হাজান মাঝি
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২১ মার্চ, ২০১৫, ১০:৫১:১৬ রাত
এই অশোক...এই অশোক ! এইবার খ্যাপ দিয়ে খেতে আয়,তোর বৌদী খাবার পাঠিয়েছে। আচ্ছা কর্তা বলে মাঝ নদী থেকে জানান দিল অশোক।
অশোক কিছুদিন হয় হাজান মাঝির নৌকায় মানুষ নিয়ে এপার ওপার করে। বড় ভাল ছেলে সে। নদীতে আর আগের মত পানি নেই। এই নদীতেই একসময় কত পানি ছিল,সর্বদা থৈ থৈ করত। সে সময়ও হাজান মাঝির বাপ এখানে নৌকা চালাতো,মাছ ধরত। বংশ পরষ্পরায় তারা এটা করে আসছে।
: অশোক নৌকাটা বেধে হাত পা ধুয়ে আয়। দুপুরের এই সময় কেউ খেয়া পার হবেনা।
: জি কর্তা
: আহা তোকে না বলেছি আমাকে কর্তা বলবি না। ভাই ,দাদা যেটা তোর ভাল লাগে সেটাই বলবি।
:জি ,কিন্তু আমার কেমন যেন লাগে। তারপরও আপনি যখন বলছেন তাই হবে।
: এক সময় আমাদের বেশ কয়েকখান নৌকা ছিল মাছ ধরার। মহাযনি সুদ শোধ করতে না পারার কারনে আব্বার কাছ থেকে সব নৌকা নিয়ে গেল। অবশেষে আমি ভিটা বাড়ির এক অংশ বন্দক রেখে এই নৌকাটা কিনলাম। এখন খেয়া পার করে যা পাই তা দিয়ে সংসার চলতে চায়না কিন্তু টেনে টুনে চললেও আমরা সুখী।
অশোক বস এখানে। আহা , দূরে যাস ক্যান ? অস্পৃশ্যতার ভাব তোর গেলনা দেখছি।
: না দাদা, অনেক মুসলমান আমাদের ঘৃণা করে তাই আমরা দূরে দূরে থাকি। ম্যাথর পল্লীর অশোককে কেউ কি ডেকে কাছে বসিয়েছে কখনও !
: সবায় সমান হয়নারে অশোক। অহংকার, বুঝলি অহংকারই মানুষখে খেলো। আর ম্যাথর ফ্যাতর আবার কি রে ? তুই,তোর পরিবার বা তোরা যা করেছিস তা হল কাজ,এটাও কাজ। কেউ যতি ওই কাজ না করত ,তবে তো আমাদেরকেই সেটা করতে হত। তাহলে কি আমরা সবাই ম্যাথর হয়ে যেতাম না ? ম্যাথর তো খারাপ বিষয় নয়। সমাজের লোকেরা এটাকে খারাপ বানিয়েছে। নে খেয়ে নে....আবার কোথায় যাচ্ছিস ?
:জি কচুর পাতা আনতে।
: অশোক তুই কচুর পাতায় আর খাবি না। তোর বৌদী জানত না যে তুই এখানে যোগ দিয়েছিস। রাতেই বললাম তোর কথা। সে তোর জন্যে অনেক ধুয়ে মুছে এই থালাটা পাঠিয়েছে। এটা এখন থেকে তোর।
অশোক একটু লাজুক হেসে হাজানের পাশে বসে। তার এই হাসির অর্থ পরিষ্কার। তাকে সম্মান দেখানো হয়েছে। অশোকদেরকে কেউ কখনই সম্মান করেনি। অনেক মুরব্বীদের সাথে তাদের দূরে দাড়িয়ে কথা বলতে হত,যেন তাদের গায়ে সর্বদা মল-মূত্র মাখানো থাকে।
নে অশোক এই আলুটা খা। কি করব গরীব মানুষ নইলে তোর পাতে মাছই তুলে দিতে পারতাম। নদীর বুকে চলাচল করেও মাছ খেতে পারিনা। নদীতেও তেমন মাছ নেই। সবই মড়ক। মানুষের বিবেক বুদ্ধি আর আগের মত নেই তাই আল্লাহ গজব দিয়েছে।
: দাদা, বৌদীর রান্নাটা খুব ভাল।
: হ্যা সে রানতে পারে বেশ কিন্তু ওই এক ভাগেরই তরকারী। কি করব, যা পয়সা পাই তা আবার ঘাট ওয়ালাদের দিতে হয়। এই দু পয়সার মধ্যেও তাদের ভাগ আছে।
: আপনি খুব ভাল দাদা। আপনার মধ্যে অহংকার নেই।
: ওরে পাগল, আছে রে আছে। ওটা সবার মধ্যেই থাকে,দেখা যায় না। সময়ে ওটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তবে চেষ্ষ্টা করি ভাল থাকতে।
: দাদা, মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ কেন ?
: হুমম তুই অনেক কিছু ভাবিস মনে হচ্ছে। আসলে আল্লাহ তো ভেদাভেদ করে মানুষকে পাঠায়নি,আমরাই এসব বানিয়েছি। যুগে যুগে নবী রসূল এসে মানুষকে সেই মর্মই উপলব্ধী করতে শিখিয়েছে কিন্তু বেশীরভাগই তা মেনে নেয়নি। আমাদের রসূল(সাঃ) এসব ভেদাভেদ করতেন না। তার কাছে সব মানুষই আসত। তিনি কারো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন না। তার থেকে কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যেত না। একবার এক ইহুদী তার মেহমান হল কিন্তু সে ছিল বেশ পাজি। ৩ দিনের মেহমান হয়ে থাকল। অনেক ভাল খাবার খেল। নবী(সাঃ)তাকে নিজের সবথেকে ভাল বিছানায় তাকে শুতে দিলেন,আর সে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে পালালো। অথচ রসূল(সাঃ)এটা যখন দেখলেন তখন উদ্বীগ্ন হয়ে পড়লেন এই ভেবে যে,লোকটার পেটে গন্ডগোল হয়েছে হয়ত, নইলে এই কাজ করে চলে যাবে কেন। সেই লোকটির স্বাস্থ্যের খোজ নিতে তিনি লোক পাঠালেন।
: সব মহামানবরাই সত্যিই ভাল। আমরা তাদের মত হতে চাইনা,এইটাই সমস্যা কিন্তু আমরা জানি সব।
:হুমম ঠিক। আরেক ঘটনা বলি শোন। এক ইহুদী তরুন আল্লাহর রসূলের আচরনে এতটাই চমৎকৃত হয়েছিল যে ,সে সর্বদা রসূলের আশপাশে থাকা শুরু করে। রসূল(সাঃ)তাকে খুব স্নেহ করতেন,ভালবাসতেন। একবার সেই ছেলেটি যখন অসুস্থ্য হল তখন রসূল(সাঃ) তার বাড়িতে গেলেন দেখতে। ছেলেটি তখন কি যে খুশী হল। অথচ আজ আমরা কারো বিপদে বা অসুস্থ্যতায় তার পাশে যাইনা। কিন্তু তিনি অনেকক্ষন ছেলেটির পাশে থেকে তার সাথে কথা বললেন। তার মন ভাল করার জন্যে অনেক কিছু বললেন। ছেলেটির চোখ চক চক করে উঠল। রসূল(সাঃ) তাকে বললেন-হে বালক আমি তোমাকে কি সর্বোত্তম উপদেশ দিব না ? বালক আগ্রহী হল। তখন রসূল(সাঃ)বললেন-তুমি ইসলামে ফিরে এসো,ইহকাল এবং পরকালে মুক্তি পাবে। সে ছিল বালক আর পিতা,মাতা তার শিওরে দাড়িয়ে ছিল। বালকটি তার পিতার চোখের দিকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তাকিয়ে থাকল। তার ভেতরে ইচ্ছা জেগেছিল কিন্তু তার বয়সের কারনে কি বলবে তা বুঝতে পারছিল না। আর তখন তার পিতা তাকে বলল-আবুল কাশেম(রসূল সাঃ)যা বলছে তা মেনে নাও।সে তোমার কল্যান চায়.. .....অশোক বুঝলি কিছু
:জি কর্তা..
: কর্তা নয়রে পাগল,বল দাদা ...নে তুই একটু বিশ্রাম কর আমি যাচ্ছি নৌকায়।
==========
অশোক এদিকে আয়, আজ বেশ ভাল খাবার অাছে মনে হচ্ছে। পেট তো চো চো করছিল,নারীর মন বুঝলি নারীর মন,,,পেটের খবরও রাখে। আহা এ দেখী মুরগীর গোস্ত।
: ওকি দাদা মুরগীর গোস্ত দেখে মন খারাপ করলেন ক্যান ?
: অশোক, আমার মুরগী কেনার সাধ্য তো নেই। তোর বৌদী মানুষের বাড়িতে কাজ করে। কতবার নিষেধ করেছি,সে নিষেধ মানেনা। এই খাবার সে অন্যের বাড়ি থেকে এনেছে। মনে হয় পুরো খাবারই আমার জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই মেয়েটা কেন যে এমন করে। আমি কোথাকার কে,যে আমার জন্যে ওর এত মায়া ! আমি ওর জন্যে কি এমন করেছি ? পরের বাড়িতে কাজ করে কোমরে মাঝে মাঝে ব্যাথা হয়। আমি তেল মালিশ করতে গেলে বলে ওসব লাগবে না,আমার কিছুই হয়নি,আর স্বামীরা এসব করেনা। ...ও আসলে নিজেই জানেনা ও কত ভাল একটা মেয়ে। নিজের কষ্ট হলেও তা আমার কাছে প্রকাশ করেনা। আমি ঠিকই তা বুঝে যাই। আমার চোখ সে ফাকি দিতে পারে না। সে যেমন করে আমিও তেমন করি। মাঝে মাঝে বাজার থেকে এক পোয়া বুন্দিয়া কিনে নিয়ে বলি -শোনো তোমার কথা তো খাওয়ার সময় মনে থাকেনা ,কিন্তু আজ খাওয়ার পর অন্তত মনে পড়েছে তাই শেষ টুকু কাগজে মুড়ে নিয়ে এসেছি। এটার পুরোটাই তোমার। কিন্তু সেও কিভাবে জানি মনে খবর বুঝে ফেলে। খুব বুদ্ধিমতি সে। বলে-ঠিক আছে, সেটা তো তুমি দোকানে বসে খেয়েছো,বাড়িতে এসে তো আর খাওনি,তাই এসো দুজনে মিলেই খাই। ওর কথা না মেনে উপায় থাকেনা।
======
: আচ্ছা আমাদের বাড়িটার এক অংশ যে বন্দক দেওয়া অাছে সেটা ছাড়ানোর ব্যাপারে কিছু ভেবেছো ?
: কি আর ভাবব। খেয়া ঘাট থেকে যা পাই তাতে তো সংসারই চলেনা।
: আমি কিন্তু ভেবেছি।
:কি?
: শোনো, আমার মা আমাকে বিয়ের সময় তার নিজের হাতের দুটো স্বর্ণের চুড়ী দিয়েছিল...
:খবরদার ! খবরদার !! এসব আর বলবে না। মাঝ রাতে ঝাঝিয়ে উঠল হাজান।
: কিন্তু কিছুই তো করার নেই।
:আছে অনেক কিছুই করার আছে। প্রয়োজনে নৌকা বেচে বন্দক ছাড়াবো কিন্তু এসব করবে না। তোমার মায়ের উপহার তোমার কাছে রেখে দাও। যে নতুন অতিথী আসছে সে যদি মেয়ে হয় আল্লাহ বাচিয়ে রাখলে তাকে এটা দিও। আমাদের দিন একভাবে না একভাবে চলে যাবে। তুমি চিন্তা করোনা।
: কি করব, চিন্তা তো এসে যায়। আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়?
: কি কাজ ?
: এই যে বাড়ির পাশে এক শতক পতিত জমি আছে ওখানে কিছু শাক সব্জীর চাষ করলে কেমন হয় ?
: হ্যা তা তো ভালই। শুক্রবারে খেয়াঘাটে লোক তেমন হয়না। আমি আর অশোক মিলে জমিটায় কোদাল মেরে একেবারে ঝরঝরে করে ফেলব।
: আর শোনো, তুমি কিন্তু বাজার থেকে লাউ,মিস্টি কুমড়া,বেগুন,শিমের বীজ আনবে। বেগুনের দাম কিন্তু কম না। বেগুন বেচেই আমরা বন্দক ছাড়াবো। আর আমাদের খাওয়াও হবে।
:ঠিক আছে,সবে মাত্র রবীবার আজ, শুক্রবার আসতে দাও ইনশাআল্লাহ হবে।
=========
:একি সকালে দেখলাম জমি সমান আর এখন অর্ধেক কোপালো কে ?
: হেহেহে তোমার মুরোদের জন্যে বসে থাকব আমি ??
: হায় হায় তুমি মাটি কুপিয়েছো ?? সর্বনাশ !দেখী হাত দেখী...
: হাত দেখতে হবে না, শোনো আমি যা বলি করেই ছাড়ি।
:কিন্তু তুমি তো এটা বলনি..
: মনে মনে বলেছিলাম..
:পাজি কোথাকার....দাড়াও আমি আর তোমাকে কোনো মওকা দেব না...এই ধরলাম কোদাল...
: আচ্ছা ঠিক আছে আমি গেলাম।
:গেলাম মানে ?
:হবিবর মোল্লার বাড়িতে কাজ আছে।বেশীক্ষন লাগবে না।
:হবিবরের বাপ এসে তোমার পায়ে ধরলেও আমি তোমাকে যেতে দেব না। পরের বাড়ি কোনো কাজ করতে পারবা না। আমরা না খেয়ে থাকব কিন্তু এটা চলবে না। তুমি গেলে আমি কিন্তু তরি তরকারীর পরিকল্পনা বাদ দেব।
:আচ্ছা ঠিক আছে গেলাম না।
:কখোনো যাবে না।
:আচ্ছা যাবো না।
:আমার মাথা ছুয়ে কসম কাটো।
: এই যে হুজুর শীরকি লাইনে যাও ক্যান ?
:তার মানে ?
:মাথা ছুয়ে কসম কাটা ইসলামে আছে নাকি...??
: ওরে বাপরে ...এ দেখী সেরের উপর সোয়াসের.....আচ্ছা আচ্ছা তাইলে আল্লাহর নামে কসম করো।
: শোনো সকল সময় কসম কাটা জরুরী নয়। আর এটা এতটাই ভয়ঙ্কর ব্যাপার যে ভাঙ্গা যায় না। ভাঙ্গলে কাফফারা দিতে হয়। মুসলিম কসম কাটতে ভয় পায়। আমি আর ওই কাজে যাব না, কথা দিলাম।
: তবে ওই কথাই রইলো.....
:কোন কথা ?
: আমরা তরি তরকারী বিক্রী করব,বাড়ির বন্দক ছাড়াবো,জমি বর্গা নিব আরও তরী তরকারী,,,এরপর অামাদের একটু সুন্দর বাড়ি হবে...
: তা বাজার থেকে বীজ কিনে আনবে কে শুনি,,,,?
হাজান হাসতে হাসতে বাজারের পথ ধরল,যেন আজই তার সব্জী ফলাতে হবে......
বিষয়: বিবিধ
১৫০৯ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লিখাটি এখনো পড়ি নি, পড়তে পারবও এখন, তবে ইনশাআল্লাহ পড়ে নেব সময় করে। কথা দিলাম। আহ, কথা দিলেম তো!
ভাষা কুজে পাচ্ছিনা!
ভাইটির জন্য বেশী বেশী দোয়া ও শুভকামনা থাকলো।
আমার এক নিকট জন ছিল, যার শরীরে মাঝে মাঝে মধ্যে ব্যথা করত, স্বামী রাত জেগে জেগে প্রায় তেম মালিশ করে দিতেন। হা এটা ঠিক, অধিকাংশ স্বামী স্ত্রীর অসুখ বিসুখে উদাসীন থাকে, যা মোটেও কাম্য নয়।
আপনার গল্প শুধুই গল্প নয়, প্রতিটা প্যারায় প্যারায় গল্পোচ্ছলে দারুণ সব বার্তা দিয়েছেন, যা থেকে অনেক পাঠক উপকৃত হবে। যে কথাগুলো গল্পয়াকারে বললেন, তা যদি সরাসরি বলতেন, পাঠক খুব একটা গ্রহণ করতে বলে মনে হয়য় না।
স্বামীর কাছে এটা অনেক অপমানজনক, কষ্টের বেদনার, স্ত্রী অন্যের কাছে ছোট হয়ে থাকবে, হাঝন মাঝি ঠিক কাজটিই করেছেন বউকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে না দিয়ে।
ওরে বাপরে ...এ দেখী সেরের উপর সোয়াসের.....আচ্ছা আচ্ছা তাইলে আল্লাহর নামে কসম করো।
আপনার বলার ঢংয়ের প্রশংসা না করে পারছি না। অনেক ভাল লেগেছে। গ্রামের চিরায়ত ভালবাসা ভালবাসা নিপূনভাবে উপস্থাপন করার সব হুন আপনার মধ্যে বিদ্যমান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন