নো-ম্যান্স ল্যান্ড (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৪)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৫ মার্চ, ২০১৫, ০৬:০৭:৪৬ সন্ধ্যা
মায়ের সাথে বের হলো কণা।
বাসা রসামনে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছিল। কণাদের বের হতে দেখেই সচকিত হল। সেকি করছিল? এমনিতেই তো বসে ছিল। তবে কেন অহেতুক এই চমকে ওঠা? ওর ভিতরে কি কোনো পাপবোধ কাজ করছিলো?
সরকারী কলোনির নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কণা এগুলো ভাবছিল। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যে ওর জন্য অপেক্ষা করছে... ওর মা পেছনের সীটে সরে বসে দরোজা খুলে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন- এসবই সে বেমালুম ভুলে আছে। মিসেস তাহমিনা ফারুক অবাক হলেন। তাঁর দুইভ্রুর কুঞ্চনের সাথে সাথে মনের কোথায়ও যেন একটু অমসৃণ অনুভবে বিদীর্ণ হলেন। সদ্য আকদ হওয়া নিজের মেয়ের এই ভাবান্তর তাঁর নজর এড়ালো না; বরং মনের চোখে অনেক কিছু দেখতে চাইলেন।
রায়হানকে তিনি একদম পছন্দ করেননি।
কিন্তু তাঁর সংসারে নিজের পছন্দ অপছন্দে কিছুই যায় আসে না। কণার বাবা রায়হানকে পছন্দ করেছেন।
ব্যস। সব হয়ে গেলো। কেইস ডিসমিস।
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মেয়েকে ডাকেন,’ কিরে আয়। গাড়িতে ওঠ।‘
মায়ের ডাকে কণাও বাস্তবে ফিরে আসে। মুখে লজ্জিত হাসি নিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের মন এই হাসিতে ভরে যায়। একটু আগের মনের অমসৃণ অনুভব অনেকটা মসৃণ হয়। নিজের এই বড় মেয়েটির প্রতি তাঁর অনেক টান। বাকী ছেলেমেয়েদের প্রতি কি তবে টান নেই?
নাহ! এমন নয়।
তবে কেমন?
নিজের সাথে নিজের কথোপকথনে অসহায় বোধ করেন মিসেস ফারুক। কণাই তাঁকে প্রথমবার একজন মায়ের স্বাদ পাইয়ে দিয়েছে... নিজের ভেতরে তিল তিল করে বড় হওয়া অন্য একটি প্রাণ অনুভবের প্রশান্ত আবেগময়ী অনুভূতিতে এক যুবতী নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন! জগতের সব থেকে মধুর ডাক ‘মা’ শব্দটিও তাঁকে প্রথম উপহার দিয়েছিল কণা!
শুধু কি এজন্য?
যে মেয়েটির বাঁচার আশা ছিল না মোটেই, সেখান থেকে আল্লাহপাকের ইচ্ছায় সে বেঁচে ফিরেছে,সম্পুর্ণ সুস্থ জীবনযাপন করেছে। এজন্যই কণার প্রতি মিসেস ফারুকের অন্য ধরণের একমায়া রয়েছে। মা এবং সন্তানের স্বাভাবিক মায়াকে ছাড়িয়েও কেমন এক আলাদা অনুভূতি কেন জানি অনুভব করেন তিনি।
মায়ের পাশে বসে কণা বেশ ভালোলাগা অনুভব করে। এই বয়সেও ‘মা মা’ এক ঘ্রাণেএ খনো আন্দোলিত হয়। মায়ের দিকে তাকায়। মা হাসে। হাসি কেন জানি সংক্রামক। কণাও হেসে ফেলে। মা ওর হাতে নিজের হাত রাখেন। আলতো চাপ দেন।
যেন ওকে আশ্বস্ত করেন। পাশে আছেন এটাই কি বুঝান?
কণার পাশে এখনো কেন মাকে থাকতে হবে? ওর পাশে থাকার একজন মানুষ তো বাবা পছন্দ করেছেন? বিয়েও হয়ে গেছে। হ্যা, আকদই তো বিয়ে। এরপর যা রয়েছে, সেটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
আচ্ছা,রায়হানকে বাবা পছন্দ করেছেন, এই ভাবনা ওর মনে কেন এলো?
কণা কি তবে রায়হানকে পছন্দ করেনি?
‘আমি জানি না’।- একটু বোধহয় জোরেই বলে ফেলেছে সে। মা ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেন। ড্রাইভার আলতাফ রিয়ার ভিউ মিররের ভিতর দিয়ে দেখলো। তবে সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। ড্রাইভারদের সব কিছু দেখা এবং শোনা উচিত নয়।
এবারে মিসেস ফারুক বেশ দ্বিধার ভেতর পড়ে গেলেন। একটু আগের মনের অস্বস্তি কেবলি ভালো হওয়া শুরু করেছিল। এইমাত্র তা আরো খারাপের দিকে যেতে থাকলো।
‘খালাম্মা কোন দিকে যাবো?’
ড্রাইভারের প্রশ্নের উত্তরে মিসেস ফারুক প্রথমটায় কিছুই বললেন না। কিন্তু সে গ্লাসের ভিতর দিকে ওনার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে বললেন,’ রেয়াজুদ্দিন বাজারের দিকে চলো।‘
যাকাতের লুঙ্গি এবং শাড়ি কিনতে এসেছিলেন।
ফারুক সাহেব সরকারী চাকুরী করলেও হিসাব করে প্রতি বছর যাকাত আদায় করেন। আর মিসেস ফারুককে সেই হিসাব অনুযায়ী শাড়ি-লুঙ্গি কিনতে হয়। রেয়াজুদ্দিন বাজারে এরকম অনেক দোকান আছে,সেখানে তিনি যান না। কারণ ঐ দোকানগুলোতে একেবারে নিম্ন মানের কাপড় বিক্রি হয়। অধিকাংশ ক্রেতাই পরিমাণে বেশী নিতে চায়। সেখানে কোয়ালিটি যেমন তেমন হোক, তাতে কিছু যায় আসে না।
মিসেস ফারুক সব থেকে ভালো মানের লুঙ্গি এবং শাড়ি কিনেন। ওনার নির্দিষ্ট একটি দোকান রয়েছে। সেখান থেকেই নিজের বাসার জন্যও কিনে থাকেন। ছেলে ইকবাল যদিও লুঙ্গি পড়ে না,কিন্তু ফারুক সাহেব বাসায় লুঙ্গি ছাড়া স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।
শেষ পর্যন্ত সব কেনা হলো।
ড্রাইভার আলতাফ গাড়ির বুটে সব কাপড়গুলো রেখে দিলো।
মিসেস ফারুক মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ’নিউ মার্কেট যাবি?’
তাঁর এই কথায় কণার চেহারা ঝলমলে এক রোদ্রোজ্জল মায়াবি বিকেলে পরিণত হলো। মা বুঝলেন মেয়ের এই আনন্দের কারণ। বুঝেন বলেই তো এই কথা বলেছেন। সেই ছেলেবেলা থেকে এই মার্কেটটি কেন জানি কণার খুব পছন্দ। মায়ের সাথে কি মাঝে মাঝে বাবার অমূল্য সময়ের ভেতর থেকে কিছু সময় বাবা বের করতে পারলে, ওদেরকে সাথে নিয়ে এখানে আসেন। দোস্ত বিল্ডিঙয়ের সামনে দিয়ে নিউ মার্কেটে প্রবেশের এক আলাদা আনন্দ বুকের মাঝে বয়ে যেতো। এখনো যায়। এই যে মা বললেন, সে যাবে কিনা, তাতেই পুরনো সময়ের সাথে ঘুরে ফেরা শীষ দেয়া দোয়েলের আনন্দময় শাব্দিক অনুভূতিতে মন তরল হয়ে গেলো। তবে এর বাইরেও আরো একটি কারণ রয়েছে যা মিসেস ফারুক জানেন না।
মায়ের সাথে হেঁটে হেঁটে দু’পাশের দোকানগুলো দেখে দেখে প্রশস্ত লনে কোণ আইসক্রিম হাতে চলার মুহুর্তগুলো আসলেই অসাধারণ! দোতলার একেবারে পুর্ব দিকে একটি আইসক্রীম পার্লার রয়েছে। এখানেই রায়হানের সাথে ওর প্রথম দেখা!
মা জানেন না।
আড়চোখে মায়ের দিকে একবার তাকায়। মা ও হাসিমুখে ওর দিকে তাকায়। কিন্ত কণার মনের গোপন কথা মা বুঝতে পারেন না। সে ও কি মায়ের সব কিছু বুঝে? অনুভব করে?
হ্যা, কিছু তো করে। এই যে মা রায়হানকে পছন্দ করেন না, এটি বুঝতে পারে।
কিন্তু কেন করেন না, সেটি বুঝে আসে না।
মা যে রায়হানকে পছন্দ করেন না, এজণ্য কণার কি মন খারাপ? কণার কি খারাপ লাগে?
লাগা কি উচিত নয়?
এই মানুষটির সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। এখন দুজনের ভেতরে এমন একটি সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, যা মা-বাবার সাথের এতোদিনের সম্পর্কের চেয়েও কেন জানি অনেক আলাদা মনে হয় কণার কাছে।
আইসক্রীম পার্লারের সামনে দিয়ে মাকে নিয়ে হেঁটে যায় কণা।
ভিতরে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়ে বসে আছে। একজন অন্যজনকে আইসক্রীম খাইয়ে দিচ্ছে। একটু দূরে বসা এক জুটি একই আইসক্রিম দুজনে দু’পাশ থেকে কামড়ে খাচ্ছে দেখতে পেলো কণা কাঁ চভেদ করে।
ওর শরীর কেন জানি শিরশির করে উঠলো!
ইদানিং এরকম আবেগঘণ দৃশ্য দেখলে কণার চব্বিশ বছরের শরীরটি কেন জানি কেঁপে উঠে। ভিতরে কোথায় যেন সুউচ্চ পাহাড়ের কান্না জমা শীতল জল গড়িয়ে পড়ার শব্দ শুনতে পায়। সেই শীতল জলে অবগাহনের প্রচন্ড এক ইচ্ছে জাগে মনে। আর ক্রমশঃ শরীর উষ্ণ হতে থাকে।
দোকানটি পার হতে হতে কনার মনে হয়, ওদের আকদের আগে এক সন্ধ্যায় সে আর রায়হান এই যায়গাটিতে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিল। মাকে রিতার বাসায় যাবার কথা বলে সেদিন রায়হানের সাথে ছিল সে।
ঐ দূরের ছেলেমেয়েটির মত একই আইসক্রীমে কামড় দিয়েছিল নিঃশ্বাস দূরত্নে থেকে! এখন ভাবতেও কেমন লাগছে যেন।
নিজের ওপর কি ঘেন্না হচ্ছে ওর?
মায়ের পাশে হেঁটে যেতে যেতে এক যুবতী যার সদ্য বিয়ে হয়েছে, কিন্তু নিজের মানুষটির ধারে কাছেও সে যেতে পারছে না, হৃদয়ে প্রচন্ড এক ভালোলাগা কিছু অসমাপ্ত প্রশ্নকে সাথে নিয়ে থেকে থেকে ওকে প্রগলভ করে তুলছে। কিন্তু সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর কোথায় কিংবা যে দিতে পারবে, সেটি জেনেও সে কিছুই করতে পারছে না।
হাতে বরফের কোণ... হৃদয়ে আগুনের আঁচ।
সদ্য নাক ফোড়ানো এক যুবতী লম্বা পেভমেন্ট ধরে অনেক মানুষের ভীড়ে তাঁর মায়ের পিছু পিছু হেঁটে চলে... অনুভূতিতে একেলা! এমন এক বিরানভূমিতে সে বিরাজ করে, যেখানে দূরে মরীচিকার মতো একটি প্রিয় মুখ তাকে ডাকে। কিন্তু সে যতই কাছে যায়, সেই মুখটি ততো দূরে সরে যেতে থেকে।
এতো কষ্ট কেন ভালোবাসায়!!
হাত থেকে কোণ আইসক্রীমটি পড়ে যায়। চিন্তাও থেমে যায়। কণার মা সব দেখেন।
আর কনা কিছুই দেখে না।
ওর মনের গভীরে একটি সুরই বেজে যেতে থাকে... এতো কষ্ট কেন ভালোবাসায়?... রায়হানকে সেভালোবাসে!
হ্যা! ভালোবাসা তৈরী হতে বেশী সময় লাগে না। মাত্র এক মাস আগে ওদের পারিবারিকভাবে পরিচয়... এবং বিয়ে। তাও অভিভাবকদের ইচ্ছেতে।
আবার হোঁচট খায় কণা।
অভিভাবকদের ইচ্ছেতে কেন ভাবছে? সে না ভালোবাসে? তবে রায়হানের মনোভাব জানতে পারলে ভালো লাগতো। মানুষটি এখন কোন এক পাড়া গাঁ এ মাস্টারি করে বেড়াচ্ছে!
হেসে ফেলে কণা। মাস্টারি শব্দটা ওর মনে এলো কি করে? ওর বাবা বলেছিলেন একবার বলেই কি? সেই প্রথমবার রায়হানের কথা মিসেস ফারুককে জানানোর সময়। ছেলে কি করে কণার মা জিজ্ঞেস করাতে বাবা বলেছিলেন,’ কোন এক কলেজে মাস্টারি করে।‘
কিন্তু সে যে ঐ কলেজটি চালায়, পরে জেনেছে।
মিসেস ফারুকের অবাক চাহনিকে অগ্রাহ্য করে কণা বলে,’ চলো মা।‘
মেয়ের পিছু পিছু এবার মিসেস ফারুক সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যান।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৯৮৪ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
প্রতি কথায় কথায় নিজেকে নিজে প্রশ্ন, সাথে সাথে উত্তর, কখনো এলোমেলো কখনো ঠিক।
অতি মামুলি বিষয়গুলো রসালো করে উপস্থাপন, হুমায়ন আহমেদ করতেন, এখন আপনি তাই করছেন। কথাচ্ছলে সুন্দর উপকারী শিক্ষণীয় কিছু বুঝানোর চেষ্টা, সব মিলিয়ে বেশ ভালই লিখতে পারেন।
সব সময় পড়ার সুযোগ হয় না, পারলে আপনার সব লিখাই পড়তাম। সত্যি বলছি আপনার লিখা আমার বেশ লাগে।
হ্যা, প্রতিটি চরিত্রকে তাদের নিজে চোখেই দেখানোর চেষ্টা করি। এতে করে এক একটি চরিত্র দোষে-গুণে অসাদাহ্রণ হয়ে উঠে। এভাবেই কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করি।
ভালো থাকুন আপনি।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার ভালো লাগার অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
রায়হানকে তিনি একদম পছন্দ করেননি।
কিন্তু তাঁর সংসারে নিজের পছন্দ অপছন্দে কিছুই যায় আসে না। কণার বাবা রায়হানকে পছন্দ করেছে....!
বর্তমান সমাজে এইরকম মানতে দেখা যায়না বললেই চলে।
আজকাল ব্লগে আপনার উপস্থিতি হতাশা জনক! আশা করি আাবারো উপস্থিতি বাড়িয়ে প্রাণবন্ত করে তুুলবেন।
আমি নতুন লিখা লিখতে পারছি না বলেই ব্লগে আসছি না। আর মাঝখানে তো ব্লগে ঢুকতেই পারছিলাম না.। কি যে সমস্যা, বুঝতে পারছি না।
ভালো থাকুন আপনারা দুজন। শুভেচ্ছা জানবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন