ইসলাম, গনতন্ত্র, খেলাফতঃ বিভ্রান্তি নিরসন -৮

লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ১৯ জুলাই, ২০১৩, ০১:৫৯:০৯ রাত

গনতন্ত্রকে কুফরি বলার মূল উপাদান হলো 'সার্বভৌমত্বে'র প্রশ্ন । আমরা আগেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দেয়া গনতন্ত্রের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি যে, গনতন্ত্রে 'জনগনের সার্বভৌমত্বের ধারণা' আবশ্যক নয় । অন্যকথায় বলতে গেলে এর কোন প্রয়োজন নেই। গণতন্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রন্থে সার্বভৌমত্বের ধারণাকে তেমন গুরুত্বের সাথে আলোচনাও করা হয় না । এছাড়া সার্বভৌমত্বের ধারণা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে একরকম তো নয়ই, তাদের অনুসৃত গনতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতিও বিভিন্ন । রয়েছে বিস্তর ফারাক ।

একধরণের মুসলিম এবং ওলামার বৈশিষ্ট্যই হলো তাঁরা নিজেদের কোন ত্রুটিই দেখেন না , 'সবই পাশ্চাত্যের ইহুদি নাছারাদের ষড়যন্ত্র' বলে গলা ফাটান । কেউ কেউ গনতন্ত্রকে শুধুমাত্র এজন্যই কুফরি ভাবেন যে , 'আমেরিকা গনতন্ত্রের কথা বলে' ! আমার ভাবতে খুব কষ্ট হয় যে একসময় আলেমদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মাইক ব্যবহার করাকে নাজায়েজ বলেছেন । এখনো নাকি দুএকটি মসজিদে মাইকে আজান দেয়া হারাম ভেবে মুখেই আজান দেয়া হয় !

কোনকিছু সম্পর্কে কুরআন হাদিসের মূলনীতি দিয়ে যাচাই করাটাই ঈমানের দাবি। কিন্তু তাই বলে নতুন সবকিছুকেই হারাম ঘোষণা করা কিংবা যাকে তাকে কুফরির খাতায় ফেলা নিশ্চয়ই ঈমানের দাবি তো নয়ই , পরিপন্থিই বলা যায় । প্রথমে হঠাত্‍ করেই হারাম ঘোষণা করা হয় , এরপর ধীরে ধীরে সেটাকে গ্রহণ করা হয় । একসময় টিভি দেখাকেই হারাম বলা হয়েছে । (অবশ্যই টিভির কোন হারাম কন্টেন্ট দেখা হারাম , কিন্তু টিভিতো নয় নাকি !)

সার্বভৌমত্ব শব্দটির আপত্তি সম্পর্কে এ সময়ের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী তাঁর ‘Priorities of The Islamic Movement in the coming Phase’ বইয়ের ‘The Movement and the political Freedom and Democracy’ শীর্ষক অংশে লিখেছেন-

"The fear of some people here is that democracy makes the people a source of power and even legislation (although legislation is Allah’s alone) should not be heeded here, because we are supposed to be speaking of a people that is Muslim in its majority and has accepted Allah as its Lord, Mohammad as its Prophet and Islam as its Religion. Such a people would not be expected to pass a legislation that is contestable in Islam and its incontestable principles and conclusive rules. Any way these fears can be over come by one article (in the constitution) that any legislation contradicting the incontestable provisions of Islam be null and void."

-কিছু সংখ্যক মানুষের ভয় গণতন্ত্র মানুষকে ক্ষমতার উৎসে পরিণত করে এবং আইন প্রণয়ন করার অধিকার দেয় (যদিও আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর), তার প্রতি কর্ণপাত করা উচিত হবে না। কারণ আমরা এমন এক মানবগোষ্ঠী সম্পর্কে কথা বলছি যারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আল্লাহকে তাদের প্রভু হিসেবে, মুহাম্মদ (সা) -কে তাদের নবী এবং ইসলামকে তাদের ধর্ম হিসেবে মেনে নিয়েছে। আশা করা যায়, এ ধরনের মানুষ এমন আইন প্রণয়ন করবে না, যা ইসলামের অকাট্য নীতি ও সিদ্ধান্তমূলক আইনের পরিপন্থী হবে। যা হোক, 'ইসলামের অলংঘনীয় বিধানের পরিপন্থী যে কোন আইন বাতিল বলে গণ্য করা হবে' এমন একটি অনুচ্ছেদ সংবিধানের সংযোজন করে এ আশংকা দূর করা যেতে পারে।

আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী এতে আরো দেখিয়েছেন যে, ইসলাম কোন স্বৈরাচার বা রাজতন্ত্র সমর্থন করে না। তিনি তুলে ধরেছেন যে Political Freedom-এর মধ্যেই ইসলাম বিকশিত হয়। যদিও ইসলাম গণতন্ত্র থেকেও ব্যাপক একটি বিষয়, একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, তবুও তিনি গণতন্ত্রকে ইসলামের সাথে সংগতিপূর্ণ মনে করেন এবং ইসলামে মানুষের জন্য যে সব মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা গণতন্ত্রের মাধ্যমেই পূরণ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন । তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে লিখেছেন। তবে যারা ভয় পান যে, গণতন্ত্রের নামে ইসলামবিরোধী আইন প্রণীত হতে পারে, তাদেরকে আশ্বস্ত করার জন্য সংবিধানে ‘কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন পাশ করা যাবে না’ এমন একটি ধারা সংযোজনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি ।

তিনি আরও বলেন,

'যা হোক, গণতন্ত্র যে সকল নীতি ও নিশ্চয়তা দান করেছে তা শাসকদের উচ্চাশাও খেয়ালীপনার উপর একটি নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য ইসলাম পৃথিবীতে যে সকল রাজনৈতিক নীতির অবতারণা করেছে তার নিকটতম। এ সকল নীতিসমূহ হচেছ শূরা (consultation), নসিহত (পরামর্শ প্রদান), যা সংগত তার আদেশ দেওয়া, যা খারাপ তা বর্জন করা, অবৈধ আদেশসমূহ অমান্য করা, অবিশ্বাস প্রতিরোধ করা এবং যখনই সম্ভব শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবিধান করা । স্বাধীন রাজনৈতিক পরিবেশ এবং গণতন্ত্রেই কেবল সংসদীয় পদ্ধতির বৈধতা ও ক্ষমতা স্বীকৃত এবং জনগণের প্রতিনিধিগণ যে কোন সরকারের উপর সংবিধান লংঘনের অপরাধে অনাস্থা জ্ঞাপন করতে পারে এবং এটি (গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা) এমন একটি পরিবেশ যেখানে স্বাধীন সংবাদপত্র, নিরপেক্ষ সংসদ,বিরোধী দলের অবস্থান এবং জনসাধারণের মতামত সর্বাপেক্ষা অধিক প্রতিফলিত ।'

এই অনুবাদের ভাষাটা সম্ভবত খুব একটা সরল হয়নি । আমি নিজে অনুবাদ না করে এটা নিয়েছি জনাব শাহ্ আব্দুল হান্নানের অনুবাদ থেকে । তবে এটুকু নিশ্চয়ই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে আল্লামা কারদাওয়ী গনতন্ত্রকে সরাসরি কুফরি বা শিরক বলতে রাজি নন । বরং তিনি এটাকে ইসলামের অনেক কাছাকাছি একটি রাজনৈতিক সিস্টেম হিসেবে মনে করছেন । আর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সংবিধানে একটি মূলনীতি যোগ করার কথা বলছেন যা কুরআন সুন্নাহ বিরোধী সকল বিধানকে বাতিল করবে ।

বিষয়: বিবিধ

১৪০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File