বিয়ে,যেীতুক, মোহরানা এবং আমাদের করণীয়- পর্ব: ১
লিখেছেন লিখেছেন মিজবাহ ২৯ মে, ২০১৪, ০২:১৭:২০ দুপুর
ইমাম সুহাইব ওয়েব একদিন এক আলোচনায় বলেছিলেনঃ "বিয়ে ইসলামে সবচেয়ে সহজ এবং আমাদের সংস্কৃতিতে সবচেয়ে কঠিন একটি বিষয়"। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ইসলামিক অথবা নন-ইসলামিক -- যেকোন পরিবারগুলোই পৃথিবীর আর কিছু যা-ই থাক, বিয়েতে বিশাল আয়োজনের, টাকা খরচ করার, সমাজের কাছে মাথা উঁচু করে(!) তাদের খুশি করার চেষ্টাতে কিছুতেই কমতি করেনা। অথচ আল্লাহ বলেন, "কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ"(২৬-২৭)
এবং সুরা আল আরাফঃ ৩১ আয়াতে বলেন,"খাও ও পান কর এবং অপব্যয় করো না।তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না"।
আমাদের দেশের বিয়েগুলোতে মেয়েপক্ষ সজ্ঞানে-অজ্ঞানে ছেলেপক্ষের কাছে *দায়গ্রস্ত* থাকেন, খুব প্রচলিত একটা ঘটনা হলো ফার্নিচার দেয়া। মেয়ের বাবা যেমন অর্থ-সম্পদের মালিকই হোন না কেন, তিনি ধার-দেনা করে মেয়ের বিয়েতে খরচ করতে মরিয়া হয়ে যান। মেয়ের সুখের জন্য তাকে যে করেই হোক জামাইকে কিছু দিতে হবে!!!এখানেও যন্ত্রণা,কষ্ট,ধার-দেনা। কতরকম খোঁটা খাওয়ার ভয়!বিয়ের আয়োজনেই অস্থির অবস্থা। আরো কত রকম আদিখ্যেতা বিয়ের অনুষ্ঠানে! যেগুলোর কোনটাই সুন্নাহ নয়, বরং স্কলারদের মতে অনেকগুলোই নিষিদ্ধ।আঞ্চলিক কিছু প্র্যাকটিস তো বলার মতই না,এতই জঘন্য।যেমন,দুধে পা ডুবানো,আয়নায় মুখ দেখা,অনেকগুলো মিষ্টি খাওয়া --এরকম আরো অনেকগুলো অসভ্য ঢং করার পর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষটাকে ঘুমাতে দেয়া হয় কয়েক ঘন্টা পর,মাঝরাতে পেরিয়ে গেলে।
এইসব ছাড়াও সার্বজনীন আর বাহুল্য কালচার যেসব আছেঃ আংটি পড়ানো,দামী কার্ড ছাপানো,শুধু শুধু বা আভিজাত্য জাহিরের জন্য দামী কমিউনিটি সেন্টার/হোটেল ইত্যাদি ভাড়া করা, শুধু মাত্র বিয়ের দিনের জন্য দামী পোশাক কেনা যা আর কখনও পড়া হয় না,পুরুষ মহিলা একসাথে গায়ে হলুদ,কনের/বরের সাজসজ্জায় অপ্রয়োজনীয় খরচ,অনুষ্ঠানে নারী পুরুষ একসাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ,নাচ-গানের আয়োজন,গেটে টাকার জন্য বর-কনেদের বিব্রত করা,বাদানুবাদ,বিয়ের দিনে সাজুগুজু আর অতিথি আপ্যায়ন করতে গিয়ে নামায না পড়া।
ইসলামে মেয়ের/মেয়েপক্ষের বলতে গেলে কোনই খরচ নেই একটা বিয়েতে।কিন্তু আমাদের সমাজে প্রচলিত যত বোঝা,তার সমস্ত কিছুই আমরা নিয়ে এসেছি অন্য ধর্মের সংস্কৃতি থেকে।একইভাবে একটা বিয়েতে যত কম খরচ হয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে সেই বিয়ে বেশি পছন্দের।আমরা কি আল্লাহর পছন্দের বান্দা হতে চাই,নাকি সমাজের দাস?
যৌতুক শব্দটি বতর্মান আমাদের সমাজে বেশ পরিচিত। ছোট বড় এবং নারী পুরুষ সবাই এব্যাপারে কিছু না কিছু আইডিয়া রাখে। বিয়ে শাদীর বেলায় বরপক্ষ কণ্যাপক্ষের নিকট থেকে যে টাকা, অলংকার,গৃহসজ্জা এবং বিনোদনমূলক সামগ্রী গ্রহণ করে থাকে, তাকে বলে যৌতুক। ধনী পরিবারগুলোতে বাড়ি-গাড়িও আদান-প্রদান হয়ে থাকে। মূলত এই কুসংষ্কার টি হিন্দুদের থেকেই আমাদের মাঝে আমদানী করা হয়েছে। হিন্দু সমাজে মেয়েরা পিতার সম্পত্তির ভাগ পায় না বলে বিয়ের সময় পিতা যথাসাধ্য ধন সম্পদ দিয়ে ভাল পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মুসলমান সমাজে মেয়ের অধিকার ক্ষুন্ন করা হয় না। বরং বাপ স্বামী সবাই থেকে সে সম্পত্তির ভাগ পেয়ে থাকে। সুতরাং তাকে সম্পূর্ণরূপে চিরবিদায় করার চিন্তা করার দরকার ছিল কিন্তু বিভিন্ন সমাজে বহুদিন ধরে এই নিষ্ঠুর প্রথা প্রচলিত আছে। হিন্দু মুসলমান উভয় সমাজ যৌতুক প্রথা আঁকড়ে আছে।সামর্থ থাক,বা না থাক,মেয়ে বিয়ে দিতে হলে যৌতুক দিতেই হবে এমনটাই যেন প্রচলিত নিয়ম।
যৌতুক প্রথা আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নির্মম ও কলঙ্কজনক অভিশাপ। অগনিত নারীর জীবনে নেমে আসে এর জন্য দুঃখজনক ও মর্মান্তিক পরিণতি । কখনো অভাবনীয় পন্থায় লাঞ্ছিত হয় মানবতা। একে নারী নির্যাতন প্রথাও বলা যেতে পারে। এটা আমাদের সমাজের একটা বিষাক্ত ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। এ ব্যাধির শিকার নারী সমাজ ও কণ্যাদায়গ্রস্থ পিতা। কত সরল-সহজ নারী যে যৌতুক ব্যাধির যুপকাষ্ঠে নিগৃহীত হচ্ছে তার হিসাব মেলানো মুশকিল। কত নারীকে সহ্য করতে হচ্ছে জুলুম নির্যাতন। এমনকি কখনো জীবনও বিসর্জন দিতে হয়। নারী নির্যাতনের খবর আমাদের দেশে প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকা খুললেই দেখা যায়। আর এ নারী নির্যাতনের মূলে রয়েছে যৌতুক নামক ভয়াবহ ব্যধিটি।
অনেকে বলেন, কনের পক্ষ থেকে খুশীতে কোন কিছু দিলে এটা যেীতুক হয়না কিন্তু কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে খুশীতে দিয়েছি বা খুশীতে দিলেও একজন দায়ী হিসাবে বুঝা উচিত যে সব আত্বীয়স্বজন,প্রতিবেশী গরীব তাদের উপর প্রভাব পড়বে কি পড়বে পড়বেনা? সে প্রভাবের কারনে কনের পক্ষ ধার কর্জ করে যেীতুক দেয়।
আবার অনেক বর পক্ষ রুম খালি করে বা পুরাতন আসবাবপত্র রেখে দিয়ে কনের পক্ষ থেকে আকাংখা করে কারণ সে জানে কিছু দাবী না করলেও পাওয়া যাবে, এটা কি যেীতুক না? কেউ কেউ বলেন, আমাদের প্রিয় নবী(স: ) উনার মেয়েকে আলী (র: )এর সাথে বিয়ে দেওয়ার সময় ঘরের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র দিয়েছিলেন কিন্তু তার প্রেক্ষাপট দেখতে হবে, আলী (র: )কে প্রিয় ভুমি মক্কা থেকে সব কিছু ছেড়ে মদিনায় হিযরত করতে হয়েছে?আর উনাদের মতো এরকম করুন কঠিন পরিস্থিতি কি আমাদের হয়েছে? এটার সুযোগ নিয়ে আজ কিছু মহল কেীশলে যেীতুককে জায়েজ করে নিয়েছে!!বলা হয়ে থাকে খুশীতে কনে পক্ষ কিছু দিলে তা যেীতুক হয়না। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের প্রথা দেখা যায় কি? ওখানে কি মুসলিম স্কলার নেই?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় ইসলামে ওয়ালিমাহ এর ব্যবস্থা থাকলেও আমরা অনেকে এটাকে মান্য না করে কনের পক্ষের উপর চাপিয়ে দিই। আবার কেউ কেউ ওয়ালিমার ব্যবস্থা করলেও গরীবদেরকে মাহরুম করি!!
এজন্য আমাদের আদর্শ রাসূলুল্লাহ (স: ) বলেছেন "সবচাইতে নিকৃষ্ট খাদ্য হচ্ছে সেই ওয়ালিমাহ এর খাদ্য যেখানে কেবল ধনীরাই নিমন্ত্রন পায়,গরীবেরা নয়"। (সহীহ বুখারী)
বিষয়: বিবিধ
১৯৫৭ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকুম আল্লাহ খাইরান।
কিন্তু মুসলিম পরিবারে স্ত্রীদের শরিয়ত পরিপন্থি অযাচিত বসিং দেখলে মনে হয় যৌতুক নেওয়াটা একদিক দিয়ে হয়ত ভালই ছিল ।
যেহেতু কর্তৃত্ব করার কথা স্বামীরই , কারণ সেই ব্যয় করে ; সেখানে বউ যদি বসিং করে , আলগা ফাঁপড় নেয় - তাহলে স্বামীদের এত টাকা খরচ করে এত কথাশোনার তো কোন মানে হয় না ।
স্ত্রী তার কাছ থেকে ভরনপোষনও নিবে , আবার বসিং করবে - তাহলে সে যৌতুক দিয়েই সেই অযাচিত বসিংটাকে কিছুটা হলেও যুক্তিযুক্ত করে নিলে পারে। স্বামীও মনে করবে যে টাকা ঢেলেই সে তার বসিংটাকে বাগিয়েছে।
মূলতঃ ইসলামকে বলি দেয়ার জন্য, ইসলামে ভেজাল তৈরীর জন্য যা কিছু করার দরকার ছিল - দেশের যারা মাথা - তারা তা বছরের পর বছর ধরে নিশ্চিত করেছেন।
স্বভাবতঃই আমরা যে সব সোর্স হতে যৌতুক ও অনৈসলামিক বিষয়াদি সম্পর্কে অবগত হবার কথা ছিল - সে সব সোর্সকে বিকৃত অবস্থায় পেয়েছি - তাদের কাছ হতে বিকৃত শিক্ষা পেয়েছি। অন্যদিকে সমাজের মুরুব্বী শ্রেনীকে এ সব বিষয় নিয়ে হাসি তামাশা, ঠাট্টা মশকরা করতে দেখে ইসলামী বিধি বিধানকে আমরা সেকেন্ড ক্লাস লেভেল এ নামিয়ে ফেলেছি।
পরিনতিতে কেউ আর এ বিষয়টিকে, এ ব্যাধিটিকে সিরিয়াসলী নেয় না, নিচ্ছে না - এবং পরিবারগুলো এর বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে, সন্তানাদি সেই বোঝা সমাজে চাপিয়ে দিচ্ছে।
ধন্যবাদ সুন্দর লিখা উপহার দেবার জন্য।
আমি সমাজে ইসলাম প্রেকটিস করে এরকম অনেক পরিবারকে দেখেছি যারা ব্যাপারটি নিয়ে খুবই সামান্য গুরুত্ব দিচ্ছে। উনারা বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে তা সমাজে এসটাবলিস্ট করার জন্য সদা ব্যস্ত!
আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের কথা, আমার মা-বাবা যেীতুকের টাকা ম্যানেজ করার জন্য বিভিন্ন সোর্স থেকে টাকা ধার করেছিলেন। সঠিক সময়ে পরিশোধ করতে পারেন নি বলে ঐ সোর্স গুলো ভোর বেলায় আমাদের বাসায় আসতো কারণ ভোর বেলায় বাবাকে পাওয়া যাবে! আমি তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাদের বিভিন্ন অসুন্দর কথাগুলো শুনছিলাম আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম নিজে যেীতুক থেকে বিরত থেকে তার প্রতিরোধে সময় দিব। আলহামদুলিল্লাহ ব্যাপারটি আমার জন্য কঠিন হলেও চেষ্টা করে যাচ্ছি।
মাঝে মাঝে এমন রাগ লাগে যে পুরো সমাজটি যেন যেীতুকের পক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সময় দিচ্ছে। অথচ ভাবছেনা যে আমারওতো মেয়ে আছে! আমার না থাকলেও নিকট আত্বিয়েরতো আছে। তাঁরা কি যেীতুকের বলি হচ্ছেন না??!!
আমাদের দেশে যেীতুক জিনিসটা এমনভাবে ঢুকে গেছে যে এ থেকে যারা বের হতে চান তারাও অপমানিত হন। বিবাহ সংক্রান্ত বিভিন্ন অপসংস্কৃতি অনুসরন না করায় আমি শশুড়বাড়িতে বেয়াদব এবং নিজবাড়িতে বউএর দালাল খেতাব লাভ করেছি!!!
এই ক্ষেত্রে কিন্তু বেশি দোষ পরিবারের বয়োজেষ্ঠ মহিলাদের। তারা অনেক ক্ষেত্রেই ভুল শিক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেক বয়স্ক পুরুষ পড়াশোনা করে মত পরিবর্তন করে থাকেন কিন্তু কোন মহিলাকে তা এখনও করতে দেখলাম না।
জাজাকুম আল্লাহ খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন