বিউটি পার্লারে যাওয়ার হিড়িক বনাম নারীর সচেতনতা

লিখেছেন লিখেছেন FM97 ০৬ নভেম্বর, ২০১৩, ০৪:৪৫:৪০ বিকাল

পুরাতন আমলের ফিল্মগুলোতে দেখতাম- ভিলেন তার সাগরেদদের দিয়ে বডি ম্যাসাজ করাতো। তবে বাস্তবিকে এখন আর ভিলেনরা বডি ম্যাসাজ করে না, করে মেয়েরা। আর এই ম্যাসাজের নাম হলো স্পা (Spa)। বিস্তারিত আলোচনার আগে বলে নিতে চাই- আমি সৌন্দর্য চর্চার বিরোধী নই। কারণ পরিচর্যা ছাড়া কোনো কিছুই তার স্বরূপে টিকে থাকে না। তবে প্রশ্ন হলো- স্পা করাটা আমাদের জন্য কতটা জরুরী? ঘরে বসেই যেখানে মেনিকিউর- পেডিকিউর, (হাত ও পায়ের পরিচর্যা) কিংবা ফেসিয়াল প্যাক লাগিয়ে সৌন্দর্য চর্চা করা যায়, সেখানে স্বল্প বসনে আরেকটা মেয়ের সামনে পুরো শরীর ম্যাসাজ করার কোনো মানে হয়? আপনি হয়ত বলতে পারেন- “স্বল্প বসন হলে সমস্যা কোথায়? সেখানে তো কোনো পুরুষ নেই, সবই তো মেয়ে” ঠিক আছে, তবে আশেপাশে, সবাই মেয়ে থাকলেও প্রত্যেকটা মানুষের একটা নিজস্ব লজ্জাবোধ থাকে। রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন- “কোনো পুরুষ কোনো পুরুষকে এবং কোনো নারী কোনো নারীকে যেন উলঙ্গ অবস্থায় না দেখে” (মুসলিম)

স্পা নিয়ে যেহেতু কথা হচ্ছে তাই বিস্তারিত বলতে- শব্দটি এসেছে বেলজিয়ামের এক শহরের নাম থেকে। উপত্যকার মাঝে অবস্থিত যে শহরকে পানির শহরও বলা হয়ে থাকে। এদিকে স্পা’কে অনেকটা ওয়াটার টিটমেন্টও বলা যায়। যা দেহে ও মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বলে বেলনিওথেরাপি। এদিকে অনেকে শারীরিক রোগ মুক্তির জন্যও এটা করে থাকে। ইউরোপ, আমেরিকা জুড়ে কিছু কিছু শহর রয়েছে যা ‘স্পা টাউন’ নামে পরিচিত। কারণ- সেখানে রয়েছে প্রশান্তি লাভের জিনিস, তথা পাহাড়ি ঝর্ণা ও লেক। যেখানে পর্যটকরা ঝর্ণার ধারে স্নান করে মানসিক প্রশান্তি পায়। সেই হিসাবে আমাদের দেশে সিলেটের মাধবকুণ্ড, রাঙ্গামাটি অথবা বান্দরবানকে ‘স্পা টাউন’ বললে ভুল হবে না। তাই কেউ যদি দৈহিক অথবা মানসিক প্রশান্তি লাভ করতেই চায়- তাদেরকে সেখানে যাওয়া উচিত। সেখানে যা পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে এটা বিউটি পার্লারের ঘরেও পাওয়া যাবে না।

যেহেতু বিউটি পার্লার নিয়ে কথা হচ্ছে তাই এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত বলতে চাই, লক্ষ্য করেছিঃ বিউটি পার্লারের মেয়েরা ওড়না ছাড়া অবস্থায় থাকে। তাছাড়া এমনও দেখা গেছে যে তারা ওপর দিয়ে এপ্রোনও পরে না। সেই সাথে তাদের মানসিকতাও ঠিক মনে হয় না। একদিন আমার এক পরিচিতা ফেসিয়াল করতে যাওয়ায় স্বভাবত তাকে ফেসিয়াল ড্রেস পরতে বলে। তো সেই মেয়েটি ড্রেস পরিবর্তন করে ড্রেসের উপর দিয়ে ওড়না পরে তাদের সামনে আসে। আসা মাত্রই বেশ রুঢ় কন্ঠে তারা বলে উঠে- যান! ওড়না খুলে আসেন!, যান! খুলে আসেন!” মেয়েটি বললো- “হ্যা, কাজ যখন শুরু করবেন তখন তো খুলবোই, ফেসিয়াল আরম্ভ হোক তারপর…..”। কিন্তু তারা নাছোড় বান্দা- তাদের মতে, চেঞ্জ রুমে কেনো ওড়না রেখে আসে নি। কিন্তু আমি তাদের কথায় কোনো যুক্তি দেখলাম না, একটা মেয়ের কাছে ওভাবে চেঞ্জ রুম থেকে ফেসিয়াল রুমে যেতে খারাপ লাগলো তাই সে ভেবেছে- ফেসিয়াল শুরু করুক, তারপর না হয় ওড়নাটা পাশেই রাখবে। এতে পার্লার ওয়ালীদের সমস্যা কোথায় তাই বুঝলাম না। এ কি অবস্থা! নারী হয়েও যেন নারীদের মান-সম্মান, লজ্জাবোধ যেন কিছুই বুঝে না!

স্বনামধন্য বিউটি পার্লারের আরেকটা ধান্দাবাজি খেয়াল করলাম। আজকাল বউ সাজ কিংবা পার্টি মেকআপ সবকিছুকে একটা প্যাকেজের আওতায় নিয়ে ফেলেছে। যার সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে, তবে আমার নজরে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাটাই বেশি মনে হলো। সুবিধা হচ্ছে—আপনার হাত-পা-চুল, এমনকি ড্রেসও তারা পরিয়ে দিবে। তবে অসুবিধা হলো- কেউ যদি শুধু মুখ আর চুলে সাজ দিতে চায় তাহলে তাকে আলাদা ভাবে করে দেয়া হবে না। তাকে অবশ্যই প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এদিকে হাত-পায়ের সাজ না করলেও তার টাকা দিতে হবে। কারণ, শুধু মুখ-চুল করানোর (আমার দেখা মতে) প্যাকেজ তাদের নেই। তাই এমনও হচ্ছে যে, প্যাকেজের কিছু জিনিস না করেও বাধ্য হয়ে টাকা দিতে হচ্ছে কিংবা আপনার প্রয়োজন না থাকলেও প্যাকেজের সব কিছুই করে নিতে হচ্ছে। অপরদিকে ধরে নেই- কেউ যদি মুখ-হাত-পা-চুল সব কিছুর সাজ করলো, তবে সবার সামনে ড্রেস পরবে না, তবুও তাকে টাকা দিতে হবে, যেহেতু প্যাকেজে আছে। তাই অনেকে বাধ্য হয়ে পার্লারে ড্রেস পরে। যদিও পার্লারে ঘর ভর্তি মানুষের সামনে শাড়ী পরাটা ব্যক্তিগতভাবে লজ্জাজনক মনে করি। এক আত্মীয়’র বউকে নিয়ে ফারজানা শাকিল’স মেকঅভার স্যালুনে গিয়ে স্বচক্ষে দেখলাম- রুমে প্রায় ২০-২৫ জন মেয়ে। বিভিন্ন মেয়ে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত আর সেই ঘরেই এক এক করে মেয়েদের শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে- যদিও আমার মতে, তারা একটা আলাদা রুম রাখতে পারতো। এত বড় বিউটি পার্লার- যেখানে মডেলরাও আসে, সেখানে এমন কেনো? যাই হোক, ব্লাউজ-পেটিকোট পরে এভাবে এত মানুষের সামনে (তাও অপরিচিত) শাড়ি পরাটা গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। হ্যা, বিয়ের শাড়ি তুলনামূলক ভারী হওয়ায় অনেকেই একা পরতে পারেন না বা অনেকে এমনও আছেন যে, শাড়ী পরতে পারেন না, অন্যের সাহায্য লাগে। সে ক্ষেত্রে আমার মতে, নিজের একান্ত আত্মীয় তথা মা/চাচী/খালা- যাদের সামনে সে ছোট থেকে বড় হয়েছে- তাদের কাউকে দিয়েই কিন্তু শাড়ি পরা যায়। পরিচিত হোক বা অপরিচিত ঘর ভর্তি মানুষের সামনে শাড়ি পরা ঠিক নয়। আর রইলো প্যাকেজের টাকার কথা। প্যাকেজে শাড়ি পরার টাকা এমনিতে চলে গেলে চলে যাক। টাকা বড় না সম্মান বড়?

আরেকটা বিষয় লক্ষ্যণীয়। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন বিউটি পার্লারে যেতাম শুধু চুল কাটতে, আর মহল্লায় এতটা বিউটি পার্লার ছিলো না, যেমনটা বর্তমানে অলিতে-গলিতে গজিয়ে উঠেছে। যাই হোক- তবে ইদানিং কিছু মা’রা ছোট ছোট মেয়েদেরকে বিউটি পার্লারে নিয়ে গিয়ে হেভি মেকআপ দিয়ে আনেন। যদিও আমার কথা হলো- ছোট মানুষ তো দেখতে এমনিতেই সুন্দর। তারা একটা সুন্দর ড্রেস পরে আর হালকা সাজ দিলেই তো সুন্দর লাগে, তাই বলে তো বিউটি পার্লারে যাওয়ার প্রয়োজন দেখি না। ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে বিউটি পার্লারে যাওয়ার রীতিমত অভ্যাস গড়ে দিলে বড় হয়ে সেটা আরো মারাত্মক হতে পারে। এদিকে, আগে দেখতাম বিয়ের উৎসব থাকলেই সবার বিউটি পার্লারে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যেতো, একটা আনন্দ থাকতো এটা ভেবে যে, অনেক দিন পর সবাই মিলে সাজতে যাচ্ছি। কিন্তু আজকাল দেখি আমাদের বড়রাও সামান্য একটা ঘরোয়া পার্টি থাকলেও বিউটি পার্লার থেকে সেজে আসেন। প্রশ্ন হলো- নারীদের মধ্যে এই যে প্রবণতা এটা আসছে কোথা থেকে? জরিপ চালিয়ে দেখা যাবে- অতীত ও বর্তমানের এই যে, রকমফের এই বিষয়টা আমাদের মা/বোন রা স্বীকার করবে, তবুও অবস্থা এমন হচ্ছে কেনো, এই প্রসঙ্গে তারা বলবে- “সবাই তো এখন পার্লার যায়, সেটা ছাড়া কিছু বুঝে না, তাই তারা অনেক স্মার্ট। আমরা আর পিছিয়ে থাকবো কেনো? যুগের সাথে চলতে হবে”। আসলে স্মার্ট- আনস্মার্টের কথা না, বিষয়টা হচ্ছে প্রচার-প্রচারণা। কিছু কুচক্রী মহল যারা নারীদের ফ্যাশন ও প্রসাধনীর সাথে জড়িত, তারা নারীদেরকে এককেন্দ্রিক মনোভাবের গড়ে তুলতে চান- শুধুই নিজের স্বার্থে। আমি আগেও বলেছি- আমি সৌন্দর্য চর্চার বিরোধীতা করছি না, তবে দিন দিন এই যে অতিরিক্ততা হচ্ছে- তার আমি বিরোধী। কতিপয় মহল, সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েডের মাধ্যমে, ফ্যাশন ম্যাগাজিন কিংবা বিলবোর্ডের মাধ্যমে এসবকে নারীদের সামনে এত আকর্ষনীয় করে তোলে যে, তারা কখনো আকৃষ্ট হয় আবার কখনো ধোকা খায়। যেমনোটি পারসোনা বিউটি পার্লারের চেঞ্জ রুমে হয়েছে। সিসি ক্যামেরা রেখে নারীদের অজান্তেই তাদের শ্লীলতাহানী। সুতরাং আমাদের নারীদের অনেক সচেতন হওয়া দরকার। নতুন কিছু দেখেই উত্তেজিত না উঠে, আগে ভাবুন- সেটা আমার জরুরী না অহেতুক। নিজেদের মেধা, সময়, শ্রম, অর্থ- কোথায়, কিভাবে, কখন কাজে লাগাতে হবে- সেই বিষয়ে সতর্ক হয়া উচিত।

বিষয়: বিবিধ

২৪২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File