বিবেকেরে তাড়না

লিখেছেন লিখেছেন নাহিদ হাকিম ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১২:২৮:১২ দুপুর

বিবেকের তাড়না

আবদুল হাকিম নাহিদ



(১)

সালামত আলী আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন।বিশাল আকাশ,ধূসর মেঘাচ্ছন,শীতল বাতাসে বৃষ্টির পূর্বাভাস। হয়ত কিছুক্ষণ পরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামবে, যার প্রতিটি ফোঁটায় থাকে কৃষকের মুখভরা একরাশ হাসি স্বপ্ন ও জীবন জীবিকা। জীবনে আয়েশ করে কখনো বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি, শুধু বইয়ের পাতায় পাতায় পড়েছেন আর মুখস্থ করেছেন কবিদের উপভোগ ও বাস্তবতা। বৃষ্টি পড়ছে, মনে হয় আলতো করে প্রকৃতি ছুঁয়ে দিচ্ছে তার শরীরে । টিনের ওপর ঝুম ঝুম শব্দ হতে ছাদের উত্তর দিকে চাখ গেল। ছাদে তো টিন থাকার কথা না। তাহলে এ কীসের শব্দ? ছেঁড়া পলিথিনের উপর জলকেলির আওয়াজ। সালামত আলীর হঠাৎ মনে পড়ল গ্রামের বাড়ীতে বৃষ্টির দিনে টিনের শব্দে স্কুল ফাঁকি দিয়ে কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাতে ভীষণ ভাল লাগত ।মা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পুকুরে যেত,শাক তুলত,হাঁস মুরগীরে খাবার দিত। দাদা বলত “বৌ মা,করছ কী? ঠান্ডা লাগবে তো!”

মা বলতেন,“প্রায়শ্চিত্ত করছি।” বাবার সাথে পালিয়ে বিয়ে করে মা সুখী ছিলেন না, তবুও আমাদের জীবন বিপন্ন হবে বিধায় মদ্যপ বাবার সংসার করে গেছেন। সালামত আলীর চেতনা ফিরে আসে, তার মনে হয় তিনিও প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে বৃষ্টিতে ভিজছেন।

(২)

ইসমাত জাহান ব্যানিটি ব্যাগে হাত দেন, সর্বনাশ ফোন বাসায় ফেলে এসেছেন। ড্রাইবার কে বললেন,“বদি,ফোন দাও।”

ক্যান খালাম্মা।

তোমার সাবেরে কল করব।

রিং পড়ছে, বারবার রিং পড়ার পরেও ফোন না ধরার ইসমাত জাহানের মেজাজ বিগড়ে গেল। অদিল কে বললেন,“বাবা,বাসায় চলো।” অদিল বাসায় গিয়ে আম্মুর ফোন থেকে আব্বুকে ,“হ্যালো,আব্বু রেজাল্ট দিয়েছে।”

সালামত আলী বললেন “ভালো, গোল্ডেন আসছে তো?”

জ্বী,আব্বু।

তোমার আম্মুকে দাও।

ইসমাত জাহান ছেলে থেকে ফোন নিয়ে বললেন,“মিষ্টি নিয়ে জলদি এসো।”

সারাদিন মিষ্টি বিতরণ করে সালামত আলী ভীষণ ক্লান্ত ।একমাত্র মেয়ে ত্রিনা কে বললেন,“মা,এদিকে এসো।”

কিছু বলবে পাপ্পা।

অদিল কোথায়,বাসায় এখনও ফিরে নি।

টিভির রিমোট খাটে রেখে, ইসমাত জাহান বললেন শুধু শুধু টেনশন করো না তো ! ছেলে টা তো কখনো একা বাইরে যায়নি, আজ ওর বন্ধুরা জোর করেছে। সালামত আলী দীর্ঘশ্বাস পেলে বললেন দেশের যা অবস্থা, ইচ্ছা করে বাইরে(বিদেশ) চলে যায়। ইসমত জাহান স্বামীকে খোঁচা মেরে বলেন, দেশে ১৬ কোটি মানুষ থাকতে পারলে আমরা পারবো না কেন?সালামত আলী বিছানা থেকে উঠে টিভি অন করলেন। প্রিয খবরের চ্যানেল খুঁজছেন চোখে মুখে বিরক্তির প্রচ্ছন্ন ভাব এঁকে বলেন,শালা বিদেশী চ্যানেলের ভীড়ে নিজের দেশের চ্যানেলই খুঁজে পাওয়া যায় না।অবশেষে পেলেন, নয়টা খবরের ভিতর আটটি খবরই খুন গুমের। অবশিষ্ঠ একটি এবারও পাশের হার বেড়েছে, জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষাবিদগণ বেজায় ক্ষিপ্ত শিক্ষার মান নিয়ে। ইসমত জাহান মুখে ভেংচি কেটে বলেন,উনাদের হিংসা হচ্ছে কেন?ছেলেরা লেখাপড়া করছে, ভালো রেজাল্ট করেছে; সবকিছুতেই সন্দেহ খুঁজলে চলবে না, এতে করে ছেলেমেয়েদের মন ভেঙ্গে যাবে। সালামত আলী ধমকের স্বরে থাম বললেন, এত্ত বেড় বেড় করো কেন? পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, মুখস্থবিদ্যা, পাঠ্যবই নির্ভর পুঁথিগত বিদ্যা, কোচিং বাণিজ্য শিক্ষার মান তলানিতে নিয়ে গ্যাছে। শোন, শিক্ষাও এখন বাণিজ্য হয়ে গেল, আমাদের বিশুদ্ধ বলে আর কিছুই রইল না কথাটি আক্ষেপের স্বরে বলেন চল্লির্শোধ্ব সালামত আলী।

(৩)

রাত দশ’টা বাজে। কলবেল শুনে স্বামী স্ত্রী দুইজনেই দৌড় দিলেন, এ যেন বন্দিদশা থেকে ছেলের মুক্তি পাওয়া। কলিজায় পানি আসল তাঁদের। ত্রিনা প্রথম বারের মতো ভাইয়ের হাতে খাবারের প্যাকেট দেখে অবাক হলো।কারণ ভাইয়া জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ পেলেও এমন সারপ্রাইজ আনেনি।প্লেটে খাবার নিয়ে সবাই বসে অদিলের জন্যে অপেক্ষা করছে।সালামত আলী স্ত্রীকে বলল,“ছেলে,এসব আনার কী দরকার ছিল।” ত্রিনা বলল,“খাবারের সেন্ট হেব্বি!”অদিল বলল,“তোমরা খাও,আমার ক্ষুধা নাই।”

গোলাকার শক্ত দেখতে মাংসের মতো মনে হলো।সালামত আলী কামড় দিয়ে অস্বস্তিবোধ করলেন। ইসমাত জাহান ডোরাকাটা ক্রপ ক্রপ সাদাকালো রেখা দেখে বললেন,“এতো সাপ,সাপের মাংস।” ত্রিনা তখনও ওলট পালট করছিল, মুখে দেয় নি। সালামত আলী অনর্গল বমি করছেন,অদিল নিজের রুমে গিয়ে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। ভিতর থেকে চাপা হাসি বের হচ্ছে ফুস ফুস করে। এ মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছেড্রিয়ার থেকে ডিএসএলআর ক্যামেরাটা বের করে ভিডিও ধারণ করে অবসরে কমেডি হিসেবে দেখার জন্য সংরক্ষণ করেন রাখতে। ইসমাত জাহান হতবিম্ব! ছেলেকে বললেন,“এসব কী অদিল ,তোমার বাবা বমি করছে আর তুমি শুয়ে পড়লে।”

হ্যাঁ ,পড়েছি।

তার মানে,তুমি সব জেনে বাবার জন্যে.........।

রাগে সালামত সাহেব গজ গজ করেন।ছেলেকে মারার জন্যে তেড়ে আসেন। ইসমাত জাহান স্বামীকে বাঁধা দেন ।যে ছেলে কোনো দিন কথার ওপর কথা বলেনি, অবাধ্য হয়নি, অথচ সে আজ........।

“কী অপরাধ করেছি যার দরুণ তুমি আমাকে মারতে বসেছ” কথাটা বলে সালামত সাহেব চোখের পানি মুচতে লাগলেন। খাট থেকে নেমে অদিল জানালার পাশে গিয়ে দাড়াল। আকাশে অনেক তারা দেখতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মনে হয়। কিন্তু সংখ্যায় অনেকর্ অথচ চাঁদ বড় হয়েও অসহায় মনে হচ্ছে তাকে। সালামত ।আলী বললেন হারামী তোর জন্য কী না করছি, এত্তবড় শুয়র হবি জানলে ডাস্টবিনে ফেলে আসতাম। অদিল বলল তাই করতে, ভালোই হতো। ডাস্টবিনের ময়লার চেয়ে আরও নিকৃষ্ট জিনিষ খাইয়েছ আমাকে। সে রাগে নখ দিয়ে চামড়া রক্তাক্ত করছে। আমি জানি তোমার সাথে এটা করা আমার ভীষণ অন্যায় হয়েছে। কি করব বাবা, এর চেয়ে ভালো কিছু জানা মাথায় আসছিল না। তুমিও জেনে শুনে দিন দিন অবৈধ হারাম টাকার খাবার খাইয়েছ। নামকরা স্কুলে পড়ালে ভালো চার পাঁচটা গৃহ শিক্ষক রাখলে, গোল্ডেন এ প্লাস পেলাম। মিথ্যা অহংকার দিয়ে বেশী দিন টিকা যায় না।আমার বন্ধুদের তো কাড়ি কাড়ি ধন সম্পদ নাই,ওরাতো দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।আর আমি শিকলে বাঁধা। চেয়ে দ্যাখো ঔ চাঁদের মত জন্মের পর থেকে সবপেয়েও একেলা, বন্দি জীবন কাটাচ্ছি চার দেয়ালের ভিতর। কখন অপহরণ হয়ে যায় এ ভয়ে খেলার মাঠে, বাইরে কোথাও যেতে পারি না। আমি তো এসব চাইনি বাবা, কেন অন্যকে চুষে আমার জন্যে ব্যাংকে টাকা জমা কর। আর তুমি যদি আমার জন্যে টাকা ইনকাম করো তাহলে পছন্দ-অপছন্দের কোন পাত্তাই দিচ্ছ না কেন? তোমার জমানো টাকা তো আমি,আমার সন্তানেরা সারাজীবন খেলেও থাকবে।তবে হারাম পন্থায় অর্জিত টাকা দিয়ে আমি আর এক ফোঁটা জলও খাব না এ সংসারে।

অদিলের চোখ ছল ছল করছে, ঘৃণায় নিজের শরীর ছিঁড়ে পেলতে চাইছে। সালামত আলী ভাবলেশহীন, ত্রিনা মেঝের চকচকে টাইলসের বাহারি ডিজাইনে নীলপদ্ম দেখছে। মনে হচ্ছে এটাই শেষ দেখা, এভাবে আর কখনো দেখেনি,দেখার ইচ্ছাও জাগবে না।অদিল বলে যাচ্ছে,“কিন্তু আমরা তো তোমাকে বলিনি,নামী দামী গাড়িতে চড় অন্যদের কাছে, দেশের কাছে,স্রষ্টার কাছে,নিজের বিবেকের কাছে চির অপরাধী হয়ে বেঁচে থাকতে।”

বাকশক্তিহীন জড় পদার্থের মতো সালামত আলী ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন।কিছুই বলার নাই,সন্তানের কাছে হেরে গেলে ,নিজের কাছে হেরে গেলে জীবনে এর চেয়ে নির্মম ব্যর্থতা আর নাই। যে দেশের প্রকৃতি আলো বাতাস মাটি তিঁল তিঁল করে বড় করল ;সে দেশের সাথে,মানুষের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা,আল্লাহ কীভাবে ক্ষমা করবেন ?

সালামত আলীর মনে হয়,তিনি সদ্য ভুমিষ্ঠ হওয়া কোনো নবজাতক! যার অনেক কথা বলার আছে কিন্তু কেউ শুনবে না, বোঝবে না! হাঁটি হাঁটি পায়ে তিনি বাসার ছাদে ওঠেন।অতঃপর...........

বিষয়: সাহিত্য

১০২০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File