মানে চেয়ার ম্যান, এটা খেলে তুমি চেয়ারম্যান হবে। আরেক টুকরা নিয়ে বলল, এটা ডি মানে ডাক্তার ভিটামিন, এটা খেলে তুমি ডাক্তার হবে। সে দুই হাত নেড়ে বলল, না, না, না, যে দিন আমার পায়ে কাটা ফুটেছিল-সেদিন ডাক্তার আমাকে খুব ব্যথা দিয়েছিল, আমি কখনোই ডাক্তার হব না, ডাক্তাররা পাজি। তার মা হাসতে হাসতে বলল আচ্ছা ঠিক আছে। এটা আর ভিটামিন, মানে রাজা, এটা খেলে তুমি রাজা হবে। তারপর রবিন বলল, আচ্ছা মা এস ভিটামিন নাই ? তার মা বলল মানে ? সে বলল এস মানে সালমান খান। আমি যে বড় হয়ে সালমান খান হতে চাই। তার মা হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ আছে, ঐ বস্তায় এস ভিটামিন আছে। এখন এগুলি খাও, আরেক বার এস ভিটামিন কেটে দিব।
আব্বু তুমিও আমাকে এগুলি বলে বলে খাওয়াবে। তবে মনে রেখ আমি কিন্তু এস ভিটামিন খাব না, আমি বেশি বেশি ডি ভিটামিন খাব, আর বড় হয়ে ডাক্তার হব। কেন জান আব্বু ? আমার অসুখ হলে আম্মু ডাক্তার আনতে পারে না, ডাক্তার আনতে নাকি অনেক টাকা লাগে, তাদের অনেক দাম। এজন্যই আমি ডাক্তার হব।
আব্বু এখন বল তুমি কবে আসবে। খুব তাড়াতাড়ি না আসলে কিন্তু আমি রাগ করব, তোমার সাথে কথা বলব না। তুমি আম থাকতে থাকতেই আসবে কিন্তু বলে দিলাম। আর আসার সময় আমার জন্য এক বস্তা আম, দশটা কাঁঠাল, পাঁচশ লিচু নিয়ে আসবে, মনে থাকে যেন। তুমি ভাল থাক এবং তাড়াতাড়ি আস। ইতি, তোমার মুনীরা।
বিষয়: সাহিত্য
১৭৩৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন