অভাব (ছোটগল্প)-এম মিজান রহমান

লিখেছেন লিখেছেন এম মিজান রহমান ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১১:১৮:২৯ সকাল

অভাব

এম.মিজান রহমান

আমাদের ক্লাসের রুপম নামের মাথামোটা ছোকরাটাকে তো তোমরা চেনো । তার ডান পাশেরভ্রুর নিচে একটা তিল আছে । চশমা পরে ক্লাসে আসে । বাবা পুলিশ অফিসার । মা উকিল। প্রতিবার অংকেতে সে ডাবলজিরো পায় । অবশ্য পরীক্ষায় ফেল করলে তাকে আদুভাই সাজতে হয় না । তার বাবার ভয়ে স্যাররা তাকে উপরের ক্লাসে তুলে দেন । রূপম প্রতিদিন গাড়িতে করে স্কুলে আসে । তার সঙ্গে থাকেন ড্রাইভারসহ আরেকজন । ছুটি শেষে আবার এই গাড়িতে

করে বাড়িতে চলে যায় ।

আমার নাম অয়ন । আমি বাস করি গ্রামের একটি বাড়িতে । আমার বাবা একজন সাধারণ কৃষক । যখন যা লাগে আমার বাবা তা আমাকে সময়মত দিতে পারেন না । সেদিন আমি আমার বাবাকে বললাম-বাবা, আমাদের বাড়ি পাকা নয় কেন? আমাদের যদি একটি গাড়ি থাকতো তাহলে আমি গাড়িতে চরে স্কুলে যেতাম,আমার যদি একটি কম্পিউটার থাকতো সারাদিন আমি গেম খেলতাম,আমাদের এতো অভাব কেন বাবা? আমার বাবা আমাকে বললেন- আমাদের যা আছে তাই যথেষ্ট,অনেক ভাল। আমরা এসব চাইনা । আমি বাবার কথায় মুখ ফ্যাকাসে করে আনমনে বসে রইলাম । এমন সময় আমার মা আমার মাথায় এসে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলেন । আমি আহ্লাদে বেশ আটখানা হলাম। ।

ক্লাসের অন্য সকলের চেয়ে রুপমের সাথে আমার বেশ খাতির । প্রতিদিন ও তার ব্যাগভর্তি চকলেট,চুইংগাম থেকে আমাকে খাওয়ায়। তার টিফিনের বাক্সতেও আমি অংশীদার । আমার সাথে তার খাতির হওয়ার কারন পরীক্ষার সময় সে আমার দেখে দেখে লিখে । আবার ভাবতে পারেন আমিও অংকেতে ডাবলজিরো পাই । আসল কথা হল অংক তো আর দেখে দেখে লিখলে ও ভুল হয়ে যায় । তাই সে ডাবলজিরো পায় , আর আমি পাই স্টার মার্ক।

আমার সাথে রুপমের সখ্যতার আর ও একটি নির্ভেজাল কারন আছে । আমি ওকে খুব বেশি ভালবাসি । সে ও আমাকে ভালবাসে। ক্লাসে সে সবসময়য় আনমনে থাকে । সত্যি কথা কি জানো ,রুপম খুব ভাল একটা ছেলে। ভাল বন্ধুর তালিকায় সে আমার কাছে রেঙ্কিংয়ে নাম্বার ওয়ান ।

গত চারদিন ধরে রূপম স্কুলে আসছে না । আমার তো আর স্কুলে দিন কাটে না । পরদিন স্কুল ছুটি শেষে আমি,দীপন ও জামান পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিলাম রূপমের বাড়ির উদ্দেশ্যে । স্কুল গেট থেকে রূপমদের বাড়ির গেটে আসতে ১৪ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড সময় লাগলো , হাত ঘড়ির দিকে থাকিয়ে বলল জামান ।এলোমেলো কলিংবেল টিপতে টিপতে দারোয়ান এসে গেট খুলতেই তিনজন ভেতরে ঢুকলাম ।

আরে এটা কি? রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজপ্রাসাদ নাকি? চারিদিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে বলল দীপন । আমি দ্রুত বাড়ির ৬ তলা গুনলাম । গ্রাউণ্ড ফ্লোরে গ্যারেজ । ৪-৫ টা গাড়ি রাখা। সুবিশাল বাগানবাড়ি । একপাশে লেক ।এ যেন স্বর্গরাজ্য । দারওয়ানের সাহায্য নিয়ে লিফটে চড়ে ৩ তলায় রূপমের রুমে গেলাম । ৩ তলার মাঝামাঝি রুমটা রূপমের । ভেতরে ঢুকতেই দেখি রূপম শয্যাশায়ী ।

আমাদের দেখে সে আনন্দে চিৎকার শুরু করল । কোনোকিছু জানতে চাওয়ার আগে সে বলে উঠলো-ডাক্তার বলেছে আমার নাকি জন্ডিস হয়েছে । ১৫/২০ দিন বিশ্রামে থাকতে হবে। আমি ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখি কদিনে তার চেহারা কেমন জানি হয়ে গেছে । ওর ঠোঁটে-চোখে-মূখে কী জানি এক বিষণ্ণতার চাপ । আমি তার দিকে তাকাতেই সে বারবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে । বিছানার পাশে চেয়ে দেখি দামি দামি ঔষধ । দীপন ও জামান পাশে রাখা কম্পিউটারে গেম খেলতে শুরু করলো ।

রূপেমর কাছে তার বাবা-মা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে নীরব হয়ে গেল । মায়াভরা করুণ কণ্ঠে সে বলল ওরা অফিসে । রাত সাড়ে আটটার আগে বাড়িতে ফেরেন না । আমি রূপমের চোখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলাম আমার কাছ থেকে সে একটা কিছু আড়াল করতে চাইছে । তাহলে এতো বিশাল বাড়িতে সারাক্ষণ তুই একা থাকিস,আমি প্রশ্ন করলাম তাকে । না কাজের বুয়া ,রহমত চাচা, দারওয়ান,মালীসহ ৭-৮ জন আছে বাড়িতে, বলল রূপম ।

বুয়ার ডাকে আমি,রূপম,জামান এবং দীপন সবাই একসাথে দুপুরের খাবার খেলাম । রূপম আমাদের নিচতলায় লেকের পাশে নিয়ে এলো । আমরা বিস্ময়ে সবকিছু দেখলাম । দীপন ও জামান নিচে রাখা সাইকেল নিয়ে ব্যস্ত ।

আমি রূপমকে বললাম, রূপম তোর তো আর ভাইবোন নেই। তুই কীভাবে এ বাড়িতে একা থাকিস? তোর আম্মা-আব্বা তোকে এভাবে রেখে যান।

সবাই যা জানো এরা আমার সত্যিকারের বাবা-মা নয়, একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল রূপম । আমি তার কথার আগাগোড়া কিছুই বুজলাম না । প্রশ্ন করার আগে চেয়ে দেখি তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে । জন্মের আগে বাবা মারা গেছেন,১৩ মাস পরে কী জানি এক বেমারে মা মারা যান । তখন আমার আপন বলতে আর কেউ ছিল না ।গরিব এক রিক্সাচালক আমাকে লালনপালন করছিল । অনেক কষ্ট করেছিল সে আমার জন্য ,সে না খেয়ে আমাকে খাওয়াইত । আমাকে চিকিৎসা করাতো । একবার এক অভাবে পড়ে সে আমাকে এই বাড়ির পুলিশসুপারের হাতে তুলে দেয় । পুলিশসুপারের কোনো ছেলেমেয়ে নেই । আমাকে তিনি নিজের সন্তানের মত মনে করেন । বাড়ির দারওয়ান রাকীব চাচার কাছ থেকে এসব শুনেছি ,এক শ্বাসে এতোগুলো কথা বলল রূপম ।

রূপম বলল এ বাড়িতে আমার সব আছে । কোনকিছুর অভাব নেই । শুধুমাত্র একটা জিনিসের বড়ই অভাব। অভাব আছে শুধু আমাকে সত্যিকারে ভালোবাসে এমন মানুষের । আমি সবসময়য় নিজের কাছে কি জানি এক শূন্যতা বোধ করি । আমার যদি মা থাকতেন তাহলে এভাবে আমাকে একা রেখে যেতেন না বলে রূপম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। রূপমের কথাগুলো শুনে আমার খুব কষ্ট হল । আমি ও নীরবে কাঁদলাম। একজন বন্ধু হিসেবে রূপমকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আজ আমার নেই । পাশের জারুল গাছের রঙিন ফুলের দিকে তাকাতেই নিজেকে বড় অপরাধী মনে হল আজ। অভাবের মনস্তাত্ত্বিক মূল দর্শন কি, আজ বুঝতে পারলাম ।

বাড়িতে এসে পড়ার টেবিলে বসলেও পড়তে মন চাইলো না আমার । জীবনের একযুগে পদার্পণের মোহনায় আজ সবকিছুকে বড় তুচ্ছ মনে হল । মা আমার জন্য একগ্লাস দুধ নিয়ে এলেন । আমার আজ মনে হল মা-বাবাই আমার সব।

রচনাকালঃ ২০/১১/২০১৩ ইং

লেখকঃ এম মিজান রহমান

E-mail:

বিষয়: সাহিত্য

১০৪৯ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

263909
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৪৯
উম্মে আদনান লিখেছেন : অসাধারণ! পড়ে চোখে পানি চলে এল।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০১:৫৬
210754
এম মিজান রহমান লিখেছেন : আপনার চোখে পানি আনতে পেরেছি বলেই তো আমার লেখাটি সার্থক হয়েছে ।ধন্যবাদ আপনাকে...
263910
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৫১
মামুন লিখেছেন : " জীবনের একযুগে পদার্পণের মোহনায় আজ সবকিছুকে বড় তুচ্ছ মনে হল । মা আমার জন্য একগ্লাস দুধ নিয়ে এলেন । আমার আজ মনে হল মা-বাবাই আমার সব। "- চমৎকার অনুভূতি!
তবে রুপমের জন্য অনেক কষ্ট লাগলো।
খুব সুন্দর একটি গল্পের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শুভকামনা। Rose Rose Rose Good Luck
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০১:৫৯
210755
এম মিজান রহমান লিখেছেন : আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ ক্ষুদ্র লেখাটি পড়ার জন্য ।বাস্তবতা আসলে অনেক কঠিন...
263941
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:২৬
কাহাফ লিখেছেন : রুপমের মত আজকাল নিজের ভিতর অসহ্য এক শুণ্যতা অনুভব করি,এ শুণ্যতা প্রিয়দের থেকে সুদুরে থাকার পরিণাম। অনেক ধন্যবাদ সুন্দর উপস্হাপনার জন্যে.....। Rose
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০২:০২
210759
এম মিজান রহমান লিখেছেন : ঐ একই সমস্যায় আমি ও আছি ।প্রিয়জনের কাছ থেকে আড়াল থাকাটা আসলে অনেক কষ্টের...
@ধন্যবাদ আপনাকে লেখাটি পড়ার জন্য...
263959
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:৫৯
হতভাগা লিখেছেন : গল্পটা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল ।

'' আমার যদি মা থাকতেন তাহলে এভাবে আমাকে একা রেখে যেতেন না বলে রূপম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।''

০ রুপম যদি উনাদের আপন সন্তান হত তাহলেও কি উকিল মা তাকে একা ফেলে রেখে কাজে যেতেন না ?

এ ধরনের ফ্যামিলির প্রায় সবারই রুপমের মত অবস্থায় পড়ে এবং বেশীর ভাগই ডিরেইলড হয়ে যায় ।

Sad but True
265580
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৫০
এম মিজান রহমান লিখেছেন : আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ ।আপনাদের উত্‍সাহ আমার লেখাটি সার্থক করেছে...

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File