হিজরত কি পলায়ন,নাকি রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ?? পর্ব ২
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৩ জুলাই, ২০১৪, ১১:২১:১৩ সকাল
রসূল(সা: )এর আগমনের পূর্বে মদীনার নাম ছিল ইয়াসরিব। এটা ছিল কৃষিতে সমৃদ্ধ একটি নগরী এবং গরম মশলার জন্যে বিখ্যাত । মদীনার লোকেরা বিশেষ করে ইাহুদীরা ব্যবসা-বানিজ্যে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করে। মদীনার আবহাওয়া মক্কার মত রুক্ষè নয়,এটি সবুজ শ্যামল এলাকা। আরামদায়ক আবহাওয়া বিরাজমান। মক্কায় যখন প্রচন্ড গরম ,মদীনাতে তখন সহনীয় তাপমাত্রা। অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া সমৃদ্ধ স্থান হল মদীনা।
সে যুগে বানিজ্য কাফেলা বা সফরের জন্যে প্রসিদ্ধ এবং নিরাপদ রাস্তা ছিল তিনটি। একটি এসেছে ভূমধ্যসাগর থেকে,দ্বিতীয়টি সিরিয়া থেকে এবং তৃতীয়টি মিসর থেকে। এভাবে একটি রাস্তা সিরিয়া থেকে দূওমাতুল জান্দাল হয়ে ইরাক চলে গেছে। দ্বিতীয়টি দূওমাতুল জান্দাল থেকে মদীনা হয়ে মক্কা চলে গেছে। তৃতীয়টি দূওমাতুল জান্দাল থেকে ইয়ামবু এবং সেখান থেকে সমুদ্র উপকূল বরাবর মক্কা চলে গেছে। মক্কা থেকে পূণরায় এই রাস্তা ইরাক ও পারস্যোপসাগরের দিকে গেছে অথবা চলে গেছে লোহিত সাগরের উপকূলীয় সমভূমী পর্যন্ত। এসব রাস্তা ধরে এশিয়া,ইউরোপ এবং মিসরের বাণিজ্য কাফেলা চলাচল করত। দেশের বাকী অংশ ছিল বিরানভূমী এবং দূরতিক্রম্য ভূমী। এসবের মধ্যে ছিল বিস্তীর্ণ মরুভূমী,গভীর উপত্যকা। সেখানে পানির নাম নিশানাও ছিলনা। মানুষ সেদিকে যাবার কথা কল্পনাও করত না। এসব দিকে বালুঝড় সাইমুম ছিল গজব সমতুল্য। ফলে সেসব এলাকা ধরে বানিজ্য কাফেলা কখনও পরিচালিত হত না। সফর বা বানিজ্য কাফেলা পরিচালিত হত প্রসিদ্ধ এবং পরিচিত রাস্তাগুলো ধরে।
সেসব রাস্তার নির্দিষ্ট মঞ্জিল পরপর যাত্রা বিরতী হত এবং সেসকল স্থানে বহু সংখ্যক বেদুইন গোষ্ঠী বসবাস করত। তারা কাফেলার মালামাল পরিবহনে সহায়তা করত অর্থের বিনিময়ে। তারা এদের কাছে পশম,চামড়া,উট,বকরী বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করত। মক্কা থেকে কোনো বানিজ্য কাফেলা বিদেশে পরিচালিত হলে তাদেরকে অবশ্যই মদীনার ওপর দিয়ে যেতে হত। ফলে মদীনার রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং প্রতিরক্ষা গুরুত্ব সম্পর্কে যে কোনো বিজ্ঞ লোক একমত হবেন।
মদীনাতে পানির প্রাচুর্য ছিল। রৌদ্রতাপ থেকে বাঁচার জন্যে ছিল খেজুর বাগানের ছায়া। আবহাওয়ার দিক দিয়ে এটি ছিল সর্বোত্তম। কাফেলা মাসাধিককালের সফরের মধ্য দিয়ে যখন মদীনায় এসে পৌঁছত তখন মানুষ ও পশু উভয়েই চরম তৃপ্তী লাভ করত। ইয়ামবু থেকে উপকূলীয় রাস্তা ছিল সাংঘাতিক কষ্টসাধ্য,এজন্যে কাফেলা সেদিকে চলাচল করত না বললেই চলে। যেসকল লোকেরা মিসর থেকে জাহাজে আসত,তারাও মদীনা হয়েই মক্কায় যেত।
মক্কাবাসীরা ইয়াসরীব থেকে খেজুর,আটা ও অন্যান্য দ্রব্য নিয়ে যেত। সকল কাফেলাই মদীনা থেকে তাদের রসদ পূর্ণ করে নিত,কারণ এটি ছিল খাদ্য প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ।
একটি ঘটনায় মদীনার উল্লেখযোগ্যতা ফুটে ওঠে। মক্কার অদূরে আকাবা নামক স্থানে মদীনার গোত্র আওস ও খাজরাজের নেতৃস্থানীয় লোকেরা রসূল(সা এর হাতে বায়আত বা আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে এবং তাকে মদীনায় যাবার আমন্ত্রণ করেছিল। তিনিও এ দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন। উক্ত লোকেরা যখন মদীনার দিকে যাত্রা করে ,তখন মক্কার কাফিররা এই আনুগত্যের খবর জানতে পেরে ক্রুদ্ধ হয় এবং তাদের কিছু লোক স্বশস্ত্র অবস্থায় মদীনাবাসীদের পিছু নেয়। উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে অনুরোধ করবে এবং তাতে কাজ না হলে জোরপূর্বক আবারও পূর্বের ধর্মে প্রত্যাবর্তন করাবে। কিন্তু তারা সেখানে গিয়ে জানতে পারে যে,কাফেলা চলে গেছে। এই বাহিনীটি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে আওস ও খাজরাজের উক্ত কাফেলাকে অনুসরণ করে এবং তাদের মদীনায় পৌঁছনোর পূর্বেই ধরে ফেলে। ইয়াসরীব বাসীরা সংখ্যায় ছিল কম এবং লড়াই করার জন্যেও তারা সফর করেনি,ফলে তারা ছিল দূর্বল। তারা বিপদ বুঝতে পেরে মদীনায় পালিয়ে যায়। মক্কাবাসীরা তখন ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের ধাওয়া করেনি। কারণ তারা মদীনার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছিল, আর তা সংঘটিত হলে সেটি তাদের বড় বিপদের কারণ হতে পারে ,এটাই মনে করছিল।
তবে এই ঘটনার পর মক্কার কুরাইশরা আওস ও খাজরাজের শত্রু হয়ে যায়। তারা এই ঘটনার কঠিন জবাব দেওয়ার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এ বিয়টি রাজনৈতিকভাবে ছিল মুসলিমদের পক্ষে।
মদীনার সবথেকে বড় গোত্র ছিল আওস ও খাজরাজ,তারা পরষ্পর যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকত। একে অপরের উপর কোনো রকম আধিপত্য তারা সহ্য করত না। সিরিয়া থেকে একদা যেসব ইহুদী মদীনায় বসতি গড়ে তোলে তারা এই দুই গোত্রের সংঘাত থেকে ফায়দা লুটত। তারা উভয়কে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে ব্যবসা করত। উভয়কেই তারা মোটা সূদে অর্থ ধার দিত,তারপর তাদের ঋণ পরিশোধের অপারগতায় জমি,বাগান সম্পতি,বাড়ি ঘর দখল করত। আওস ও খাজরাজ নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করে বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছিল কিন্তু তারপরও তারা একে অপরকে সহ্য করতে পারত না। কিন্তু রসূল(সাএর নবুয়্যতের দশম বা একাদশ বছরে এসে একটি সম্ভাবনা দেখা গেল, আর তা হল তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সম্বাবনা এবং তা গৃহীত হবারও সম্ভাবনা।
রসূল(সা এর প্রতিনিধির মাধ্যমে মদীনাতে নিরলস ইসলামের দাওয়ার ফলে মদীনার কিছু সাধারণ ও কিছু নেতৃস্থানীয় মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, আওস ও খাজরাজের এই ধবংসাত্মক যুদ্ধ বন্ধ হবে, ইহুদীদের অর্থনৈতিক,সামাজিক নির্যাতন বন্ধ হবে। তারা নতুন এক নেতৃত্বের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠে। এ বিষয়টি হিযরতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ফলে হিজরত ছিল সুবিধাজনক সময়ে কর্তৃত্বের স্থানান্তর। আর তা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। রসূল(সা শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর আদেশের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আর শেষ সময়ে তার হত্যা প্রচেষ্টা ছিল একটি উপলক্ষ্য মাত্র। তাকে হত্যার পরিকল্পনা না হলেও তিনি হিজরত করতেন । মূলত : তার পূর্বেই তিনি সাহাবাদেরকে মদীনাতে পাঠিয়ে দিয়েছেন এক নতুন সময়ের জন্যে। হিজরত ছিল একটি পরিকল্পনার নাম, পলায়নের নাম নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি যে কেউ তার পলায়ন বা পরাজিতের ইতিহাস মনে রাখতে চেয়েছে, বরং তা ভুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু সাহাবাগণ রসূলের(সা হিজরত থেকে হিজরী সাল গননা শুরু করেন, বিষয়টি যথাযোগ্য মর্যাদায় শ্মরণ রাখার জন্যে। কারণ এটি ছিল মুসলিমদের বিশাল বিজয়ের প্রথম ধাপ।
বিষয়: বিবিধ
১২১০ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ইয়াসরিব অর্থ ছিলো- খারাপ আবহাওয়া,রোগ বিরোগের জায়গা। রাসুল সাঃ নাম বদলিয়ে রাখলেন মদীনা তাই্য়্যেবা- পবিত্র ভূমি!
হিজরী ১ম সাল থেকে শুরু করে আজ আমরা ১৪৩৫ হিজরীতে এসে পৌঁছেছি আলহামাদুলিল্লাহ! কিন্তু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও উনার সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুম গনের শিক্ষা কতটুকু ধারন করেছি? খুব কষ্ট লাগে! আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দিন!
আবারো শুকরিয়া!
মন্তব্য করতে লগইন করুন