থ্রি-সিস্টার হয়ে ব্যান্ড সিটি(বহু সংখ্যক ছবি আছে)
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৪ জুন, ২০১৪, ০৮:০৯:১৫ সকাল
আজ রবীবার। ফজরের নামাজ পড়েই নাস্তা সারলাম। সাধারণত: এরপর একটা ঘুম দেই। আজ অনেক দূরে যাচ্ছি ঘুরতে,তাই সকাল সকাল রওনা হতে হবে। ‘ব্যান্ড সিটিতে’ সফরসঙ্গী বন্ধুর পিতা বসবাস করেন। আমি একটা ব্যাগে কিছু খাদ্য-পানীয় ভরে নিলাম। সাথে অতিরিক্ত পোষাক নিলাম। ঘোরাঘুরি করার মত উপযুক্ত পোষাক পরেছি এবং বরাবরের মত মাথার ক্যাপটি উল্টো করে পরা। দু-একজন আমার ছবি দেখে মন্তব্য করেছে,আপনার মাথায় কি চুলের ঘাটতি আছে,যে ক্যাপ দিয়ে ঢেকে রাখেন ? যখনই কোনো ছবি দেখী,সেখানে কোনো না কোনো ক্যাপ থাকবেই !
আসলে ক্যাপ ছাড়াও আমার বহু ছবি আছে,তবে ক্যাপ আমার পছন্দের। আর আমার চেনা বহু ছোট ভাই অল্প বয়সে ন্যাড়া হয়ে গেলেও আমার মাথা থেকে কোনো চুল ঝরেনি। জিনিসটা বংশগত বোধ হয়,কারন আমার নানী সেন্সুরী করার দ্বারপ্রান্তে আসার পর যখন উইকেটটি পড়ে গেল,তখনও তার মাথায় কিছু কাঁচা চুল ছিল। মারা যাবার কিছুকাল পূর্বেও দাঁত দিয়ে সুপারী চিবিয়ে খেতেন। চুল,দাঁত এবং চোঁখের দৃষ্টির জন্যে আমাদের বংশ বিখ্যাত। লেকচার বাদ।
রওনা হলাম, লেবাননের পথ ধরলাম। আমেরিকাতে অনেকগুলো স্থানের নাম আরব দেশগুলোর নামের সাথে মিলে। ইতিহাস বলে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের বহুকাল পূর্ব থেকেই আরব বণিকরা আমেরিকাতে আসা যাওয়া করত এবং ব্যবসা বানিজ্যের সাথে তারা যুক্ত ছিল। যতদূর মনে পড়ছে সম্ভবত: অষ্টম শতাব্দীতে মহিউদ্দীন রইস নামক একজন আরব বিজ্ঞানী সমুদ্র পথে আরব থেকে আমেরিকা যাবার নির্ভূল ম্যাপ তৈরী করেন। যাইহোক লেবাননের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
লেবানন সিটি আমার বেশ ভাল লাগে। এখানে বেশ কিছু চমৎকার ফার্ম হাউস চোখে পড়ল। রাস্তার দুপাশে দেখলাম ঘাসের পাশাপাশি গমের চাষ করা হয়েছে। এরা বছরে একবারই গম উৎপাদন করে কিন্তু সে উৎপাদন হয় বিশাল। মাইলের পর মাইল গমের ক্ষেত,আইলের বালাই নেই। বিশেষায়িত চলমান মোটরের মাধ্যমে বৃষ্টির মত করে পানি সিঞ্চন করা হচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফলন হবে বিরাট। এরা সরকারের কাছ থেকে ব্যপক ভূর্তুকী,সহায়তা পায়। সার,পানি,বীজের অভাব এদের হয়না। আমাদের দেশে এসব ব্যাপারে সরকারের সাহায্য সহযোগীতা একেবারে নি¤œ মানের। দুটোই পুঁজিবাদ কিন্তু এরা একটা মার্জিত রূপ ব্যবহার করে এবং মধ্যবিত্তদেরকে বাচিয়ে রাখে। বহির্বিশ্বের জন্যে এরা খারাপ নীতি বলবৎ রাখলেও নিজ দেশে এরা জনগনের জন্যে কিছু করে।
আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সন্ত্রাসী পূজিবাদ বলা যায়। এখানে সকল অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু সংখ্যক পূঁজিপতির মাধ্যমে। স্বয়ং সরকার বা সরকারী ক্ষমতাশালীরাও সেই বিশেষ পূঁজিপতি,যারা চরম নির্মমতায় তাদের অর্থনৈতিক সন্ত্রাস চালান। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা টিকিয়ে রেখে শোষণ অব্যাহত রাখাই এখানে নিয়ম। তাই কৃষক মরল না বাঁচল,মধ্যবিত্ত শ্রেণী বেঁচে থাকল নাকি ডুবে মরে ভেসে উঠে অস্তিত্বের উপস্থিতি জানান দিয়ে কিছুদিন টিকে রইল; তাতে তাদের কিছু এসে যায় না। প্রতি বছরই কৃষি নিয়ে তামাশা হয়। বীজ,সার,সেচযন্ত্র,তেল এসব নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটে থাকে। কৃষি উৎপাদনে সহায়তা দূরে থাক,উৎসবের সাথে কৃষকের পরনের বস্ত্র হরণ করা হয়। উৎপাদন ব্যয় এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে কৃষক চোখে সর্বদা ক্ষেত ছাড়াই সর্ষেফুল দ্যাখে। ধান হোক,গম হোক আর ডালই হোক, কৃষক ক্ষেতের সামনে দাড়িয়ে সর্বদা সবকিছু সর্ষেফুল আকারেই দ্যাখে। এরপর উৎপাদীত ফসল ঘরে তোলার সময় পরিকল্পিতভাবে ফসলের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। তার সকল প্রয়োজনের একমাত্র উৎস্য যেহেতু উৎপাদীত ফসলটুকু, তাই তাকে কম দামেই ফসল বিক্রী করতে হয়। যেহেতু পেশা পরিবর্তন সহয নয় এবং অন্য কাজ জানা নেই, তাই এই যুলুমের প্যাঁচে এরা সারা বছর এবং সারা জীবন আটকে থাকে। পাঁচ বছর পর পর দেশের অনেকে আশ্বাস পেলেও কৃষক তেমন কোনো মুখরোচক আশ্বাসও পায়না।
লেবাননের চমৎকার ফসলের ক্ষেত, ফলমূলের ক্ষেতের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে বাংলাদেশের মলিন কৃষকের কথা ভাবছিলাম। আর ভাবছিলাম আমাদের মত মহা উর্বর জমি পেলে এরা কি করত !
চলে আসলাম সুইটহোম। এই সিটিটা সত্যিই সুইট। এখানে লোক সংখ্যা বেশ কম। এদিকে কিছু কোম্পানী বেশ কিছু বাস্তব মূলো ঝুলিয়ে মানুষকে কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসে। এটি পাহাড়ী এলাকা। এখানকার ফার্মহাউসগুলো অত্যন্ত চমৎকার। এখানে অনেক ধনী লোক বসবাস করে,যারা গাড়ি চালিয়ে অনেক দূরে গিয়ে অফিস করে। নিরিবিলি পরিবেশে তারা থাকতে ভালবাসে। কয়েকটা লগ হাউস দেখলাম। গাছের বড় বড় কান্ড একটার পর একটা জোড়া দিয়ে এমন সব কাঠের বাড়ি তৈরী করা হয়,দেখলেই থাকতে ইচ্ছে করে। এগুলোর দাম অনেক। পাহাড়ী লেক,চমৎকার বাগান আর লগ হাউস এই তিনে মিলে যা দাড়ায় তাতে আত্মহারা হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
মূলত এই স্থান থেকে চলমান পরবর্তী মুহুর্তগুলোতে আমি “সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি,সুবহানাল্লাহিল আযিম” পড়েছি। অত্যন্ত অসহ্য সুন্দর প্রকৃতি আল্লাহ তৈরী করেছেন। এসব দেখার জন্যেই আল্লাহ আমাদেরকে ভ্রমন করতে বলেছেন। আমি যতই ভ্রমন করি, ততই আল্লাহর সৃষ্টিতে মাত্রাতিরিক্ত মুগ্ধ হই। আর নিজের চিন্তা শক্তির উপর করুনা হয়। মনে মনে নিজেকে ধিক্কায় দেই এই কারনে যে, কিছুক্ষন পূর্বেও জান্নাত সম্পর্কে যেরকম কল্পনা করছিলাম বা ছবি তৈরী করছিলাম,সেটা এই প্রকৃতির চাইতেও নি¤œ মানের। অথচ সেটা এমন একটি স্থান,যা কোনো চোখ ধেখেনি, কোনো মন কল্পনা করেনি। আবারও “সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি,সুবহানাল্লাহিল আযিম”।
লেকের পাড়ে থামলাম। এখনও সুইটহোমেই আছি। সকালের সূর্য্য পাহাড়ের উপর থেকে উদীত হয়ে লেকের উপর পড়ল। এটা হল ফস্টার লেক। মসৃণ সুন্দর রাস্তার বামে লেকটি, আর ডানে নয়নাভিরাম পাহাড়ী বন এবং তারই মাঝে কিছু সংখ্যক লগ হাউস। সত্যিই অসাধারণ। এই লেকটি চট্টগ্রামের ফয়েস লেকের মত। সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একেঁ বেঁকে লেকটি প্রবাহিত হয়েছে। রাস্তার ধারে একটি শেড তৈরী করা হয়েছে চমৎকারভাবে। সেখানে খানিক থামলাম এবং দুচোখ ভরে সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এরা যেখানে কোনো শেড তৈরী করে সেখানে নারী-পুরুষের জন্যে আলাদা টয়লেট তৈরী করে। এই লেকটি সৌন্দর্যে নিশ্চয় ফয়েস লেকের থেকে বেশী নয় কিন্তু আমরা আমাদের সৌন্দর্য গুছিয়ে রাখতে পারিনা,জানিনা। আমাদের কোনো দর্শনীয় স্থানে ভ্রমন করলে সকল সরঞ্জাম বাড়ি থেকেই নিয়ে যেতে হয় এবং টয়লেট পর্বও সেরে যেতে হয়। কোনো কারনে কোথাও টয়লেট থাকলেও তাতে প্রবেশ করার অবস্থা থাকেনা। আমাদের সরকার সচেতন হলে পর্যটন থেকে দেশে ব্যপক আয় আসত। আবারও চলতে শুরু করলাম।
পাহাড়ী আকাঁ বাঁকা রাস্তায় চলার সময় একটুও খারাপ লাগল না। আজ নাস্তা করেছি উত্তম রূপে। আমার ধারনা আঁকাবাঁকা রাস্তায় শরীরে অস্বস্তি লাগার একটি কারন হল শরীরে কোনো খাদ্য উপাদানে ঘাটতিও। তবে অনেকের সমস্যা হয়,অনেকের হয়না। আমার কখনও কখনও এই অস্বস্তি হয় ,যখন পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তায় ঘন ঘন মোড় নেওয়া হয়। আজ ফুরফুরে মেজাজে আছি। সত্যিই ভাল লাগছে। এরা পাহাড় কেটে বেশ প্রশস্ত রাস্তা তৈরী করেছে। রাস্তার এক পাশে চমৎকার পাহাড়ী নদী,অন্যপাশে বড় বড় বৃক্ষ,যার গায়ে সবুজ শাওলা জমে আছে। এই শ্যাওলা পড়া প্রাচীন সব বৃক্ষ আমাকে দারুনভাবে আকর্ষণ করে। পাহাড়ের মাটিতে ছোট ছোট ফার্ণ জাতীয় উদ্ভীদ দেখলাম। এগুলো সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়। পরিপূর্ণ এক সবুজ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি।
এইটা হল ট্রাউট ক্রিক। এর পানির উৎস্য হল দূর পাহাড়ের উপর জমে থাকা তুষার এবং ভূগর্ভ। খুবই শীতল পানি প্রবাহিত করে এই ছোট নদী। সর্বদা ক্ষর¯্রােতা আর সৌন্দর্যে অতুলনীয়া। বড় ছোট নানান আকৃতির পাথর খন্ডের উপর বা পাশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। পানি প্রবাহের শব্দ একটানা চলতে থাকে। রাস্তার ডানে একটি মঞ্চ দেখতে পেলাম এবং থামলাম। এখানে পাহাড়ীয়া নদীটি একটু প্রশস্ত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর কিনার থেকে মাঝ বরাবর বড় বড় কাঠের গুড়ি এবং চৌক তক্তা দিয়ে একটি বড় মঞ্চ তৈরী করা হয়েছে। এর নীচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আমি খানিক হেটে সেটার শেষ সীমায় দাড়ালাম। এখান থেকে ডানে-বামে স্বশব্দে চলমান নদীটি দারুন বৈচিত্রময়। কোথাও পানির ধারা ধীর,কোথাও পাথরে আঘাত পেয়ে ভিন্ন গতিধারায় প্রবাহিত। চলেছে দূরে। বড় বড় শতবর্ষী বৃক্ষরাজি নদীর তীর ধরে দাড়িয়ে আছে। দেখলাম সামনের দিক থেকে বেগবান একটি ঝর্ণাধারা এই নদীতে এসে মিশেছে। বাহ অপূর্ব !
মুগ্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। এখানে সারাদিন থাকলেও মনে হবে, এই তো খানিক আগেই এসেছি। খুব ভাললাগা কাজ করছিল। মঞ্চটি দারুন করে তৈরী করা হয়েছে, মজবুত তো বটেই। এখানে বসন্ত এবং পৃষ্মে মানুষ ক্যাম্পিং করতে আসে। সত্যিই এটি ক্যাম্পিংএর জায়গা। চলে গেলাম নদীর অপর পাশে। একটি চোট্ট সুন্দর সেতু নদীর ওপারকে যুক্ত করেছে। ওপারে গিয়ে পাগল হয়ে গেলাম। এখানে বিশাল বিশাল পাইন গাছ এবং নীচে সবুজ ঘাস ও ছোট ছোট উদ্ভীদ। এপাশে নদীর আরেকটি শাখাও প্রবাহিত। সেটার পাশে বড় বড় বৃক্ষ এবং সবুজ সমতল ভূমী নদীর কিনার পর্যন্ত চলে গেছে। এখানে গাছের পাশে মানুষ ছোট ছোট তাবু টাঙিয়ে বনের সৌন্দর্য উপভোগে মত্ত। কেউ দলবেধে আর কেউ স্বপরিবারে,আর কেউ এসেছে তার প্রিয়জনকে নিয়ে। শহর থেকে দূরে নির্জনে প্রকৃতির কোলে নিরাপদে,আনন্দে কিছু সময় অতিবাহিত করে এরা চরম সুখ অনুভব করে। সত্যিই এ এক অসাধারণ স্থান। কিছু কিছু মানুষ মোটর হোম এনেছে। মার্সিডিজ বেঞ্জের তরী একটা মোটরহোম আমার দারুন লাগে। ইচ্ছা আছে পরবর্তীতে এমন একটা কিনব,বিয়ে করে মাঝে মাঝে এটাতে সংসারী হব। ছুটির দিনগুলোতে বিভিন্ন মনোরম স্থানে সেটা পার্ক করে ২/১ দিন পার করে দেব। দাওয়যাহ এবং ভ্রমন দুটোই এটাতে হতে পারে।
(মোটরহোমের ভেতরে)
আবারও চলতে শুরু করলাম। চলছি চলছি,চলতেই আছি,চলতেই আছি। রিভার ব্যান্ড পার্কে এসে থামলাম। এটা অসাধারণ সুন্দর পার্ক যা নদীর ধারে তৈরী করা হয়েছে। সবুজ ঘাস এবং বড় বড় বৃক্ষ,আরও আছে ফুল বাগান। এর ভেতর যেসব সুন্দর রাস্তা তৈরী করা হয়েছে,তা ধরে হাটতে থাকলে কেউ ক্লান্ত হবেনা।
বেশ কিছু দূর চলার পর সামনে দেখলাম থ্রি ফিংগার জ্যাক হিল,এটি মাউন্ট জেফারসন এলাকায়। এর উচ্চতা ২৩৯১ মিটার। এর উপরের অংশটি তিনটি আঙ্গুলের মত,তাই এই নামকরণ। এটির উপরিভাগ ছিল সাদা তুষারে ঢাকা। আড়াইমাস আগে তুষারপাত হলেও সেটা এখনও গলে শেষ হয়নি। পাহাড়ের কিছু অংশ বরফ শুণ্য হলেও অনেক অংশেই তা রয়ে গেছে।
এবার হাতের ডানে এমন একটা লেক দেখলাম যার পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছ হয়। এটা হল ব্লু-লেক।
পাহাড়ী উঁচু রাস্তা থেকে এটাকে দেখলাম। এটি খুব গভীর,আর চওড়ায় অন্তত ৩ শত মিটার হবে। উপর থেকে এটা অসাধারণ লাগে। লেকের ওপারে একটি দারুন বাগান তৈরী করা হয়েছে এবং পর্যটকদের জন্যে সকল সুবিধা রাখা হয়েছে। ছুটিতে মানুষ এই লেকের পাড়ে আসে। এখানেও ক্যাম্পিংয়ের সুবিধা আছে। লেকে স্পীডবোট রয়েছে, ইচ্ছে হলেই কিছু পয়সা দিয়ে তা চড়া যায়। নানান রকমের স্পীডবোট দেখে চড়তে ইচ্ছে হবে। আর লেকের গাঢ় নীল রংয়ের পানি যে কোনো মানুষেরই ভাল লাগবে। সবুজ পাহাড়ী বনভূমীর কোলে এমন মারাত্মক সুন্দর লেক বিখ্যাত শিল্পীর তুলীর আচড়ে তৈরী অসাধারণ চিত্র মনে হয়।
পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলছি। রাস্তার একপাশে পাহাড়,অন্যপাশে সরু ক্ষর¯্রােতা নদী প্রবাহিত। প্রায় ১২০কি:মি: চলার পর হুডু স্কি এরয়িাতে চলে আসলাম। দূর থেকে এখানকার পাহাড়ের মাথা দেখা যায়। পাহাড়ের মাথা এখনও তুষারাবৃত রয়েছে। এর এক পাশে সূর্যের আলো বেশী পড়াতে সেখানে তুষার প্রায় গলে গেছে। এদিকের পাহাড়ী বনে কয়েক বছর পূর্বে দাবানল জ্বলেছিল। বড় বড় গাছপালা পুড়ে সাদা রং ধারণ করেছে। কাঠ পুড়ে নিয়মানুযায়ী কালো হবার কথা কিন্তু কেন জানি সারি সারি বড় বড় সাদা গাছের সারি দেখলাম। এ দৃশ্য যেন আরও ভাল লাগল। বন পুড়তে দেখলে আমার মায়া লাগে,কিন্তু পোড়ার পরও দেখী বনের সৌন্দর্য কমেনি। কিছু কিছু গাছ মরে আবারও ডালপালা বিস্তার করেছে, তবে প্রায় সকল গাছই মরা। মাইলের পর মাইল পোড়া বনভূমী। এবার ডানের রাস্তা ধরে হুডু স্কী এরিয়াতে আসলাম। এখানে একাধিক রাস্তা বিভিন্ন স্পটে চলে গেছে, আর প্রত্যেকটা রাস্তার দুপাশে দারুন পাইন গাছের সারি। এমন মনোরম রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম এবং যে পাহাড়ের গা বেয়ে শীতে স্কী করতে করতে মানুষ নেমে আসে তার কাছাকাছি দাড়ালাম।
এই পাহাড়টি এখানে সবথেকে উঁচু এবং এর শীর্ষদেশ থেকে কয়েক শত মিটার নীচ পর্যন্ত পাহাড়টি মোটামুটি মসৃন ও ঢালু। এ অংশে শীতে তুষার জমলে নিরাপদে তার উপর স্কী করা যায়। পাহাড়টি খাড়াও বটে। দেখেই ভয় করে। এখানে অনেকগুলো রাস্তার সম্মিলন ঘটেছে এবং কংক্রিটের একটি বড় প্রাঙ্গন তৈরী করা হয়েছে,যাতে মানুষ এখানে এসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারে। একটি লগ হাউস দেখলাম এবং ভাল লাগল। পাশেই অরেকটি পাহাড় রয়েছ শিক্ষানবিশদের জন্যে। সেখানে অপেক্ষাকৃত কম ঢালু পথ রয়েছে ,যাতে স্কী শেখা যায়। এখান থেকে ফেরার পথে সামনে মাউন্ট হুড দেখা যায়,যা দেখতে খুব চমৎকার। মাউন্ট হুড হল ওরেগনের সবথেকে উচু পর্বতশৃঙ্গ।
এই স্কী এরিয়াতে স্কী করতে করতে মারাত্মক তুষারপাতের কবলে পড়ে আমার এক বন্ধুর পিতা-মাতা হারিয়ে গিয়েছিল। তারা যখন স্কী করছিল তখন পেছনে তুষার ধস হয় এবং তার ধাক্কায় তারা ছিটকে যায়। পুরো রাস্তা তুষারে ঢেকে যাওয়ায় তারা পথ চিনতে পারেনি। তার মা তুষারের উপর হাটতে হাটতে মূল সড়কের দেখা পায় এবং হেলিকপ্টারে তাকে উদ্ধার করা হয়, কিন্তু তার পিতা দুই দিন হাটাহাটি করার পর একটি বেজক্যাম্প দেখতে পেয়ে নিথর দাড়িয়ে থাকে,কারন শারিরীক,মানুষিক চাপে তিনি স্বাভাবিক ছিলেন না। টানা দুদিন হেলিকপ্টার টহল দিয়ে তাকে খুঁজে পায় সেখানে।
বেনসন ¯েœা পার্কে আসলাম। এখানেও একই কারবার। সৌন্দর্য সব একই রকম কিন্তু ভাল লাগল। এদিকে অনেক স্থানে ক্যাম্পিংয়ের সুবিধা রয়েছে। যেসব এলাকায় সরকার নিজ দায়িত্বে ক্যাম্পিং এরিয়া লিখে রেখেছে,সেখানে সরকারী নজরদারী ও দায়দায়িত্ব রয়েছে। সেখান থেকে কেউ হারিয়ে গেলে বিশেষ বাহিনী তাদের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি এবং সক্ষমতা দিয়ে খুঁজে বের করবে। নিয়ম মেনে চললে সমস্যা হয়না। কিছু লোক আছে যারা একটু বেশী রিস্ক নিতে চায়, অনেক সময় এরাই বিপদে পড়। তারা ঝুঁকি আছে এমনসব এলাকায় ছুটে যায় এবং নিষেধ শুনতে হতে পারে ভেবে তাদের তথ্য পর্যন্ত জানায় না। এরা হারিয়ে গেলে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়। অবশ্য এমন লোকের সংখ্যা কম। এখানে এখন যারা এসেছে, তারা কয়েকটা দিন প্রকৃতির কোলে মাথা গুজে পড়ে থাকবে। জীবনোপকরনের অনেক কিছুই তারা সাথে নিয়ে এসেছে। ফলে শান্তিতে কদিন এরা থাকবে। এরা জীবনকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে উপভোগ করে।
এবার চলার সময় রাস্তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম। এটাও পাহাড়ী রাস্তা কিন্তু এটি সমতল। মাইলের পর মাইল সমতল রাস্তা এবং তা সোজা উঁচু নীচু হয়ে কোনো টিলাকে অতিক্রম করেছে এবং আবারও প্রশস্ত ও সমতল। অনেক দূর থেকে যখন দেখা যায় রাস্তার শেষ অংশটি অনেক উঁচুতে উঠে আছে এবং রাস্তাটি ঢেউ খেলে অগ্রসর হয়েছে, আর রাস্তার দুপাশে সবুজ বনভূমী, তখন কার না ভাল লাগবে ! আমার যে কি ভাল লাগল, তা বোঝাতে পারব না।
এখানে একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরী দেখলাম, যা প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে অগ্নুৎপাত ঘটিয়েছিল। আপতত ঘুমাচ্ছে,তবে যে কোনো সময় নড়ে চড়ে উঠতে পারে। শুনেছি সে সময়ে সরকার যখন লোকদেরকে সরে যেতে বলছিল,তখন এক প্রবীন ব্যক্তি তার সুন্দর বাড়িটির প্রতি ভালবাসায় সরকারী নির্দেশ অমান্য করে থেকে যায়,এবং কিছুই হবেনা ভাবতে থাকে। সেই লোকটি জ্বলন্ত লাভায় পুড়ে মরেছিল। কিছু মানুষের কাছে জীবনের চাইতে সম্পদের মূল্য অনেক বেশী, কিছু বলার নেই।
তবে আগ্নেয়গীরিটা বেশ দারুন। এটি বিশাল নয়,তবে সৌন্দর্য আছে। এর গাছে এখন সবুজ বনভূমী ছেয়ে আছে। সোজা চলেছি। এবার চলে আসলাম সিস্টার সিটিতে। অলামেট ভ্যালীর এদিকে এটাই প্রাচীন এবং প্রথম শহর। এটি পর্যটন এরিয়া। ২০১৩ সালের হিসেব মতে এখানে মাত্র দুই হাজার লোক বসবাস করে। ছোট্ট একটি শহর কিন্তু দেখলেই ভাল লাগে। এদিকে মানুষেরা এখনও ঘোড়া পালন করে। অনেকের ঘোড়ার ফার্ম আছে।
চমৎকার শহরটিতে হাটতে থাকলাম। সুন্দর রাস্তা আর প্রাচীন সব বাড়ির সমন্বয়ে তৈরী শহরটি। নতুন কিছু বাড়িও তৈরী হয়েছে। প্রচুর রেস্টুরেন্ট দেখলাম,কারন প্রতিদিন পর্যটকরা আসে প্রচুর। শতবর্ষী একটি গাছের নীচে যখন দাড়ালাম, তখন খুব ভাল লাগছিল। এখানে একটা আর্ট গ্যালারী আছে,সেখানে মূল্যবান আর্ট শোভা পাচ্ছে,কিন্তু এসব বুঝিনা। সবুজ সুন্দর প্রকৃতির মাঝে একটি ইট-পাথরের শহর। রাস্তায় হাটার সময় বেশ ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছিল প্রাচীন কোনো ইতিহাসের বুকে হাটছি। এক সময় কাউবয় হ্যাট পরে রাস্তায় মানুষ ঘোড়া নিয়ে চলাচল করত,আজ অবশ্য কেউ কেউ শখের বসে সেরকম সাজ সরঞ্জাম জমা করে রেখেছে,কিন্তু দামি গাড়িতেই তারা চলাচল করে। অনেকে বড় বড় ফার্মের মালিক। এখানে কৃষি বেশ সমৃদ্ধ।
আজ সূর্যের তেজ বেশী কিন্তু ফুরফুরে বাতাসও আছে। এখানে শতাধীক বছরের পুরোনো অকেগুলো বেস্টুরেন্ট ও নানান প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একটা ডোনাট শপে ঢুকলাম। এটার বয়স সম্ভবত শোয়া’শ বছর। খু¦বই জনপ্রিয় এখানকার ডোনাট। ডোনাট হল বিশেষ নরম পাউরুটি,যার উপর চকলেট বা মিস্টি মিল্কবার থাকে। ইউজিনের একটি বিখ্যাত ডোনাট শপে যে ডোনাট খেয়েছিলাম, সেটার ভেতররে অরেঞ্জ জেলী ছিল,সে ছিল অতি চমৎকার। আমি মিস্টি ফিস্টি তেমন পছন্দ করিনা, তার পরও মাঝে মধ্যে ধুম ধাম ঝেড়ে দেই। মাঝে মধ্যে এমন পরিমান মিস্টি খাই যে ভয় হয়, পাছে যদি ডায়বেটিসে আক্রান্ত হই ! তবে আমি নিয়ম মেনে চলি, যদিও প্রায় সবাই আমার মুখের উপরই হাভাতে বলে। আসলেই আমি নিয়ম মেনে চলি। যদি বেশী খাই তবে বেশী কসরত করে তা পুড়িয়ে ফেলি। তবে আজ(৩১শে মে) কর্ভালিসে যখন রাস্তার উপরে বসা একটি সেটারডে মাকের্টে হাটছিলাম, দেখলাম ফ্রি ব্লাড সুগার টেস্ট করা হচ্ছে। মনের মধ্যে খটকা থাকায় মেপে নিলাম। এটা মাপার দুই মিনিট আগেও মিস্টি চেরী খেয়েছি প্রায় এক পাউন্ড। কিন্তু রক্তে চিনির পরিমান যা পাওয়া গেল,তাতে আমি অতিরিক্ত খুশী। এটা একেবারে নরমাল। মানে ইনসুলিন ভাল কাজ করছে, আলহামদুলিল্লাহ। তবে ইনসুলিনের উপর চাপাচাপি না করাই ভাল। একটু মেনে গুনে চলাই আসলে উত্তম। সমস্যা হল, খাবার-দাবার সামনে পড়লে মনের মধ্যে,দেহের মধ্যে কি যে একটা ঘটে যায়, নিজেকে সামাল দিতে পারিনা। আমার জিহবাটাকে গাছে বেধে পেটানো উচিৎ, সব দোষ ওর’ই।
সিস্টার সিটিতে ২০ মিনিট হাটলেই পুরো শহর দেখা হয়ে যাবে। এখানে সুভ্যেনিরের কিছু দোকান আছে, দামের কথা বিবেচনা করে আমার মত কাঙালরা এখানে জীবনেও কিছু কিনবে না। আবার চলা শুরু করলাম।
(ঘোড়াগুলো নকল)
এবার দেখলাম থ্রি সিস্টার হিল। এ এক অসাধারণ জিনিস। তিন বোনের উচ্চতা যথাক্রমে ৩১৫৭ মিটার,৩০৬২ এবং ৩০৭৪ মিটার। কিন্তু উচ্চতায় কিছু এসে যায় না। এরা আসমানে মাথা তুলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে,তা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। সমতল রাস্তা থেকে যখন তিনটি পাহাড়কে পাশাপাশি দেখা হয়,তখন চমৎকার লাগে। পাহাড়গুলির বেশীরভাগ অংশই সদা তুষারে ঢাকা। পাহাড়ী এলাকায় তুষারপাত বেশী। এসব রাস্তায় শীতে কখনও কখনও দশ ফুট উচু তুষার জমে। তখন বিশেষ গাড়ি এসে রাস্তা পরিষ্কার করে এবং রাস্তায় পাথরের কুচি ছড়িয়ে দেয়,যাতে গাড়ির চাকা পিছলে না যায়। এদিকে অবশ্য শীতে চলার নীতি হল,গাড়ির টায়ারের উপরে বিশেষ বেল্ট বেধে নেওয়া, যা স্পাইক সমৃদ্ধ। এটি বরফের উপর চলতে সাহায্য করে।
এদিকে ঘৌদদৌড় প্রতিযোগীতা এবং মাউন্টেন বাইক প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হয়। বেশ কিছু বড় বড় ঘোড়ার ফার্ম আছে এখানে। ধনীরা বেশ মোজ মাস্তিতে এখানে সময় অতিবাহিত করে। রাস্তার পাশে বড় বড় অনেক সংখ্যক ঘোড়া চরতে দেখলাম। ছোটবেলা থেকেই ঘোড়ায় চড়ার শখ,কিন্তু আর সেসব শখ নেই। ঘোড়ায় চড়ে দিকবিদিক ছুটে যাব, এমনটাই ভাবতাম। আগে যা ভাবলে মজা লাগত, এখন সেটাই ভাবলে মনে হয়- পড়ে গেলে সর্বনাশ হবে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি নাতো !
প্রায় আড়াই’শ কি:মি: ভ্রমন করেছি এবং চলে আসলাম ব্যান্ড সিটি। আজ এটাই হল শেষ সীমা। এই শহরটি পুরোপুরি ধনীদের জন্যে উৎস্বর্গীত। এখানে পাহাড়ী প্রকৃতির মাঝে একটি বাড়ির মালিক হতে হলে মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়। পাহাড়ের উপর বহু সংখ্যক বাড়ি দেখলাম থরে তরে সাজানো। সমতলেও মানুষ বসবাস করছে কিন্তু উভয় স্থানের বাড়িই বেশ দামী। অনেকে শহরের বাড়িতে থাকে কাজের কারনে,আর এখানে সপ্তাহিক ছুটি কাটাতে আসে ,সে কারনে এখানেও বাড়ি কিনেছে। ব্যান্ড সিটি সত্যিই পরিচ্ছন্ন ,পরিপাটি এবং সুন্দর। এখানে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে পেট ভরে মাছ ফ্রাই এবং ফ্রেন্সফ্রাই খেলাম। স্বাদটা বেশ ভাল। এখানে একটি শপিং জোন রয়েছে। যেখানে ফ্যাক্টরী শপ নামক একটি বড় এরিয়া তৈরী করা হয়েছে। বিশ্বের নামি দামী ব্রান্ডের দোকান সেখানে রয়েছে। প্রতিনিয়ত সেখানে মূল্যহ্রাস থাকে কিন্তু হ্রাসকৃত মূল্যেও আমার মত হতভাগারা বেশি কিছু কিনতে সক্ষম হবে না।
ব্যান্ড সিটির এক উম্মুক্ত স্থানে মেলা বসেছে দেখলাম। এটা এক দিনের জন্যে। গোটা পঞ্চাশেক দোকান নিয়ে মেলাটা। নানান রকমের অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এরা বসে আছে। কেউ কেউ কিছু স্ট্রবেরী,সব্জী এবং ফুলের গাছ নিয়ে এসেছে। আদীম মানুষের হাতিয়ারের অনুকরনে কিছু জিনিসপত্র তৈরী করে বিক্রীর চেষ্টা করছে। কেউ কেউ নানান রকমের পাথর নিয়ে এসেছে। নানান রকমের পেইন্টিংও আছে দেখলাম, ভাল করে খেয়াল করে বুঝলাম ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে গ্রাফিক্স সফটওয়ারে তাকে আরও অকর্ষনীয় করা হয়েছে। আকৃতি ভেদে দাম। ৪/৫ ফুট ফ্রেমে হলে দাম পড়বে ৫০০ডলার। মানুষ জিনিসপত্র না কিনে খালি হাতে ঘোরাঘুরি করছে দেখলাম। খানিক ঘুরে চলে আসলাম।
এবার আমার বন্ধুর পিতার বাড়িতে আসলাম। একটি তিন রাস্তার মোড়ের সাথে এক টুকরো অতি মনোরম সবুজ ঘাসাচ্ছাদিত জায়গা,তার মাঝে রয়েছে বিশালাকৃতির বেশ কয়েকটি পাইন গাছ। সাথে আছে ফুলের গাছ। এরপর একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। দেখেই অনুমান করা যায় এটা অনেক দামী বাড়ী। মি: হ্যারীর বয়স মাত্র ৮২ বছর,তিনি তার ৭০ বছর বয়ষ্ক মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে এটাতে বসবাস করছেন। সাথে আছে সিংহ সদৃশ দুটি কুকুর। আমি এত বড় সাইজের কুকুর এর আগে কখনও দেখিনি। এগুলো কারো সামনে এসে ঘেউ করলে সত্যিই তার দফা সারা হয়ে যেতে পারে।
সারাগায়ে লম্বা লম্বা চুল,আর মাথাটাও বেশ বড়। কুকুরগুলো রাক্ষসের মত করতে করতে আমার কাছে আসল,বন্ধুর পিতা অভয় দিলেও আমার আত্মা আমার কাছ থেকে প্রায় আলাদা হয়েই রইল। এরা নানাভাবে শুকে আমাকে চিনে নিল,যাতে ভবিষ্যতে আমি আসলেও খানিকটা অন্তত মনে থাকে। কুকুরে আমার অস্বস্তি লাগে। বললাম,আমার কুকুরে এলার্জী আছে। তখন তাদেরকে ভেতরের দিকে তৈরী তাদের বিশেষ স্থানে নিয়ে রাখা হল,আমি বাঁচলাম।
আঙ্কেল বেশ রসিক লোক এবং সাংঘাতিক গল্পবাজ। বহু রকমের গল্প হল। এক সময় আমি বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখলাম। এটা খুব নির্জন এবং চমৎকার জায়গা। বাড়িগুলো খুব সুন্দর। রাস্তার পাশে ফুল বাগান আছে অনেকগুলো। পাইনসহ নানান গাছে ভরা এলাকাটি। খানিক পর বন্ধুর সৎ মা আসল। আমরা এটা সেটা খেতে খেতে গল্প শুরু করলাম। কথার এক ফাকে ভদ্র মহিলার কাছে ফোন আসল,তিনি রিসিভ করে বললেন-চিনতে পারছি না, আপনার নামটা ভুলে গেছি,আরেকবার বলুন। ওপাশ থেকে উত্তর আসল, আহা মা, কেন এমন মজা করছ ? খানিক কথা বলে ভদ্র মহিলা জানালেন- সে আমার একমাত্র ছেলে,অথচ মাসে একবার ফোন করে। এ কারনেই তার নামটা জানতে চেয়েছিলাম। এখানে জওয়ান সন্তানরা তাদের বুড়ো পিতা-মাতার খবর রাখতে চায়না, এটাই এখানকার নিয়ম। কথার ফাকে আমাদের কালচারটা জানিয়ে দিলাম। আমাদের সমাজে আমরা পিতা-মাতাকে কোন চোখে দেখী এবং কেমন সম্মান করি তা জানালাম।
এক সময় মি: হ্যারী আমার সাথে কথা বলা শুরু করলেন। এক পর্যায়ে আমাদের দেশের ধর্ম নিয়ে কথা হল, আর আমি মওকা পেয়ে বয়ান ঝাড়লাম। ....বললাম, আসলে ইসলাম এবং খ্রিষ্ট ধর্মের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই মিল রয়েছে। মাত্র অল্প কিছু বিষয়ে অমিল রয়েছে যেটা উঠে গেলে আমরা এক হয়ে যেতে পারি। --- আমরা উভয়ে বিশ্বাস করি এক ¯্রষ্টায় এবং বিশ্বাস করি প্রথম মানুষ ও নবী হযরত আদম(আকে। আমরা ইব্রাহিম,ইসমাইল,ইসহাক,ইয়াকুব,ইউসুফ,মুসা,ইয়াহিয়া,ঈশাসহ(আলাইহিস সালাম) সকল নবী-রসূলকে বিশ্বাস করি। এমনকি এসকল নবীর উপর ঈমান না আনলে আমরা মুসলিমই হতে পারব না। আমরা অবতীর্ণ হওয়া আসমানী কিতাবেও বিশ্বাাস করি,এটাও আমাদের ঈমানের অঙ্গ। কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।
আমাদের গড আল্লাহ তায়ালা সকল যুগে নবী-রসূল পাঠিয়েছিলেন এবং তিনি কিতাবও পাঠিয়েছিলেন,কিন্তু পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলো পরিবর্তিত হয়েছে। আপনি যদি বাজারে বাইবেল কিনতে যান, তাহলে মার্ক,লুক,ম্যাথিউ,যোহনসহ অন্তত শত রকমের বাইবেল দেখতে হবে। গড নিশ্চয় শত রকমের বাইবেল নাযিল করেননি, তিনি একটি বাইবেল নাযিল করেছিলেন। তাহলে সেটি কোনটি ? কোনটি সত্য বাইবেল ? ব্যাপারটাতো দিবালোকের মত সত্য যে,বাইবেল পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রত্যেকটি কিতাবের ক্ষেত্রেই তাই ঘটেছে। আর তাই আমাদের ¯্রষ্টা সর্ব শেষে আমাদেরকে একটি কিতাব আল-কুরআন দান করেছেন, আর তার শিক্ষা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে একজন সর্বশেষ রসূলকে পঠিয়েছেন,তিনি হলেন-মুহাম্মদ(সা। আর এই আসমানী কিতাব শুরু থেকেই অবিকৃত আছে। পূর্বে বহু খ্রিষ্টান,ইহুদী,মুশরিক এই সত্যটি বুঝতে পেরে সর্বশেষ এই কিতাবটি মেনে নিয়ে ইসলাম গ্রহন করেছেন,তাই সকলেরই এটা মেনে নেওয়া উচিত। এটা মেনে নেওয়া মানে মুসলিমের তাবেদারী নয় বরং ¯্রষ্টার তাবেদারী করা,যে ¯্রষ্টা আমাদের কাছে পূর্বোক্ত নবী-রসূলদেরকে পাঠিয়েছেন,যে ¯্রষ্টা ঈশা(আকে পিতা ছাড়াই সৃষ্টি করেছিলেন এবং আমাদের মাঝে রসূল হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। আর খ্রিষ্টানরা হল আমাদের কিতাবী ভাই। আমি আরও কিছু কথা বলেছিলাম এবং আমার সে মুহুর্তের আবেগ,কথা বলার ধরণ অন্যরকম ছিল। ভদ্রলোক অনড় বসে রইলেন, সম্ভবত: আমার বক্তব্য তাকে আকর্ষিত করেছে। তবে তিনি কোনো কথার উত্তর দিলেন না। আসলে উত্তর দেওয়ার উপায়ও ছিলনা। আর ঠিক সেই সময়ে কুকুর ডেকে উঠল এবং তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রসঙ্গ পাল্টে কুকুরের দিকে নিয়ে গেলেন। সে সময়ে আমার বন্ধু তার সৎ মায়ের সাথে ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করছিল। এবার তারা এসে আবার গল্প শুরু করল। এদের গল্পের উপসর্গ হল অর্থনৈতিক বিষয়াদী,গাড়ি,বাড়ি,আনন্দ উজ্জাপন ইত্যাদী। আমি মাথার মধ্যে মেশিন ঝালাই করছিলাম, মওকা মিললে আইডোলজিক্যাল ডোজ দিব বলে। কিন্তু মওকা মিললো না। ভদ্র মহিলা আমাকে অনেক উপদেশ দিলেন চাকুরীর ব্যাপারে। তার পরিচিত কারা কারা বছরে লক্ষাধীক ডলার বেতন পান তা জানালেন এবং আমাকে কয়েকটি স্থানে এ্যাপ্লাই করতে বললেন। বললাম, বছর খানিক যাক,তারপর দেখা যাবে।
কথায় কথায় আমাদের দেশের অর্থনীতি উঠে আসল। বললাম,সেখানে কিছু লোক বিশাল সম্পদশালী আর একটা বিশাল অংশই চরম গরীব। তিনি বলে উঠলেন-ওহ ! তাহলে তো চুরি,ডাকাতি,খুন খারাবী হওয়ার কথা। আশ্চর্য হলাম তার চিন্তাশক্তি দেখে। আসলে এটা অনুমান করাই স্বাভাবিক। বললাম, জি সেখানে এসব হচ্ছে। তিনি বললেন, মিডল ক্লাস না থাকলে সমাজে সমস্যা থাকবেই,এবং বাড়বেই। মনে মনে বললাম, আমাদের সরকার আর কিছু পুঁজিপতি ইতিমধ্যেই অধিকাংশ মিডল ক্লাশকে মিসকিন বানিয়ে ফেলেছে। এক্ষেত্রে তারা সফল।
বিকেল হয়ে এসেছে, গল্প খ্যান্ত করে উঠলাম। মি: হ্যারী প্রথমে শুধু হ্যান্ডশেক করেছিলেন, তাই বিদায় বেলা হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে অবাক করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং অনেক সময় ধরে রাখলেন। তারপর বিদায় নিলাম। তিনি ধীরে ধীরে হাটতে হাটতে গাড়ি পর্যন্ত আসলেন। বার বার হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। দূরত্ব যদি আড়াই’শ কি:মি: না হত,তবে এই বুড়োকে দাওয়াহ করতাম। সাধারনত: আমি সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনা। তবে আমার দুজন নও-মুসলিম বন্ধু পরিস্থিতির কারনে পূণরায় খ্রিষ্ট ধর্মে ফেরত গেছে। তাদেরকে ফেরানোর জন্যে আমি এত মারাত্মক চেষ্টা করেছি,যা বলতে পারব না। রাত দিন বহুভাবে বুঝিয়েছি। এক সময় আর যোগাযোগ থাকেনি,পরে তারা পুরোপুরি পূর্বধর্মে ফিরে গেছে। তাদেরকে জীবন নাশের হুমকি দেওয়া হত। তারা গোড়া খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকায় থাকত। শেষে এটাও বলেছিলাম যে, অন্তত মনে মনে ঈমান ঠিক রাখো, গোপনে ইসলাম পালন কর,আর প্রকাশ্যে তাদের কথা শোনো। প্রথমে রাজি হয়েছিল কিন্তু পরে যোগাযোগ বন্ধ করল। এর অনেক দিন পর জেনেছিলাম তারা দ্বিধাদ্বন্দে থাকতে থাকতে এক সময় পূর্ব ধর্মেই ফিরে গেছে। পরিবেশ আসলে মানুষের উপর দারুন প্রভাব ফেলে।
খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারকদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ফাইট করার মত তেমন যোগ্যতা নেই,তাই ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে এরা অনেক সময় কূট কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। একজন নওমুসলিমকে এরা বলেছিল, মুসলিমরা তো পাথর পূজা করে বা পাথরে সেজদাহ দেয়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে ? তিনি বললেন,ক্কাবা ঘরে একটি পাথর রক্ষিত আছে,আমরা নাকি সেটার উদ্দেশ্যে সেজদাহ করি। এমন সুক্ষèভাবে একটা অপবাদ দেওয়া যায় জানা ছিলনা। তাকে বললাম, ওই পাথরটার নাম হাজরে আসওয়াদ। কথিত আছে ওটা আমাদের আদী পিতা আদম(আ জান্নাত থেকে এনেছিলেন। আর আল্লাহ যখন হযরত ইব্রাহিমকে(আ ক্কাবা নির্মান করতে বলেন,তখন তিনি এটার উপর দাড়িয়ে নির্মান কাজ করতেন। ওই পাথর খন্ডটির সাথে অনেক নবী রসূলের স্মৃতি জড়িত,এ কারনেই ওটাকে পবিত্র জ্ঞান করা হয়। আর ওটা রসূল(সা ক্কাবায় নিজহাতে স্থাপন করেছিলেন,সেটা ওখানে ওভাবেই আছে। যেহেতু নামাজ একটি জামায়াতবদ্ধ ইবাদত এবং সকল মুসলিমের উপর ফরজে আইন,তাই শৃঙ্খলার স্বার্থে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট দিকে ফিরে সেটা আদায় করতে বলেছেন। পূর্বে আমরা আল্লাহর নির্দেশে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করতাম, দশম হিজরীতে আল্লাহ পূণরায় নির্দেশ দেন ক্কাবার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করতে। ক্কাবা ঘরটি এখানে ইস্যু নয়, বরং সেটি একটি ক্কিবলা মাত্র।
আমরা আল্লাহকে সেজদা করি,তার শিখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে। সালাতে আমরা যা তিলাওয়াত করি,তার অর্থটা পড়–ন,তাহলে বুঝতে পারবেন,সেখানে কোনো পাথরে সেজদা করার নিয়তে সালাত আদায় করছি কিনা। মূলত: স্মৃতি বিজড়ীত উক্ত পাথরখন্ডটিকে আমরা একটি পবিত্র নিদর্শন মনে করি,এর বেশী কিছু নয়।
আরেক জন নওমুসলিম বলেছিল মুসলিমরা খ্রিষ্টানদেরকে ঘৃণা করে,কারন মুহাম্মদ(সা হযরত ইব্রাহিম(আ এর অপর সন্তান ইসহাকের(আ বংশধর নয়,এ কারনে। বললাম, মুসলিমরা বংশগত কারনে কাওকে ঘৃণা করেনা। বরং তারা কিতাবী ভাই এবং আমরা চাই- তারা সর্বশেষে আসা অবিকৃত সত্য কিতাবটি গ্রহন করুক। মুসলিম হওয়ার পূর্ব শর্তই হল,তাকে আল্লাহর প্রেরিত সকল নবীকে এবং তাদের উপর অবতীর্ণ হওয়া কিতাবকে বিশ্বাস করতে হবে। নবীদের মধ্যে পার্থক্য করা যাবেনা। তাদের সকলকে অবশ্যই ভালবাসতে হবে,কারন সকল নবীই একই উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। আমি যদি হযরত ঈশা(আএর সময়ে জিবীত থাকতাম তাহলে অবশ্যই তাকে মেনে নিতে বাধ্য থাকতাম। এটাই আল্লাহর আদেশ। যে আল্লাহ তখন ঈশাকে(আ মেনে নিতে বলেছিলেন তার প্রেরিত বার্তাবাহক হিসেবে, সেই একই আল্লাহ সর্বশেষ বার্তাবাহক মুহাম্মদ(সাকে মেনে নিতে বলেছেন। মুসলিমরা যদি কাওকে ঘৃণা করে থাকে তবে তা আল্লাহর আদেশ না মানার কারনে, অবশ্যই বংশধারাগত বিষয়টির কারনে নয়। আলহামদুলিল্লাহ ! তিনি বুঝলেন এবং তিনি ইসলামে অটল থাকলেন।
পাশ্চাত্যে মিডিয়া কারনে,অকারনে ইসলামের বিরোধীতা করে এবং অসংখ্য গীবত রচনা করে অমুসলিমদের কান ভারী করে রাখে,যাতে ইসলামের পক্ষে কথা শুনলে,বা দাহয়াহ পেলে তারা দ্বিধাদ্বন্দে জর্জরিত হয়,অথবা প্রত্যাখ্যান করে। অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে মানুষকে ইসলাম বিমূখ করা হয়। কিন্তু তার পরও কাজ হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, তারা যত বিরোধীতা করে ততই ইসলামের প্রসার হয় এবং বেশী পরিমানে মানুষ ইসলাম গ্রহন করে। এটা ইসলামের প্রথম যুগেও ঘটত। রসূল(সা কোথাও গিয়ে কথা বলার আগেই কাফিররা সেখানে গিয়ে তার বিরুদ্ধে উদ্ভট কথা ছড়াত। এতে সেসব মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রতি বা রসূলের(সা প্রতি কৌতুহল সৃষ্টি হত। এমন কৌতুহল মেটাতে যে কত লোক ইসলাম গ্রহন করেছে তার হিসেব নেই। বিষয়টি এখনও চলমান আছে, থাকবে।
চলতে শুরু করলাম। ফেরার পথে থ্রি সিস্টার পর্বতশৃঙ্গগুলোকে অপরূপ লাগল। সাদা পর্বতের উপর দিয়ে সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে,আর সূর্যের আলো এসে পড়েছে তার উপর। মনে হচ্ছিল পর্বত চূড়া সাদা আলোয় জ্বলছে। তাকিয়েই থাকলাম সেদিকে। সত্যিই অসাধারণ। ফেরার পথে সিস্টারর্স ট্রেইল পার্কে আসলাম। এটি থ্রি-সিস্টার্সে যাবার পথ। যারা ওদিকে ক্যাম্পিং করে অথবা পর্বতাহরণ করে তারা এদিক দিয়েই গমন করে। এখানকার পাহাড়ী বনভূমীতে প্রচুর হরিণ রয়েছে। রাস্তায় গাড়ির ধাক্কায় একটা হরিণ শাবকের শব দেহ দেখেছি। এরা রাস্তা পার হয় রাতে। কৃত্তিম যন্ত্রের সথে পরিচিত না হওয়ায় হয়ত গাড়ি দেখে সামনে দাড়িয়ে পড়েছিল।
এই পার্কটি এতটাই সবুজ সুন্দর যে সবুজ ঘাসের উপর খানিক দাড়িয়ে থাকলাম। এই ঘাসগুলো ঘন সন্নিবেশিত এবং সবুজ চকচকে। নির্দিধায় এর উপর শুয়ে থাকা যায়। পুরো প্রকৃতি অত্যন্ত মনোরম। পার্কে শতবর্ষী গাছ আছে অনেক। বিশাল মোটা আর লম্বা গাছগুলো আকর্ষণ করে। ছোট্ট পাহাড়ী ক্ষর¯্রােতা নদী পার্কের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একটি সুন্দর কাঠের সেতু রয়েছে পার হবার। সেতুটির উপরে কাঠের তৈরী ছাউনী রয়েছে। সেতুটি পার হয়ে ওপারে গেলাম এবং দেখলাম ভিন্ন রাস্তা দিয়ে ওপাশে প্রচুর লোক এসেছে ক্যাম্পিংয়ে। অনেকে বড় বড় মোটরহোম নিয়ে এসেছে। অনেকে ছোটছোট তাবু টাঙ্গিয়ে বসে আছে। বিশাল বিশাল গাছ আর সবুজ ঘাসপূর্ণ মসৃন এলাকা ভাল লাগার মত একটি স্থান। সামনে যতদূর চোখ গেল শুধু সবুজ আর সবুজ। অসহ্য ভাল লাগার অনুভূতি নিয়ে ফিরলাম।
এবার ভিন্ন রাস্তা ধরলাম যেটা আরও বেশী লম্বা,তবে ভিন্ন ধারার সৌন্দর্য উপভোগের কারনে এদিকে আসা। এটাও পাহাড়ী চমৎকার রাস্তা কিন্তু ভিন্ন রকম। রাস্তা,লেক,পাহাড়,বিশাল বিশাল বৃক্ষ,সবুজ বনভূমী সবকিছুই অসাধারণ। এদিকে রয়েছে বিশাল একটি বাঁধ। ডেট্রয়েট লেকের চমৎকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে অগ্রসর হলাম। বহুকাল পূর্বে এই লেকের পানি উপচে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হত।
১৯৫৩ সালে আমেরিকান আর্মীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এই লেকের উপর বাধ নির্মান করে। লেকটির গভীরতা ৪০০ ফুট এবং প্রশস্ত ৪৮০ মিটার। বাধটি দেখে খুব ভাল লাগল। মনে হচ্ছিল এটা হয়ত বছর তিনেক আগে বানানো। অত্যন্ত শক্তিশালী করে তৈরী করা। দুপাশের আগ্নেয় শীলার পাহাড়ের সাথে কংক্রিটের সমন্বয়ে বাঁধটি তৈরী করা হয়েছে। বাঁধের উপর হাটলাম। একপাশে বিশাল জলরাশি,অন্যপাশে বহু নীচে মন্থর গতিতে লেকটি চলে গেছে। সরু ধারায় পানি ছাড়া হচ্ছে। মনে হল ভারতের ফারাক্কা বাঁধ, যা বাংলাদেশের জন্যে এমন মন্থর গতিতে পানি ছাড়ে অথবা বন্ধ রাখে,তবে বর্ষায় বন্যা হলে ছেড়ে দেয়।
এখানে এই লেকের পানির ¯্রােতকে ব্যবহার করে ১১৫ মেগা ওয়াট বিদ্যুত তৈরী করা হয়। বিদ্যুৎ তৈরীর স্থানটি বাঁধের ভাটিতে,মানে ওপাশে। সেখানে দুটি বিশাল বিশাল পাইপের মধ্যদিয়ে পানির পতন ঘটানো হয় টারবাইন ঘোরানোর জন্যে। এই লেকের পানি শোধন করে নিকটবর্তী সেলাম নগরীতে সরবরাহ করা হয়। লেকের পানি স্বচ্ছ এবং সবুজ। চারিদিকের পাহাড়গুলো আগ্নেয় শীলায় তৈরী এবং পুরোটা সবুজ। বাঁধের উপর হাটতে লাগলাম। চারিদিকে দেখতে ভাল লাগছিল। বাঁধের যেপাশে পানির ধারা একেবারে কম সেপাশে তাকালে ভয় করে। বিশাল উঁচু বাধের ওদিকটা খাড়া ঢালু। পানি প্রবাহিত করার জন্যে অনেকগুলো গেট এবং চ্যানেল রয়েছে। বেশী পানি ছাড়ার প্রয়োজন হলে একাধীক চ্যানেল দিয়ে একযোগে ছাড়া হয়। সেসময়ের দৃশ্য দেখতে দারুন লাগে। বাঁধের উপর থেকে বহু মানুষ বর্শী দিয়ে মাছ ধরছিল। তাদের পাত্রে দেখলাম ১০ থেকে ২০ ইঞ্চি সাইজের মাছ রয়েছে। সম্ভবত এগুলো ট্রাউট মাছ। এক বাচ্চা ছেলেকে দেখলাম বর্শীতে একটা মাছ বাধিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা। অনুমতি নিয়ে তার একটা ছবি তুললাম। এলাকাটা সত্যিই ভাল লাগল। এই বাঁধের উপর দাড়িয়ে সবুজ পানির লেকের দিকে তাকিয়ে থাকলে সময় কিভাবে পার হবে তা বোঝা যাবে না। এছাড়া চারিদিকে আছে সবুজ পাহাড়,যা লেকটিকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। প্রকৃতি মানুষের মনে দারুন প্রভাব ফেলে। এমন সুন্দর স্থানে কিছুক্ষন হাটাহাটি করলে মন ভাল হয়ে যাওয়ার কথা,যদি বিশেষ সমস্যা না থেকে থাকে। আর আমি তো উৎফুল্ল চিত্তে ঘোরাঘুরি করি। আমার মালিক পবিত্র ও সু-মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কত সুন্দর করে প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন ! দেখলেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আল-হামদুলিল্লাহ !
(দ্য স্লেভ ইন সিস্টার্স)
সন্ধ্যা হতে চলেছে। এখন গৃষ্ম তাই সন্ধ্যা হয় ৯ টায়,আর সূর্য্যদয় সকাল ৪.৩০। ইদানিং গরমও পড়ছে বেশ। এবার রোজায় আমার খবর হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। খবর চলতে থাকুক। আমি চললাম। এদিকে পাহাড় পরিবেষ্টিত বনভূমীর কারনে বিকেলেই চারিদিক সন্ধ্যার মত প্রায় অন্ধকার হয়ে আসে। অনেকক্ষণ চলার পর হাইওয়ে-৫ এ উঠলাম। এবার ঘরে ফেরার পালা। হঠাৎ খাওয়ার কথা মনে পড়ল। বিশেষ ব্যাগ থেকে টুনা স্যান্ডুইচ,আপেল,চিপস,অত্যন্ত সুমিষ্ট বিশ্বখ্যাত টসটসে পাকা ওরেগন স্ট্রবেরী,জুস ইত্যাদী খেতে থাকলাম। একটা গানের বিখ্যাত কলি মনে পড়ল, জনৈক হাভাতে শিল্পী গেয়েছিল- আমার এই খেতে থাকাতেই আনন্দ !!!
বিষয়: বিবিধ
৩০৭৬ বার পঠিত, ৩৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চরম বাস্তব কথা বলেছেন মুন্নাভাই ।
আর আমি পোষ্ট ফাকি দিছি তাই আমার খাওয়াতো ভাইটারে একটা মাইনাচ দিলাম।
আপনাকে একা কষ্ট দিতে পারিনা।
আমি মনে মনে আপনাকেই খুঁজছিলাম। একটি সিরিজ শুরু করেছি। আপনার মূল্যবান মতামত কাম্য।
ডিয়ার মুসলিমস, ইসলাম ইজ নট অ্যা ম্যাটার অব জোকস (পর্ব দু্ই)
http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/1838/President/46664#.U5B-IHa3TDc
মন্তব্য করতে লগইন করুন