ঈদের আনন্দঃ উদযাপনের সেকাল

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৮ আগস্ট, ২০১৪, ০২:৫৯:১৩ দুপুর

সেই ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, ' আজ ঈদ। মদীনার ঘরে ঘরে আনন্দ।' তাই ঈদ এলেই সর্বপ্রথম সবার মনে এক নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের কথাই মনে হয়। যা সাধারণত একদিন ব্যাপী স্থায়ি হয়। কিন্তু এই একটি দিনকে ঘিরে উদযাপনের শুরুটা কিন্তু আরো আগে থেকেই।

আমার সর্বপ্রথম যে ঈদটির কথা মনে পরে তখন বোধহয় আমি ক্লাশ টু-তে পড়ি। ঈদ-উল-ফিতর ছিল সেটি। সে সময় খুলনার বাড়িতে। আমরা তিনভাই তখন। ঈদের দুদিন আগেই নানী চলে আসতেন। কখনো নানা-নানী দুজনেই আসতেন। তবে মামা বাড়িতে ঈদের জন্য ওনাদের দুজনকে এক সাথে পেতাম খুব কমই। সে এক দিন ছিল বটে! তখন বাসায় কেউ আসা মানেই যা কিছু করার স্বাধীনতা পেয়ে যাওয়া। আর সেই 'কেউ'দের ভিতরে আমার নানী ছিলেন টপমোষ্ট।

সেই সময় ঈদের আগের রাতে নতুন জামা-প্যান্ট-জুতো নিয়ে রাতভর নিজের বিছানার পাশে রেখে সকালের অপেক্ষায় থাকা... আগামীকালের দিনভর ছোটাছুটির কল্পনায় বিভোর কচি হৃদয়টিতে এক অনাবিল আনন্দ-উচ্ছাস নিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে যাওয়া... কাক ভোরে আব্বার ডাকে অনিচ্ছাকৃত ঘুম থেকে উঠেও আবার ঘুমিয়ে পড়া... এরপর ঈদের জামাত মিস করার ভয়ে ঘুমের ভিতর থেকে নিজেই লাফিয়ে উঠে ততোধিক দ্রুততায় নিজেকে তৈরী করা...জায়নামাজ হাতে আব্বার পিছু পিছু ঈদগাহের দিকে হেঁটে চলা... আব্বার পোশাকে মাখানো মিষ্টি সুগন্ধির ঘ্রাণে মৌ মৌ করা আবিষ্টতায় বুদ হয়ে তার পাশে নামাজ আদায়... নামাজ শেষে আব্বার সাথে কোলাকুলি করার সময়ে লজ্জামিশ্রিত আনন্দলাভ- এসবই ভাসা ভাসা এখনো মনে পড়ে। সেই একই সুগন্ধী নিজের পোশাকে মেখে দেখেছি... কই, সেই নস্টালজিক ঘ্রাণে মন তো আর আবিষ্ট হয় না!!

তখন ১৯৭৯ ইং সাল। সবার কাছ থেকে সালামি নিয়ে সকালে আমরা দু'জন কাছের বন্ধু ছোট ভাই মাসুমকে সাথে নিয়ে রিক্সায় করে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের বাড়ি ছোট বয়রা থেকে এরশাদ শিকদারের ঘাট এলাকায় আমাদের স্কুলের এক আপার বাসায় যেতাম। তখন আমরা আমাদের টিচারদেরকে আপা ডাকতাম। কি আশ্চর্য! সেই আপার নামটিও এখন মনে পড়ছে না। তিনি আমাদের সমাজবিজ্ঞান পড়াতেন। প্রতি ঈদে এই আপার বাসায় কেন জানি চলে যেতাম। তার বাসাটি আমাদের বাড়ি থেকে দূরে হবার জন্যই মনে হয় রিক্সায় অনেকটা সময় ঘুরতে পারব এই কারনে আমাদের অবচেতন মন প্রতিবার সেখানেই ছুটে যেতে চাইত।

আমাদের সময়ে আমরা তারা বাজি পোড়াতাম। বন্ধুদের ভিতর দুষ্টু কেউ কেউ হাজী ফয়েজুদ্দীন স্কুল মাঠে চাঁদ দেখার পরে কুকুরের লেজে এই তারা বাজি বেঁধে আগুন ধরিয়ে দিতো। আগুনের ভয়ে কুকুর মাঠভর দৌড়ে বেড়াতো। আর আমরা নিজেদের ভিতরের সুপ্ত পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠতাম। অবশ্য তখন পৈশাচিকতা কি তা বুঝতাম না, তবে উল্লাসে ফেটে পড়তাম। আজ এটা ভেবে ঐ কুকুরগুলোর জন্য দুঃখ হয়।

চাঁদ রাতে আমরা আরো কিছু বাজি ফুটাতাম। আমরা ছোট ছিলাম বলে আমাদের হাতে থাকতো সাইকেলের স্পোক দিয়ে বানানো বাজি। যার কাছে একেবারে নতুন স্পোক থাকতো, তারটা বেশী শব্দ করতো। ম্যাচের কাঠির বারুদ বের করে সেই স্পোকের মাথার দিকের একটা নাট সদৃশ খালি যায়গাতে ঠেসে ভরা হত। আর একটি সুতোর সাথে বাঁধা একটি পেরেক সেই বারুদ ভর্তি গর্তে আলতো করে ঢুকিয়ে দেয়ালের সাথে আঘাত করলেই বেশ শব্দ হত। অন্তত বেখেয়ালি কারো পিলে চমকানোর জন্য তো তা যথেষ্ট ছিল।

ঈদের দিনে সব বাসায়ই বেশ ভালো রান্না হত। বন্ধুদের সাথে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেই রস আস্বাদন করতাম। তবে ছেলেবেলায় আমার খাবার চেখে দেখার চেয়ে ঈদের সালামী নেবার প্রতিই ঝোক বেশী ছিল।

ঈদের বিকেলে মুজগুন্নিতে ঈদের মেলা বসত। বেশ ঐতিহাসিক এই মেলাটি এখনো একই যায়গায় হয়ে আসছে। তবে কলেবর একটু হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এখনো মেলা কমিটি এই মেলাকে ধরে রেখেছে। কত ধরণের জিনিসপত্রে মুখরিত থাকতো সেই মেলা! মাটির খেলনার (যার ভিতরে বাঘ, সিংহ, হাতির পাশাপাশি আবক্ষ নজরুল, রবীন্দ্রনাথও ছিলেন) প্রতি আমার বেশী আকর্ষণ ছিল। আর ছিল বিভিন্ন সাইজের গ্যাস বেলুনের। আমার সেই সময়ের একটা ভাবনা ছিল বেশ চমকপ্রদ। আমি অনেকগুলো বেলুন কিনে সেগুলোকে একসাথে বেঁধে আকাশে ঊড়তে চাইতাম। একবার একটা বিড়ালের উপর পরীক্ষা করেও দেখেছিলাম। কিন্তু কেন জানি নিজেকে গিনিপিগ বানানোটা আর হয়ে উঠেনি। মেলায় এখনকার মতো নাগরদোলা ছিল... চিনির তৈরী বিভিন্ন আইটেম ছিল। তবে আমার বেশী খেতে ইচ্ছে করত পাপড় ভাজা।

এভাবে প্রাইমারি লেভেল পর্যন্ত আমার জীবনে ঈদ প্রায় এই একই নিয়মে কেটে যাচ্ছিল। এরপর ক্লাশ এইট পর্যন্ত জীবনের আর একটি অধ্যায়ের উদযাপন প্রনালী ভিন্নতর হয়ে উঠলো। ততদিনে জীবনের অনেক অজানা জিনিসের অভিজ্ঞতা কেবল লাভ করা শুরু করেছি... যার ভিতরে কিছু কিছু কালো জিনিস ও ছিল। সিগ্রেটে আসক্ত হওয়া তেমনই একটি কালো জিনিস। এই সময়টাতে পোশাকের ব্যাপারেও একটু বেশী সচেতনতা বেড়ে যায়। আমাদের ঐ সময়টাতে 'ব্যাগি প্যান্ট' নামে প্যান্টের খুব চল ছিল। আমার সমসাময়িক কারো কি এই নামটি মনে পড়ছে?

আর আমরা বন্ধুরা মিলে রমজানের শুরুর দিনটি থেকেই ঈদের দিনের জন্য টাকা জমানো শুরু করে দিতাম। এগুলো সালামির বাইরের টাকা। এক একজনের জমানোর ধরণ এক এক রকম ছিল। কেউ নিজের টিফিনের টাকা থেকে বাঁচিয়ে, কেউ বাসায় বেশী বেশী আবদার করে কিংবা সত্য-মিথ্যে কেনাকাটার অজুহাত দেখিয়ে। কয়েকজন নিজের বাসার জিনিস না বলে বিক্রীও করে দিত। আর আমাদের এক বন্ধুর নিউমার্কেটে দোকান ছিল। সে এই সুযোগে বাসা থেকে আনা জিনিসগুলো একেবারে জলের দরে কিনে নিত। তবে এমন ভাব করত যেন আমাদের বিরাট উপকার করছে। এক বন্ধু বেশ গরীব ছিল। তাদের মাটির ঘর। সে সেই ঘরের বারান্দার এক বাশের খুঁটিতে ছিদ্র করে টাকা জমাতো। আর ঈদের আগের রাতে খুটিটার সেই নির্দিষ্টি দুটি গিরার যায়গাটুকু করাত দিয়ে কেটে নিতো। এজন্য প্রতিবারই তাকে ঈদের পরের দিন ওর বাবার হাতে প্রচন্ড 'মাইর' খেতে হত। তারপরও সে আবারো একই কাজ করতো। ওদের বারান্দায় এজন্যই ফী-বছর নতুন বাশের খুঁটি লাগাতে হতো।

ঈদের দিনে সবাই মিলে নিউ-মার্কেটের পাশের ঝিনুক সিনেমা হলটিতে একত্রীত হতাম। তারপর কার কত টাকা হয়েছে দেখাতে হত। এটা একটা 'মর্যাদার' ব্যাপার ছিল সেই সময়গুলোতে আমাদের বন্ধু মহলে। সবচেয়ে বেশী টাকার মালিককে এক বিশেষ নজরে দেখা হত। অবশ্য সবার টাকাই সবাইকে সাথে নিয়েই ঐ বয়সের জন্য নির্ধারিত সীমার ভিতরের 'মাস্তিতে' শেষ হয়ে যেত। ঈদের পরের দিন আবারো সবাই বিকেলে খেলার মাঠের পাশের দোকান থেকে বাকিতে সিগ্রেট কিনে মাঠের এক কর্ণারে জমায়েত হতাম।

তবে আমাদের স্কুল জীবন পর্যন্ত ঈদের আনন্দ ছিল এমনই সরল ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর। জীবনের বাকী সময়ে কাটানো ঈদগুলোর তুলনায় এই সময়টাই সবার কাছে বেশী উপভোগ্য হয়ে থাকে। আমাদেরও তেমন অনুভূতি। বাবা-মায়ের সাথে ঈদের কেনাকাটা করতে গিয়ে কত সময় নিজের পছন্দের জিনিসটি পাওয়া হয়ে উঠে না। মনে মনে কষ্টকর কিছু মুহুর্ত কাটিয়ে বন্ধুদের কাছে গিয়ে ভারমুক্ত হয়েছি সবাই। আর ঈদের দিনে সব ভুলে গেছি। সকাল বেলা যার যার বাবার সাথে ঈদের ময়দানে হাসিমুখে গিয়ে আনন্দের স্রোতে ভেসে গেছি... বাসায় মায়ের স্নেহমাখা ভালোবাসায় বিলীন হয়েছি ... নানান আইটেমে তার ভালোবাসার পরশ অনুভব করেছি। কিন্তু কখনো সাধ ও সাধ্যের বাইরে গিয়ে নিজেদেরকে ধ্বংসের পানে নিয়ে যেতে চাইনি।

আজ যখন শুনি একটা পাখি ড্রেসের জন্য এক কিশোরি আত্মহত্যা করেছে...কেউ দাম্পত্য জীবনের ইতি টেনেছে- তখন খুব কষ্ট পাই! নিজের মনের গভীর থেকে এক পলকের জন্য একটি ভাবনা এসে উঁকি দিয়ে যায়... কোথায় এসে দাড়িয়েছে সমাজব্যবস্থা? এতো ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে কেন এর ভিত্তি? আনন্দ করার জন্য নিজের জীবনকে ঠেলে দিতে হবে মৃত্যুর দরোজায়!! তবে তো আমাদের সময়ে এই প্রজন্ম থাকলে ওদেরকে যে কতোবার মরতে হতো... কতবার বিচ্ছেদের জ্বলুনি অনুভব করতে হতো!!

ঈদ মানে আনন্দ। তবে সেই আনন্দ যার যার সামর্থ্যের ভিতরে থেকেই উদযাপন করা উচিত। যেভাবে আমাদের সময়ে আমরা করে এসেছি।

ঈদ-উল-ফিতর। সেই ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, ' আজ ঈদ। মদীনার ঘরে ঘরে আনন্দ।' তাই ঈদ এলেই সর্বপ্রথম সবার মনে এক নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের কথাই মনে হয়। যা সাধারণত একদিন ব্যাপী স্থায়ি হয়। কিন্তু এই একটি দিনকে ঘিরে উদযাপনের শুরুটা কিন্তু আরো আগে থেকেই।

আমার সর্বপ্রথম যে ঈদটির কথা মনে পরে তখন বোধহয় আমি ক্লাশ টু-তে পড়ি। ঈদ-উল-ফিতর ছিল সেটি। সে সময় খুলনার বাড়িতে। আমরা তিনভাই তখন। ঈদের দুদিন আগেই নানী চলে আসতেন। কখনো নানা-নানী দুজনেই আসতেন। তবে মামা বাড়িতে ঈদের জন্য ওনাদের দুজনকে এক সাথে পেতাম খুব কমই। সে এক দিন ছিল বটে! তখন বাসায় কেউ আসা মানেই যা কিছু করার স্বাধীনতা পেয়ে যাওয়া। আর সেই 'কেউ'দের ভিতরে আমার নানী ছিলেন টপমোষ্ট।

সেই সময় ঈদের আগের রাতে নতুন জামা-প্যান্ট-জুতো নিয়ে রাতভর নিজের বিছানার পাশে রেখে সকালের অপেক্ষায় থাকা... আগামীকালের দিনভর ছোটাছুটির কল্পনায় বিভোর কচি হৃদয়টিতে এক অনাবিল আনন্দ-উচ্ছাস নিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে যাওয়া... কাক ভোরে আব্বার ডাকে অনিচ্ছাকৃত ঘুম থেকে উঠেও আবার ঘুমিয়ে পড়া... এরপর ঈদের জামাত মিস করার ভয়ে ঘুমের ভিতর থেকে নিজেই লাফিয়ে উঠে ততোধিক দ্রুততায় নিজেকে তৈরী করা...জায়নামাজ হাতে আব্বার পিছু পিছু ঈদগাহের দিকে হেঁটে চলা... আব্বার পোশাকে মাখানো মিষ্টি সুগন্ধির ঘ্রাণে মৌ মৌ করা আবিষ্টতায় বুদ হয়ে তার পাশে নামাজ আদায়... নামাজ শেষে আব্বার সাথে কোলাকুলি করার সময়ে লজ্জামিশ্রিত আনন্দলাভ- এসবই ভাসা ভাসা এখনো মনে পড়ে। সেই একই সুগন্ধী নিজের পোশাকে মেখে দেখেছি... কই, সেই নস্টালজিক ঘ্রাণে মন তো আর আবিষ্ট হয় না!!

তখন ১৯৭৯ ইং সাল। সবার কাছ থেকে সালামি নিয়ে সকালে আমরা দু'জন কাছের বন্ধু ছোট ভাই মাসুমকে সাথে নিয়ে রিক্সায় করে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের বাড়ি ছোট বয়রা থেকে এরশাদ শিকদারের ঘাট এলাকায় আমাদের স্কুলের এক আপার বাসায় যেতাম। তখন আমরা আমাদের টিচারদেরকে আপা ডাকতাম। কি আশ্চর্য! সেই আপার নামটিও এখন মনে পড়ছে না। তিনি আমাদের সমাজবিজ্ঞান পড়াতেন। প্রতি ঈদে এই আপার বাসায় কেন জানি চলে যেতাম। তার বাসাটি আমাদের বাড়ি থেকে দূরে হবার জন্যই মনে হয় রিক্সায় অনেকটা সময় ঘুরতে পারব এই কারনে আমাদের অবচেতন মন প্রতিবার সেখানেই ছুটে যেতে চাইত।

আমাদের সময়ে আমরা তারা বাজি পোড়াতাম। বন্ধুদের ভিতর দুষ্টু কেউ কেউ হাজী ফয়েজুদ্দীন স্কুল মাঠে চাঁদ দেখার পরে কুকুরের লেজে এই তারা বাজি বেঁধে আগুন ধরিয়ে দিতো। আগুনের ভয়ে কুকুর মাঠভর দৌড়ে বেড়াতো। আর আমরা নিজেদের ভিতরের সুপ্ত পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠতাম। অবশ্য তখন পৈশাচিকতা কি তা বুঝতাম না, তবে উল্লাসে ফেটে পড়তাম। আজ এটা ভেবে ঐ কুকুরগুলোর জন্য দুঃখ হয়।

চাঁদ রাতে আমরা আরো কিছু বাজি ফুটাতাম। আমরা ছোট ছিলাম বলে আমাদের হাতে থাকতো সাইকেলের স্পোক দিয়ে বানানো বাজি। যার কাছে একেবারে নতুন স্পোক থাকতো, তারটা বেশী শব্দ করতো। ম্যাচের কাঠির বারুদ বের করে সেই স্পোকের মাথার দিকের একটা নাট সদৃশ খালি যায়গাতে ঠেসে ভরা হত। আর একটি সুতোর সাথে বাঁধা একটি পেরেক সেই বারুদ ভর্তি গর্তে আলতো করে ঢুকিয়ে দেয়ালের সাথে আঘাত করলেই বেশ শব্দ হত। অন্তত বেখেয়ালি কারো পিলে চমকানোর জন্য তো তা যথেষ্ট ছিল।

ঈদের দিনে সব বাসায়ই বেশ ভালো রান্না হত। বন্ধুদের সাথে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেই রস আস্বাদন করতাম। তবে ছেলেবেলায় আমার খাবার চেখে দেখার চেয়ে ঈদের সালামী নেবার প্রতিই ঝোক বেশী ছিল। :D

ঈদের বিকেলে মুজগুন্নিতে ঈদের মেলা বসত। বেশ ঐতিহাসিক এই মেলাটি এখনো একই যায়গায় হয়ে আসছে। তবে কলেবর একটু হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এখনো মেলা কমিটি এই মেলাকে ধরে রেখেছে। কত ধরণের জিনিসপত্রে মুখরিত থাকতো সেই মেলা! মাটির খেলনার (যার ভিতরে বাঘ, সিংহ, হাতির পাশাপাশি আবক্ষ নজরুল, রবীন্দ্রনাথও ছিলেন) প্রতি আমার বেশী আকর্ষণ ছিল। আর ছিল বিভিন্ন সাইজের গ্যাস বেলুনের। আমার সেই সময়ের একটা ভাবনা ছিল বেশ চমকপ্রদ। আমি অনেকগুলো বেলুন কিনে সেগুলোকে একসাথে বেঁধে আকাশে ঊড়তে চাইতাম। একবার একটা বিড়ালের উপর পরীক্ষা করেও দেখেছিলাম। কিন্তু কেন জানি নিজেকে গিনিপিগ বানানোটা আর হয়ে উঠেনি। মেলায় এখনকার মতো নাগরদোলা ছিল... চিনির তৈরী বিভিন্ন আইটেম ছিল। তবে আমার বেশী খেতে ইচ্ছে করত পাপড় ভাজা।

এভাবে প্রাইমারি লেভেল পর্যন্ত আমার জীবনে ঈদ প্রায় এই একই নিয়মে কেটে যাচ্ছিল। এরপর ক্লাশ এইট পর্যন্ত জীবনের আর একটি অধ্যায়ের উদযাপন প্রনালী ভিন্নতর হয়ে উঠলো। ততদিনে জীবনের অনেক অজানা জিনিসের অভিজ্ঞতা কেবল লাভ করা শুরু করেছি... যার ভিতরে কিছু কিছু কালো জিনিস ও ছিল। সিগ্রেটে আসক্ত হওয়া তেমনই একটি কালো জিনিস। এই সময়টাতে পোশাকের ব্যাপারেও একটু বেশী সচেতনতা বেড়ে যায়। আমাদের ঐ সময়টাতে 'ব্যাগি প্যান্ট' নামে প্যান্টের খুব চল ছিল। আমার সমসাময়িক কারো কি এই নামটি মনে পড়ছে?

আর আমরা বন্ধুরা মিলে রমজানের শুরুর দিনটি থেকেই ঈদের দিনের জন্য টাকা জমানো শুরু করে দিতাম। এগুলো সালামির বাইরের টাকা। এক একজনের জমানোর ধরণ এক এক রকম ছিল। কেউ নিজের টিফিনের টাকা থেকে বাঁচিয়ে, কেউ বাসায় বেশী বেশী আবদার করে কিংবা সত্য-মিথ্যে কেনাকাটার অজুহাত দেখিয়ে। কয়েকজন নিজের বাসার জিনিস না বলে বিক্রীও করে দিত। আর আমাদের এক বন্ধুর নিউমার্কেটে দোকান ছিল। সে এই সুযোগে বাসা থেকে আনা জিনিসগুলো একেবারে জলের দরে কিনে নিত। তবে এমন ভাব করত যেন আমাদের বিরাট উপকার করছে। এক বন্ধু বেশ গরীব ছিল। তাদের মাটির ঘর। সে সেই ঘরের বারান্দার এক বাশের খুঁটিতে ছিদ্র করে টাকা জমাতো। আর ঈদের আগের রাতে খুটিটার সেই নির্দিষ্টি দুটি গিরার যায়গাটুকু করাত দিয়ে কেটে নিতো। এজন্য প্রতিবারই তাকে ঈদের পরের দিন ওর বাবার হাতে প্রচন্ড 'মাইর' খেতে হত। তারপরও সে আবারো একই কাজ করতো। ওদের বারান্দায় এজন্যই ফী-বছর নতুন বাশের খুঁটি লাগাতে হতো।

ঈদের দিনে সবাই মিলে নিউ-মার্কেটের পাশের ঝিনুক সিনেমা হলটিতে একত্রীত হতাম। তারপর কার কত টাকা হয়েছে দেখাতে হত। এটা একটা 'মর্যাদার' ব্যাপার ছিল সেই সময়গুলোতে আমাদের বন্ধু মহলে। সবচেয়ে বেশী টাকার মালিককে এক বিশেষ নজরে দেখা হত। অবশ্য সবার টাকাই সবাইকে সাথে নিয়েই ঐ বয়সের জন্য নির্ধারিত সীমার ভিতরের 'মাস্তিতে' শেষ হয়ে যেত। ঈদের পরের দিন আবারো সবাই বিকেলে খেলার মাঠের পাশের দোকান থেকে বাকিতে সিগ্রেট কিনে মাঠের এক কর্ণারে জমায়েত হতাম।

তবে আমাদের স্কুল জীবন পর্যন্ত ঈদের আনন্দ ছিল এমনই সরল ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর। জীবনের বাকী সময়ে কাটানো ঈদগুলোর তুলনায় এই সময়টাই সবার কাছে বেশী উপভোগ্য হয়ে থাকে। আমাদেরও তেমন অনুভূতি। বাবা-মায়ের সাথে ঈদের কেনাকাটা করতে গিয়ে কত সময় নিজের পছন্দের জিনিসটি পাওয়া হয়ে উঠে না। মনে মনে কষ্টকর কিছু মুহুর্ত কাটিয়ে বন্ধুদের কাছে গিয়ে ভারমুক্ত হয়েছি সবাই। আর ঈদের দিনে সব ভুলে গেছি। সকাল বেলা যার যার বাবার সাথে ঈদের ময়দানে হাসিমুখে গিয়ে আনন্দের স্রোতে ভেসে গেছি... বাসায় মায়ের স্নেহমাখা ভালোবাসায় বিলীন হয়েছি ... নানান আইটেমে তার ভালোবাসার পরশ অনুভব করেছি। কিন্তু কখনো সাধ ও সাধ্যের বাইরে গিয়ে নিজেদেরকে ধ্বংসের পানে নিয়ে যেতে চাইনি।

আজ যখন শুনি একটা পাখি ড্রেসের জন্য এক কিশোরি আত্মহত্যা করেছে...কেউ দাম্পত্য জীবনের ইতি টেনেছে- তখন খুব কষ্ট পাই! নিজের মনের গভীর থেকে এক পলকের জন্য একটি ভাবনা এসে উঁকি দিয়ে যায়... কোথায় এসে দাড়িয়েছে সমাজব্যবস্থা? এতো ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে কেন এর ভিত্তি? আনন্দ করার জন্য নিজের জীবনকে ঠেলে দিতে হবে মৃত্যুর দরোজায়!! তবে তো আমাদের সময়ে এই প্রজন্ম থাকলে ওদেরকে যে কতোবার মরতে হতো... কতবার বিচ্ছেদের জ্বলুনি অনুভব করতে হতো!!

ঈদ মানে আনন্দ। তবে সেই আনন্দ যার যার সামর্থ্যের ভিতরে থেকেই উদযাপন করা উচিত। যেভাবে আমাদের সময়ে আমরা করে এসেছি।

বিষয়: বিবিধ

১১১৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File