রশিদের ব্যাটারিচালিত স্বপ্ন (ছোট গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৫ অক্টোবর, ২০১৪, ০৮:৩৫:৪৯ রাত
রশিদ হাইওয়ের নির্দিষ্ট একটি যায়গায় অবস্থান নিয়েছে।
অপেক্ষা করছে। ওর শিকারের আসার অপেক্ষায়। রশীদ ওর ব্যাটারি চালিত রিক্সায় বসে হাইওয়ের অপর পাশে শকুনের দৃষ্টি নিয়ে রাস্তার শেষ মাথায় তাকিয়ে আছে। এই পথ দিয়েই আসবে সে। তবে রশিদ রয়েছে এখন রাস্তার অপর সাইডে। তাতে কোনো সমস্যা নেই। সে যেখানে রয়েছে, তার সোজাসুজি রাস্তার ডিভাইডার বেশ খানিকটা ফাঁকা। দুই রাস্তার সংযোগস্থল। এখান দিয়েই সে তার রিক্সাটি নিয়ে ওর শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
একজন ভিআইপি শিকার। যে কিনা সামনে পিছনে পুলিশের গাড়ি নিয়ে নিজে বিলাসবহুল বুলেটপ্রুফ গাড়িতে বসা থাকবে। সামান্য একটি ব্যাটারি চালিত রিক্সা নিয়ে রশিদ প্রচন্ড গতিতে ধেয়ে আসা সেই গাড়িতে বসে থাকা একজন মন্ত্রীকে টক্কর দিতে চাচ্ছে! পাগল না হলে কেউ এমন চিন্তা করে?
হ্যা, রশিদ আসলেই পাগল হয়ে গেছে। চারপাশের সবকিছু মিলিয়েই পরিস্থিতি ওকে পাগল করে দিয়েছে। সে বুকের ভিতরে একটা প্রচন্ড ক্ষোভকে তিল তিল করে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আজ সেটার বিস্ফোরণ ঘটাবে বলেই এখানে অপেক্ষা করছে। সে জানে ধাক্কার প্রথম চোটেই সে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে। তবে আজ সে নিজেকে শেষ করে দিতেই এসেছে। একটা প্রতিবাদ... ছিন্নমূল এক মানুষের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের করাপ্টেড সিষ্টেমের বিরুদ্ধে... শোষিতের সংগ্রাম শোষকের বিরুদ্ধে।
বাতাসে হুইসেলের শব্দ ভেসে আসে... চমকে উঠে রশিদ। বার কয়েক চোখের পাতা ফেলে দৃষ্টিকে ধারালো করে নিয়ে রাস্তার শেষ প্রান্তে তাকায়। হ্যা, পুলিশের গাড়ির খোলা জীপের উপরে কয়েকটি মাথা দেখা যাচ্ছে। প্রথম গাড়িটাকে দেখা যেতেই রশীদ রিক্সার ইঞ্জিন চালু করে... একই সাথে হৃদয়ের ভিতরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সমেত অন্য আর এক ইঞ্জিনও নিমিষে চালু হয়। তীরের ফলা সামনে এগিয়ে যাবার জন্য যেভাবে প্রথমে একটু পিছিয়ে আসে, রশিদও রিক্সাটিকে একটু ব্যাক করে পিছিয়ে নিয়ে যায়... প্রচন্ড একটা গতি লাভের জন্য ওর প্রয়োজনীয় স্পেসটুকু এবং রাস্তার ডিভাইডার পর্যন্ত এসে ডানে বাঁক নিতে নিতেই ওর শিকারের গাড়িকেও একই সময়ে সেখানে পাওয়া... সবকিছুর চুলচেরা হিসেব করেই সে ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছে। একজন অতি সাধারন মানুষ নিজেকে এক আগুনের গোলায় পরিণত করছে... । রশিদ একই সাথে নিজের কিছু দিন আগের কথা স্মরণ করে... কেন ওকে এই পথে আসতে হল সেটা ভাবে... দাঁতে দাঁত পিষে চলে... এক পর্যায়ে দুই মাড়ি ব্যথা হয়ে যায়। স্থির নিষ্পলক দৃষ্টি সামনে... মন অতীতে... ... ... ...
তিন মেয়ে আর এক ছেলে।
ছেলেটি বড়। স্কুলে দিলে এখন এইটে পড়ত। মেয়েরা একজন আর একজনের থেকে দু'বছরের ছোট-বড়। রশিদ তখন টঙ্গীতে একটা বস্তিতে থাকে। সারাদিন রিক্সা চালায়। অনেক সময় রাতেও চালায়। ছেলেটাকে নিয়ে কি করবে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ভিতরেও রশিদ ভেবে ভেবে উদাস হয়ে যায়। বউটা মানুষের বাসায় কাজ করে। বাচ্চাগুলো মায়ের ভীষণ ন্যাওটা। সকাল বেলা লাইন দিয়ে মায়ের পিছু পিছু রওয়ানা হয়। বড় মেয়েটি বাকি তিনজনকে সামলায়। সে নিজেই শিশু হয়েও বাকি দুজনকে দেখে শুনে রাখতে গিয়ে কীভাবে যেন বড় হয়ে গেছে। জোবেদা যে বাসায় কাজ করে, সেই বাসার সিঁড়িতে মেয়েগুলো খেলা করে। এটা নিয়েও জোবেদাকে অনেক কথা শুনতে হয়। একেবারে ছোট মেয়েটি যখন-তখন হিসি করে দেয়। সাথে সাথে পরিষ্কার না করলে এ জন্য আশেপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা যাওয়া-আসার পথে চেঁচামেচি করে। বাড়িওয়ালি জোবেদাকে অনেক বার মেয়েদেরকে নিয়ে আসতে নিষেধ করেছে। কিন্তু বললেই তো আর ওদেরকে রেখে আসতে পারে না। কাজের মানুষও এখন পাওয়াটা খুব টাফ। এজন্য বাড়িওয়ালিও বেশী জোর করে না।
ছেলেটা বস্তির অন্য ছেলেদের সাথে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গীরা সব এক একটা বিচ্ছু... ধীরে ধীরে অপরাধ জগতের সাথে পরিচয় হতে শুরু করেছে। বিড়ি খাওয়া শুরু করেছে। রশিদ দু'দিন দেখেছে। প্রচন্ড মার দিলেও সে জানে, একবার যখন এই নেশার স্বাদ পেয়েছে সহজে ছাড়বে না। মনে মনে এই বস্তি ছাড়ার চিন্তা করে রশিদ। কিন্ত চাইলেই তো আর যাওয়া যায় না। কোথায় যাবে সে? রিক্সা চালিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেই তো আর এক বস্তিতে গিয়েই উঠতে হবে। এখন এক রুমের একটি ঘর নিয়ে থাকে সবাই মিলে। নোংরা পরিবেশ...ভিতরে ভিতরে সিটিয়ে থাকে রশিদ। ভাগ্যের ফেরে সে আজ ঢাকায়। নাহলে নিজের জমি-জমা নিয়ে ভালোই তো ছিল। নদী ভাঙ্গনে এক রাতে সব শেষ। এরপর একমাত্র ছেলেকে সাথে নিয়ে পেটের দায়ে ওরা স্বামী-স্ত্রী শহরে আসতে বাধ্য হয়। সেই যে এসেছে... এই শহর ওকে গিলে খেয়েছে। কীভাবে সময় যে চলে যায়...
জোবেদা যে বাসায় কাজ করে সে বাসার মানুষটার নজর খুব খারাপ। জোবেদাই ওকে বলেছে। দুজনে সারাদিন পরিশ্রমের পরে ছেলে-মেয়েগুলো ঘুমালে যে একান্ত সময়টুকু পায়- বস্তির একটা পুতি-দুর্গন্ধময় ঘরে তখন যেন স্বর্গ নেমে আসে! নিজেদের হৃদয়ে ধারণ করা ভালবাসার সুরভি দিয়ে সকল দুর্গন্ধকে হটিয়ে দেয়... একে অপরের কাছে আসার দ্বারা সারাদিনের শারীরিক কষ্ট ও মানসিক দৈন্যতা মুহুর্তে দূর হয়। একান্ত এই সময়ে জোবেদা ওকে অনেক কিছু জানায়। নিজের অন্তরে লালন করা কিছু টুকরো টুকরো স্বপ্নের কথা বলে... আনন্দ-মধুর কিছু স্মৃতিকে ঘিরে এখনকার পরিবর্তিত পরিবেশে বেদনা-বিধুর মুহুর্তকে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এক নারীর অসহায়ত্ব অনুভব করে রশিদ কষ্ট পায়। বেদনায় নীল হয়... তারপর জোবেদার ভালবাসার বাঁধ ভাঙা জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে দিতে নিজের ভিতরেও কিছু স্বপ্নকে লালন করে।
গরিবি হালত মানুষের ভিতর থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নেয়। প্রতিটি মানুষের ভিতরে দয়া-মায়া কিছু না কিছু থাকে। কিন্তু গরীবদের যেন এই মায়া থাকতে নেই। রিক্সা নিয়ে প্রতিদিন মেয়েদেরকে সহ জোবেদাকে ওর কাজের যায়গায় পৌঁছে দেয় রশিদ। যাবার সময় মেয়েরা খাবারের বিভিন্ন দোকান দেখে সেগুলোর জন্য বায়না ধরে। আইসক্রিমের দোকানের পাশ দিয়ে আইস্ক্রীম হাতে নিয়ে বের হওয়া অন্য ছেলেমেয়েদের দেখে ওরাও অসহায় হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকায়। ছোট মেয়েটি তো বাবাকে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে কিনে দিতে। কিন্তু অতি হিসেবের সংসারে সামান্য রকমের বিলাসিতা করারও যে জো নেই। জোবেদা ও রশিদ মনে মনে অসহনীয় চাপা ব্যথা নিয়ে নিরন্তর কষ্ট পেতে থাকে। আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে চেয়ে থেকে সামান্য কিছু স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে। যে যত গরিব, তার স্বপ্নও ততোধিক গরীব। আশাগুলো কেন জানি দীর্ঘায়িত হতে চায় না।
ওরা দুজনে এতো হিসেবের ভিতর থেকেও কিছু কিছু টাকা প্রতি মাসে জমাতে থাকে। একটা একাউন্ট করেছে রশিদ। সেখানে জমায়। ওর ইচ্ছে নিজের একটা রিক্সা হবে। তখন স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনকে চালিয়ে নিতে পারবে। মোটকথা অপরের রিক্সা চালানোর ভিতরে একটা প্রচ্ছন্ন গোলামীর পাট্টা গলায় বাঁধাই থাকে। তাই জোবেদার সাথে পরামর্শ করে এই রিক্সা কেনার ব্যাপারেই একমত হয়। এখন রাতের বেলায়ও রশিদ রিক্সা চালায়... সারা রাত না। তবে সারাদিনের পরে আরো চার- পাঁচ ঘন্টা রিক্সা চালানোতে কিছু টাকা এলেও শরীরের ক্ষতি হতে থাকে। দিনে দিনে রশিদ ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যায়। একদিন রিক্সা চালাতে চালাতে অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাস্তায় পড়ে থাকে। লোকজন ধরাধরি করে কাছের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়।
অক্লান্ত পরিশ্রমের দরুন রশিদের যক্ষ্ণা ধরা পড়ে। অবশ্য এই রোগ এখন নিরাময়যোগ্য। একটু সুচিকিৎসার দ্বারাই এটা ভালো করা যায়। তবে রশিদের মতো প্রতিদিনের আয়ের উপর নির্ভরশীল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম কারো পক্ষে বসে বসে চিকিৎসা করানোটা যে কল্পনাতীত, তা রশিদের চেয়ে ভালো আর কে জানে। ডাক্তার টোটালি বেড রেস্ট দিয়ে দিলো। জোবেদা সব শুনে মনকে শক্ত করে। রশিদকে আশ্বাস দেয়। রশিদের চিকিৎসা শুরু হয়।
একজোড়া দম্পতি নিজেদের লালিত স্বপ্নকে সাকার করতে যে টাকাগুলো জমিয়েছিল, এখন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সেগুলো খরচ করতে হয়। ধীরে ধীরে রশিদ সেরে উঠে। তবে রিক্সা চালানোর মতো পরিশ্রমের কাজ আপাতত সে করতে পারবে না। ছেলে বাবুলকে সাথে নিয়ে তাই বস্তির ঘরটিতে বসে বসে ঠোঙ্গা বানানোর কাজ শুরু করে। ছেলে-মেয়েগুলো এখন বাবাকে সারাদিন কাছে পায়। ওরা মায়ের সাথে এখন আর যেতে চায় না। মেয়েরাও ঠোঙ্গা বানানোর কাজে রশিদকে সাহায্য করে। কিন্তু এভাবে ঘরে বসে বসে রশীদের দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। জোবেদা সারাদিন বাইরে থাকে। দুপুরে একবার আসে। ওদেরকে খাইয়ে আবার চলে যায়। এখন আরো একটা বাসায় কাজ নিয়েছে। সন্ধ্যার পরে সে আসে। তখন ছয় জনের এই পরিবারটি রাতের খাবার এক সাথে খায়। প্রতিদিনই যেন ওদের ভিতর ঈদের আনন্দ বিরাজ করে। লোড শেডিং তো নিত্যকার ব্যাপার। তাই অন্ধকারে মোমবাতির আলোতে রশিদেরও যেন 'ক্যাণ্ডল লিট ডিনার'... তাও প্রতিদিন!
একটা বছর এভাবে কাটায় রশিদ। আবারো দুজনের আয়ে বেশ কিছু টাকা জমে যায়। শরীরের অবস্থাও আগের থেকে অনেকটা ভালো। একদিন জোবেদার সাথে গভীর রাতে রশিদ আর একবার আলোচনায় বসে। সে আবারও রিক্সা চালাতে চায়। জোবেদা আৎকে উঠে। কিন্তু রশিদ হেসে ওকে আশ্বস্ত করে। এই রিক্সা গায়ের জোরে চালাতে হবে না। ব্যাটারিতে চলবে। ততোটা পরিশ্রম হবে না। আর এই এক বছরে শরীরে অনেক শক্তি ফিরে পেয়েছে। অনেক বুঝিয়ে শেষে জোবেদাকে রাজী করাতে পারে রশিদ।
কিন্তু টাকা লাগবে অনেক। পঞ্চান্ন হাজার টাকার মত লাগবে। কিনবে যখন ভালোটাই কিনুক। এতো টাকা কোথায় পাবে? জোবেদা দিশেহারা বোধ করে। ওদের জমানো সব মিলে রয়েছে পনের হাজারের মত। বাকি চল্লিশ হাজার কোথা থেকে জোগাড় করবে?
রশিদ ও জোবেদা পুরো একটা দিন অনেক ভাবে। জোবেদা যে বাসায় কাজ করে সেখানের মালকিনকে ব্যাপারটা জানায়। মহিলা অন্যদের তুলনায় ভালো। তবে এক কথায় বাসার কাজের মহিলাকে চল্লিশ হাজার টাকা ধার দেবার মতো অতোটা ভালো নয়। সে তার পরিচিত একটা সমিতি থেকে টাকা লোন নেবার কথা বলে। এখানে আগে রশিদ এবং জোবেদাকে মেম্বার হতে বলে। দুজনে মেম্বার হয়ে কয়েকটি কিস্তি দিলে সেখানের নিয়মিত সদস্যতে পরিণত হবে। তারপর না হয় বাড়িওয়ালি নিজে গ্যারান্টার হয়ে ওদেরকে প্রয়োজনীয় টাকাটা নিতে সাহায্য করবেন। খুশী হয়ে জোবেদা বাসায় ফিরে।
রাতে রশিদকে সব জানায়। রশিদও পরেরদিন জোবেদাকে সাথে নিয়ে সেই সমিতিতে গিয়ে প্রাথমিক সদস্য হয়। মনের গভীরে একটা আশা নিয়ে ওরা দুজন আরো তিনটি মাস পার করে। এরপর আসে সেই শুভক্ষণ।
জোবেদার বাড়িওয়ালি মহিলা নিজে গ্যারান্টার হয়ে সমিতি থেকে টাকা তুলে দেন।
সেই টাকায় সুন্দর দেখে একটা ব্যাটারিচালিত রিক্সা বানায় রশিদ।
একটা স্বপ্ন পূরনের দিকে অর্ধেক আগায় নদী-ভাঙ্গন থেকে ফিরে আসা একটা পরিবার।
প্রতিদিন প্রায় হাজার খানেক টাকা আয় করে রশিদ। সমিতির টাকাটা শোধ দেবার জন্য সেখান থেকে বেশীরভাগই জমায়। এক একটি দিন, রশিদের মনের লুক্কায়িত কিছু আশার প্রদীপে ধীরে ধীরে আলো জ্বেলে দিয়ে যায়। পুরনো বস্তির ঘরটি ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো যায়গায় রশিদ দুই রুমের একটা টিনশেড বাসা ভাড়া নেয়। এখানের পরিবেশ আগের যায়গার থেকে অনেকটা ভালো। ছেলে বাবুলকে পাশের স্কুলে ভর্তি করে দিবে আগামী মাসে। মেয়েদেরকেও স্কুলে পাঠাবে। আর জোবেদার বাসার কাজ এখন না করলেও চলবে। তবে দুই বাসায় না করে ওদেরকে সাহায্য করেছেন যে মহিলা, আপাতত তার বাসায়-ই কাজ করুক এটা রশিদ মনে মনে ভাবে। ওকে অনেক ভাবে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে জোবেদা। দুঃসময়ে সে শক্ত হাতে ওর সংসারটা ধরে রেখেছে... ভেঙে পড়েনি বা রশিদকেও ভেসে যেতে দেয়নি।
সব কিছুই রশিদের মনের গোপন ছক অনুযায়ী চলছিল। কিন্ত হঠাৎ করেই রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিক্সার চলাচলের উপরে বিধিনিষেধ জারি করা হল। বিনা মেঘে ব্জ্রপাতের মত অকূলপাথারে পড়ে গেলো যেন রশিদ! একটা মাসও চালাতে পারলো না সে নতুন রিক্সাটি। অনেক দূরে দূরে গিয়ে অবশ্য চোরের মত চালানো যায়। ট্রাফিক পুলিশকে সেজন্য এক্সট্রা টাকা দিতে হয়। তবে আজীবন সে সৎ থেকে জীবিকা নির্বাহ করেছে। কখনো কারো কাছে হাত পাতেনি বা কারো হক মেরে খায়নি। এখন সুন্দর ভাবে জীবনটা কেবলই শুরু করেছে... শুরু না হতেই শেষ হয়ে যাবে! যদি রাজধানীতে এই রিক্সা চালানো যাবেই না তবে শুরুর দিকে চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছিল কেন? লাইসেন্স কেন দেয়া হলো?
আবারও সেই পুঁতি-গন্ধময় বস্তির এক নির্জন কক্ষে বসে বসে ছেলেমেয়েদেরকে সাথে নিয়ে ঠোঙ্গা বানাতে হবে? ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তি করা হবে না... মেয়েদেরকে সেই সিঁড়ির নীচে অলস সময় পার করে করে বড় হতে হবে... জোবেদার সারা জীবনটাই কাটবে বাসায় কাজ করে করে... কোনো পরপুরুষের নির্লজ্জ কামুক দৃষ্টির আঘাতে ওকে বার বার মরতে হবে... প্রতিদিন নতুন ভাবে আসবে এক একটি মৃত্যু! কিন্তু কেন?
কেন রশিদ ওর অন্তরের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবে না? এখন সে চাইলেও আগের মতো গতরের শক্তি খাটিয়ে সাধারণ রিক্সা চালাতে পারবে না। আর এই রিক্সার কিস্তি কীভাবে জমা দিবে?
প্রচন্ড এক ক্রোধে নতুন বাসায় বসে বসে ভাবে রশিদ। জোবেদাকে সব জানায়। জোবেদা ওকে সান্ত্বনা দেয়। অপেক্ষা করতে বলে। নিশ্চয়ই ভালো একটা কিছু হবেই। ভিতরে ভিতরে একটা চরম সিদ্ধান্ত নেয় রশিদ। আত্মহননের এক পৈশাচিক উল্লাস ওর ভিতরে থেকে থেকে নাড়া দিয়ে যায়। আগামীকাল ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের দিনে একজন রশিদের পরাজয়ে কি-ইবা আসে যায়?
... ... ... ...
ব্যাটারি চালিত রিক্সার পুর্ণ গতি নিয়ে নিজেকে ধ্বংস করার জন্য রশিদ ওর প্ল্যান অনুযায়ী সেই বাঁকের কাছে পৌঁছায়... ওদিক থেকে পুলিশের প্রথম গাড়িটি ডিভাইডার ক্রস করল এই মাত্র... সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া সরকারের এই প্রভাবশালী মন্ত্রীকে বহন করা গাড়িটি এখনই রশিদকে ক্রস করবে। কিছু করতে হলে এখনই যা করার...
প্রচন্ড একটা আক্রোশে চীৎকার করে উঠে রশিদ নিজেকে থামিয়ে ফেলে শেষ মুহুর্তে! আর মাত্র একটা মুহুর্ত দেরী হলেই সে নিজের স্বপ্ন সহ মন্ত্রীর গাড়ির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু একজন রশিদের ভিতরে ঠিক ঐ মুহুর্তে একজন বাবা আত্মপ্রকাশ করে ওকে থামিয়ে দেয়। নিজের বুকের গভীরে কিছু জমানো স্বপ্নকে সাকার করতে না পারার ক্ষোভে সে এই মুহুর্তে যা করতে যাচ্ছিল, তাতে করে ওর পুরো পরিবারটি-ই শেষ হয়ে যেত। একা জোবেদার পক্ষে চার সন্তানকে আগলে রাখাটা ভীষণ কষ্টকর হতো। এক একটি মেয়েকে হয়তো এক একজনের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতে হতো। ছেলেটা বস্তির অন্য ছেলেদের সাথে মিশে অপরাধ জগতের নোংরা জীবনে প্রবেশ করতো।
শেষ সময়ে ওকে ক্রস করে যাওয়া গাড়ির জানালার ভিতর দিয়ে রশিদের সাথে সেই প্রভাবশালীর চোখে চোখ পড়ে। একটা প্রবল ঘৃনায় রশিদ তার চোখে চোখ রেখে এক দলা থুতু কালো পীচ ঢালা রাস্তায় ফেলে। রশিদের বুকের গভীর থেকে জমাট বাঁধা ঘৃনাকে চোখে ধারণ করে সেই মন্ত্রী তার গাড়িসমেত সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এদেরকে কোনো ধরণের লাজ-লজ্জা বা ঘৃণা এখন আর বিব্রত করতে পারে না।
রশিদ ফিরে আসে।
জীবনটা অনেক বড়।
এতো সহজেই তাকে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না।
আশাকে শেষ হতে দেয়া যাবে না। আশাই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। একটি স্বপ্ন কিন্তু একটা আশা নয়। অনেকগুলো স্বপ্ন মিলে আশার জন্ম হয়। তাই স্বপ্নরা হারিয়ে যায় যাক- আশা তাদেরকে আবার ফিরিয়ে আনবে।
জীবনের মত এই দুনিয়াটাও অনেক বিশাল। সেখানে রশিদের মত লোকেদের বেঁচে থাকার একটা না একটা উপায় ঠিকই বের হয়ে আসে।
একটা ব্যাটারি চালিত স্বপ্ন আপাতত শেষ হয়ে যাওয়াতে একজন রশিদ সাময়িক বিব্রত হতে পারে ঠিকই। কিন্তু নিজেকে একেবারে শেষ করে দেওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হতো?
আরো কিছু ছোট ছোট স্বপ্নকে বুকে নিয়ে রশিদ ওর ব্যাটারি চালিত রিক্সাটা নিয়ে গ্যারেজের দিকে আগায়। এবারে একজন বাবা জীবনের পথে ফিরে আসে। এত সহজে কিন্তু স্বপ্নরা এইবার হারাতে পারবে না।।
(শেষ)
বিষয়: সাহিত্য
৯০২ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার দোয়ায় আমীন।
সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
একজন বাবা জীবনের পথে ফিরে আসে। এত সহজে কিন্তু স্বপ্নরা এইবার হারাতে পারবে না।।
আমার খুব খুশী লাগছে-
জাযাকাল্লাহ...
আল্লাহতায়ালা আপনার পরিবারটিকে কবুল করুন (আমীন)
আপনার খুশী লাগার অনুভূতিতে আমিও আনন্দিত হলাম।
আপনার দোয়ায় আমীন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
সহমত
শুভেচ্ছা রইলো নিরন্তর।
ভালোলাগারা যেন আপনার থেকে কখনো দূরে সরে না যায়।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ধন্যবাদ আপনাকে সাথে থাকার জন্য।
বারাকাল্লাহু ফিক।
অনুভূতির তীব্রতা 'রশিদের' মত আমাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে অসাধারণ এমন লেখনী।
জাযাকাল্লাহু খাইরান মামুন ভাই......
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন