আমার আব্বু........
লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ০৩ মে, ২০১৪, ১০:১৪:০৩ রাত
২০১২ সালের জুন মাসের কোন এক সময়। আব্বুর সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছি। প্রায় ১ বছরের বনবাস। এর মধ্যে বাসা থেকে ফোন করলেও ধরিনি। নিজের বাসার ঠিকানাও কাউকে জানাইনি। তবে এর মধ্যে ১ বার বাসায় গিয়েছিলাম। ফুফুর কাছে শুনলাম আব্বু নাকি আমার কম্পিউটার বিক্রি করে দিয়েছে। কেন করেছে তার কারণ হিসেবে কিছুই বলতে পারলো না। শুনে আমার মাথায় আগুন লেগে গেল। এমনিতেই আমি বেশ শর্ট টেম্পার্ড। সাথে সাথে বাসায় গেলাম। গিয়ে আব্বুকে পেলাম না, পেলাম আম্মুকে। রাগের মাথায় অনেক কিছু বললাম। আম্মু একটি বারের জন্য কোন উত্তর দিলো না। ফিরে চলে এলাম বাসায়। বিছানায় শুয়ে নিজের অজান্তেই কিছু কথা মনে পড়ে গেল। শৈশবের কথা। আব্বু তখন কারখানা দিয়েছেন লালবাগে, আর আমরা থাকছি মিরপুরে। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আব্বু আসতেন। ততক্ষনে ছোট্ট আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু যখনই আব্বু আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতেন, তার চির চেনা আতরের সুবাসে আমার ঘুম ভেঙে যেত। আমি মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে দেখতাম আব্বু হাসছে। তার হাতে আমার প্রিয় চিপস্, বাকরখানি আর একটা কোকের বোতল। ছোটবেলায় আমি আবার কোক অনেক পছন্দ করতাম। ঝাঁপিয়ে পড়তাম আব্বুর গায়ে। একসাথে খেতে বসতাম। তারপর আব্বু তার গল্পের ঝুড়ি খুলতেন- নবীদের গল্প, সাহাবাদের গল্প, আল্লাহর খাস বান্দাদের গল্প..........কিভাবে ১২ বছরের ছেলে মুয়াজ বিন জাবাল (রাযি.) আবু জাহলকে মৃত্যু অবস্থায় নিয়ে গেল, কিভাবে নাম না জানা এক কিশোর সাহাবা দুই লক্ষ সৈন্য ডিঙিয়ে রোমান সেনাপতির মাথা কেটে এনে আবু উবাইদাহ (রাযি.) এর সামনে পেশ করলো, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মেরাজে কী কী দেখলেন, থানভী (রহ.) ছোটবেলায় কী কী করতেন, আরো কত কি। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম।......এখনো আমার মনে হলো আমি আব্বুর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। ভাবতেই চোখ থেকে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
পরদিন যথারীতি কোচিংয়ে ক্লাশ নেওয়া, টিউশন ইত্যাদি সেরে বাসায় আসতেই পাশের রূমের একজন আমার হাতে বেশ কিছু টাকা ধরিয়ে দিলো। জানতে পারলাম আমারই এক খুব নিকটবন্ধূ টাকাগুলো দিয়ে গেছে। কিন্তু কেন সে আমাকে টাকা দিবে? ফোন করলাম। শুধু বললো, আব্বু তার মাধ্যমে টাকাগুলো পাঠিয়েছে। আর কিছু বলতে চাইলো না। আমি বারবার প্রশ্ন করাতে শুধূ এতটুকু বললো, ”আঙ্কেল পিসিটা বিক্রি করেছে কারণ তোর ছোটটা সেদিন কি-বোর্ড ভেঙে ফেলেছে। তাই তিনি ভাবছিলেন এভাবে পড়ে থাকলে নষ্ট হয়ে যাবে, বরং বিক্রি করে দিলে পরে টাকাটা দিয়ে আরেকটা কিনে নেয়া যাবে। তবে তুই যা করলি তা কোন মানুষ করতে পারে না।” ফোনটা নিঃশব্দে রেখে দিলাম। চোখের কোণায় তরল কিছু একটার অস্তিত্ব অনুভব করলাম।
কয়েকদিন পরে...
এর মাঝের সময়টা অনেক ভেবেছি, বাসায় গিয়ে আব্বু-আম্মুর পায়ে ধরে আমার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইবো। কিন্তু কেন যেন পারছিলাম না। কোন এক অজানা কারণে কয়েকবার পথ পরিবর্তন করে ফিরে এসেছি। সেদিন বিকেলে আমার বড় বোনের ফোন আসলো। আব্বু অসুস্থ্য। হঠাৎ করেই পা ব্যথা। তার পর থেকে হাটতেও পারেন না, উঠতেও পারেন না। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আর কোন পিছুটানের পরোয়া না করেই বাসায় ছুটে গেলাম। আব্বু বিছানায় শোয়া। হয়ত ঘুমিয়ে আছে। আম্মু. আপু আর ফুফু আব্বুর পাশে বসা। কিছু না বলেই আব্বুর পায়ে হাত রাখলাম। নিজের অজান্তেই কান্না এলো...প্রচন্ড কান্না। এরই মধ্যে আব্বুর ঘুম ভেঙে গেছে আমি খেয়াল করিনি। মাথায় চিরচেনা এক স্পর্শ অনুভব করলাম। আব্বু আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর বলছে, ”কান্নার কি আছে! খাওয়া দাওয়া করেছো? মনে তো হয় না.....খেয়ে নাও।” তার কথা থেকে কেউ একটুও বুঝতে পারবে না, কিছুদিন আগেও এই অপদার্থ ছেলেটা তাকে বেশ কটা কথা শুনিয়ে গেছে। বাবারা হয়তো এমনি হয়.......
এরপর থেকে আর নিজের আলাদা বাসায় ফিরে যাওয়া হয়নি। আব্বু আমার ছোট ভাইকে পাঠিয়ে আমার বইপত্র আর বাকি মালসামানা আনালেন। আমি আবার নিজের পরিবারের মাঝে থাকতে শুরু করলাম।
২০১৩ সালের শেষ দিকে। একদিন রাতে বাসায় ফিরে এসে আব্বু বললেন, ”আমার কোমরে কেমন জানি একটা ব্যথ্যা হচ্ছে।” সেই ব্যথা বাড়তেই থাকলো। আব্বু হাটার শক্তি হারিয়ে ফেললেন। বাধ্য হয়ে আব্বুকে ভর্তি করতে হলো মিরপুরের খ্যাতনামা একটি বেসরকারী হাসপাতালে। সেখানের একজন সিনিয়র চিকিৎসকের সাথে আমার খুব ভালো ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিলো। তার বিশেষ তত্ত্বাবধায়নে আব্বুর অবস্থার একটু উন্নতি হতে লাগলো।
হাসপাতালে ভর্তির প্রায় দেড় মাস পর। আমি সেদিন সকালে যেতে পারিনি অফিসের জরুরী কাজ থাকায়। দুপুরে আম্মুর ফোন আসলো, সেখানকার একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমার সাথে জরুরী ভিত্তিতে দেখা করতে চান। দেরী না করে মোটর সাইকেল নিয়ে রওনা দিলাম। দেখা হলো সেই চিকিৎসকের সাথে। তিনি যা বললেন, তা আমার জন্য বজ্রপাতের চেয়ে কোন অংশে নয়। তার ভাষায়, আব্বুর ফুসফুসে অস্পষ্ট কোন একটি বন্তু দেখা গেছে, যা আসলে কি তা তারা নির্ধারণ করতে পারছেন না। এরই সাথে আব্বুর ডায়বেটিস ও অনেক বেড়ে গেছে। কিডনীতেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাদের পরামর্শে আব্বুকে নিয়ে গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অতঃপর শুরু ভোগান্তির পর ভোগান্তি। সীট নেই...... পরীক্ষা করাতে গিয়ে দিনের পর দিন ঘোরাঘুরি, নার্স নেই, ডাক্তার নেই, আরো কত কি। কিন্তু আব্বু কখনো সাহস হারান নি। বরং আমরা শঙ্কিত হলে আমাদের সাহস যোগাতেন। এর মধ্যে একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম আব্বু আর নেই। স্বপ্নের মধ্যেই চিৎকার দিয়ে কাঁদতে চাইলাম। কিন্তু গলা থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছিলো না। বিষয়টা শুধুমাত্র আমার ছোট ভাইয়ের সাথে শেয়ার করলাম। সে আমাকে সাহস দিলো, বললো ইনশাআল্লাহ আব্বু ভালো হয়ে যাবে। সেদিন হাসপাতালে গিয়ে আব্বুর পা ধরে অনেক ক্ষন কাঁদলাম। কেউ বুঝলো না আমি কেন কাঁদছি, আব্বু হয়তো বুঝতে পেরেছিলো। তিনি বললেন, ”কান্ন্াকাটি করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এরপর আব্বুর অবস্থা কখনো ভালো, কখনো খারাপ। ডাক্তাররাও স্পষ্টভাবে কিছু বলতে পারছিলো না। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্ঠা করে যাচ্ছিলাম। প্রয়োজনীয় কোন কিছু যোগাতে বিন্দু মাত্র দেরী হতো না। প্রায়ই পরীক্ষার জন্য আব্বুকে বিভিন্ন ডায়াগোনস্টিকে নিয়ে যেতে হতো। স্ট্রেচারে করে নাড়াচাড়া আব্বুর খুব অপছন্দ। কতবার যে আমাকে বকা দিতেন। বলতেন, দরকার নাই। আমার এত ঘনঘন এ্যাম্বুলেন্সে করে যেতে ভালো লাগলো না।
ফেব্রুয়ারী ১, ২০১৪। সেদিন সারাদিনই বাসায় একটার পর একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছিলো। একবার পাশের বাসার বিদ্যুতের লাইন কাটতে গিয়ে আমাদের বাসার লাইন কেটে দিলো। সেটা ঠিক করতে না করতেই ওয়াসার লোক এসে একগাদা রিকোয়ারমেন্ট ধরিয়ে দিয়ে গেল। এভাবেই সারাদিন হাসপাতালে যাবো যাবো করে আর যাওয়া হলো না। এর মধ্যে বেস কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। আব্বু নাকি বলছিলো, আমি যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু কাজের কারণে যেতে পারছি না শুনে বললো, থাক। এতো চাপ নেওয়ার দরকার নেই। রাত আনুমানিক ৮.৩০ বা ৮.৪৫ এর দিকে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসলো। রিসিভ করতেই আম্মু ওপার থেকে শুধু এতটুকু বললো, বাবা জলদি আয়। আমি বুঝতে পারলাম খুব ভয়াবহ কিছু একটা হয়ে গেছে। কোন রকমে একটা সিএনজি নিয়ে রওনা দিলাম। পথিমধ্যেই জানতে পারলাম আব্বু আর নেই। হঠাৎ করেই নাকি তার খুব খারাপ লাগা শুরু হলো। তারপর আস্তে আস্তে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে রওনা দিলেন পরম আরাধ্য আল্লাহর দরবারে।
তারপর আব্বুকে বাসায় আনা হলো, পরদিন বাদ জোহর জানাযার পর দাফন করা হলো কবরস্থানে। জানাযায় ইমামতি করেন মাওলানা নোমান মাজহারী সাহেব। এর মাঝের সময়টুকুতে যে কি হয়েছে. তা এখন আর মনে করতে পারি না। সবকিছুই স্বপ্নের মতো মনে হয়। ভাবি হয়তো ঘুম ভাঙলেই আব্বুর দেখা পাবো। কিন্তু তা আর হয় না।
গত কয়েকবছর ধরেই আমার কিছু অদ্ভুদ সমস্যা হতো। রাতে ঘুমাতে গেলে প্রায়ই মাথা ঘুরতো আর মনে হতো আমাকে ঠেলে কবরে ঢুকানো হচ্ছে। প্রচন্ড ভয় পেতাম। কী করব বুঝতে পারতাম না। কখনো কখনো রুম থেকে বের হয়ে পাগলের মতো বারান্দায় ছোটাছুটি করতাম। আব্বু গভির রাত পর্যন্ত জেগে কিতাবে ডুবে থাকতেন। আব্বু বিষয়টা লক্ষ্য করেছিলেন। কাছে ডেকে নিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। দুআ পড়ে ফু দিয়ে দিতেন আর বলতেন সব ঠিক হয়ে যাবে। কখনো হয়তো আমি এই সমস্যায় রূমের মধ্যে ছটফট করছি, আব্বু কিভাবে জানি বুঝতে পারতো। এসে দরজায় টোকা দিতেন। দরজা খুলতেই জিজ্ঞেস করতেন, সেই সমস্যা কি আবারো হচ্ছে? পাশে থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন আর সাহস যোগাতেন।
আব্বু, তোমার মনে আছে? গত বছরের এমনি এক দিনে তুমি আমার কী প্রচন্ড রাগ করেছিলে, বাইক চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করার কারণে? ডিসেম্বরের এমনি এক দিনে তুমি আমাকে বসিয়ে কত সুন্দর করে বুঝিয়েছিলে জীবনে সব কিছু এভাবে হেলায় ঠেলে দিতে হয়না, সবকিছুকে এভাবে এড়িয়ে চলতে হয় না। সম্পকের্র গুরুত্ব বুঝতে হয়, দায়িত্ব নিতে শিখতে হয় এবং দায়িত্ব পালন করতে শিখতে হয়। এমনকি তোমার চলে যাওয়ার মাসের এমনি এক দিনে তুমি আম্মুকে বলেছিলে, আমার বড় ছেলের উপর যত অভিমান, যত অসন্তুষ্টি ছিলো সব আমি ভুলে গেছি কারণ ও এখন বুঝতে শিখেছে।
এখনো বিশ্বাস হয়না, তুমি আমাদের মাঝে নেই। এখনো যখন রাত করে ঘরে ফিরি, দরজা ঠেলে ঢুকতে গেলে মনে হয় এই বুঝি তুমি এসে বলবে "রাত কয়টা বাজে? এত রাত পর্যন্ত বাইরে কী?" দরজার পাশে রাখা তোমার স্যান্ডেল দেখলেই মনে হয়, তুমি বুঝি সেই আগের মতোই তোমার বসার স্থানে বসে কিতাব নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু তুমি যে নেই.........................
আব্বু- এখনো রাতে আমি বাজে স্বপ্ন দেখি। অস্থির হয়ে সারা বাড়িতে দাপিয়ে বেড়াই, কিছুতেই শান্তি পাই না। তুমি থাকলে তোমার কাছে গিয়ে বলতেই তুমি দুআ পড়ে ফু দিয়ে দিতে আর বলতে "সব ঠিক হয়ে যাবে। অনিয়ম করা বন্ধ কর আর নিয়মিত নামাজ পড়, কুরআন তিলাওয়াত করো, তাহলে আর সমস্য হবে না।" কিন্তু তুমি আজ নেই.........ভাবতেই মনে হয় হয়তো স্বপ্ন দেখছি, চোখ খুললেই হয়তো দেখবো সকাল হয়ে গেছে আর তুমি আম্মুকে বলছো, "তোমার ছেলের ঘুম কী শেষ হয়নি?" কিন্তু এ কেমন নিষ্ঠুর বাস্তবতা- যা মেনে নিতে ইচ্ছে করে না?
আব্বু... তোমাকে খুব মিস করি, তুমি যেখানেই আছো- আমাদের কী তুমি মিস করো না?
বিষয়: Contest_father
২৩২৪ বার পঠিত, ৩৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনার আব্বুকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুক
আপনার বাবার চেহারায় তো আল্লাহওয়ালাদের নুর আছে আলহামদুলিল্লাহ।
যাক এখন বাবা আর কখনও কম্পিউটার বেচবেননা।
আপনি বাবার জন্য এখন বেশি বেশি দোয়া করবেন।
আপনার আব্বুর সাথে হয়তো কখনও আমার সাক্ষাৎ হলেও হতে পারে মনে হচ্ছে আমার।
তিনার নাম কি ছিলো?
অভিনন্দন জানিয়ে গেলাম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন