বাংলা সনের জন্মকথা : বর্ষবরণের এই কলুষিত সংস্কৃতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া..
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১৩ এপ্রিল, ২০১৬, ০৭:০১:০১ সন্ধ্যা
স্বাগতম বাংলা নববর্ষ-১৪২৩ বঙ্গাব্দ। নববর্ষ আমাদের কাছে আগমন করে নতুন বার্তা,নতুন আশা ও চেতনা নিয়ে। জীবন পঞ্জিকার স্ব স্ব প্রাপ্তি স্মরণ করিয়ে দিতে। আগামী দিন বা বর্ষটি যদি গত দিন বা কালের চেয়ে উত্তম না হয় তাহলে তো এগিয়ে যাওয়া হল না। সংক্ষিপ্ত এই জীবনকালের এক একটি বর্ষ হলো এক একটি নতুন প্রত্যয়ে জেগে উঠার এলার্মস্বরূপ। ইহকাল পেরিয়ে মহাকালের পাড়ি দেবার এক মাইলফলক। নববর্ষের সাথে জড়িয়ে আছে এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও চেতনার স্বাক্ষর। আমাদের দেশে তিনটি বর্ষকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। এগুলো ইংরেজী বা গ্রেগরিয়ান সন, হিজরি বা আরবী সন এবং বাংলা সন। এগুলো একটির সাথে অপরটির বেশ সাদৃশ্য আছে। হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে, বাংলা বর্ষপঞ্জি ১৫৮৪ ঈসায়ী বা খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেছেন এটা আমরা জানি। উপমহাদেশ ছিল কৃষি প্রধান (বাংলাদেশও কৃষি প্রধান দেশ, শিক্ষার ন্যায় কৃষকদেরও জাতির মেরুদন্ড বলা হয়) কৃষক এবং কৃষককুল থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত খবরানুযায়ী, ভারত বর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে আরবী বর্ষ হিজরি পঞ্জিকা আনুযায়ী তারা কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সাথে এর কোন মিল পাওয়া যেত না। কারণ চন্দ্র ও সৌরবর্ষে মধ্যে ১১/১২ দিনের ব্যবধান এবং এই কারণে ৩১ চন্দ্রবর্ষ ৩০ সৌরবর্ষের সমান। সে সময় চন্দ্র বর্ষ অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা হতো, কিন্তু ফসল উৎপাদন ও সংগ্রহ করা হয় সৌরবর্ষ অনুসারে। আর তখনই সম্রাট আকবর-এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স¤্রাটের আদেশ আনুযায়ী সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী সৌর বছর ও আরবী হিজরী সালেরও ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের তৈরির কাজ শুরু করেন। বাংলা বর্ষ নির্ধারণ নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ের প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলক এই গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর তারিখ থেকে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের তারিখ থেকে। এর কারণ দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার সিংহাসনে আরোহণের ঐতিহাসিক মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এ দিন থেকে গণনা শুরু করা হয়। তখন এ নতুন সালের নাম ছিল তারিখ-ই-এলাহী। (কুখ্যাত দ্বীন-এ ইলাহীর প্রবর্তকও সম্রাট আকবর। অবশ্য দ্বীন-এ-ইলাহীর পৃথিবীর বুক থেকে ধ্বংস হয়ে গেছে)
“.. ..আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর প্রচেষ্টায় হিজরি ৯৬৩ সালের মুহররম মাসের মাসের শুরু থেকে বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়। মজার ব্যাপার হলো বাংলা, বর্ষপঞ্জি শুরু হয়েছে ৯৬৩ অব্দ ধরেই। অর্থাৎ জন্মদিনের দিনই বঙ্গাব্দের বয়স ৯৬৩ বছর। শুরুর বছর যেহেতু মুহররম মাসের সাথে বৈশাখ মাসের মিল ছিল তাই এ মাসকেই প্রথম মাস ধরে গণনা শুরু হয়। আগে বঙ্গ বা বাংলাদেশে শক বর্ষপঞ্জি প্রচলিত ছিল। শক বর্ষপঞ্জি অনুসারে চৈত্র মাস ছিল বছরের প্রথম মাস। আকবরের সময় মাসের প্রতিদিনের জন্য একটি স্বতন্ত্র নাম ছিল। প্রতিদিনের নাম মনে রাখা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। এই জটিল ও কষ্টকর পদ্ধতিকে সাপ্তাহিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন করার জন্য একজন পর্তুগীজ প-িতকে দায়িত্ব দেন। তিনি সাত দিন বা বারের নাম দিয়ে সাপ্তাহিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। আমরা যদি একটু ভাল করে লক্ষ্য করি তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারি যে, রোমান বারের নামের সাথে আমাদের সাত দিন বা বারের নামের যথেষ্ট মিল আছে। যেমন: সানডে রবিবার ইংরেজি ও রোমান ভাষায় সান শব্দের অর্থ রবি বা সূর্য, মানডে সোমবার মুন বা চাঁদ, মার্স (টুইস ) বা মঙ্গল, মারকুরি (ওয়েডনেস) বুধ, জুপিটার (থার্স) বা বৃহস্পতি, ভেনাস (ফ্রাই) শুক্র এবং রোমান সেটার্ন ইংরেজি সেটার ডে বা শনিবার। পশ্চিমাদের অনুসরণে আগের দিনে বাংলাবর্ষ পঞ্জিতে প্রথম সপ্তাহ শুরু হতো রোববার দিন। বঙ্গাব্দের শুরুতে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সময় বার মাসের নাম ছিল : ফারওয়ারদিন, উর্দিবাহিশ, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহারিবার, মেহের, আবান, আজারদে, বাহমান এবং ইসফান্দ।
পরবর্তীতে তারকারাজির বাংলা নাম অনুসারে বার মাসের রাখা হয়। যেমন: বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদা থেকে ভাদ্র, আশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃতিকা থেকে কার্তিক, আগৈহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের আগে এ অঞ্চলে শকাব্দ চালু ছিল সেই অব্দের মাসের নাম হতেই মাসের এ নামগুলো নেয়া হয়েছে সম্রাট আকবরের দরবারের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমীর ফতুল্লাহ শিরাজীর দেয়া ফারসি নামগুলো পরিবর্তন করে। এর আসল কারণ কি সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক কোন সর্বসম্মত মত না পাওয়া গেলেও অনুমান করা হয়, শকাব্দের মাসের নামগুলো এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে আগে থেকেই ছিল, তাই তাদের রণশীল মন থেকে তা মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।” (বঙ্গাব্দের জন্মকথা, হারুন ইবনে শাহাদাত- সাপ্তাহিক সোনার বাংলা ১ লা এপ্রিল ২০১৬ সংখ্যা)
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রচলিত সর্ব প্রাচীন সন হচ্ছে হিজরী সন। এই হিজরী সন থেকে বিকশিত হয়েছে বাংলা সন। বহু পরে এখানে ইংরেজী সন বা খৃষ্টীয় সনের প্রচলন হয়েছে। সে জন্যই খাজনা আদায়, ফসল তোলা, ফসল বোনা, বিয়ে-শাদী, বিভিন্ন আচার এ ক্ষেত্রে বাংলা সনের হিসাব থেকে করা হচ্ছে এবং বাংলা সন অনুযায়ী অমাদের দেশে এখনো বহু ইসলামী মাহফিল, ধর্মীয় সভা, সামাজিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়। নববর্ষকে পুঁজি করে কী শহর, কী নগর সর্বত্রই চলছে তারুণ্য উদ্দামের বৈশাখি মেলা। মেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে লটারী, জুয়া, হাউজি, মদ্যপানের আসর, চাঁদাবাজিসহ আরো অনেক কুপ্রথা। পান্তা-ইলিশ, বাঁশি, ঢাক-ঢোলের বাজনায় আর মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ কত আয়োজন-এসব আয়োজন করে নেচে গেয়ে আমরা কী ঢেকে আনছি! মঙ্গলশোভা যাত্রায় এমন কিছু শিরকী আচরণ করা হয় তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেতনা বিরোধী। তাই বাংলা নববর্ষের আগমনকে স্বাগত জানিয়ে যা আমরা করি তা শুদ্ধ-সংস্কৃতির পরিচায়ক হতে পারে না। "বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মুসলমান নারী-পুরুষ যুবক-যুবতী আর শিশু কিশোর কিশোরীর মধ্যে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের নামে যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তাতে আগামী শতাব্দীতে হয়তো বা মুসলিম সংস্কৃতি কি তা আমাদের সন্তানদের যাদুঘরে সংরক্ষিত ইতিহাস থেকেই জানা লাগতে পারে। পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ অনেকটা উৎসব প্রিয়। কোন ধর্মে আনন্দ উৎসব পালনে বাধা নেই। তবে যে দেশে ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান ও ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী,তাদের উৎসব পার্বণ জীবন ও সংস্কৃতি সবই তো হওয়া উচিত কুরআন সুন্নাহর আলোকে। একজন হিন্দু বা খ্রিস্টান তার ধর্মের যাবতীয় উৎসব পালন করুক তাতে আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী ধর্মের অনুসারীদের দেব দেবীর সাথে যুক্ত ও ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কৃতির কোনো অংশ নিদর্শন বা প্রতীক বাঘ, রাক্ষস, কুমির, সাপ, পেঁচা ও প্রজাপতি মুসলমানদের সংস্কৃতি হওয়া উচিত নয়। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের নামে মঙ্গল শোভাযাত্রায় আমরা দেখেছি, বাঘ, রাক্ষস, কুমির, সাপ, পেঁচা ও প্রজাপতিসহ বিভিন্ন প্রকার প্রাণীর মূর্তি ও মুখোশ। সনাতন ধর্ম মতে এগুলো তাদের মঙ্গলের প্রতীক হতে পারে! কিন্তু ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের জন্য মূর্তি ও মুখোশ নিষিদ্ধ বা হারাম।" (পহেলা বৈশাখের বেলেল্লাপনা কারও কাম্য নয়- মোঃ তোফাজ্জল বিন আমীন-দৈনিক সংগ্রাম ১৩ এপ্রিল ২০১৬) তাই বর্ষবরণপ্রথার নামে যা কিছু আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ঈমান-আকিদা বিরোধী তা বর্জন করা একান্তই প্রয়োজন। সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির লালন করলে জাতীয় ঐহিত্য ও চেতনা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মুসলমানিত্ব বিসর্জন দিয়ে বাঙালি নয়, মুসলমানিত্ব রক্ষা করেই বাঙালী-সেটাই বরং আসল কাজ। তাই নববর্ষকে সুন্দর আগামীর গড়া লক্ষ্যে সুস্থ পদ্ধতিতে এগিয়ে নেয়াই হোক দৃপ্ত অঙ্গীকার।
[পাদটিকা : বাংলা সন (মোঘল সম্রাট আকবর প্রবর্তিত), হিজরি(হযরত উমর ফারুক প্রবর্তিত) এবং ইরানের নওরোজ (নববর্ষ), যা খৈয়ামের ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত (প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও ইসলাম-আলীয়া আলী ইজেতবেগবিচ : পৃষ্ঠা-৯০) তিনটি বড় বড় বর্ষের জনক মুসলমানরা। বিজ্ঞানে অনেক অবদান রয়েছে মুসলিম বিজ্ঞানীদের, কিন্তু বর্তমানে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। তা আশ্চর্য নয় কি? অথচ আমাদের পূর্ববর্তীরা জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণায় অনেক সফলতা দেখিয়েছিলেন-আজ সময় এসেছে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার। আমরা সেই সে জাতি।]
=====
বিষয়: সাহিত্য
১৫৪১ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কে শোনে কার কথা!!
বড়রাই শোনেননা, তো ছোটদের আর কী বলা যায়!!
তবু বলে যেতেই হবে..
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
মন্তব্য করতে লগইন করুন