মাতৃভাষায় খুতবা

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১৭ জানুয়ারি, ২০১৬, ০১:১৫:১৫ রাত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ ۖ فَيُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

" আমি প্রত্যেক রসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করবার জন্য।আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা ইবরাহীম: ৪)

এর মানে হলো- প্রত্যেক রসূলকে তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করলেন, যাতে হিদায়াতের রাস্তা বুঝতে কোন প্রকার জটিলতা না আসে।

জুময়ার বা ঈদের খুতবা মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত আবশ্যকীয় বিষয় বলে ইসলামি জীবনব্যবস্খায় এটির প্রয়োগের গুরুত্বও অপরিসীম। খুতবার মানে হলো বক্তব্য, যা উপস্থিত লোকদের জন্য দেয়া হয়। খুতবা দেয়ার উদ্দেশক উপস্থিতি আর লক্ষ্য হলো ইসলামী শরীয়ার বিবরণ ও সম সাময়িক বিষয়ে মানুষদের বুঝানো।

জুময়ার দিনে প্রথম মসজিদে প্রবেশকারীর সওয়াব সংক্রান্ত আবু হুরায়রা রা: বর্ণিত হাদিসে জিকির শব্দটি খুতবা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; রাসূল সা: বলেন, ‘…তারা মসজিদে প্রবেশ করে ও আল্লাহর জিকির (খুতবা) শুনতে থাকে।’ (বুখারি ও মুসলিম)। জুময়ার খুতবা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ায়, রাসূল সা: মনোযোগসহকারে খুতবা শোনার নির্দেশ দিয়েছেন (বুখারি ও মুসলিম)

যদি উপস্থিত লোকজন খুতবার মর্মই বুঝতে না পারলেন, তাহলে খুতবার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যর্থ আর "মনোযোগের" দাবী অমূলক।

মাতৃভাষায় খুতবার যৌক্তিকতা ও মাহাত্ম্য:

খুতবার ভাষা কি নামাজের মতো আরবিই হতে হবে, না কি অন্য ভাষায়ও খুতবা প্রদান করা যাবে?

রসুলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাতৃভাষা যেহেতু আরবী ছিল এবং ছাহাবীদেরও ভাষা আরবী ছিল, তাই তিনি আরবীতেই তাদেরকে নছীহত করতেন। এখন যারা নবীজির উত্তরসূরী হয়ে জুমার খুতবা দিবেন তাদেরকেও উল্লেখিত আয়াত ও হাদীছ অনুসারে তাদের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে মাতৃভাষায় খুতবা দেয়াটা শরীয়ত সম্মত এবং যুক্তি সংগত।

এই বিষয়ে প্রথম যুগ থেকেই বিতর্ক ছিল। সুতরাং আরবী ছাড়া খুতবা দেওয়া বৈধ নয়,বা বিষয়টা নতুন সৃষ্ট" যারা বলেন তারা অসাড় কথা বলেন।

•ইমাম আবু হানিফা এবং হাম্বলি ও শাফেয়ি মাজহাবের একদল আলেমের মতে সমর্থন থাক আর না থাক খুতবা শুদ্ধ হওয়ার জন্য আরবি ভাষায় খুতবা প্রদান শর্ত নয়।

• হেদায়াতে লেখা আছে-ইমাম আবু হানিফার মতে, সালাতও ফারসী ভাষায় বৈধ, এবং খুতবা -তাশাহহুদ -অনারব ভাষায় আযান দিলেও চলবে।

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন: প্রত্যেক খতীবকে জুমার সময় তাঁর মাতৃভাষায় ওয়াজ করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য। (তানক্বীহুর রুওয়াত ১/২৬৪)

• আল্লামা তাহাভী হানাফী বলেন: জুমার খুতবা আরবী জানলেও ফারসী ভাষায়ও চলবে। (হাশিয়া তাহতাবী আলা মারাক্বিল ফালাহ ২৭)

• আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী হানাফী (রহ) বলেন: শ্রোতাদেরকে তাদের মাতৃভাষায় খুতবা বুঝিয়ে দেয়া জায়েজ। (মাজমূআহ ফাতাওয়া ১/২৪৫)

• হানাফী ফিক্বহ গ্রন্থ নিহায়া, মুজতাবা, ফাতাওয়া সিরাজিয়্যাহ, মুহীত প্রভৃতি গ্রন্থে আছে যে, ইমাম আবূ হানীফার মতে ফারসী ভাষাতে জুমার খুতবা দেয়া জায়েজ।

• হানাফী ফতোয়ার কিতাব শামীতে আছে, আরবী ভাষায় খুতবা দেয়া শর্ত নয়।

যদি সালাত অন্য ভাষায় বৈধ বলা যায়, তাহলে খুতবা কেন নয়?

ইসলামের প্রথম যুগে অনারবি ভাষায় খুতবা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত না হওয়ার কারণ স্পষ্ট; কেননা সে সময় ইসলামের বিস্তৃতি মূলত আরব ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল, আরব ছাড়া যেসব অনারব রাষ্ট্রে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে স্খান নিয়েছিল তারা অতি অল্পসময়ে আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

খুতবার মূল দাবি " নসিহত" অনুসারে উপস্থিত লোকজনদের মাঝে অধিকাংশের বোধগম্য ভাষাতেই দেওয়া সঠিক ও যুক্তিযুক্ত।

কেননা-

১.খুতবা আলাদা কোনো ইবাদত নয়, এটা ঈদ ও জুমআর সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং এটাকে সালাতের সাথে মিলানো ঠিক নয়।

২.সালাতের সংজ্ঞায় রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- "নিশ্চয়ই এই সালাতে মানুষের কোনো কালাম নেই, এটা তাসবীহ ও কেরাতের নাম" (দ্রষ্টব্য সহীহ মুসলিম)

সালাতের নিয়ম-পদ্ধতি ও পঠিত শব্দাবলী নির্দিষ্ট। খুতবার জন্য নির্দিষ্ট কোনো শব্দাবলী নেই এবং সবাই একই পদ্ধতিতে খুতবা দেয় না।

৩. সালাতের উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলা আর খুতবার উদ্দেশক উপস্থিতির মধ্যে নসিহত।


বর্তমান সময়ের অধিকাংশ ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞের মতে আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা প্রদান বৈধ ও জরুরি। এ সম্পর্কিত কয়েকটি ফতোয়া নিচে উল্লেখ করা হলো -

১) ইসলামি ফিকহ পরিষদ, ১৪০২ হিজরির ৮-১৬ রবিউস সানিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সম্মেলনের পাঁচ নম্বর সিদ্ধান্ত। অনারব রাষ্ট্রগুলোতে অনারবি বা আঞ্চলিক ভাষায় খুতবা প্রদান ও নামাজে মাইক ব্যবহার সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে (সিদ্ধান্ত নম্বর ৫) পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়: …. এ বিষয়ে আমরা অধিকতর ন্যায়সঙ্গত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি তা হলোন্ধ অনারব রাষ্ট্রগুলোয় জুময়া ও দুই ঈদের নামাজের খুতবা শুদ্ধ হওয়ার জন্য আরবি ভাষা শর্ত নয়। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তম পদ্ধতি হলো, খতিব খুতবার সূচনা, পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলো অবশ্যই আরবিতে উচ্চারণ করবেন। অবতীর্ণ আয়াত কুরআনের ভাষায় তিলাওয়াত করবে, যাতে অন্যান্য ভাষার মানুষ আরবি শিক্ষা ও কুরআনের ভাষা অনুশীলনে আগ্রহী হয় এবং মানুষের বোধগম্যতার খাতিরে খতিব খুতবার মূল আলোচনা স্খানীয় ভাষায় প্রদান করবেন। (পৃষ্ঠা- ৯৭/৯৮)

২) সৌদি আরবের ফতোয়া বিষয়ক স্খায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত (৮/২৫৪-২৫৫, ফতোয়া নম্বর- ৬৮১২)

৩) সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি শায়খ আব্দুল আজিজ বিন বাজ র:-এর দু’টি ফতোয়া (ফতোয়া শেখ বিন বাজ ১২/৩৭০-৩৭৫) যা বর্তমানে তার ওয়েবসাইটে চলমান রেখেছেন।

৪) শেখ মোহাম্মদ বিন উছাইমিন র: বলেন: প্রকৃতপক্ষে উপস্খিত মুসল্লিদের দুর্বোধ্য ভাষায় জুময়ার খুতবা প্রদান বৈধ নয়। উদাহরণস্বরূপ যদি তারা অনারবি কোনো ভাষাভাষী হয় এবং তারা আরবি ভাষা ভালোভাবে অবগত না থাকে তবে খতিব তাদের মাতৃভাষায় খুতবা প্রদান করবেন। কেননা খুতবার মূল উদ্দেশ্য উপস্খিত লোককে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের পদ্ধতি অনুশীলন ও বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামি নির্দেশনা প্রদান। তবে, মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আয়াতগুলো আরবিতেই তিলাওয়াত করবেন এবং আঞ্চলিক ভাষায় এর ব্যাখ্যা করবেন (ফতোয়া আরকানুল ইসলাম: পৃষ্ঠা ৩৯৩)।

উপরোল্লিখিত মতামতের সমর্থনে মহাগ্রন্থ আল কুরআন এবং হাদিসে রাসূল সা:-এর বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া যায় এবং সাধারণ বুদ্ধি-বিবেকও এটিকে সমর্থন করে। ভাষা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য এক উত্তম নেয়ামত এবং তার অস্তিত্বের প্রমাণ। তিনি বলেন: ‘তার নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে আকাশগুলো ও জমিনের সৃষ্টি আর তোমাদের ভাষাগুলো ও তোমাদের বর্ণের পার্থক্য।’ (সূরা রুম: ২২)

"আমি যদি অনারবী ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করতাম, তাহলে ওরা অবশ্যই বলত, ‘এর আয়াতগুলি (বোধগম্য ভাষায়) বিবৃত হয়নি কেন? কী আশ্চর্য যে, এর ভাষা অনারবী অথচ রসূল আরবী!’ বল, বিশ্বাসীদের জন্য এ পথনির্দেশক ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে এদের জন্য অন্ধকারস্বরূপ। এরা এমন যে, যেন এদেরকে বহু দূর হতে আহবান করা হয়। (সূরা হা-মিম সাজদাহ:৪৪)

এভাবে আমি তোমার প্রতি আরবী ভাষায় কুরআন অহী করেছি; যাতে তুমি সতর্ক করতে পার মক্কাবাসীদেরকে এবং ওর আশেপাশের বাসিন্দাকে.... (সূরা আশশূরা: ৭)

"আমি এ অবতীর্ণ করেছি কুরআনরূপে আরবী ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝতে পার। (সূরা যুখরূফ: ৩)

বোধগম্য ভাষাতে খুতবা না দেওয়াতে আমাদের সমাজে বিদআত চালু হয়েছে- খুতবার আগে নসিহতের নামে (মাতৃভাষায়) আরেকটি খুতবা।

অনেকেই যুক্তি দেখিয়ে বলবে, নিজের ভাষায় নসিহত করলে দোষ কোথায়? মানুষ তা নাহলে দ্বীন বুঝবে কীভাবে? কুরআন ও হাদীসে নিষেধ কোথায়??? ইত‌্যাদি

তাদেরই বলব- খুতবা আরবী ছাড়া দেওয়া যাবে না, নিষেধ আছে কোথায়?

তাই বলব-

খুতবা দানের পূর্বে বয়ান দেয়া এবং ইহাকে এভাবে স্থায়ী রূপ দেয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আদৌ প্রমাণিত নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবার পূর্বে কখনো এ ধরণের বয়ান দেন নি। দিতে বলেছেন বলে ও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং বিদআত বর্জন করে খুতবাটাই বোধগম্য ভাষাতে দিন। এতেই উম্মাতের জন্য মঙ্গল। আল্লাহই ভালো জানেন।

অযথা এই নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে, কুরআন-হাদীস বুঝি, ভালো করে বুঝি। ইমামদের মতামত গ্রহণ করে মাসয়ালাগুলো বুঝি।

বিষয়: বিবিধ

২২৯১ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

357082
১৭ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ০৪:৪২
শেখের পোলা লিখেছেন : মাতৃ ভাষায় খোৎবা হওয়া উচিৎ৷ অন্যথায় ঐ সময়টা মানুষ ঘুমিয়ে কাটাবে, এবং এটাই হয়৷
357088
১৭ জানুয়ারি ২০১৬ সকাল ১১:৪০
আবু জান্নাত লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ


আপনার পক্ষে ে উত্তর এখানে দলিলসহ দেওয়া আছে।
357089
১৭ জানুয়ারি ২০১৬ দুপুর ১২:০৬
মুজাহিদ হোসাইন সজিব লিখেছেন : জাজাকাল্লাহুল খাইরান, মূল্যবান পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File