পৃথিবির সর্ববৃহৎ স্থাপনা--থ্রি জর্জেস ড্যাম

লিখেছেন লিখেছেন বশর সিদ্দিকী ১১ মার্চ, ২০১৪, ০৮:৪২:২৬ রাত

সোজা বাংলায় বললে ড্যাম শব্দের বাংলা অর্থ বাধ। প্রাকিতিক কোন পানির গতিপথ( যেমন নদি, খাল ইত্যাদি) কে কৃত্তিম উপায়ে বাধা দিয়ে মানুষের প্রয়োজনে কাজে লাগানো। পৃথিবীর ইতিহাসে ড্যাম অনেক পুরানো একটি স্থাপনা। আগে ড্যাম তৈরি করা হত মুলত কৃষিকাজে সুবিধার জন্য অথবা বন্যা ঠেকানো বা নদির গতিপথ পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু আধুনিক এই ইলেকট্রনিক্স এর যুগে ড্যাম তৈরি হচ্ছে মুলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। কারন বিদ্যুৎ আমাদের বর্তমান জীবনে একটা গুরুত্বপুর্ন অংশ হয়ে দারিয়েছে। এবং একটি দেশের অর্থনিতির উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ এর কোন বিকল্প নেই। আর স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য হাইড্রেলিক ড্যাম এর কোন বিকল্প নেই।

আসুন দেখি পৃথিবির সবচেয়ে বড় ড্যামটি এবং এর তৈরির ছবি সহ বর্ননা।



গনচীনের ইয়াংজি নদির উপর স্থাপিত এই ড্যামটি এই মুহুর্তে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ড্যাম। এখন আসি ড্যাম এর আসল কিছু বিষয় সম্পর্কে।

ইয়াংজি নদি একটি বিশাল নদি যার উৎপত্তি একটি পাহারি অঞ্চল থেকে। নদিটি চিনের অর্থনিতির একটি গুরুত্বপুর্ন অংশ। চীন এই মুহুর্তে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দেশ মানুষ সংখ্যা এবং অর্থনিতির ক্ষেত্রে। এই বিশাল অর্থনিতির জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমান কলকারখানা এবং তাদের জন্য প্রয়োজন সাশ্রয়ি মুল্যে প্রচুর বিদ্যুৎ। এবং সে জন্যই প্রথম ১৯৩৯ সাথে এই ড্যামটি নির্মানের পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের দ্বারা দখল এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যার কারনে প্রযেক্টটি দির্ঘদিন আলোর মুখ দেখেনি। সবশেষে ১৯৯৪ সালে ড্যামটি আলোর মুখ দেখে। শুরু হয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ এবং সর্ববৃহৎ এই ড্যামটির কাজ।

প্রথমেই বলেছি ড্যামটির মুল উদ্যেশ্য হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। হাইড্রোলিক পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে বিষয় গুলো প্রয়োজন।

১) বিশেষ ভাবে তৈরি টারবাইন।(সাইজ দেখছেন? এক একটা ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। এরকম ৩২ টা টারবাইন স্থাপন করা হয়েছে ড্যামটিতে।)



২) টারবাইনের সাথে তৈরি জেনারেটর। এগুলো বেশেষ ভাবে চিনে তৈরি জেনারেটর। এগুলো কম হিট জেনারেট করে। যারা এই ব্যাপারে পরাশুনা করছেন তারা বুঝবেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে জেনারেটর গুলো উপরে উল্লেখিত টারবাইনে সাথে যুক্ত করা হচ্ছে।



৩) টারবাইনে পানি সন্চালনের ব্যবস্থা।



খুব ভাল করে খেয়াল করুন এই বিশাল আকারের পাইপগুলো থেকে পানি উপরের ছবির টারবাইনকে আঘাত করবে। এবং সেটি ঘুরবে সাথে জেনারেটরকে ঘুরাবে।



এইবার কিছু সাধারন বিষয় জেনে নিন।

১) সর্বোমোট ৩৪ টি জেনারেটর রয়েছে ড্যামটিতে। ৩২ টি ৭০০ মেগাওয়াটের এবং ২ টি ৫০ মেগাওয়াটের। যারা সব মিলিয়ে ২২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎতাপদন করতে পারবে। মনে করা হচ্ছে এটি বাৎসরিক ১০০ টেরা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে।

২) এর টারবাইন গুলোকে ফ্রান্সিস টারবাইন বলা হয়। এগুলো পার মিনিটে ৭৫ বার ঘুরে এর সর্বোচ্চ ক্ষমতায় যেতে পারে।

৩) জেনারেটর গুলোর বাইরের ব্যাস কম বেশি ৭০ ফিট। এবং ভিতরের ব্যাস কমকেশি ৬০ ফিট।

৪) আমরা যেটাকে কয়েল বলি(স্টেটর) সেগুলো হচ্ছে পৃথিবীর এইমুহুর্তে সবচেয়ে বড় স্টেটর। এক একটার বিয়ারিং লোড হচ্ছে ৫০৫০-৫৫০০ টন পর্যন্ত।



প্রায় ২.৩ কিলোমিটার লম্বা এই ড্যামটির পাওয়ার প্লান্ট এর চিত্র।



ড্যাম বানাতে গেলে আপনি প্রথম যে সমস্যায় পরবেন তা হচ্ছে কন্সট্রাকশনের স্থানটিতে একটি অস্থায়ি বাধ দেয়া। কারন অস্থায়ি বাধদিতে না পারলে আপনি ড্যামটির বেইজ করতে পারবেননা। অস্থায়ি বাধ তৈরিতে প্রয়োজন পাথর বার মাটি। কিন্তু বিশাল গভিরতা সম্পন্ন এবং ২.৩ কিলো একটা নদিতে একটা অস্থায়ী বাধ তৈরির জন্য এত বিপুল পাথর কোথায় পাওয়া যাবে??

সমাধান হচ্ছে চায়না সরকার এই ড্যমের অস্থায়ী বাধ তৈরির জন্য হাজার হাজার বিশাল সাইজের কংক্রিটের ব্লক তৈরি করে। এই ব্লক গুলো নদিতে স্তুপ আকারে ফেলে একটি নির্দিস্ট এরিয়া কাভার করে তার পর তার পানি সেচ করে মুল নির্মান কাজ শুরু হয়। ছবিতে অস্থায়ি বাধটি দেখা যাচ্ছে।



এর পর আসে ড্যামের বেইজ এবং নির্মান জনিত কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা।

এতবড় প্রযেক্ট যার দৈর্ঘ ২.৩৩ কিমি আর প্রস্থ ১৩১ ফিট এবং উচ্চতা ৬০০ ফিট কমবেশি। তার মানে প্রায় ৬০ তল বিল্ডিং এর সমান উচু। আপানাকে অবশ্যই একে একটি শক্ত ভিত্তির উপর স্থাপন করতে হবে। কিন্তু নদির তলাতে তো শক্ত কিছু তো নেই উল্টা নরম কাদা মাটি। এটির একটি খুব পুরানো এবং চমৎকার উপায় আছে। নরম মাটির মধে ছোট ব্যসের কিন্তু খুব গভির কিছু গর্ত করা হয় এবর তার মধ্যে সিমেন্টের মর্টার প্রচন্ডচাপে প্রবেশ করানো হয়। এগুলো পরে জমে গিয়ে পুরো ড্যামটির জন্য একটি প্রচন্ড শক্ত বেইজ তৈরি করা হয়।

নির্মানজনিত সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে নতুন মিক্স করা কংক্রিটের তাপমাত্রা কন্ট্রোল করা।



আমরা সামান্য একটা বিল্ডিং এর ৪-৫ ইন্চি ছাদ ঢালাই দিতে গেলে প্রত্যেকটা নির্মান সামগ্রি ভাল করে ভিজিয়ে নেই এবং বার বার ভিজাই কারন তাপমাত্রা কন্ট্রোল করার জন্য। কারন সিমেন্ট পানির সাথে বিক্রিয়া করলে একটি ভাল মানের তাপমাত্রার উৎপত্তি হয়। এতে সমস্যা কোথায়???

যদি একলেয়ার কংক্রিটের তাপমাত্রা ঠান্ডা না করে তার উপর আর এক লেয়ার কংক্রিট ঢালা হয় তবে উপরের লেয়ার দ্রুত ঠান্ডা হয় কিন্তু ভিতরের গরম লেয়ার কোন না কোন এক সময় ফেইল করবে। এছারা সংকোচন এবং প্রসারনে কিছু ব্যাপার আছে। এবং এতে ভায়বহ দুর্ঘটনা ঘটাবে। এই সমস্যার সমাধান করেন আমেরিকার হুভার ড্যাম এর এক নির্মান প্রকৌশলি।



তিনি ড্যামটি ছোট ছোট লেয়ারে নির্মান করেন। ছবিতে ভাল করে খেয়াল করুন। এবং মিক্সিং এর জন্য বরফ হওয়ার ঠিক আগের তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করেন। ঠিক এই বুদ্ধিটি ব্যবহার করে থ্রি জর্জেস ড্যাম এর ইন্জিনিয়াররা। তারা এর সাথে বরফ এবং ঠান্ডা পানির স্প্রে ব্যবহার করে। যদিও এতে শ্রমিকদের ভায়নক স্বাস্থ ঝুকি থেকে যায়। কিন্তু এ ছারা আর কোন উপায় নাই।

আগেই বলেছি চীনের ইয়াংজি নদি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটি গুরুত্বপুর্ন নদী। এই নদী দিয়ে প্রচুর মালবাহি এবং মানুর্ষ বাহি জাহাজ চলাচল করে। কিন্তু ড্যাম তো অনেক উচু এবং পুরো পানি পথকে আটকে দিয়েছে। এই সমস্যার সমাধান করেছে লক গেইট। আপনারা তো মনে হয় পানামা থালের লক গেইট গুলো দেখেছেন?? এখানেও একই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।



তবে পানামা থেকে এটির পার্থক্য হচ্ছে এখানে লকের সংখা ৫ টি যাতে সর্বোমোট ৪ ঘন্টার উপরে লাগে একটি জাহাজকে নিচে নামতে বা উপরে উঠতে। তবে এখানে একটি আশ্বর্যজনক নির্মান কাজ হচ্ছে। আর তা হচ্ছে পৃথিবির প্রথম এবং সর্ববৃহৎ জাহাজ বাহি লিফট যার প্রধান কাজ জাহাজ তুলবে এবং নামাবে। এত বড় লিফট পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখোনো তৈরি হয়নি।

সর্বোমোট ৩০০০ টন ওজন বহন করতে পারবে লিফটি। এটি একটি হাইড্রোলিক লিফট। তবে লিফটটির কন্সট্রাকশন কাজ এখনো চলছে।



সর্বশেষ জানা গেছে লিফটটির চারটি কলামের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ শেষ করে এটি জাহজ উঠানামার কাজ শুরু করতে ২০১৫ সাল নাগাদ শুরু করতে পারে।

এর পর সমস্যা ছিল ইরোশন এবং সেডিমেন্টেশন। আগে বলি এই জিনিষটি হচ্ছে নদির পানির বয়ে আনা বিপুল পরিমানে পলি যা নদিল পারের অনেক দুর পর্যন্ত মাটিকে উর্বর করে এবং ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করে। কিন্তু এই ড্যামটি এই পলিবহনের কাজটি একেবারে থামিয়ে দেবে যা পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভারসম্যকে নস্ট করবে। তাই এই ড্যামটির নিচে ঠিক নদির সেডিমেন্টেশেন স্তরে একটি বিশাল গর্ত সমৃদ্ধ পাইপ বসানো হয়েছে। ফলে ড্যামটির পুরোপুরি না হলেও ৪০-৫০% পলিমাটি পানির সাথে ছেরে দিতে পারে।



উপর থেকে নেয়া ছবিটিতে খেয়াল করুন টারবাইনের ছোরা পানি ছারাও নিচ দিয়ে ঘোলা একটি পানি যাচ্ছে। এটিই হচ্ছে মুলত সেডিমেন্টশনের পানি।

ড্যামটি তৈরিতে একটি বিশাল পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো হয়েছে। কারন ড্যামের ঠিক পিছনে একটি সুবিশাল বনান্চল ধংশ হয়েছে রিজার্ভারের পানির কারনে। প্রায় ৬৩০০ প্রজাতির গাছ তার আসস্থল হারিয়েছে। যার মধ্যে ৫৭ শতাংশই বিলুপ্তপ্রায়। এছারা বিপুল পরিমান বন্যপ্রানি তার আবাসস্থল হারিয়েছে। আবাস্থল হারিয়েছে প্রায় ১৩,০০,০০০ মানুষ যারা সবাই ওই অন্চলের আদিবাসি। যাদের প্রায় অর্ধেকই আর নতুন সমাজের সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি। এছারা অনেকেই সরকারের প্রতিশ্রুত নতুন

আবাসস্থল পাননি।

এই লেখাটি লিখেঠি মুলত না জানাকে জানার জন্য। আমি নিজেও অনেক কিছু শিখেছি।

আর উৎসর্গ করছি রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার তাদের প্রতি। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের ধংস ছারা আরকিছু দিবে না। তাই আসুন সব ভেদাভেদ ভুলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং এর সুন্দর বন ধংসকারি এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র কে না বলি।

এতক্ষন কস্ট করে পরার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

বিষয়: বিবিধ

৩৮৪১ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

190768
১১ মার্চ ২০১৪ রাত ০৮:৫১
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : আপনার লেখাটা পড়ে খুব ভালো লেগেছে।
১১ মার্চ ২০১৪ রাত ০৯:০১
141712
বশর সিদ্দিকী লিখেছেন : আপনি খুব দ্রুত পরতে পারনে মনে হয়। তবে একটু সময় নিয়ে পরলে বুঝতে আরো সুবিধে হবে। ধন্যবাদ।
190782
১১ মার্চ ২০১৪ রাত ০৮:৫৯
হতভাগা লিখেছেন : ইয়াংজি নদী কি আন্তর্জাতিক নদী ? এটার মাধ্যমে কি অন্য দেশকে ফারাক্কার মত বাঁশ দেওয়া গেছে ?

সুন্দর পোস্ট দিয়েছেন । এরকম আরও চাই ।
১১ মার্চ ২০১৪ রাত ০৯:০২
141714
বশর সিদ্দিকী লিখেছেন : না ভাই। এটা চিনের একেবারে নিজস্বনদি। আমি লিংক দিতে চাচ্ছিলাম কিন্তু এই ব্লগে লিংক দেয়া একটা খুব কস্টের কাজ। জানিনা কবে কর্তৃপক্ষ এগুলো আরো সহজ করে আনবেন।
190870
১১ মার্চ ২০১৪ রাত ১০:০৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ এই সুন্দর শিক্ষামুলক পোষ্টটির জন্য।
তবে নামটি কি থ্রি জর্জেস না গর্জেস হবে।
১১ মার্চ ২০১৪ রাত ১০:২৭
141829
বশর সিদ্দিকী লিখেছেন : নামটা নিয়া আসলে অনেক বিতর্ক আছে। তবে চায়না অথরিটি এটা জর্জেস বলে সম্মোধন করেছে। মুলত তিন জন জর্জ টাইপের কিছু একটা থেকে নামটা এসেছে।
191371
১২ মার্চ ২০১৪ রাত ০৯:৫৩
সজল আহমেদ লিখেছেন : ভাল লাগল ধন্যবাদ।
১৩ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:২৩
142690
বশর সিদ্দিকী লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File