কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর, পর্ব-৩: আত্মপরিচয়ের সংকট ও বহুধা বিভক্ত সমাজ
লিখেছেন লিখেছেন মাহরুফ চৌধুরী ০৩ মে, ২০১৩, ০৬:৩৪:০৩ সকাল
লেখকের কৈফিয়ত
বিডিব্লগ কর্তুপক্ষের কাছ থেকে ইমেইল পেলাম যে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিরোধী কোনো শিরোনাম গ্রহণযোগ্য নয়’। তাই গত দুই পর্বে মডারেটর মহোদয়, আমার ব্লগের শিরোনাম পরিবর্তন করে দিয়েছেন ‘কোন পথে বাংলাদেশ’। ‘বাংলাদেশে কী গৃহযুদ্ধ আসন্ন’ শিরোনামটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে আমি নিজেও এমুহূর্তে জানি না, এলেখা আখেরে জ্ঞানীয় পর্যালোচনায় কতদূর সফল হবে। সে যাই হোক, একজন লেখক হিসেবে আমি মনে করি নিজের লেখাটির নাম নির্বাচনের স্বাধীনতা আমার থাকা উচিত। তাই এপর্ব থেকে কর্তৃপক্ষের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি আমার এলেখার শিরোনাম পরিবর্তন করে ‘কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর’ রাখছি। আশাকরি কর্তৃপক্ষের এনতুন নামে কোন আপত্তি থাকবে না।
তিন: আত্মপরিচয়ের সংকট: বহুধা বিভক্ত সমাজ
আমরা আমাদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মেলবন্ধে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথকে সুগম করেছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকালে রাজনৈতিক সুবিধাবাদী শ্রেণী ও তাদের উতসাহ দাতা এবং অনুসারীরা অতিসুকৌশলে আমাদের সমাজ জীবনকে বহুধা বিভক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। আসলে ঔপনিবেশিক পেতাত্মা জাতিকে ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতিমালার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফয়দা হাসিল করে যাচ্ছে বিভিন্নভাবে।
হতাশ হই, যখন আমরা অহেতুক জড়িয়ে পড়ি জাতিসত্তার পরিচয়ের বিতর্কে। এখনও আমরা যুক্তিতর্কে ঘাম ঝরাই- আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী? প্রকৃতপক্ষে জাতিসত্তার যে নানা পরিচয় হতে পারে সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি আমরা এখন রাখি না। ফলে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও আমরা একমত হতে পারছি না। আসলে এটা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাগ্রসরতার ব্যর্থতার প্রমাণ। কারণ দুটোই আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়- প্রথমটি আমাদের সাংস্কৃতিক জাতিসত্তার পরিচয়, আর অপরটি আমাদের রাজনৈতিক জাতিসত্তার পরিচয়। এই সহজ সত্যটুকু মেনে নিতে আমাদের বাঁধা কোথায়? বিভেদের রাজনীতিতে মশগুল বলেই দেশ ও জাতির স্বার্থে আত্মপরিচয়ের সংকট নিরসনের সময় আমাদের নেই।
আমরা এক ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিমুখ জাতি। আমরা ভুলে যাই যে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে আমরা একটি সমৃদ্ধ জাতি। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে আমরা হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তেমনি আমাদের রক্তধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে নানা জাতির রক্ত। আত্তীকরণের মধ্যে দিয়েই সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি আমাদের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। যে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল আমাদের জাতীয় জীবনে আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে লালন-পালন ও পরিচর্যার সুযোগ দিচ্ছে না, সেখানে আমরা নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ কিংবা শাসক আশা করি কীভাবে? কিন্তু এই অবক্ষয় কবলিত আর্থ-সামাজিক ও সংস্কৃতিক পরিমন্ডল কি আমরা পরিবর্তন করতে পারি না? অবশ্যই পারি। সেটা করার জন্য যে ত্যাগ আর পরিশ্রমের প্রয়োজন সেই পথ করে দিতে হবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের আদর্শের বাস্তবায়নের মাধ্যমে। যোগ্য মানুষকে যথাস্থানে নিয়ে আসতে পারলেই, তাকে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারলেই সেটা সবার জন্যই হবে কল্যাণকর।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত জাতিগতভাবে আমাদেরকে যেভাবে নানা পরিচয়ে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে, সেই বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া। জাতীয় স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠা করা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীন জাতিসত্তার মাইল ফলক। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সে চেতনাকে কাজে লাগিয়ে একটি আদর্শের উপর দাঁড়ানো দরকার। তাহলে আমরা আর নিরর্থক বির্তকে জড়াবো না। নির্বাচনে পরাজিত দল বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানিয়ে দেশ গঠনে ক্ষমতাশীল দলকে সহায়তা দেয়ার মত উদার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। সেই সহায়তা হরতাল অবরোধের মাধ্যমে জনজীবনকে অতীষ্ট করে তোলার মাধ্যমে নয়- যদিও হরতাল-অবরোধকে গণতান্ত্রিক অধিকার বলা হয়ে থাকে- সেটা সামষ্টিক স্বার্থে অনেক সময়ই আত্মঘাতী, সেটা হবে সরকার যেখানে জনস্বার্থের পরিপন্থী কাজ করতে যাবে সেখানে তাকে বাস্তবতা, যুক্তিতর্ক, তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন এবং শান্তিপূর্ণ বাদ-প্রতিবাদ ও জনমত গঠনের মাধ্যমে বাঁধা দেয়া।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সুস্থ বিতর্ক হওয়া উচিত আমরা কোন ধরনের রাষ্ট্র চাই, তার জন্য কোন ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও পরিকাঠামোয় আমাদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশ নিশ্চিত করা যায়। কিভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতির অবস্থানকে সুসংহত করা যায়- সেই বিতর্কই এখন সবার আগে করা দরকার। পরিবর্তিত বিশ্ব-ব্যবস্থায় পারিপার্শ্বিক ও আন্তর্জাতিক আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং আধিপত্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে জাতিকে নিরাপত্তা কিভাবে দেয়া যেতে পারে, সেটাই হ্ওয়া উচিত আমাদের রাজনৈতিক আদর্শের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের সবার সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠবে নতুন বাংলাদেশ। আমরা ভবিষ্যতে কি হতে চাই, সেটাই হওয়া উচিত আমাদের রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়। আমাদের যদি কোন ভবিষ্যতই না থাকে, তবে পেছনমুখী বিতর্কে জড়িয়ে লাভ কোথায়?
একটি দেশের স্বাধীনতার অর্থ কেবল সেদেশের ভূ-খন্ডের উপর বসবাসকারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সীমাবদ্ধ নয়। জাতি হিসেবে যখন অধিবাসীরা সংঘবদ্ধভাবে ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে জাতিসত্তার পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং মুক্ত জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, তখনই কেবল জাতি হিসেবে তাকে প্রকৃত স্বাধীন বলা চলে। বহু ত্যাগ ও প্রাণের বিনিময়ে কেনা আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতা। চওড়া দামে কেনা এই স্বাধীনতাকে কত সস্তায় না আমরা বিকিয়ে দিচ্ছি! আমরা কি একটি হতাশাগ্রস্ত দু:খ-বিলাসী জাতিতে পরিণত হয়ে গিয়েছে? আমাদের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে, হবে- সেটাই তো স্বাভাবিক। বিশ্বের প্রতিটি স্বাধীন জাতিই তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা, স্বার্থ ও ভবিষ্যত নিয়ে সচেতন। সামাজিক কিংবা মানবিক অবক্ষয় নিয়ে হাপিত্যাস কিংবা রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নের কারণে হাল ছেড়ে দিলে কি চলবে? কারণ ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধিনতা’- এই সহজ সত্যটিকে আমাদের বুঝতে হবে।
পরিতাপের বিষয় যে, আমরা প্রায়শই দেখি আমাদের রাজনীতিবিদদের বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের দরজায় ধর্ণা দিতে। অবাক বিস্ময়ে আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের বাত-চিত। অথচ আমাদের রাজনীতিবিদরা কথায় কথায় বলেন যে তারা ‘জনগণকে সাথে নিয়ে’ পতিপক্ষকে ‘মোকাবেলা’ কিংবা ‘প্রতিরোধ’ করবেন। কিন্তু পক্ষে তারা জনতার দরজায় ধর্ণা দেন কেবল ভোটের সময়। আমাদের রাজনীতিবিদরাই কি কেবল খারাপ, নাকি আমরাও খারাপ? তাঁরাতো আমাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। আমরা তাদেরকে আমাদের নেতা হিসেবে নির্বাচিত করছি কিংবা মেনে নিচ্ছি বলেইতো তারা আমাদেরকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বুদ্ধিবৃত্তির দীনতার কারণেই আমরা নিজেদেরকে অসহায় ভাবি। এ ডিজিটাল যুগেও আমাদেরকে যেভাবেই নানা তথ্য আর তত্ত্ব খাওয়ানো হচ্ছে, আমরা সেভাবেই সেসব খাচ্ছি এবং বমি করছি। জ্ঞানীয় দ্বীপ্তিতে আলস্যকে ত্যাগ করে আমাদেরকে নিলর্জ্জ জ্ঞানপাপীদের খপ্পর থেকে নিজেদেরকে উদ্ধার করতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৪১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন