ভালবাসার সাতকাহন (ধারাবাহিক গল্পঃ শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১২ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:১৭:৩৬ সন্ধ্যা
বরগুনাতে রাশেদুল করীম সাহেব একাকী আয়েশা বেগমকে নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন।
এক সকালে ফেরিওয়ালা আবুল হোসেন তার ভ্যান থামাল রাশেদ সাহেবের বাসার সামনে। আবুল হোসেনের শব্দ শুনে রাশেদুল করিম দরজায় এসে দাঁড়ান। কুশল জানতে চান।
নতুন বউয়ের মত নতুন ভ্যান। আবুল হোসেনের স্বাস্থ্য বেশ ভাল হয়েছে। বুড়োর মুখে সদ্য বিবাহিত যুবকের সলাজ প্রশান্ত হাসি। তার ভ্যানটাতে হরেক রকম মাল।
বড়ই গরীব মানুষ ছিল সে। নিজের বউ, ছেলে এবং ছেলের বউ নিয়ে মোটামুটি কোনোমতে জীবন্ধারণ করছিল। বয়সের কারণে সে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লে এক সময় ফেরি করতেও অক্ষম হয়ে গেল। তার অসহায় অবস্থায় ছেলে বউকে নিয়ে পাশের গ্রামে তার শ্বশুর বাড়ি চলে যায়। আবুল হোসেনের বউও দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। সে চোখে মুখে অন্ধকার দেখে। উপায়ন্তর না দেখে শেষে আবুল হোসেন ভিক্ষা করতে নামে।
কিছুদিন পর অকৃতজ্ঞ ছেলের সিদ্ধান্তকে উপহাস করতেই বোধ হয় আল্লাহ আবুল হোসেনের দিন ফিরিয়ে দেন। এলাকার অল্পবয়সী ছেলেরা চাঁদা তুলে ওকে একটা ভ্যান কিনে দেয়। বেশ কিছু মালপত্রও কিনে দেয়। এক মাসের খাওয়া আর ওষুধ খরচও দেয়। আবুল হোসেন এখন বেশ ভালো আছে। আর সোনায় সোহাগা হিসেবে ১০০ টাকার প্রাইজবন্ডের ড্র হলে, প্রথম পুরষ্কারটি এই আবুল হোসেনই পায়। মোটকথা তার অভাব ঘুচে যায়। তবুও সে ভ্যানে করে মালামাল ফেরি করা বাদ দেয় না।
আজ আবুল হোসেনকে পেয়ে রাশেদুল করীম সাহেব ওর সাথে একটু আলাপ করতে চাইলেন। কথায় কথায় রাশেদুল করিম জানলেন, আবুল হোসেনের ছেলে শ্বশুর বাড়ি থাকাকালীন বিভিন্ন যন্ত্রনায় পড়ে। শালারা তাঁকে দেখতে পারত না, ঐ গ্রামের অন্যরাও তাঁকে নিজ বাবা মায়ের সাথে এরকম খারাপ ব্যবহার করে ঘরজামাই থাকাতে ঘৃণা করা শুরু করে। মোটকথা ওর জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠে। শেষে অনেক চিন্তা ভাবনা করে সে নিজ বাবা-মায়ের কাছেই ফিরে আসে। আর আবুল হোসেন ও তাঁকে মাফ করে দেয়।
এই ঘটনা শুনে রাশেদুল করীম অবাক হন। গভীর চিন্তায় পড়ে যান। আবুল হোসেনকে জিজ্ঞেস করেন, " যে ছেলে তোমার অসহায় অবস্থায় তোমাকে ফেলে চলে গেল, যার জন্য তোমাকে ভিক্ষা করতে হয়েছে, তাঁকে মাফ করে দিলে?!! "
জবাবে আবুল হোসেন বলে, " হাজার হোক মোর ছেলে তো! মুই বাপ ওর। ও ভুল করতে পারে, তাই বলে কি মুই মাফ করবার পারুম না?' তাইলে ওর আর মোর মাঝে ফারাকটা রইলো কই? ... মুই তো একজন বাপ...”
ভ্যান নিয়ে আবুল হোসেন চলে যায়। তার অপসৃয়মান পিছনটা কেন জানি আজ রাশেদুল করীমের কাছে বেশ দীর্ঘ লাগে। সে কি একজন বাবার মহত্বের জন্য? বাবার ভালবাসার জন্য? সন্তানকে ক্ষমা করে সর্গীয় সুখ লাভের জন্য?
রাশেদুল করীম সাহেবের চিন্তায় আবুল হোসেনের শেষ কথাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে, " তাইলে ওর আর মোর মাঝে ফারাকটা রইলো কই? ... মুই তো একজন বাপ...”
চকিতে নিজের মনে বেজে উঠে, আমিও তো একজন বাবা... কিন্তু আমি এতোদিন ক করছি? মুহুর্তে একজন বাবা নিজের ভিতরে ফিরে আসেন। রাশেদুল করীম সাহেবের এতোদিনের জেদ, রাগ সব নিজের হৃদয়ে লুক্কায়িত অফুরন্ত ভালবাসার স্রোতে ভেসে যায়। রায়হানের প্রতি সেই পুরনো ভালোবাসা অনুভব করেন।
নিজের রুমে ফিরে এসে আয়েশা বেগমকে সব বলেন। আয়েশা বেগম মোবাইলটা বের করে রাশেদুল করীম সাহেবকে বলেন,
: কথা বলো ওর সাথে।
কেমন বোকার মত আয়েশা বেগমের দিকে চেয়ে থাকেন কিছু সময়। নিজেকে নিজের ভিতরে ফিরে পেলেও ধাতস্থ হতে একটু সময় নেন। আয়েশা বেগমের হাত থেকে মোবাইল্টি নিজের হাতে নেন। ফোনবুকে সযতনে সেভ করা একটি গোপন নাম্বার পর্দা উন্মোচন করে প্রকাশ্যে বের হয়ে আসে।
রায়হানের মোবাইলে আজ দশ বছর পরে কম্পিত হাতে বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে ফোন করেন। রিঙ বাজতে থাকে। সুদূর মফঃস্বল শহর থেকে এক অভিমানী বাবার ফোন! ইথারে অদৃশ্য ভাবে ভালোবাসাসহ কয়েক শো মাইল দূরে নিজের দ্বিতীয় স্বত্বার কাছে হৃদয়ের প্রগলভ অনুভূতিটুকু পৌঁছাবার অপেক্ষায় থাকে...
রায়হান তখন নিজের মাশরুমের ঘরের মাচায় বসে ছিল। এমন সময় মোবাইলে ফোন আসে। খুবপরিচিত নাম্বারটি যা ওর হৃদয়ে বসে ছিল, আজ এতোগুলো বছর পরে নিজের মোবাইলের ডিসপ্লেতে দেখে সে অভিভূত হয়! হার্টের বীট মিস করে! অনুভূতির দূর্বোধ্য কিছু কম্পনে অপ্রতিরোধ্য উচ্ছাসে সে ভেসে যেতে থাকে। বাবার ফোন! একি ভুলে আসলো? চাপ লেগে কি রিঙ পড়ছে? তাই-বা কি করে হয়? এতোগুলো বছর যখন এরকম হয় নি আজ কিভাবে ভুলে রিঙ হবে? দুরু দুরু বুকে কল রিসিভ করে... গলা থেকে শব্দ বের হতে চায়না। তবুও বলে, 'হ্যালো"। ওপাশ থেকে জনকের সেই চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়... 'রায়হান!'
আহ! কি শান্তি!
একটি কণ্ঠস্বরে যে এতো মধু, ভালোলাগা থাকতে পারে, রায়হানের সেটা জানা ছিল না। সে, 'বাবা!' বলে কেঁদে উঠে। শিশুর মতো চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। চোখের দু'পাশ বেয়ে পানি গড়িয়ে ওর বুক ভিজিয়ে দেয়। ওদিকে রাশেদুল করীম সাহেবের চোখও অশ্রুসজল হয়ে উঠে। পাশে থাকা আয়েশা বেগম তাঁকে দেখেন। রাশেদুল করীমের প্রগলভ অবস্থা দেখে তিনিও আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। রাশেদুল করীম সাহেব বলেন,
: আমি আসছি বাবা। কাদিস না।
এটুকুই বলতে পারেন। এরপর তিনিও নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আয়েশা বেগমও কাঁদতে থাকেন। তবে এই কান্না আনন্দের। একজন অভিমানী বাবা আর রুষ্ট সন্তানের আজকের এই মিলনমেলায় তিনিই একমাত্র সাক্ষী। রায়হানের হাত থেকে মোবাইল মাচার মেঝেতে পড়ে থাকে। সে দীর্ঘক্ষণ মাথা নীচু করে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে।
মিতু কি কাজে যেন ওর পাপার কাছে এসেছিল। সে পাপাকে এভাবে কাঁদতে দেখে এক নি:শ্বাসে দৌড়ে রুমার কাছে ছুটে যায়, ' পাপা কাঁদছে! পাপা কাঁদছে! '
রুমা কি জানি কি হয়েছে ভেবে দ্রুত মাশরুমের ঘরে আসে। এই প্রথম সে এখানে এলো। এই মুহুর্তে এখানে আসার সকল নিষেধাজ্ঞা সে ভুলে যায়। বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে মাচায় উঠে। মাথা নিচু করে থাকা রায়হানকে স্পর্শ করে। জিজ্ঞেস করে, ' কি হয়েছে?' বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে রায়হান শুধু বলতে পারে, ' বাবা... আসছে!' রুমাও অবাক হয়। প্রথমে অবাক... এরপর ভালোলাগা এবং সর্বশেষে একটা বিজয়ের অনুভূতি ওর মনে জেগে উঠে। সেও মনে মনে চাইছিল নিজেদের ভুলগুলোর সমাপ্তি হোক। জীবনকে নতুনভাবে শুরু করুক রায়হান। ভিতরে ভিতরে রায়হানের একেবারে শেষ হয়ে যাওয়াটা রুমা সহ্য করতে পারছিল না।
একটা বাঁশের মাচার মেঝেতে দাঁড়িয়ে এক দম্পতি নিজেদের একমাত্র কন্যাকে নিয়ে এক হয়ে থাকে। ভালোলাগার অনুভূতিতে তারা পুর্ণ হয়ে আছে।
... ... ...
শেষ দৃশ্য...
জাহাঙ্গীরনগর প্রান্তিক গেইট।
রায়হান আর শাহেদ অপেক্ষা করছে। সাথে শিহাব। এখানেই বাস থেকে নামবেন রাশেদুল করীম ও আয়েশা বেগম।
রায়হান আর শাহেদের দিকে তাকিয়ে শিহাবের অদ্ভুত একটা অনুভুতি হল। মনে হল পৃথিবীর সব ছেলে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে তাদের স্নেহময় বাবার বাস থেকে নামার অপেক্ষা করছে - স্পর্শের শান্তির জন্য!
বাবার আলিংগনে রায়হানের কেমন লাগল তা কি সে বাকি সারা জীবনেও বলে বোঝাতে পারবে?
.....
শেষ কথাঃ
এই উপন্যাসে কয়েকটি পরিবারকে দেখালাম। লতা তার নিজের জীবনে ফিরে গেছে। সুখের দেখা না পেলেও সে শান্তিতেই আছে। লেখক মিনার মাহমুদ তার মা বাবা এবং রেখাকে সহ পালিত কন্যাকে নিয়ে ভালোই আছে। শিহাব ও কণা দুই মেয়ের সাথে বেশ আছে। শাহেদ ও বিথী নিজেদেরকে নিজেদের মাঝে ফিরিয়ে এনেছে। আর রায়হানতো হাতে স্বর্গই পেলো বাবাকে কাছে পেয়ে। তবে এই প্রশান্তির জন্য তাঁরা নিজেদের জীবনকে পজিটিভলি দেখার চেষ্টা করেছে। এভাবে আমরা আমাদের কাছের সম্পর্কগুলোকে একটু যত্ন করে, নিজেরা সকল জেদ ভুলে গিয়ে একটু যদি কাছে আসার চেষ্টা করি, তবে ভালোবাসায় কানায় কানায় পুর্ণ হয়ে উঠবে আমাদের পরিবারগুলো। এক একটি পরিবার যখন শান্তিতে থাকবে, তখন একটু একটু করে সমগ্র দেশ ও জাতিও শান্তিতে থাকতে পারবে। তাই আসুন সবাই এক সাথে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করি। সেজন্য প্রয়োজনে নিজেদেরকে একটু ছোট করে হলেও... নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে রেখে হলেও প্রিয়জনের কাছে একটু এগিয়ে যাই। সে রুষ্ট হয়েছে বলে কি আমি তার রাগ ভাঙ্গাতে আগাতে পারি না?
ধন্যবাদ।
ভালোবাসার সাতকাহন এখানেই শেষ।
ভালোবাসা অশেষ।
সবার জীবন ভালোবাসায় পূর্ণ হোক। শান্তিময় হোক।
(শেষ)
বিষয়: সাহিত্য
১১৩৮ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া ভাইয়া। অসাধারণ পর্বটির সমাপ্তি সত্যিই দারুণ এবং উপভোগ্য। লিখাটি পড়ে অনুভূতিতে এবারও প্রচণ্ড নাড়া পড়লো। আল্লাহ্ পাক আপনার কলমকে আরও শাণিত করুণ। জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার উৎসাহপুর্ণ এবং আবেগী মন্তব্যে আমি অভিভূত আপু!
আপনার দোয়ায় আমীন।
বারাকাল্লাহু ফীহ।
জাজাকাল্লাহু খাইর
বারাকাল্লাহু ফীহ।
আবারও নতুন কোন গল্পের নতুন ইপিসোডের অপেক্ষায় রইলাম।
আপনার মত উঁচু মানের একজন সাহিত্যিকের কাছ থেকে যে কোনো লিখার ব্যাপারে যে কোনো কিছু নিসঙ্কোচে জানানোর জন্য অনুরোধ করলাম।
অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
কী যে বলেন না মামুন ভাই? এভাবে লজ্জা দেওয়ার কি দরকার ভাই? আমি কোনকালে কোন লেখকের খাতাতে নিজেকেই ধরিনা, আর আপনি বলছেন আমি উঁচু মানের সাহিত্যিক। লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার দসা প্রায়। আপনাদের দেখে, আপনাদের অনুপ্রেরণায় ব্লগে টুকটাক লিখি। সময় কাটে আর কী।
আপনার গল্প আমার অনেক ভালো লেগেছে। কিছু ব্যাথা দিয়েচ্ছে ছোট ছোট ঘটনা। পাঠক মন বা মানব মন তো এগুলো এড়াতে চাইবেই। কিন্তু এসব না থাকলে কি আর গল্পের পূর্ণতা আসে? তাই বলেছিলাম লেখক যেভাবে লিখবেন সেভাবেই গল্পের সার্থকতা।
দুয়া করবেন ভাই। আর নতুন গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।
লিখতে লিখতে হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম। এইটি-ই একমাত্র লিখা, যেখানে আমি প্রতিদিন ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পাই নাই। তাই শেষ করে নতুন কিছু লিখার জন্ম দিবার ইচ্ছেটা মনে জন্মেছিল।
আপনার সুন্দর অনুভূতির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
"'ভালবাসার সাত কাহন'এখানেই শেষ!
ভালবাসা অশেষ!
সবার জীবন ভালবাসায় পুর্ণ হোক!শান্তিময় হোক!"
সবগুলো পর্বই পড়েছি!বিক্ষিপ্ত সম্পর্কহীন দু'এক শব্দ মন্তব্যের ঘরেও জমা হয়েছে!
কিন্তু আজ........!!!
অব্যক্ত অবর্ণনীয় কিছু অনুভূতি উপলব্ধিতার প্রকাশ কে আটকে আটকে দিচ্ছে যেন!
.........................
.........................
..........................।
সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
বারাকাল্লাহু ফীহ।
আপনার শুভকামনা করছি।
সবার জীবন ভালোবাসায় পূর্ণ হোক। শান্তিময় হোক।- সবার ভিতরে আপনি এবং আমিও রয়েছি, তাই আপনার দোয়ায় আমীন।
শুভেচ্ছা আপনার জন্যও নিরন্তর।
আর আর মস্তিস্কের দরজা খুলে লিখতে থাকুন আপনার মেধার প্রকাশ করুন......সবসময়!
সার্বিক কল্যানের প্রার্থনা আপনার জন্য!
আপনার কামনাগুলো বাস্তবে রুপ লাভ করুক-আমীন।
আপনার প্রার্থনায় আমীন।
শুভকামনা আপনার জন্যও রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন