যে কারণে ভারতের “বাংলাদেশ নীতি” পরিবর্তন জরুরি
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ২০ মে, ২০১৪, ০২:০৯:৩৯ দুপুর
ভারতে সদ্য অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশে চলছে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা। ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে চলতি মাসের ১২ তারিখে শেষ হওয়া নির্বাচনটির ফলাফল প্রকাশিত হয় গত ১৬ মে’। ভারতের লোকসভা নির্বাচন বরাবরই এই উপমহাদেশের প্রতিটি দেশের জন্যই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। ফলে বিগত নির্বাচনটি বাংলাদেশের জন্যও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুরু থেকে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত তাই পুরো নির্বাচনের গতিবিধি নিবিড়ভাবে মনিটরিং করেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। বের করার চেষ্টা করেছে দলীয় সুবিধা আদায়ের ফাঁক-ফোকর। ভারতের সরকার পরিবর্তন হলে বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বে কিনা বা সরকার পরিবর্তনে বাংলাদেশের সরকারি দল ও বিরোধী দলের লাভ-লোকশান কোন ক্ষেত্রে কতটুকু তার হিসাব নিকাশ কষা হচ্ছে নির্বাচনের পূর্বে থেকেই। আর এ আলোচনা-পর্যালোচনার অন্যতম খোরাক এনে দেয় বাংলাদেশ সম্পর্কে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর বিতর্কিত কিছু উক্তি। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হয়ে তিনি যদি প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে ১৬ মে’র পর বাংলাদেশিদের তল্পীতল্পা গুটিয়ে ঝেঁটিয়ে ভারত থেকে বিদায় করা হবে বলে এক জনসভায় তিনি হুঁশিয়ারি দেন। এর আগে এক বিজেপি নেতা বিহারের একটি জনসভায় বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দাবি করে বসেন। এ সকল কারণে নির্বাচনে জয়ী হলে বিজেপির বাংলাদেশ বিষয়ক অবস্থান নিয়ে শঙ্কায় পড়েন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। কারণ, ভারতের সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কটাই এমন যে, ভারতের সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়া এক প্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার। বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যাগুলোর একটি বিরাট অংশ রয়েছে যেগুলোর সমাধানে ভারতের সহযোগিতা বাঞ্ছনীয়। আবার ভারতের সামান্য অসহযোগিতাই এদেশে শত শত সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট।
যাই হোক, নির্বাচনের ফলাফল মোতাবেক বিজেপি এখন ক্ষমতা গ্রহণের দ্বারপ্রান্তে। সুতরাং সেই নরেন্দ্র মোদীই হতে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এখন দেখার বিষয় ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কেমন হতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে মতামতেরও কোনো অন্ত নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চিন্তাবিদরা মনে করছেন না যে, ভারতের নতুন সরকারের অধীনে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে পরিবর্তন আসবে। তাদের মতে, বিগত কংগ্রেস আমলের বাংলাদেশ নীতিই বিজেপি অনুসরণ করবে। একই মনোভাব বাংলাদেশ সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপিরও। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে বললেন, ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসলেও পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন না আসাটাই বা বাংলাদেশের জন্য কতটুকু সুবিধাজনক হবে? বিগত কংগ্রেস আমলে ভারত বাংলাদেশ বিষয়ক যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তার কতটুকু সুফল আমরা পেয়েছি? বিজেপি সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে বিগত কংগ্রেস সরকারেরই পদচিহ্ন অনুসরণ করবে- এমনটাই যদি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায় তাতেও বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের পার পেয়ে যাবার কোনো উপায় আছে কি?
বিগত বছরগুলোতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক আমরা দেখেছি তাকে কোনোভাবেই পারস্পরিক সহযোগিতামূলক ও ভারসাম্যযুক্ত সম্পর্ক বলা যায় না। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তার অধিকাংশই ছিল একপেশে, যার দ্বারা বাংলাদেশের স্বার্থ খুব কমই অর্জিত হয়েছে। দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মাটিতে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে অর্থনৈতিকভাবে ভারত বিপুল পরিমাণ সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কী পেয়েছি? কিছুই না। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জী যখন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো এই মমতা ব্যানার্জীই টিপাইমুখ ইস্যুতে বাংলাদেশের তীব্র বিরোধিতা করেন, এমনকি এ বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পর্যন্ত বসতে রাজী হন নি। বাংলাদেশ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, “সম্পর্ক গড়া যত কঠিন, ভাঙ্গা তার চেয়েও সহজ।” বাংলাদেশ ও ভারতের অভীন্ন ৫৪ টি নদীর উপর ৫৩ টি বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে বছরের পর বছর ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে, এখানকার কৃষকরা ফসল ফলাতে না পেরে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে সেই পানির গতিপথ ঘুরিয়ে ভারত নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করছে। বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে ভারতের এমন আচরণ বাংলাদেশের জনগণের কখনই কাম্য ছিল না। অন্যদিকে সীমান্ত হত্যা চলছেই। বারবার আলোচনা করার পরও এই সমস্যার কোনো যথাযোগ্য সমাধান আজ পর্যন্ত আসে নি। তাছাড়া মিডিয়া, খেলাধূলা, বিনোদন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কাছে থেকে কার্যত বন্ধুভাবাপন্ন সাড়া পায় নি। সুতরাং এই একই নীতি যদি নব্য বিজেপি সরকারও অটুট রাখে তাহলে আমাদের আত্মতুষ্টির কোনো কারণ আছে কি? দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের রাজনীতিবিদ ও সুশীলরা বিজেপি সরকার কর্তৃক কংগ্রেস সরকারের নীতি পরিবর্তন না হওয়ার জন্য আশা প্রকাশ করছেন। তারা অনেকটা ধরেই নিয়েছেন যে, বিগত কংগ্রেস সরকারের আমলে বাংলাদেশ যে বৈষম্যগুলোর সম্মুখীন হয়েছে তা বিজেপি সরকারের আমলেও হবে। কাজেই ও ব্যাপারে কথা বলে কোনো লাভ নেই। এই বৈষম্য যাতে বিগত দিনের চেয়ে বেড়ে না যায় সেটার জন্যই তারা মূলত চিন্তিত। কিন্তু এ হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করার জন্য চেষ্টা না করলে স্রষ্টাও সে ব্যক্তির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না। কাজেই আমাদের চাওয়া-পাওয়া, সুবিধা অসুবিধাকে যদি আমরা তুলে না ধরি, নিজেদের অধিকার আদায় করতে সত্যিকার অর্থে সচেষ্ট না হই তাহলে আমাদের স্বার্থ ভারত নিজে উদ্যোগী হয়ে যাচাই-বাছাই করবে না। তাই, আমাদেরকে আগে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে হবে। পার্শবর্তী দেশ হিসেবে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক ও সৌহাদ্র্যপূর্ণ আচরণ আমরা অবশ্যই করবো কিন্তু সে সম্পর্ক যাতে হয় সমমর্যাদা ও সমঅধিকার বাস্তবায়নের ভিত্তিতে- এ বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ভালোভাবে স্মরণ রাখতে হবে। আমাদের উচিত হবে সুসম্পর্ক নিশ্চিত করা, উভয় দেশের স্বার্থকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এ কাজে কতটা সফল হবেন তা প্রশ্নাতীত নয়। অন্যদিকে ভারতেরও উচিত হবে, এতদিন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে বৈষম্য ও ভারসাম্যহীন নীতি বজায় ছিল তা থেকে অচিরেই বেরিয়ে আসা। এই নীতি আধিপত্যকেন্দ্রিক না হয়ে হোক উভয় দেশের শান্তি ও সৌহার্দ্র্যপ্রেমিক জনগণের ভারসাম্যপূর্ণ স্বার্থকেন্দ্রিক- ভারতের নব্য সরকারের কাছে এমনটাই কাম্য।
বিষয়: বিবিধ
১০৪১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন