কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা মুছে যাওয়া সভ্যতার ইতিহাস
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০১:২৩:১০ রাত
>>বইঃ কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা মুছে যাওয়া সভ্যতার ইতিহাস
>>লেখক: সুমিতা দাস
>>প্রকাশনী: পিপলস বুক সোসাইটি, কলকাতা।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা সম্পৃক্ত ইতিহাস (connected histories) রচনা। জাতিরাষ্ট্র অঞ্চল দেশ মহাদেশ ইত্যাদি ঐতিহ্যগতভাবে সীমায়িত ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে সীমায়িত না থেকে নানা অঞ্চল, দেশ, মহাদেশের মধ্যে যোগসূত্রের উপর আলোকপাত করে ইতিহাস রচনাকে নতুন মাত্রা দেওয়া। এই ধরনের ইতিহাস রচনার সাথে সাথে নতুন প্রশ্ন ও পদ্ধতিও উঠে আসে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সাম্রাজ্যবাদের উপর ধ্রুপদী ইতিহাস রচনায় জোর দেওয়া হতো শাসক-রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতা কেন্দ্রের উপর। শাসক-রাষ্ট্র কেমন করে উপনিবেশের উপর প্রভাব ফেলেছে, ঔপনিবেশিক ক্ষমতা, সংস্কৃতিকে গ্রাস করেছে- তার উপর। এর সাথে যুক্ত ছিল ঔপনিবেশিক প্রতিরোধের ইতিহাস। এই ক্ষমতা-প্রতিরোধের মডেলের বাইরে গিয়ে নতুন ইতিহাস রচনার স্বাক্ষর রাখল সম্পৃক্ত ইতিহাস যেখানে শাসক-রাষ্ট্র/উপনিবেশ পরস্পরযুক্ত, এককে বাদ দিলে ওপরের ইতিহাস রয়ে যায় অধরা, অসম্পূর্ণ। ধ্রুপদী ইউরোপ কেন্দ্রিক ইতিহাস চর্চা থেকে সরে গিয়ে মানব সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাসকে একটু কম একপেশে দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণই সম্পৃক্ত ইতিহাসের উদ্দেশ্য। তবে একটি সমস্যা থেকেই যায়। সম্পৃক্ত ইতিহাস লিখতে গেলে চাই বিভিন্ন সমাজ ও সভ্যতা সম্বন্ধে সমপরিমাণ জ্ঞান আর ধ্রুপদী ইতিহাস চর্চায় এই সমতার পরম অভাব। সুমিতা দাস তার বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন আমাদের চিন্তাজগৎ প্রায় পুরোপুরি ইউরোপ বা আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক। আমেরিকার ইতিহাস বা পশ্চিমি ইতিহাস বলতে বুঝি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বা পশ্চিম ইউরোপের ইতিহাস। আমেরিকার ইতিহাস যে নানান সভ্যতার মিশেল দিয়ে তৈরি, এবং বিশ্ব ইতিহাস যে একাধিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র, তা ফুটে উঠেছে কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা ।
>>এছাড়া পাবেন কিছু প্রশ্নের উত্তর, প্রশ্নগুলো এরকম : ১) কলম্বাস যখন আমেরিকায় গেলেন তখন আমেরিকার জনসংখ্যা কীরকম ছিল ? ২) সেখানকার অধিবাসীদের জীবনযাত্রা কীরকম ছিল— তারা কি শিকার করে আর ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন নির্বাহ করতেন (হান্টার্স অ্যান্ড গ্যাদারাস), নাকি কৃষি ছিল? ভ্ৰাম্যমাণ উপজাতি, নাকি স্থায়ী গ্রাম ছিল ? শহর ছিল ? ৩) যদি বলেন শহর ছিল, তাহলে কত বড় শহর ছিল ?
>> জানতে পারবেন, ভুট্টা, আলু, লংকা, টমেটো, পেঁপে, নানা ধরনের বিন, কুমড়ো, চীনাবাদাম, কাজুবাদাম, আনারস, সূর্যমুখী, পেয়ারা, সবেদা, আতা, শাকালু, রাঙালু, স্কোয়াশ, ক্যাপসিকাম, ট্যাপিওকা, অ্যাভোকাডো, তামাক, রবার, অ্যামারান্থ, ভ্যানিলা, কোকো। কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকার অধিবাসীদের কৃষিজ আবিষ্কারের এই তালিকাটি ভোজনরসিক বাঙালির মনে ধরবে।
>>এ কথা আজ বহুল প্রচারিত যে আমেরিকান সভ্যতা মূলত ইউরোপীয় সভ্যতার ধারাবাহিকতা। ইউরোপীয়রা আমেরিকা মহাদেশ দুটিতে গেলেন, গড়ে উঠল আমেরিকান সভ্যতা— এই তত্ত্ব বিশ্বাস করানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। ইউরোপীয়দের ভ্রমণবৃত্তান্তগুলি পড়লে মনে হয় ঐ অঞ্চলকে সভ্যতার আলোকে আলোকিত করার জন্যই ইউরোপীয়রা ঐ অঞ্চলে পা রেখেছিলেন।
>>ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয়রা যে সম্পদের নেশায় আমেরিকা মহাদেশ দুটিতে পাড়ি দিয়েছিলেন— তা অক্ষমের ভ্রান্ত অভিযোগ হিসাবে দেখানো হয়।
>>অথচ ইউরোপীয়রা আসার বহু আগে থেকে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেই ইতিহাসই এই গ্রন্থে লেখক নিপুণতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। সাম্প্রতিক কালের গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে ১২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের
>>আগেও উত্তর আলাস্কা অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই অঞ্চলে শিকারের নানাবিধ সরঞ্জামের সন্ধান পেয়েছেন। নিউ মেক্সিকোর ক্লোভিস অঞ্চলে সূক্ষ্ম কারুকার্যকরা ছুচোলো বর্শার খোজ পেয়েছেন তারা। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে, এই বর্শাগুলির সময়কাল ১২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। মোটামুটি একই সময়ে দক্ষিণ আমেরিকাতেও যে অধিবাসীরা সুপ্রতিষ্ঠিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, তারও বিস্তর প্রমাণ ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা পেয়েছেন। সে সব অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রথমে ম্যামথ শিকার করতেন। তারপর ম্যামথ অন্তহিত হবার পর তারা বাইসন শিকার করে ক্ষুগ্নিবৃত্তি করতেন।
>>তারপর ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমেরিকান আদিবাসীরা কৃষিজ উৎপাদনের কৃৎকৌশল আয়ত্ত করলেন। ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ মেক্সিকোর মধ্যাঞ্চলের আমেরিকানরা শস্য, স্কোয়াশ, বিন ইত্যাদি কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদন করতে শিখলেন। কৃষিজ উৎপাদন সংক্রান্ত জ্ঞান ক্রমে আরও উত্তর দিকে বিস্তৃত হতে থাকে। ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ নিউ মেক্সিকো ও আরিজোনার উপত্যকা অঞ্চলে আরও উন্নত মানের শস্য উৎপাদিত হয়। তারও বেশ কিছু পরে ঐ অঞ্চলে আদিম সেচ ব্যবস্থার নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, মেক্সিকোর পাশ্ববর্তী অঞ্চলে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ সুবিন্যস্ত গ্রামীণ জীবন গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে মেক্সিকো, ফিনিক্স, আরিজোনা প্রভৃতি অঞ্চলের অধিবাসীরা বল খেলার মাঠ, পিরামিড ধরনের কাঠামো ও বেশ উন্নত মানের সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। সুতরাং এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই যে আমেরিকার আদি মানুষেরা তাদের মতো করে সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। প্রখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যিক জ্যাক লন্ডনের বেশ কিছু লেখায় উত্তর আমেরিকার জনজাতিদের কথা উঠে এসেছে।
>>এই সুদীর্ঘ সভ্যতার ইতিহাস বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে গেছে। মায়া, অ্যাজটেক, ইনকা প্রভৃতি সভ্যতার কথা স্কুল ইতিহাসের পাঠ্যবইতেও স্থান পায় না। আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের (রেড ইন্ডিয়ান) বিতাড়িত করে তাদের ভূমিতে গড়ে উঠেছে আধুনিক ‘মার্কিন সভ্যতার ইমারত— এ কথাই বা ক’ জন শিক্ষিত মানুষ মনে রেখেছেন? আসলে এ সমস্ত কিছুকে বিস্মৃতির অন্তরালে পাঠিয়ে দেওয়া ইউরোপীয়দের এক সচেতন প্রয়াসের অনিবার্য পরিণতি। কেন এই সচেতন প্রয়াস ? তার প্রধান কারণ, পৃথিবীর যাবতীয় সভ্যতার উৎসমুখ ইউরোপ কেন্দ্রিক, এই মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করা।
>>মানুষের কাছে অস্বস্তিকর তথ্যগুলি সচেতনভাবে লোপাট করতে চেয়েছে। ইতিহাসের বিচারে তারা কলঙ্কিত হতে চায় নি। আমেরিকার ইতিহাসও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ফরাসি ঐতিহাসিক জাঁ শ্যেন্যের (Jean Chesneaux) Pasts and Futures or What is History For গ্রন্থে লিখেছিলেন, “বিশ্বের ইতিহাসের সেটুকু অংশেরই অস্তিত্ব আছে, যেটুকু অত্যাচারীরা আমাদের জানতে অনুমতি দিয়েছে”।
>> আমেরিকা মহাদেশের হারিয়ে যাওয়া সভ্যতাগুলির ইতিহাস এক সূত্রে গেথেছেন এই গ্রন্থের লেখক।
বিষয়: বিবিধ
২০০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন