প্রজাপতি... একটি ফেইক আইডি ও নীল ডানা (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-২)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৯:৫৬:২৬ সকাল
৩.
পহেলা বৈশাখ এর আগের রাতটা কত ইনকামিং আনন্দ ও সুপ্ত ইচ্ছের প্রজাপতিগুলোর ডানা মেলার অপেক্ষায় কাটতো!
রাহেলার।
আব্বু-আম্মু ও ভাইয়ার সাথে।
আর এবার?
একাকি হয়েও হৃদয়ে দু’জনের যায়গা নিয়ে ক্লান্ত... অপেক্ষারত রাহেলা নিজেও জানে যার জন্য হৃদিপদ্মগুলো সে এখনো সযতনে রেখে দিয়েছে- ওগুলো সে নিবে না।
তাঁর চাহিদা অন্য কিছু যা সে রাহেলাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। হৃদয়ের তাঁর দরকার নেই। সে চায় হৃদয়কে ধারণ করা খোলসটিকে। রাগে-দুঃখে-অপমানে সেদিন সে চলে এলেও বাসায় আসার পরে বিস্ময়করভাবে অনুভব করল, এখনো লোকটির জন্য ওর মনে গভীর মমতা রয়ে গেছে। যে মমতা সেই প্রথম দেখাতেই ওর ভিতরে জন্ম নিয়েছিল, আজ তিলে তিলে ভালবাসার এক বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে। তবে ভালোবাসাটা শুধুই রাহেলার দিক থেকে।
জাফরকে লোকটা বলা কি ঠিক হল?
এতো ক্রিটিক্যাল অবস্থার ভিতরেও হাসি পেল। রাহেলার এই হাসি নাকি জাফরের সব থেকে ভালো লাগতো।
‘জীবনকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় তোমার এই হাসি’- ঠিক এভাবেই বলতো সেই দিনগুলোতে জাফর।
তবে সে যে বিবাহিত কিংবা দুটো সন্তান রয়েছে- এ কথা প্রথম দিকে চেপে গিয়েছিল। রাহেলা নিজেও কি কখনো জিজ্ঞেস করেছে?
হ্যা, জাফর এখন কেবলই একজন লোক। যে লোকটার সাথে ওর ফেলে আসা কিছু স্মৃতি রাহেলার এখনকার নিরানন্দ ভূবনে একমাত্র আনন্দের উৎস।
এতোটাই ভালোবেসেছে সে জাফরকে!
ওদের দুজনের মাঝে অন্য একজনও কীভাবে যেন এসে গেলো। জাহিদ নামের একজন ভিন্ন দিক থেকে ওর হৃদয়ের কাছে আসার জন্য কতোটাই না এগ্রেসিভ ছিল। শেষ পর্যন্ত ওকে না পেয়ে দেশের বাইরে চলে গেলো।
এটাই হয়... হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের ঠোকাঠুকি। হৃদয় যেন এক চুম্বক... একটা অদৃশ্য ম্যাগনেটিক ফিল্ড যা খুব যত্ন করে সম মেরুগুলোকে দূরে রাখে। দুর্ভাগ্যবশত রাহেলা, জাফর ও জাহিদ একই মেরুতে পড়ে গেছে। তাই একে অপরের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভালোবাসা ধারণ করেও ওরা কেউ কারো নয়।
জানালার থাই গ্লাস দমকা বাতাসে শব্দ করে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। বাতাসের ধাক্কার সাথে সংগ্রাম এবং টিকে থাকা... বেশ দমকা হাওয়া শুরু হয়েছে। গাছগুলোও ওদের চিরন্তন টিকে ঠাকার লড়াইয়ে নেমে পড়েছে। হঠাৎ করে এরকম ঝড় শুরু হলে রাহেলার কেন জানি খুব ভালো লাগে। ঠান্ডা বাতাস... ঘরের খোলা দরোজা-জানালাগুলোর সশব্দে বন্ধ হওয়া... বাতাসের পালকিতে চড়ে ধুলোবালির প্রলয়নৃত্য... অন্ধকারকে বিদীর্ন করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিদ্যুতের চলে যাওয়া- এ সব মিলেমিশে ভালোলাগার এক মধুময় আবেশ রাহেলাকে সবসময় ঘিরে ধরে।
সব শেষে বৃষ্টির কান্নায় বিষন্ন থাই গ্লাস জমাট বাঁধা কুয়াশায় পরিণত হয়... একটানা অনেকক্ষণ চলতে থাকে সেই কান্না।
রাহেলা, জাহিদ ও জাফরদেরকে ঠান্ডা করে হৃদয়ে অনবরত জ্বলতে থাকা ভালবাসার উষ্ণ শোণিত যদি এই কান্নাতে কিছুটা শান্ত হয়!
ওদেরকে একদন্ড শান্তি দিতে পারে!
জানালার গ্লাস আরো খুলে দেয় রাহেলা। বৃষ্টি এখনো শুরু হয়নি। তবে বাতাস ওর রুমকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। ঠিক যেভাবে জাফর ওকে করে দিয়েছে। ড্রয়ার থেকে মাটির তৈরী কিছু গহনা বের করে। এগুলো জাফর গত বছর পহেলা বৈশাখে ওকে কিনে দিয়েছিল। বিছানায় রেখে হাত দিয়ে সেগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করতে থাকে... বিগত একটি সন্ধ্যা নিমিষে সেই সময়ের সকল রুপ-রস-ঘ্রাণ নিয়ে রাহেলার সামনে হাজির হয়। হৃদয়ের অনুভুতি হাতে এসে গহনায় লেগে থাকা সময়ের ঘ্রাণ রাহেলাকে যেন জাফরকে অনুভবে সাহায্য করে। ভালোবাসা মেঘ হয়ে হৃদয়ের অনবরত সংকোচন-প্রসারনে বৃষ্টি হয়ে চোখের দ্বারা বয়ে বয়ে মৃত নদীতে জোয়ারের সৃষ্টি করে। এভাবেই কি প্রেম সাগরের সৃষ্টি?
অনেকদিন পরে ল্যাপটপের সামনে আসে।
জাফরের সাথে শেষ কথা হবার পরে জাফর ওকে ব্লক করে দিয়েছিল। তবে রাহেলার একটা ফেইক আইডি রয়েছে। এই আইডি দিয়ে সে জাফরের ফেসবুক বন্ধু হয়েছে। এখন মাঝে মাঝে চুরি করে জাফরকে দেখে... পরিচিত মানুষ সময়ের ফেরে ভার্চুয়াল জগতে অপরিচিত থেকেও যে কত পরিচিত হতে পারে... কাছে আসতে পারে, সেটা রাহেলার ফেইক আইডিধারী ‘বিষন্ন মেঘ বালিকা’ এবং জাফরকে দেখে বোঝা যায়।
বিষন্ন মেঘ বালিকা ভালবাসার ওয়ান ওয়ে টানেল দিয়ে দ্রুত ধাবমান নিহারিকার পিছু ধেয়ে ধেয়ে আরো বিষন্ন হতে থাকে... ...
... ...
Every time we touch
I get this feeling
Every time we kiss
I swear I can fly
Can't you feel
My heart beat, so..
I can't let You go
Want You in my life..
তামাক ঘরের সাউন্ডপ্রুফ রুমে জাহিদের মাথার ভিতরে ‘I can't let You go’ বার বার বাজতে থাকে। ইদানিং এমনই হচ্ছে। কোনো গান শুনলে কিংবা কবিতার দু’একটি লাইন ভালোলাগা মাত্রই মাথায় ঘুরপাক খায়। সহজে সেখান থেকে বের হতে পারে না।
হয়তো অবচেতন মনে সে নিজেই বের হতে দিতে চায় না।
পহেলা বৈশাখ চলে গেলো।
এখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে যথেষ্ট জাকজমকের সাথে বাঙালি অনুষ্ঠানগুলো পালন করা হলেও কোথায় যেন তাল কেটে যায়... কেমন বেসুরো মনে হয় জাহিদের কাছে। হয়তো নিজ দেশের মাটির সোঁদা গন্ধ পায় না বলেই!
হয়তো পরিবারের সকলকে দেশে রেখে একাকি থাকাতে... হয়তো!
আচ্ছা ওর সাথে যদি রাহেলা এখানে থাকতো?
তখন কি ওই অনুষ্ঠান ওর কাছে সুর-তাল-লয় বিহীন মনে হতো?
নিশ্চয়ই না।
একটি মেয়ে জাহিদের চিন্তা-চেতনাকে কীভাবে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে ভেবে সে অবাক হয়। বুকের বাম পাশে চিনচিনে একটু ব্যাথা... দম বন্ধ হয়ে আসা এবং মনের গভীরে কোথায় যেন অনেকটা ভালোলাগা- এসব কিছু এক লহমায় জাহিদের অনুভুতিকে আচ্ছন্ন করে। কষ্টটাও যেমন রাহেলার জন্য, ভালোলাগাটাও তাঁর জন্য।
একই হৃদয়ে কিভাবে দুই বিপরীত বস্তু এক সাথে থাকে, সময়ের প্রযোজনে কোন অদৃশ্যলোক থেকে যে সেগুলো নিজদেরকে হাজির করে!!
বড়ই বিচিত্র এই মানব মন।
মোবাইল হাতে নিয়ে কয়েক হাজার মাইল দূরের এক অতৃপ্ত রমণীকে মানসপটে কিছুক্ষণ দেখে নেয়... উত্তেজনায় খাবি খেতে খেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জাহিদ ভাবে...
আজ কথা বলতেই হবে।
এভাবে নিজেকে শেষ করে দেবার কোনো মানে হয় না। অন্তত ওর সাথে শেষ একবার কথা বলা প্রয়োজন।
মোবাইলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে রাহেলার। চোখ একটু লেগে এসেছে, এমন সময় এই ফোন।
বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে সেলফোনটা হাতে নেয়।
সেই অপরিচিত কারোর পরিচিত নাম্বারটি ডিসপ্লেতে ভেসে রয়েছে। ও ধরার আগেই লাইন কেটে গেলো।
এই নাম্বার এর আগেও অনেক বার ওকে ফোন দিয়েছে। ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। কিন্তু যখনই রাহেলা কল ব্যাক করার চেষ্টা করেছে, অপরপক্ষ নিশ্চুপ থেকেছে।
বিছানার উপর বসে কিছুক্ষণ ভাবল।
নাহ! এই ফোনের সমস্যাটা আজই মিটিয়ে ফেলবে। নাহলে এভাবে বার বার বিরক্ত করেই যাবে। অদূরে রাখা ল্যাপটপ টেনে আনে। বালিশে অর্ধশায়িত ভঙ্গীতে কোলের উপর রেখে সেটা চালু করে। আজ এই লোকের (কিংবা মহিলার) ম্যাসেজ অনুযায়ী একবার ঢুকবে নিজের ফেসবুক একাউন্টে।
নেট পেতে সমস্যা হল না।
অনেকগুলো ম্যাসেজ জমা হয়েছে ইনবক্সে। ক্লিক করে দেখা শুরু করেছে এমন সময় ঐ নাম্বার থেকে এবারে ম্যাসেজ এলো। রাহেলাকে ওর নিজের একাউন্টে ঢোকার সেই পুরনো রিকোয়েস্ট। রাহেলা রিপ্লাই দিলো ম্যাসেজের।
জাহিদের মোবাইলে ম্যাসেজ এলো...
দুরুদুরু বুকে ম্যাসেজ ওপেন করল...
পড়ল... এবং
স্বর্গ যেন নেমে এলো তামাক ঘরে!!
হাজার মাইল দূর থেকে সহস্র বছরের সাধনার ধন- ওর পরম আরাধ্য ‘সেই চেনা মুখ’ এই মুহুর্তে ওর অনুরোধে সাড়া দিয়ে ইনবক্সে অপেক্ষারত!!!
ওর জন্য।
না, ভুল হল। ওর জন্য নয়। এই অপরিচিত মোবাইল নাম্বারের মালিকের জন্য।
নিজের সেই ফেইক একাউন্টে দ্রুত লগ অন করে জাহিদ। এতোদিনের অপেক্ষার অবসান হল আজ। অন্তত রাহেলার সাথে চ্যাটে বসার সৌভাগ্য তো হচ্ছে। রাহেলার সেই অপমানজনক প্রত্যাখ্যানের পরে সে কয়েকবার নেটে যেয়ে দেখেছে- ওকে আনফ্রেন্ড কিংবা ব্লক করে দেয়নি সে। কিন্তু ফেসবুক এ রাহেলা না আসার কারণে ওকে জাহিদ পাচ্ছিল না। আর মোবাইলে কেন যে ফোন করে কথা বলতে পারেনি সেটা ওর নিজের কাছেও কেমন দুর্বোবোধ্য মনে হয়।
ইনবক্স ওপেন করে...
ভার্চুয়াল জগতে ওর প্রিয়তমা নিজের মোহনীয় ভঙ্গীতে তাকিয়ে ওকে বলছে,
: কে আপনি?
মাত্র দুটো শব্দ।
কিন্ত কোন সে যাদু ভালবাসার রঙে মায়াকে মিশিয়ে অপার্থিব আকর্ষনে দৃষ্টিকে সম্মোহিত করে রাখলো জাহিদের! বিশ্বচরাচর দুলে উঠলো... সময় যেন স্থির হয়ে আছে। সব কিছু ফ্রোজেন মুডে... মাত্র দুটি শব্দ অক্ষরে পরিণত হয়ে সব কিছুকে গ্রাস করছে।
জাহিদ ভুলে গেলো ওকে লিখতে হবে...
ওর মাথার ভিতরে অনেক গভীর অচেনা এক উপত্যকায় প্রতিধ্বনি হয়ে চলেছিল ‘I can't let You go’ এখন সেখানে আরো দুটি বাংলা শব্দ ইংরেজী বাবুদেরকে হটিয়ে নিজেদের যায়গা করে নিল।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
বিষয়: সাহিত্য
২৫২৮ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার অসাধারণ লেখার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা প্রায় অজানা কিছু একটা আচ্ছন্ন করে অনুভূতি কে,কষ্টের মিশেলে অন্য রকম ভাললাগা।
অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা.......
মন্তব্য করতে লগইন করুন