নো-ম্যান্স ল্যান্ড (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৫)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২২ মার্চ, ২০১৫, ০৬:৩৩:৫২ সন্ধ্যা
ছেলেমেয়েরা মধ্যাহ্ন বিরতিতে সবাই বাড়ি যায় না। প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন গ্রামের ছেলেমেয়েরা পায়ে হাঁটা দূরত্ব পেরিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে সময়মত আসতে পারলেও বাকী তিনটি গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা পারে না। এরা এই সময়টুকু স্কুল মাঠের একেবারে শুরুর দিকটাতে ভ্রাম্যমান বিক্রেতাদের কাছ থেকে কিছু একটা কিনে ক্ষুধা মিটিয়ে থাকে। তবে অনেকেই ব্যাগে করে বইখাতার সাথে টিফিন নিয়ে আসে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় কমনরুম না থাকায় সেই ক্লাশ রুমেই খেতে হয়। তবে রায়হানের কাছে ক্লাসরুমে খাওয়াটা কেন জানি পছন্দ হয়না। আর একটা সমস্যা হল, ছেলেরা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে সময়টা পার করলেও, মেয়েদের সেই নিজ নিজ ক্লাসরুমে বসে থাকায় ওদের ভিতরে একধরণের একঘেয়েমি বাসা বাঁধে।
এভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর।
রাসেল সাহেবের সাথে পরামর্শ করে স্কুল ফান্ড থেকে কিছু টাকা বরাদ্দ করে একটি কমনরুম বানানোর পরিকল্পনা করে রায়হান। পরিচালনা পরিষদের এক সভা ডেকে বিষয়টি অনুমোদনও করিয়ে নেয়। অধ্যক্ষ হবার সাথে সাথে সেই এই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারীও। মিটিং ডাকার এখতিয়ার সাধারণত তাঁর। তবে প্রয়োজনে সভাপতি এবং সহ-সভাপতিও মিটিং ডাকার অধিকারপ্রাপ্ত।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কলেজ ভবন এবং স্কুল ভবনের মাঝখানে যে অনেকটা খালি জায়গা ছিল, দুটো বিল্ডিঙয়ের ছাদের সাথে টিনের ছাদ দিয়ে চারপাশ ঘিরে একটি মোটামুটি আকারের রুম বানানো গেলো। সেখানে কিছু টেবিল ও বেঞ্চ দিয়ে মেয়েদের জন্য একটি কমনরুমের ব্যবস্থা করা হল। আপাতত মেয়েদের একঘেয়েমি কাটাবার ব্যবস্থা তো হল।
রায়হানের খাবার রফিক নিয়ে আসে।
সকালের নাস্তা সে পাশের দোকান থেকে খেয়ে নেয়। দুপুর আর রাতের খাবার রফিক নিজে রান্না করে। অন্য অনেক গুণের সাথে এই রান্নার গুণটিও তাঁর মজ্জাগত। চমৎকার রাঁধে সে। শহরের যে কোনো হোটেলের একজন দক্ষ বাবুর্চির মতো স্বাদ ওর রান্নায়। কেন এখানে পড়ে আছে, শহরের যে কোনো হোটেলে গেলেই তো অনেক টাকা আয় করতে পারে? রায়হানের এই প্রশ্নের জবাবে সে মৃদু হেসেছে শুধু। এই হাসি ই অনেক কিছু প্রকাশ করে। কিন্তু সামনের জনের তা বুঝার মতো দক্ষতা থাকতে হয়।
রায়হান নিজে মাঝে মাঝে বাজার করে দেয়। রফিককে সাথে নিয়ে বাজারে যায়। যা খেতে ইচ্ছে করে কিনে। তবে কিনবার সময়ে কেন জানি রফিকের কাছে জিজ্ঞেস করে কি কিনবে। রফিক ওর পছন্দমত এইটা ঐটা বলে। আসলে গরিবী হালতে থাকা এই বিপত্নীক নিঃসন্তান মানুষটিকে রায়হানের কাছে অনেক ভালো লেগেছে। এজন্য সে ইচ্ছে করে বাজার করার সময়ে রফিকের কাছে জিজ্ঞেস করে, যাতে করে একজনের প্রয়োজনের চেয়ে বেশী রান্না করা খাবারের অতিরিক্তটুকু সে খেতে পারে। কিন্তু মানুষটি বড্ড সরল। হয়তো সে বুঝতে পারে। হয়তো পারেনা। কিন্তু একদিন বেঁচে যাওয়া খাবার নিয়ে সে রায়হানের কাছে এসে বলেছিল, ‘ এতোগুলা রানতে কন, অহন খাবে কেডা? আরো কম কম বাজার করন লাগবো।‘ কিন্তু রায়হান হেসে বলে, ‘ আমার ক্ষুধা কোনদিন বেশী লাগে, তাতো আর জানিনা, তুমি প্রতিদিন এই পরিমাণে রান্না করবে। আমি খেতে না পারলে তুমি খাবে। খাবার নষ্ট করা যাবে না, বুঝেছ?’
রফিক মাথা নেড়ে চলে যায়।
ওর চেহারায় কোনো ভাব প্রকাশ পায় না। হয়তো পায়। রায়হানের নজরে পড়ে না।
এমন অনেক কিছুই তো আজকাল ওর নজরে পড়ছে না। কাছের মানুষদের যা দেখা দরকার, সময়মত সে দেখে না। আর দেখলেও অনুভব করে না।
দুপুরের খাবার সে নিজের অফিস রুমে বসেই খেয়ে নেয়। রাসেল সাহেব এবং অন্যরা টিচারস রুমে যার যার মতো খেয়ে নেন। সহঃপ্রধান শিক্ষক তাপসবাবু এবং আরো তিনজন পাশের গ্রামে যাদেরকে প্রাইভেট পড়ান, সেই বাসাগুলো থেকে তাদের জন্য খাবার আসে। পরিচালনা পরিষদের একজন অতি-উৎসাহী অভিভাবক সদস্য রায়হানের জন্যও তিনবেলা স্বেচ্ছায় খাবার পাঠানোর প্রস্তাব রেখেছিলেন।
কিন্তু ভদ্রভাবে রায়হান তাঁকে না করে দিয়েছে।
জয়েন করার আগে বাবা বলেছিলেন এরকম অনেক কিছুর প্রস্তাব আসবে। সেগুলোর কোনটিকে কিভাবে না বলে দিতে হবে, তাও বলে দিয়েছিলেন।
এতোদিনতো বাবাই ওকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন।
এখন কি তবে করছেন না?
সে একটি স্কুল ও কলেজের দায়িত্বে রয়েছে, এজন্যই কি এমনটি ভাবছে? বাবা কাছে নেই, তাই বলে কি বাবার নিয়ন্ত্রণ থেকে সে দূরে রয়েছে?
সে কি বল্গাহীন ঘোড়ার মতো এক দুরন্ত গতি লাভ করার বাসনা পোষণ করে এসেছে এতোদিন? বাবার নিয়ন্ত্রনহীন দুরন্ত গতি!
কেন এমন মনে হয় তাঁর?
চিন্তা-ভাবনা এই দুপুরবেলাতেই কি আজ ওকে বেসামাল করে ফেলবে? জোর করে খাবারের দিকে মনোযোগ দেয় রায়হান। আজ রুই মাছের তরকারি দেখতে পেলো। ইদানিং রফিককে সাথে নিয়ে বাজারে যেতেপারছে না। টাকা দিয়ে বলে দেয় কি কি আনবে। তবে এরকম মাছ দেখে একদিন প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল রফিকের ওপর। মনে পড়ল এখন। সেদিন কি কারণে জানি উপজেলায় চলে যেতে হয়েছিল খুব ভোরে। রফিককে টাকা দিয়ে যেতে পারেনি। আসন্ন এস.এস.সি পরীক্ষায় হল সুপারনির্বাচন নিয়ে মিটিং ছিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে। দুপুরের দিকে ফিরে এসেছিল রায়হান। খাবার সময় রুই মাছ দেখে জিজ্ঞাসু নেত্রে রফিকের দিকে তাকালে সে বলেছিল, ’পুকুরের মাছ স্যার। জবর টেস। খাইয়া দেখেন।‘
প্রচণ্ড ক্রোধে বেসামাল হতে হতেও অতোটা বেসামাল হলো না রায়হান। রফিকের বয়সের দিক বিবেচনা করে অপেক্ষাকৃত ধীর আওয়াজে বলেছিল, ‘ তুমি জানো না, পুকুর লীজ দেয়া হয়েছে। এই মাছ অন্য মানুষের। কেন সেখান থেকে ধরেছ?’ একটু অবাক হয়েছিল সেদিন রফিক। সেও সমানভাবে উত্তর দিয়েছিল,’ কি কন আপনে স্যার। আপনে না চাইলে এই পুকুর কেউ লীজ নেতে পারবে? এইডা সবাই জানে। আগের হেডস্যারে তো প্রায় সপ্তায়ই আমারে দিয়া মাছ ধরাইতেন।‘
একটু থেমে রফিককে বলেছিল, ’শোন, আমি তোমার আগের হেডস্যার না, বুঝেছ? আর আমাকে জিজ্ঞেস না করে এরপর নিজে চিন্তা-ভাবনা করে কোনো কাজ করবে না।‘ রফিক ঘাড়কাত করে তাঁর সম্মতি জানিয়েছিল।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত এমন কিছু সে আর করে নাই যে জন্য রায়হানের তাঁকে বকা দিতে হয়েছে। সেই মাছের দাম সে পুকুর লীজ নেয়া ভদ্রলোককে নিতে বাধ্য করেছিল।
তবে ক্রোধ একটু বেশী ই রায়হানের। ওর বাবার থেকে উত্তরাধীকার সুত্রে এই রাগ সে পেয়েছে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দ্রুত খেয়ে নেয়। লাঞ্চের পরে কলেজের ক্লাশ নিতে হবে।
দশ মিনিট নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু আরামবোধ করতে চাইলো। কিন্তু তাঁর আগেই রাসেল সাহেব একজন হাল্কা পাতলা অল্প বয়সী ছেলেকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। রাসেল সাহেব নিজেই পরিচয় করিয়ে দিলেন, ’স্যার,ইনি মিজান সাহেব। ডিইও স্যার ওনার ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলেছিলেন।‘
মিজান নামের ছেলেটির সাথে হাত মিলিয়ে তাঁকে বসতে বললো রায়হান। রায়হানের অনেক কথা মনে পড়ল। ওর পদটি এম.পি.ও ভুক্তির জন্য এই ডিইও (জেলা শিক্ষা অফিসার) সাহেবের কাছে প্রথমে ওর ফাইল গিয়েছিল। সেখানে রাসেল সাহেবের অনেক ভালো পরিচয়। তিনি ই রায়হানকে স্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। আলাপ-পরিচয়ের এক পর্যায়ে ডিইও স্যার রায়হানকে বলেছিলেন, ’আমারএক ছাত্র আছে। কৃষিতে ডিপ্লোমা করে এখন বেকার। দেখুন তো ওকে আপনার প্রতিষ্ঠানে কোথায়ও নেয়া যায় কিনা। আমি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবো ওকে।‘ রায়হান নীরবে সম্মতি জানিয়েছিল সেদিন।
ডিইও স্যার ওর ফাইলে ৭২০০ স্কেল লিখে দিয়ে শিক্ষা বোর্ডে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কলেজ এম.পি.ও ভুক্ত না থাকাতে ভাইস-প্রিন্সিপ্যালের এই স্কেলও ওর জন্য বোর্ড অনুমোদন করেনি। নন-বি.এড স্কেল দিয়েছিল (তখন ছিল ২৫৫০ টাকা )। গতমাসে ওর ইন্ডেক্স নাম্বার আসে মন্ত্রনালয় থেকে। সেটি হল ...০৮৮৭। এরিয়ার হিসেবে অনেকগুলো টাকাই পেয়েছে সে। মায়ের কাছে সেগুলো সব পাঠিয়ে দিয়েছে।
ভুল হল। সব টাকা সে মাকে দেয়নি। ওখান থেকে কিছু টাকা রেখে দিয়েছে। টাকাটা পাবার পরে মায়ের মুখটি আগে ভেসে উঠলেও, কণা নামের একজন, যে আইনত অফিসিয়ালি ওর বউ এখন, ওর চেহারাটিও দেখতে পেয়েছিল মনের আয়নায়।
ওকে নিয়ে কিছু করার বাসনা থেকেই কি বাকী টাকাগুলো মাকে দেয় নাই সে?
কেন এই লুকোচুরি? কণা আসার আগে তো কখনো এমনটি হয়নি।
আবারো চিন্তার গভীরে যেতে যেতেও রায়হান সামনে বসা নতুন মানুষটির দিকে চোখ পড়তেই থেমে যায়। কয়েকবার ছেলেটিকে দেখে। সদ্য ডিপ্লোমা পাস করা ছেলেটি ওর দৃষ্টির সামনে কেমন যেন মিইয়ে যায়। রায়হান চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রাসেল সাহেবের দিকে তাকায়।
মিজান সাহেবকে সামনে রেখেই রায়হান রাসেল সাহেবকে নতুন করে শূন্য পদে লোকাল এবং একটি জাতীয় পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিতে বলে। আর মিজান সাহেবকে ঐ পদে আবেদন করতে বলে নির্দিষ্ট সময়সীমার ভিতরে।
খুশী মনে মিজান সাহেব চলে যায়।
রায়হান ক্লাশ নিতে কলেজ সেকশনের দিকে আগায়। বাইরে প্রচণ্ড বাতাস। দক্ষিণের দীঘির কালো জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে পুরনো এই বিল্ডিঙটিকে শীতল করার অবিরাম চেষ্টায় রত দক্ষিণা সমীরণ! একইসাথে রায়হানকেও কেন জানি অনুভূতিতে আবেগময়ী করে তোলার চেষ্টা করে।
কিন্তুপারে কি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রায়হান সামনে আগায়, মনে পড়ে আজো ইংরেজীর খন্ডকালীন প্রভাষক আসেননি। মন খারাপের চূড়ান্ত হল যখন ক্লাশরুমে গিয়ে দেখলো, অর্ধেকের বেশী ছেলে টিফিন পিরিয়ডের পরে আসেনি। এরা পালিয়েছে।
কি হবে এদের? ওদের আগের ব্যাচের পাসের হার একেবারেই কম। কলেজ এম.পি.ও ভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় হারের অনেক নীচে। ওর দিকে পরিচালনা পরিষদ এবং অভিভাবকেরা যেমন তাকিয়ে আছে, একই সাথে এখানে চাকুরী করা প্রভাষকেরাও আশায় বুক বেঁধে আছে- কিছু একটা হবে। রায়হান নামের এই লোকটি কিছু একটা করে দেখাবে।
কিন্তু কিভাবে সেটি রায়হান জানে কি?
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৯৩২ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
উপভোগ্য লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার ভালো লাগার অনুভূতি জেনে খুশী হলাম।
বারাকাল্লাহু ফীহ।
শুভেচ্ছা জানবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন