১০ ই মহরম এবং আমার ছোটবেলার স্মৃতি

লিখেছেন লিখেছেন রফিক খন্দকার ২৫ অক্টোবর, ২০১৫, ০৬:১৮:৩২ সন্ধ্যা

শিয়া মুসলিমরা "মহরম" অনেক জাকজমক পূর্ণ ভাবে করলেও সুন্নিরা সেভাবে করে না। এই নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক আছে। তবে আমি আজকে মহরম নিয়ে আমার ১ টি অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করব।

খুব ছোটবেলায় দেখতাম "মহরমের" দিনে আমার ছোট চাচা আর তার সমবয়সী বন্ধুবান্ধব মিলে একটা সাইকেল আর ২ টা বস্তা নিয়ে বিকেল বেলা বেরিয়ে পড়ত, প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি। মহরমের চাঁদা তুলতে। বেশিরভাগ মানুষই চাল দিত, কেউ টাকাও দিত। আমাদের ওখানে সমাজ বলে একটা ব্যাপার আছে। সমাজ মানে হল, যে কয়টি খানা বা বাড়ি এক মসজিদে নামাজ পড়ে বা একসাথে কোরবানি করে এমন বাড়িগুলো নিয়ে সমাজ। তো এই সমাজের অন্তর্ভুক্ত সব বাড়ি থেকেই চাঁদা তুলতে হত। সবাই দিত কারো কোন দ্বিমত থাকত না। বরং কোন বাড়ি ভুলে বাদ গেলে এইটা নিয়া পড়ে মন কালা কালি অভিমান হত। কেন আমাদের বাড়িতে চাঁদা নিতে আসল না, আমরা কি সমাজের সদস্য না? এইসব। আমাদের মত ছোটরা সবাই এই সাইকেলের পিছনে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটতাম, সে কি খুশি। এই সুযোগে আমাদের গ্রাম এবং পাশের গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়ি ঘোরা যেত, আর রাতে বই পরা মাফ। একটু বড় হয়ে চাঁদা তোলার মহান সামাজিক দায়িত্ত টা আমাদের ঘারেও এসে পড়ে। তো শুধু সাইকেলের পিছনে দৌড়ালেই তো হবে না, গান ও তো গাইতে হবে নাকি।

সবাই সুর করে গাইতাম " মহরমের ১০ তারিখে কি করিলেন রাব্বানা--" (বাকিটা আর মনে নাই)।

বড়রা এক লাইন গাইত পরের লাইন আমরা ছোটরা সুর করে মিছিলের মত করে কোরাস গাইতাম। চাঁদা তোলা শেষ হলে মাগরিবের নামাজের পর পর আস্তে আস্তে সবাই মসজিদে আসত। বিভিন্ন ধরনের এবাদত করত, এশার নামাজের পর আর মসজিদে জায়গা ধরে না। বড় ছোট সব এসে মসজিদ ভরপুর। কিছু মানুষ মশজিদের বাইরেই বসত। এদিকে চাঁদা যে তোলা হল সেটা দিয়ে রান্নার আয়োজন চলছে আমাদের বাড়িতেই। রান্নার দায়িত্তে থাকত কয়েকজন যাদের নেতা হচ্ছে আমার ছোট চাচা। বাড়ির উঠানে ইয়া বড় বড় চুলা খোরা হয়েছে। তার উপরে ধান সেদ্ধ করা বড় বড় হাড়ি চাপানো সেখানে দাউ দাউ করে জলছে আগুন। খিচুরি বা ভাত মাংস রান্না করা হচ্ছে। এবাদত করা খুদারত মানুষ গুলো খাবে তাই ! সবাই তো চাল দেয়, মাংস আর মশলা তেল এইসব তো আর কেউ দেয় না। চাঁদার ছালের একটা অংশ বিক্রি করে এইগুলো কেনা হয়। প্রতি বারই চাল ডাল কম পড়বে, মশলা তেল কম পড়বে, সব দিতে হেবে আমাদেরকেই। ৬০/৭০ জন মানুষের খাবার জন্য বসার জায়গা, গ্লাস প্লেট, দেখার জন্য হারিকেন, কুপি সব আমাদের। নামাজের সময় লোক হিসাব করা হয়, কিন্তু মজার ব্যাপার হল যে খাবার সময় লোক ২ গুন হয়ে যায়। তাই রান্নাও বেশি করতে হয়। তবে সবাই খেতে পারত, কেউ বাদ পরেনাই কখনো।

মসজিদে তুমুল এবাদত চলছে। প্রথমে মিলাদ তার পড়ে জিকির। সে কি জিকিরের জোস !! যে যেমন পারছে তেমন করে পরছে, একজন আরেকজনের গায়ের উপরে পড়ে যায় "ইসকের" ঠেলায়। বেসিরভাগই এই দুষ্টুমি টা ইচ্ছে করে করত আরেক জনকে রাগানোর জন্য। ছোটদের উপস্থিতি থাকত সেইরকম বেশি। ছওয়াব টা যেন তাদেরই বেশি দরকার !! আমরা ছোটরা "এলহু এলহু" করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম মসজিদের চটে। এরি মাঝে কিছু অতি কৌতহলি মানুষ এসে দেখে যেত যে রান্না কতটুকু হয়েছে আর কতক্ষন লাগবে এইসব। তার পর তারা মসজিদে এসে কানে কানে সবাইকে এই খবর দিত। কেউ আবার বিড়ি খাবার জন্য, কেউ "ইসতেনজা" করার জন্য জিকিরে বিরতি নিয়ে বের হত।

মোটামুটি রাত আড়াইটার দিকে এবাদতের শেষ পর্ব মুনাজাত পারফর্ম করা হত। এই পর্ব আরও মজার। সবাই হাত তুলে "আমিন আমিন" বলতে শুরু করলে ঘুমিয়ে থাকা মানুষজনকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে দেওয়া হত মুনাজাত ধরার জন্য। মুনাজাতের সময় আবার লোকজন বাড়তে শুরু করত। মুনাজাত চলছে আর আমাদের পারার "কান্নারাজ" জালাল ভাইয়ের কান্নার পারফর্ম শুরু। এই জালাল ভাই তার কান্নার জন্য বিখ্যাত। এমন কোন মুনাজাত নাই যে উনি কাঁদেন নাই। উনার স্বাভাবিক ভাবে কথা বললে বা হাসলে অনেক সময় কান্নার মত লাগে। সেই লোক কাদলে আরও কেমন লাগে ! তো উনাকে সঙ্গ দেবার জন্য আরও বেশ কয়েকজন আছেন আমাদের পাড়ায়। তারা উনাকে নিয়মিত কান্নার সঙ্গ দেয়। অনেকটা কোরাস গাইবার মত ব্যাপার। তো কান্নার রোল শুরু। কান্নার রোল শুরুর হলে মরা মানুষও উঠে আসবে, মসজিদে আর কেউ ঘুমিয়ে থাকতে পারে? দুই পাড়ার বাড়ির মানুষ এসে মুনাজাতে জড় হতে থাকে। রাতের বেলা এই কান্নার শব্দ সবাই শুনতে পেত আর বুজত যে এখন মুনাজাত চলছে, এখন মুনাজাত খুব গভীরে অবস্থান করছে। সবাই এসে যোগ দিত। আমরাও দেখাদেখি খুব কান্নাকাটি করার চেষ্টা করতাম। কি জন্য করতাম তা জানিনা তবে করতাম,। ২/১ বার সফলও হয়েছি মনে হয়। কাদতে কাদতে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ত। আস্তে আস্তে মুনাজত ও হাল্কা হতে শুরু করে। মানে মুনাজাত এর গভীরতা কমতে থাকে। তারপর মুনাজাত শেষ করা হয়।

সবাই বের হতে শুরু করে একসাথে। কারো স্যান্ডেল আছে কারো নাই, কারো বা একটা আছে একটা নাই। এই নিয়ে খোজাখুজি। পরে দেখা যায় যে কেউ কারো স্যান্ডেল অন্ধকারে ছুড়ে ফেলেছে, হয়ত ওই স্যান্ডেলে আটকে ঊষ্ঠা খেয়েছে সেই রাগে। সবাইকে সুসংবাদ দেওয়া হয় রান্নার টিম থেকে যে সব রেডি আপনার আসুন আর খান।

এবার খাবার পালা । সবাই দল বেধে আমাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির। নানা ধরনের গল্প, আর রসিকতা চলছে। মসজিদের চট নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর সবাইকে বসতে দেওয়া হল। এক বারে না হলে অনেক সময় ২য় ৩য় টার্মে লোক বসানো হয়। সবাইকে প্লেট দেওয়া, হাত ধোয়ানো, পানির গ্লাস দেওয়া, কুপি বা হারিকেন দেওয়া সব আমাদের দায়িত্ব !! সে যে কি হৈ হল্লা ! সবাই খেতে খেত হয়রান। গ্রামের মানুষ একটু বেশি খায়। পারলে বাসায়ও নিয়ে যায়। খাওয়া শেষ হলে ঢেকুর তুলতে তুলতে আর আলহামদু লিল্লাহ বলতে বলতে বাড়ি যায়। দূর থেকে শোনা যায় গ্যাস লিক হবার শব্দ ??

বাড়ি তো গেল সবাই কিন্তু এইসব হাড়ি পাতিল বাসন কোসন কে পরিষ্কার করবে কে ধুবে ? আমরা। গ্লাস প্লেট কে দিয়ে আসবে? আমরা। হারালে জরিমানা কে দেবে? আমরা। ভাংলেও, আমরা দিব।

৪ টা ঝোলে ভরা চট কে ধোবে? আমরা। কে শুকাবে। আমরা। আবার মসজিদে দিয়েও আসতে হবে। শেষে দেখা যায় আমাদের খাবার জন্য তেমন কিছু অবশিষ্ট নাই। সেক্ষেত্রে ধর মুরগি, কর জবাই, আবার রান্না, সবাই খাই। বাড়ির অসহায় মহিলা সদসদের নিদারুন পরিশ্রম হত এই দিন গুলোতে। সবচেয়ে বিপদে পড়ে আমার ছোট চাচি। উনার যে কি পরিশ্রম হয় তা উপরওয়ালা ছাড়া কেউ বুজবে না। আর আমরা কিছুদূর হেল্প করে ঘুমিয়ে পড়তাম ঘরে গিয়ে।

আর এভাবেই চলে যেত মহরম। এটাই আমাদের বাড়ির ঐতিহ্য !!!!!!!!!!!!

আজ ফোন করে জানলাম যে, আগের নিয়মেই সব চলছে। শুধু বারিতে লোকজন খেতে যায়নি। মশজিদ থেকে কষ্ট করে হেটে যেন আমাদের বাড়ি পর্যন্ত না যেতে হয় তাই আমার চাচা বাসায় রান্না করে প্যাকেট করে মশজিদে পাঠিয়ে দিয়েছে !!! শুধু তাই নয়, এখন আয়োজন হয় ডাবল। আমার ফুপুও নিজ উদ্যেগে এটা করা শুরু করেছেন আলাদা ভাবে !!

বিষয়: বিবিধ

১২৭১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

347175
২৫ অক্টোবর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৫৫
শেখের পোলা লিখেছেন : হাঁ ঠিকই, মহরম ও একটা উৎসব ছিল যা রোজার ঈদকেও হার মানাত৷আমি তখন শিশু৷ স্কুলে যাব যাব এমন অবস্থাই হবে৷ কিছু কিছু আবছা মনে পড়ে৷ এটা ছিল পশ্চম বঙ্গের হুগলী জেলার একটা মুসলীম প্রধান গ্রাম৷ গ্রামের দুটি পাড়া, তারই মাঝ বরাবর ছিল বহু পুরাতন ছোট্ট একটি ইটের তৈরী দরগা৷এটাকে কেন্দ্র করেই যত অনুষ্ঠান৷ তিনদিন ধরে নানান অনুষ্ঠান হত৷ তার মধ্যে তাজিয়া আর লাঠি খেলাটাই বেশী মনে আছে৷আলাউদ্দীন আর ময়জুদ্দীন দুই ভাইয়ের অনেক খেলার মাঝে অসাধারণ লাঠি খেলার কথা আজও যেন দেখতে পাই৷এর পর তবলীগ জমাতের প্রচেষ্টায় তা বন্ধ হয়ে যায়৷তবে নামাজ রোজা আজও অবশিশ্ট আছে৷
347195
২৫ অক্টোবর ২০১৫ রাত ১১:০৩
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ১০ই মহররম হযরত হুসাইণ(রাঃ)এবং পরিবারের শাহাদাহ এর কারনেই বিখ্যাত নয়। এই দিনে পূর্ববর্তী নবীগনের ক্ষেত্রে অনেক ঘটনা ঘটেছেল। আর রসূল(সাঃ)ও তার পরিবারের প্রতি ভালোবাসা থাকলে সুন্নাহকে অনুসরন করতে হবে। এটাই আসল ভালোবাসা। কিন্তু যেভাবে আমরা এই দীবসকে অনুসরন করি তা পুরোটাই বিদআত। মুহাররম থেকে শিক্ষা নিতে হবে। হুসাইন(রাঃ) যালিম শাসকের প্রতিবাদ করেছেন ইসলামের জন্যে, সেটাই করতে হবে। রসূ(সাঃ)বলেন-যালিম শাসকের যুলুমের প্রতিবাদ করা সবথেকে বড় জিহাদ। কাজের যারা তাকে ভালোবাসে তারা বাদ্য বাজনা,হলকায়ে জিকির না করে হুসাইন(রাঃ) যা করেছেন সেটা করা এবং রসূলের সুন্নাহর অনুসরন করাই প্রকৃত ভালোবাসা।
347200
২৬ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০২:২৭
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আসসালামুআলাইকুম।

বর্ণনাটি এতো চমৎকার মনে হলো চোখের সামনে সমস্ত আয়োজন দেখতে পেলাম।

শেয়ারের জন্য শুকরিয়া! Good Luck
347241
২৬ অক্টোবর ২০১৫ বিকাল ০৫:৪৮
রফিক খন্দকার লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ, ভালো লাগলো।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File