ওজনে কম-বেশ করা একটি জঘন্য অপরাধ
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৪ অক্টোবর, ২০১৪, ১২:০৫:০০ দুপুর
তিনটি রাস্তা তিন দিকে সাপের মত এঁকেবেঁকে আরো কিছু শাখা প্রশাখা ছড়ালেও এই মোড়টিতে এসে একসাথে মিলেছে। এখানেই গড়ে উঠেছে বাজারটি। কয়েকটি ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর, কিছু মুদি দোকান, ইলেকট্রনিক্স এবং ইলেক্ট্রিকের সাজসরঞ্জামের দোকান, সেলুন আর ডিসপেনসারি পাশাপাশি রয়েছে। একটু দূরে কাঁচাবাজারটিও বেশ জমজমাট। তবে একজানে নেই কোনো কসাইয়ের দোকান। সেজন্য এলাকাবাসীকে মেইন রোডের দিকে বড় বাজারটিতে যেতে হয়। তারপরও এই ছোট বাজারটি সবার প্রতিদিনের চাহিদা মেটাবার জন্য যথেষ্ট।
আহসান হাবিব বাজারের ব্যাগ হাতে পীচের রাস্তাটি ধরে হেঁটে চলেছেন সেদিকেই। গিন্নী কিছু ফরমায়েশ দিয়েছেন। সেগুলো আনতেই নিজের সবসময়ের বাকি দোকানটির উদ্দেশ্যেই এই সময়ে যাত্রা করেছেন। সকালের স্নিগ্ধ-সতেজতা রোদের আগমনে ধীরে ধীরে ম্লান হলেও, চারপাশটা দেখতে দেখতে যেতে খুব একটা মন্দ লাগছে না। রাস্তার দু'পাশে গাছের সারি, সবুজ পাতাদের শব্দহীন কানাকানি আর দুষ্টু বাতাসের সেগুলোকে ছুঁয়ে দেয়ায় কেমন এক স্বপ্নিল আবহ বিরাজ করছে। সেই আবেশকে অনুভব করে বাজারের ব্যাগ হাতে আহসান হাবিব কিছুটা ভাবুক হয়ে পড়েন। কত সুন্দরভাবেই না আল্লাহপাক এসবকিছুকে তৈরী করেছেন! সুবহান আল্লাহ!
দোকানের কাছাকাছি আসতেই পরিবেশটা কেমন যেন অন্যরকম লাগলো। রহমতের দোকানটির সামনেই বেশ ভীড়। একটু চেঁচামেচি লক্ষ্য করলেন। সবাই দোকানের সামনে উত্তেজিত হয়ে অবস্থান নিয়েছে। তিনি ভীড় ঠেলে সামনে গেলেন। এলাকায় বেশ সম্মান করে সবাই ওনাকে। একজন নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে সবাই তাকে জানে। কি হয়েছে জানতে চাইলে মাহতাব সাহেব নামের এক প্রতিবেশী জানালেন-
' দেখেন ভাই, কতটা জোচ্চোর। এতদিন ধরে কিভাবে মাপে কম দিয়ে আমাদেরকে ঠকিয়ে আসছে।'
একজনের হাতে বিভিন ওজনের কয়েকটি বাটখারা। এর ভিতরে ছোট দু'টি পাথরও রয়েছে। যে যুবকটির হাতে সেগুলো ছিল সে এবার তার সামনে এগিয়ে আসে। সেগুলোর উল্টা দিকটি হাতের তালুতে রেখে আহসান সাহেবকে দেখিয়ে বলে-
'দেখেন আংকেল, এগুলো ঘষে কিভাবে ওজনে কমানো হইছে। আর নিচের দিকের এই গর্তগুলো দেখেন। এখানেও কারসাজি। এখান থেকেও অতিরিক্ত কিছু ওজন কমানো হইছে গোল চাকতিটা বাইর করে।
এবারে আহসান সাহেব তার এতোদিনের পরিচিত দোকানদারের দিকে কিছুটা বিস্ময় এবং ব্যথা নিয়ে তাকান। শুধু বলেন, 'এগুলো কি রহমত?' কিন্তু যাকে জিজ্ঞেস করেন সে তখন নিশ্চুপ এবং মাথা নিচু করে রয়েছে। যুবকদের ভিতর থেকে একজন বলে-
'ওরে টাইনা বাইর কর। আগে কিছুক্ষণ পিটাইয়া লই।'
এইকথায় উপস্থিত অন্যরা উৎসাহী হয়ে উঠে। বেশ গুঞ্জন উঠে। তাদেরকে থামিয়ে আহসান সাহেব বলেন, ' এইটা কোনো সমাধান না। সে অন্যায় করেছে, ভীষণ অন্যায়। কিন্তু তাকে এইটার জন্য আঘাত করাটাও আমাদেরকে আর একটি অন্যায়ের দিকে নিয়ে যাবে।'
তার কথায় উত্তেজিত অন্যরা থামে। এবার দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন-
' দেখ রহমত, আমরা সবাই তোমার মুদি দোকান থেকে বছরের পর বছর মালামাল নিচ্ছি। আমাদের সবার সাথে তোমার এমন জঘন্য কাজটি করা ঠিক হয় নাই। তুমি একজন মুসলমান। বল, কেন করেছ?'
রহমত নামের লোকটি এবার চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে সকলের সামনে করজোড়ে মিনতি করে বলে-
'আপনারা সবাই আমারে মাফ কইরা দেন। আমি শয়তানের ধোঁকায় আর নিজে লোভ কইরা এই আকামডা করছি। আজ তওবা করলাম, জীবনে আর এইকাজ করমু না।'
এরপরেও কয়েকজন মানতে চায় না। তাদেরকে আহসান হাবিব এবং আরো কয়েকজন মুরব্বি ঠান্ডা করেন। বলেন কেউ ভুল করে অন্যায় করার পড়ে ক্ষমা চেয়ে অনুতপ্ত হলে, তাকে ক্ষমা করাটাই মহত্তের লক্ষণ। সেখানে বসেই একটা সিদ্ধান্ত হয়। এখন থেকে প্রতিটি দোকানে ডিজিটাল স্কেল ব্যবহার করা হবে। আর সেটা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি দোকানের এই ওজনের পাথরগুলোকে চেক করা হবে। মানুষকে অন্যায় করার সুযোগ দেয়াটাও কম অন্যায় নয়। ধীরে ধীরে উত্তেজিত জনতার উত্তেজনা প্রশমিত হয়। সবাই যে যার মত কাজে ফিরে যায়। আহসান হাবিব হৃদয়ে এক অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করেন। এই সাধারণ মানুষগুলো আসলেই বিচিত্র স্বভাবের। এই রাগ হয় তো পরক্ষণেই প্রানখোলা হাসিতে গড়িয়ে পড়ে।
নিজের অতিপরিচিত পথটি ধরে আহসান হাবিব নামের এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক তার গিন্নির ফরমায়েশ পুরণ করে প্রসন্ন চিত্তে ফিরে আসেন।
এই ঘটনাটি আজকাল আমাদের দেশের বাজারগুলিতে অহরহ ঘটে চলেছে। মাপে কম দেয়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি জঘন্য নীতি। এরা এই কাজটি করে একাধারে মহান আল্লাহপাকের আজাবকে আমাদের দিজে টেনে আনছে, তা অজ্ঞতাবশত নিজেরাও জানে না। আর তাদের এই কাজের পরিণামে আমরা সাধারণ মানুষ দুইভাবে ক্ষতিতে পতিত হচ্ছি।
প্রথমতঃ আর্থিক ক্ষতি। কম মালের বেশী দাম দেয়া।
দ্বিতীয়তঃ আল্লাহপাকের আজাবের ভিতরে সমষ্টিগত/জাতিগত ভাবে পতিত হচ্ছি।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন-
“ ধ্বংস ঠকবাজদের” [সূরা মুতাফফীফিনঃ আয়াত নং ১]
“ যারা মানুষের নিকট হতে যখন গ্রহন করে তখন পুর্ণ মাপে গ্রহন করে” [সূরা মুতাফফীফিনঃ আয়াত নং ২ ]
“ আর যখন মেপে ওজন করে প্রদান করত তখন কম প্রদান করত" [সূরা মুতাফফীফিনঃ আয়াত নং ৩ ]
আর একটি হাদীস [আমি রেফারেন্স দিতে পারছি না, কেউ সঠিক রেফারেন্স জানলে দোয়া করে মন্তব্যে জানালে উপকৃত হব। আর হাদীসটি সহীহ কিংবা জাল হলেও জানানোর বিনীত অনুরোধ রইলো] যার মোটামুটি অর্থ এইরুপ-
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
১। যে জাতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, সে জাতির উপর তাদের শত্রুকে প্রবল করা হয়।
২। যে জাতি আল্লাহর হুকুম আহকামকে প্রবৃত্তির মুকাবেলায় পরিত্যাগ করে তারা অভাব অনটনে পতিত হয়।
৩। যে জাতির মধ্যে জেনা ও বলৎকারের আধিক্য হয় তারা মহামারি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়।
৪। যে জাতি ওজনে কম-বেশ করে তারা দুর্ভিক্ষ এবং বাগ-বাগিচা ও ক্ষেত ফসলের উৎপাদন হ্রাসে পতিত হয়।
৫। যে জাতি যাকাত প্রদান এবং এতীম মিসকীনের হক আদায় হতে বিরত থাকে তাদের প্রতি বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেয়া হয়।
আল্লাহপাক আমাদের সকলকে এই ওজনে কমবেশী না করার এবং এই ব্যাপারটি নজরে এলে সেটার উত্তম প্রতিকার করার তৌফিক দান করুন-আমীন।
বিষয়: বিবিধ
৮৭৮ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পরলৌকিক সাফল্যের জন্যে ইহলোকে ঐশী বিধিবদ্ধ কিছু বিষয় অবশ্য ই মেনে চলতে হবে। বাহ্যতঃ সামান্য স্বার্থের পিছে ছোটে তা এড়িয়ে চললে ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করতে হবে। বান্দার হক বলে স্বীকৃত 'ওজনে কম দেয়া'মারাত্মক অন্যায়ের পর্যায়ে,যা আল্লাহ সহজে মাফ করবেন না।
মানুষের দৃষ্টিভংগি বদলাতে অসাধারণ সুন্দর লেখনী ভূমিকা রাখুক এই দোয়া আল্লাহর কাছে।
শুভেচ্ছা ও জাযাকাল্লাহু খাইরান।
আপনার সাথে সহমত।
আপনার দোয়ায় আমীন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ঈদের অগ্রীম শুভেচ্ছা রইলো তোমার এবং তোমার পরিবারের সকলের প্রতি।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ওজন বিষয়টা আমার কাছে খুবই কঠিন মনে হয়; অনেক সুন্দর হয়েছে গল্পের মাধ্যমে জটিলের সরলীকরণ।
না আমরা বুড়ো বয়সের মানে পরিণত বয়সের দোস্তো
আপনার সাথে সহমত। ওজন নামের মত অভ্যন্তরীন দিকেও বেশ ওজনদার।
সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
চমৎকার পোষ্ট।
সহমত আপনার সাথে।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন