মোদী চ্যালেঞ্জ এবং মোদীর চ্যালেঞ্জ
লিখেছেন লিখেছেন জিনিয়াস ২০ মে, ২০১৪, ১০:০৯:৪৫ রাত
সকল জল্পনা-কল্পনা অবসান ঘটিয়ে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কংগ্রেসকে ব্যাপকভাবে ধরাশায়ী করে নিরঙ্কুশভাবে বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। অথচ নির্বাচন পরবর্তী ফলাফল প্রকাশের আগে পর্যন্ত গণমাধ্যমের জরিপে বিজেপি এগিয়ে থাকার কথা বলা হলেও এতটা এগিয়ে থাকবে তা কেউই ধারণা করতে পারেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা ধারণা করা হয়নি তাই বাস্তবায়িত হয়েছে। মোদী জয়ী হওয়ার পেছনে মূলত দু’টি বিষয় কাজ করেছে। এর একটি হচ্ছে নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে রাজ্যটির সব ধরনের প্রশাসনিক জটিলতার অবসান ঘটিয়ে বিনিয়োগ ও শিল্পবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনীতিতে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ঈর্ষনীয় উন্নতি সাধন এবং অপর কারণটি হচ্ছে রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের হিন্দুদের হিন্দুত্ববাদী নীতিতে জাগ্রত করে তোলা। যে সকল বিশ্লেষক ও রাজনীতি সচেতন মহল ভারতের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন তাদের চোখে নরেন্দ্র মোদীর প্রথম নীতিটি প্রশংসিত হলেও দ্বিতীয় নীতিটি কঠোররূপে সমালোচিত হয়েছে। এমনকি তার নিজ দেশের বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক ও সুশীলদের পক্ষ থেকে মোদীর উত্থানকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জন্মলগ্ন থেকেই ভারত সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত থেকে পাকিস্তান আলাদা হয়ে ধর্মরাষ্ট্রের রূপ নিলেও (যদিও তা মোটেও স্থায়ীত্ব লাভ করেনি) ভারত ধর্মনিরপেক্ষতাকে আশ্রয় করে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পথচলার এই দীর্ঘ সময়ে ভারত সা¤প্রদায়িক ইস্যুতে বহুবার হোচট খেয়েছে। কারণ, ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা হওয়ায় পাকিস্তান এবং ভারতের জনগণের মানসে সা¤প্রদায়িকতার বীজ রোপিত ছিল গোড়া থেকেই- যা থেকে এই দু’টি রাষ্ট্রের মানুষ কখনোই বের হতে পারেনি। তাই বার বারই ভারতজুড়ে সংখ্যালঘু মুসলমান স¤প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে, নিগৃহীত হয়েছে। একই কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবেও তারা পদে পদে বঞ্চনার শিকার হয়েছে।
ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান স¤প্রদায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা নিয়ে তুলনামূলক যে কোন পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ।এমনি একটি পরিসংখ্যান সাচার কমিটি রিপোর্ট। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রাজেন্দর সাচার এর নেতৃত্বাধীন আরো ৬ জনের একটি কমিটি ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর এটি লোক সভার নিু কক্ষে উপস্থাপন করে। উপস্থাপিত এই কমিটির রিপোর্টে দেখা যায় যে, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম স¤প্রদায় সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে নিয়ে রাজনৈতিক খেলা চললেও কোন সরকারই তাদেরকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করেনি। কংগ্রেস সরকার নীতিগতভাবে মুসলমান স¤প্রদায়ের উপর অনেকটা নমনীয় থাকলেও আদতে তাদের দীর্ঘকালের শাসনে সংখ্যালঘু এ স¤প্রদায়ের কোন রকম উন্নতি ঘটেনি। অপরদিকে লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী বিজেপি নিজেদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে প্রবল হিন্দুত্ববাদী চেতনা জাগ্রত করে ভারতজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। বিশেষ করে তরুণ সমাজ এবং কর্পোরেট মিডিয়াগুলো তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে এই ধর্মীয় উগ্রপন্থী দলটির গুণ-গান গাওয়া শুরু করে। ফলে বিজেপির উগ্র সাম্পদায়িকতার দিকটি আড়াল হয়ে পুঁজিবাদী মনোভাব প্রাধান্য পায়। একদিকে কর্পোরেট দুনিয়ার পক্ষপাতিত্ব অন্যদিকে সংখ্যাগুরু হিন্দু স¤প্রদায়ের স্বার্থরক্ষায় মুসলমান বিরোধী মনোভাব- এই দুইয়ের সম্মিলনেই বিজেপি এই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
যাই হোক, মোদীর দল বিজেপি এখন চাইলে এনডিএ জোটের সমর্থন ছাড়াও এককভাবে সরকার গঠন করতে সক্ষম (যদিও তারা তা করছে না) এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা এতটাই প্রবল যে এ সরকারটি হবে ভারতের ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী সরকার। এখন শুধু ক্ষমতা গ্রহণের পালা। কিন্তু গঠিত হতে যাওয়া এ সরকারটির রূপ এবং ভবিষ্যৎ ভারতের চরিত্রটি কোন দিকে বাঁক নিচ্ছে তা চিন্তাশীল মহলকে ভাবিয়ে তুলছে। এর দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত অন্যদের জন্য কতটুকু চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হবে এবং দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণভাবে মোদী সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী।
অন্যদের জন্য চ্যালেঞ্জ এই জন্য যে, দলটি যে সব ইস্যুকে জাগ্রত করে নিজেদের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি করেছে সে সকল প্রতিশ্র“তিসমূহ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিজেপি সরকার এখন কী করে তা ভাবতে হবে। বিশেষ করে অযোধ্যার বাবরি মসজিদের স্থলে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সাথে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক কী হবে তাও চিন্তা করতে হবে। বাবরি মসজিদের স্থলে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আবার ভারতকে সা¤প্রদায়িক ইস্যুতে উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। অপর দিকে এমন কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে প্রতিবেশী দু’টো দেশ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু হিন্দু স¤প্রদায় আক্রান্ত হতে পারে। এমনিতেই প্রতিবেশী দু’টো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রতি বিজেপি প্রধান নরেন্দ্র মোদীর মনোভাব নেতিবাচক। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী বাঙালিদেরকে তিনি ভারতের জন্য ঝামেলা মনে করেন। নির্বাচনের আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশিদেরকে ভারত থেকে উচ্ছেদ করা হবে- ‘শুধু হিন্দু ভাইদেরকে ছাড়া।’ বিজেপির আরেক নেতা সুব্রাহ্মনিয়াম স্বামী তো দাবি করেই বসেছেন যে, সিলেট থেকে খুলনা পর্যন্ত সমান্তরাল রেখা টেনে ভারতকে দিয়ে দেওয়া হোক। কেননা, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী মুসলিমদের সংস্থাপনের জন্য এমনটাই নাকি দরকার। এখন দেখা দরকার বিজেপি সরকার নির্বাচনের আগে যে সব প্রতিশ্র“তি জনগণকে দিয়েছে তা বাস্তবায়নে কোন নীতি গ্রহণ করে। মোদী সরকার যদি সেসবকে শুধু নির্বাচনী কথা-বার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায় তাহলে যারা তাদেরকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে তারা স্বাভাবিকভাবেই মারাত্মক হতাশ হবে। অপরদিকে এসকল প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়ন করতে গেলেও নিকটতম প্রতিবেশী এই দেশটির সাথে তাদের সম্পর্ক কিরূপ আকার ধারণ করে তা দেখার বিষয়। অপরদিকে বিজেপিকে যারা সমর্থন দিয়েছে তাদের মধ্যে ভারতের হিন্দু কট্টরপন্থী দল আরএসএসও রয়েছে। তাদের মনোভাব অনেকটা পুরাতন একক মহাভারত ধারণায় কেন্দ্রীভূত। 
[ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্র]
তাদের এমন মনোভাবের কারণে পাশ্ববর্তী প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন হয়ে যেতে পারে। তাই মোদীর এই উত্থান অন্যদের জন্যও এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
অপরদিকে বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মোদীর সম্পর্কও উষ্ণ নয়। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আগে পর্যন্ত গুজরাটের দাঙ্গায় সংখ্যালঘু দুই হাজার মুসলমান হত্যার অভিযোগসহ মোদীর উগ্রপন্থী মনোভাবের কারণে তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিলো। এদিকে বিজেপি জয়ী হওয়ার পর সে দেশের প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা তড়ি-ঘড়ি করে মোদীকে অভিনন্দন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু মোদী তার ধন্যবাদ বার্তায় সকলকে নাম ধরে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেও যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামার নাম মুখেও আনেননি। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কংগ্রেস পরবর্তী আসন্ন এ সরকারের সম্পর্কটা কেমন হবে তাও ভাবনার বিষয়।
এতো গেল বৈদেশিক সম্পর্কগত দিক। ভেতর থেকেও এই সরকারের উপর সে দেশের জনগণের প্রত্যাশা কম নয়। বিশেষ করে গুজরাট উন্নয়নের মডেল ঝুলিয়েই তিনি তরুণ এবং বিত্তশালীদের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। এখন এ সরকার পুরো ভারতকে গুজরাটের ন্যায় উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবেন কি? এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে আয়তনগত দিক থেকে ভারতের বিশালত্ব। একটি নির্দিষ্ট প্রদেশের উন্নয়ন ঘটানো এবং একশ ত্রিশ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত পুরো ভারতের উন্নয়ন ঘটানো কখনোই সমান কথা নয়। তাছাড়া ভাষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে সেখানে বিশাল ব্যবধান তো রয়েছেই। বৃহত্তর এই দেশটি এক দিক দিয়ে উঠতি পরাশক্তি হলেও এখনও সেখানকার একটি বিশাল সংখ্যা দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে। শিক্ষাখাত, স্বাস্থ্যখাত, পয়ঃনিষ্কাষণব্যবস্থা, যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সুবিধাসহ আধুনিকতার ছোয়া থেকে বঞ্চিত রয়েছে ভারতের বিশাল জনসংখ্যা। গুজরাট প্রদেশকে মডেল ধরে সারা দেশের এ সকল উন্নয়ন সাধিত করা মোদী সরকারের জন্য অবশ্যই একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।
আমাদের এ অঞ্চলের স্বাভাবিক পরিস্থিতিটাই এমন যে, প্রবল জনসমর্থন ও প্রত্যাশা নিয়ে একটি সরকার ক্ষমতায় আসে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় নানাবিধ কারণে তারা জনগণের সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই আবার সে সমর্থন উঠিয়েও নেওয়া হয়। ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে যাওয়া মোদী সরকারের কাছে প্রতিবেশী দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশাÑ তারা পাশ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও সম্মান বজায় রেখে কাজ করে যাবে। তারা এমন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না যাতে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়। বিশেষ করে সাম্পদায়িকতার যে তকমাটি নরেন্দ্র মোদীর চরিত্রে এঁটে আছে তা থেকে তাকে ও তার দলকে বেরিয়ে আসতে হবে। আরো প্রত্যাশা এই যে, তারা নিজেরা যেন কখনোই অন্যদের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত না হয়, বরং নিজেদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মনোযোগী হয়।
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন