পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-২০)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৮ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৮:০৪:২৪ সকাল
মিথিলা বাবু, তুমি কি শুনেছো গানটা? ' এ কূল ভাংগে ও কূল গড়ে এইতো নদীর খেলা..! '
প্রতিদিন জীবনের এক পাড় ধ্বসে স্রোতে বিলীন হচ্ছিলো, অন্য পারে জাগছিলো নতুন চর। কী যে হারাচ্ছিলো, কী এসে সামনে দাঁড়াচ্ছিল - এক মুহুর্তের ছুটি পাচ্ছিলাম না একটু ভাববার জন্য, একটু প্রস্তুতির জন্য।
জীবন -উপন্যাসের সমস্ত অলিতে গলিতে এক পলকে কত কিছু একইসাথে বদলে যাচ্ছিল। খেই হারাচ্ছিলাম। ডুবে যাচ্ছিলাম। হাত ঝাপ্টে যাচ্ছিলাম, ধরার জন্য একটা খড়কুটো যদি মিলে!
তখন খালু দেশের ক্ষমতাসীন দলের একজন, খুলনার প্রভাবশালী নেতা। আর চরমপন্থী দলগুলো ওই সময় নিজেদের ভিতর বিভক্ত হয়ে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের সাথে গোপনে সখ্যতা রেখেও চলছিল। খালুর সাথে মৃণালের বনিবনা ছিল না। খালু মৃণালকে শেষ করে দেবার জন্য পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা কামনা করে। তবে তার নিজ দলের কাউকেও সেটা জানতে দেন নাই। পুলিশের নিজস্ব কিছু পরিচিত অফিসার ছিলেন তার। তাদের দিয়ে একটা প্ল্যান করে ফেলেন। সেই অনুযায়ী মৃণালকে মেরে ফেলার একটা ব্যর্থ প্রয়াস ঘটে। মৃনাল বেঁচে যায়। রাতের আঁধারে সে কিভাবে যেন ঘটনাটি আচ করতে পেরে নিরাপদে সরে পড়ে। আর এখান থেকেই খালু তথা আমাদের পরিবারের সাথে মৃণালের তথা ওর দলের সাথে এক অলিখিত যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে যায়। আব্বাও খালুর সাথে একই শ্রেণীর এবং আত্মীয়তার বন্ধনে যুক্ত থাকায় এই বিরোধে আমাদের পরিবারও সংযুক্ত হয়ে গেল। ডুমুরিয়ার খবর পাচ্ছিলাম নিয়মিত।
মৃণালের পুর্ববাঙ্গলা কম্যুনিস্ট পার্টির একটা অংশ পুলিশের সাথে মিলে ওকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করাতে সে তার নিজস্ব অনুসারীদেরকে সাথে নিয়ে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টি নামে আলাদা দল গঠন করে।
এদিকে লাভলির সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আমাদের পরিবারের সাথে এলাকার প্রভাবশালী সৈয়দ পরিবারের দ্বন্দ্বটা দিনে দিনে প্রকট হচ্ছিল। ওরা ঘটনাক্রমে মৃণালের বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে এক হয়ে গেলো। মৃণাল নিজে একটা চরম্পন্থি দলের ছিল, সে আমাদের পরিবারের খালুর এন্টি ছিল। আর সৈয়দরাও আমাদের এন্টিতে। খালু এবং বাবার মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে সৈয়দরা আমাদের সাথে পারতো না। তারা মৃনালকে বাবা আর খালুর বিরুদ্ধে পেয়ে সুযোগ করে তার সাথে হাত মিলালো শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য।
দু:সহ সময় যাচ্ছিল। মোট কথা, ঠিক ঐ সময়টাতে প্রকাশ্য রাজনৈতিক হানাহানির দৃশ্যমান অরাজকতার ভিতর দিয়ে গোপন রাজনৈতিক দলগুলো যখন নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি এবং বিরোধী দলের সাথে লিঙ্কড হয়ে গিয়েছিল তখন ওই ঘূর্ণিতে পড়ে আমাদের সহজ ছোট পরিবারটাও অতল সাগরের কোন অন্ধকার গর্তে বিলীন হওয়ার পথে রওয়ানা হল । প্রভাবশালী মন্ত্রীরা এঁকে অপরের বিরুদ্ধে নিজ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এই দলগুলোর নেতাদেরকে সাথে রেখে চলেছিলেন অদৃশ্যভাবে। তবুও খুলনা শহরের সবারই জানা ছিল কে কি করছেন। কার সাথে কার সখ্যতা এটা একটা ওপেন সিক্রেট ছিল।
মৃণালকে খতমের চেষ্টার প্রতিশোধ নিতে কিম্বা নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মৃণাল খালুকে সর্বাগ্রে খতমের জন্য মরীয়া হয়ে ছিল । খালুও সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় নিজের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী এবং পুলিশ প্রোটেকশন নিয়ে চলাফেরা শুরু করলেন। বাবাকে নিয়ে আমরা শংকিত হয়ে পড়লাম। খালুর সাথে সম্পৃক্ততা আর সৈয়দদের সাথে শত্রুতা ছাড়া ও, এই সময়ে বাবা তার পেশাগত জীবনেও জটিল আর বিপদজনক অবস্থায় ছিলেন। উপর মহলের কোন এক হোমরা চোমরার সাথে কোন বিষয়ে বাবার বিরোধ চলছিল। এভাবে একটা যুদ্ধাবস্থার ভিতর দিয়ে আমাদের কয়েকটি পরিবারকে প্রতিটিক্ষণ জীবনযাপন করতে হচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত একদিন আকাশ ভেংগে আমাদের মাথায় পড়ল! সেদিন আমার ছোটভাই বাদল এবং খালু আমাদের এলাকার বাজারে কোনো একটা কাজে গিয়েছিল। দিনটি ছিল রবিবার। আমি কলেজে। দুপুর বারোটার দিকে এক ছোটভাই মারফত খবর পাই, আমাদের এলাকায় গোলাগুলি হয়েছে। খালু এবং বাদল গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি যেন আজ যেকোনো নিরাপদ যায়গায় রাতটা কাটাই। এলাকায় যেন না আসি। ওর কাছ থেকে খুঁটিয়ে জানতে পারলাম মৃণালের লোকজন খালুর উপর আক্রমণ করে। ওদের একজন যায়গায় মারা গেছে। খালুকে বুকে গুলি করা হয়েছে । বাদল সাথে থাকাতে সেও গুলিবিদ্ধ হয়েছে । বাদল এবং ওনাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। দুজনের অবস্থাই আশংকাজনক। আমার চারিদিক কেমন যেন দুলে উঠল। আমার প্রিয় ছোটভাই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ... আর আমাকে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা বোধ হল। কলেজের পিছনের নদীর ঘাট দিয়ে ওপারে সেনহাটির দিকে চলে গেলাম। আমার একজন মামাতো ভাই সেখানে থাকতেন । এই কথাটি অনেকেই জানতো না। আমি ওখানেই যাওয়াটা নিরাপদ ভাবলাম। মানুষের নির্দয়তা আমাকে চরম হতাশ করল। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য একজনকে আক্রমণ করতে গিয়ে একটি নিরীহ ছেলেকে জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিলো! একটা পরিবারের সুখ এক মূহুর্তে ধ্বংস করল! তারা চাইলে এই দিনটা ডেকে না এনে পারতো, কিন্তু এখন চাইলেও আর কোনদিন এই পরিবারকে তারা শান্তি ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
রাজনৈতিক দলগুলি তাদের বুদ্ধি, বিবেক আর হৃদয়কে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে নির্দয়, বিবেকহীন অস্ত্রকে নিয়োগ দিয়েছিল। শুধু বন্দুক দিয়ে কিছু হয় না, বুদ্ধি, সততা আর মমতার ও দরকার হয়। চরমপন্থি দলের তাত্ত্বিক নেতার মাঠ পর্যায়ের কর্মী বা নেতাদেরকে এখান ওখান থেকে টাকা ছিনিয়ে এনে তাদের নিজেদের ভিতরে সিংহভাগ রেখে ছিটেফোটা ওদেরকে বিলিয়ে দিয়েছে। এতে করে কারো কোন লাভ হয়েছিল?
ঘটনার পর মা একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যেন আমাকেই সব কিছুর জন্য দায়ী করলেন। নি:শব্দ দৃষ্টিতে প্রতি মূহুর্তে কঠিন অভিযোগ জানাতে লাগলেন। ঘরের পরিবেশ অস্বাভাবিক থমথমে হয়ে গেল। ঘর চলতে থাকল অনেকটা কাজের লোকদের হাতেই। বাবা টাকা দিচ্ছিলেন। বাজার, রান্না, খাওয়া, এর আসা, তার যাওয়া - কোন ব্যাপারেই মা একটা শব্দ ও করছিলেন না। বাদলের নষ্ট হয়ে যাওয়া জীবনটা আমার সব কাছের মানুষ আর আমার মাঝখানে কাঁটালতায় ছাওয়া বিস্তীর্ণ মরুর মতো হয়ে জায়গা দখল করল। সারাজীবনের জন্য তাদের পর হয়ে গেলাম।
মন একেবারেই ভেংগে গেল। এই অবসরে, জানলাম না, গোপন রাজনীতিতে ঢোকার পথটা ঠিক সেই মুহুর্তেই আমার ঠিক সামনে এসে খুলে গেল।
বাদলের মেরুদন্ডে গুলির আঘাত লাগাতে সে জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে যায়। বাকী জীবনটা ওকে হুইল চেয়ারে কাটাতে হবে ভেবে পৃথিবীটা অসহ্য লাগছিল। মনের এই অবস্থায় নৌকায় ওপারে যেয়ে শিমুলের দেখা পাই। তাকে সবকথা খুলে বলি। মৃনালের এন্টি দল ছিল শিমুলের দল। তবে আগে ওরা একদলই ছিল। মৃনাল পুর্ববাঙ্গলা ছেড়ে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টি করাতে শিমুলদের সাথে অলিখিত শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। শ্রেণী শত্রু খতমের নামে সেই সময়ে দেশে চলছিল একে অন্যের গলাকাটার প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক দলগুলি তাদের বুদ্ধি, বিবেক আর হৃদয়কে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে নির্দয়, বিবেকহীন অস্ত্রকে নিয়োগ দিয়েছিল। শুধু বন্দুক দিয়ে কিছু হয় না, বুদ্ধি, সততা আর মমতার ও দরকার হয়। চরমপন্থি দলের তাত্ত্বিক নেতার মাঠ পর্যায়ের কর্মী বা নেতাদেরকে এখান ওখান থেকে টাকা ছিনিয়ে এনে তাদের নিজেদের ভিতরে সিংহভাগ রেখে ছিটেফোটা ওদেরকে বিলিয়ে দিয়েছে। এতে করে কারো কোন লাভ হয়েছিল?
অসতর্ক আবেগ আমাকেও উন্নাসিক প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয়। আমি টের ও পাই না।
সৈয়দ পরিবারের লাভলিকে নিয়ে আমার পরিবারের উপর প্রভাব খাটানো এবং মৃনালের সাথে তাদের মিলে যাওয়া... বাদলের উপর হামলা... আর আগামী সময়টা আমার পরিবারের নিরাপত্তার - সব কথা ভেবে শিমুল ভাই যখন আমাকে দলে ঢোকার কথা বলেন, আমি রাজী হয়ে যাই। চোখের সামনে বাদলের গুলিবিদ্ধ দেহ, বাবা-মায়ের নিচু হয়ে থাকা মাথা, আর লাভলিকে না পাওয়ার এক চরম কষ্ট আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। আমার ভিতরে একবুক ভালবাসার পাশাপাশি প্রতিশোধের আগুনও জ্বলছিল। আমি পুর্ববাঙলা কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক সাইডের একজন কর্মী হয়ে গেলাম। তবে অন্যান্য কর্মীর মত নয়। আমি হলাম শিমুল ভাই এর ডানহাত। ব্রিলিয়্যান্ট স্টুডেন্ট হবার সুবাদে, আমাদের পারিবারিক স্ট্যাটাসের বদৌলতে, কিছুটা লাভলিকে ঘিরে আমি ঐ সময়ের খুলনা শহরে অনেকটা পরিচিত ছিলাম। তাই শিমুল ভাই সাহায্য করার জন্য ই হোক কিংবা কাজে লাগানোর জণ্যই হোক, যেভাবেই হোক সাথে নিলেন। আমি দৃশ্যত দৃশ্যমান হয়েও হয়ে গেলাম আন্ডারগ্রাউন্ডের একজন অন্ধকার মানুষ।
আলোর চেয়ে অন্ধকারেই বরং আমি পথ দেখতে পাচ্ছিলাম। হিংস্র এক শ্বাপদ জেগেছিল মনের ভিতর। তার ক্ষুধার খাদ্য প্রয়োজন ছিল।শিকার নির্দিষ্ট করেই শিকার শিখতে শুরু করলাম।
একদিন ছোট খালার চিঠি পেলাম। এত গোপনীয়তার পর ও কিভাবে যেন খবর পেয়ে গেছেন। পুরো ঘটনার জন্য খালা খালুকে দায়ী করলেন। এত কিছুর মধ্যে আমার কেমন যেন এক রকম কষ্ট হল খালুর জন্য। এমন দু:সময়েও তার জন্য দু:খ পাওয়ার কেউ নেই। এক সময়ের অর্ধাংগিনীর মনে পর্যন্ত সামান্য সমবেদনা জাগল না তার জন্য!
তারাজ্বলা জ্বালাময় অন্ধকার এক রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে লাভলিকে মনে মনে জিজ্ঞেস করলাম, 'তোমার কষ্টের জন্য কি তুমি আমাকে দায়ী কর! '
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৮৩৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে বাস্তবতা নিয়ে লেখার জন্য
জাজাকাল্লাহু খাইর।
'নদীর একূল ভাংগে তো ওকূল গড়ে'
জীবন নদীও যদি এমন হতো!! এখানে শুধু ভাংগার খেলাই বেশী হয়,গড়া হয় না যেন।
পরিবেশের চাপে কত ভাল মানুষের ভিতরও হিংস্র শ্বাপদ নির্ভয়ে বাসা বাধে!
ভালবাসার সাথে .................???
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন