আমার বিক্রমপুর
লিখেছেন লিখেছেন ইকুইকবাল ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১১:৩৫:৪৪ রাত
						 
						 
- বিক্রমপুরের ইদ্রকপুর কেল্লা 
শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রশাসন, খেলাধুলা, শিল্প, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, ও প্রত্মতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ সুজলা-সুফলা বিক্রমপুরের রয়েছে হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস। সুপ্রাচীন চন্দ্ররাজাদের তাম্রশাসনের অঞ্জলি থেকে শুরু করে পাল, সেন, মুঘল, বার ভূঁইয়াদের কীর্তিতে সমুজ্জ্বল হয়ে একটি স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের রাজধানী বিক্রমপুরের কীর্তিময় অংশ। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত অতিপ্রাচীন জনপদ বিক্রমপুর। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ বিক্রমপুর নামে বিক্রমপুর দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দক্ষিণ বিক্রমপুরকে ১৮৬৯ সালে ফরিদপুর জেলার সাথে যুক্ত করা হয়। বাকিটা মুন্সিগঞ্জ জেলার সদর, সিরাজদিখান, শ্রীনগর, লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ি মোট ৫টি উপজেলা নিয়ে উত্তর বিক্রমপুর গঠিত হয়। বিক্রমপুরের হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম সংস্কৃতির মিলিত সভ্যতার অপরূপ কারুকার্য ও শিল্প, মুর্তি, শিলালিপি, খোদাই করা কারুকার্যস্তম্ভ, ভাস্কর্য ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে স্তরে স্তরে সাজানো আছে।
চারদিকে মাছরাঙ্গা, টুনটুনি, ঘুঘু, ডাহুক, বাবুই, শালিক, দোয়েল, পাপিয়া প্রভৃতি পাখির কলকাকলি, নদীর কুল কুল ধ্বনি, পাতার মার্মর শব্দ, শ্যামল শস্যের ভঙ্গিময় হেলাদোলা প্রচুর পরিমাণে শহরের অভাব এখানে পূর্ণ করে দিচ্ছে। বিল-ঝিলের কাকচক্ষু জলে ঢ্যাপ, শাপলা-কমল-কলমির ফুটন্ত মুখগুলো ভরে আছে স্নিগ্ধ লাবণ্যে। যেদিকে তাকাই, দেখি আলোকিত আকাশ, পাই সুরভিত বাতাস।
গ্রীষ্মের আকাশে গনগনে সূর্য-রোদ্রতপ্ত দিন। কৃষকেরা প্রত্যাশার দৃষ্টি-কখন বৃষ্টি নামবে, মাটির তপ্ত বুক জুড়াবে। বর্ষায় গায়ে গা ঘেঁষে হাঁটুজলে দাড়িয়ে থাকে ধান-পাটের বাড়ন্ত শিশুরা। এখানে মেয়েরা রঙ্গিন বেত দিয়ে বোনে শীতলপাটি। কলসি-কাঁখে নদী থেকে পানি আনে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে আঁচলে ছেঁকে ছোট ছোট মাছ ধরে। ইছামতি, পোড়াগঙ্গা, ধলেশ্বরী, পদ্মা, মেঘনা নদীর বাঁকে বাঁকে জেলেদের গ্রাম। নৌকা আর জাল নিয়ে সারাদিন তারা নদীর বুকে ভেসে বেড়ায় আর মাছ ধরে। পদ্মা-মেঘনায় ধরা পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ। সুনিবিড় ছায়াঘেরা আমাদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে শরতে-হেমন্তে নদীর বুকের চরে গজায় কাশ ও শরবন। শীতকালে জমে উঠে পিঠাপুলির উৎসব। মাঠে মাঠে রাখালেরা গরু চরায়। এ অঞ্চলের উর্বর মাটিতে ফলে নানা রকমের গোল আলু, গম, আখ প্রভৃতি। মৃৎশিল্পীরা মালসা, রসের ঠিলি, দইয়ের তেলাইন, খাঁসা, মাটির ব্যাংক প্রভৃতি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকে। কামার সম্প্রদায় দা, বটি, টেডি, খুন্তি, ছেনি, হাসুয়া, ফুলকুচি ইত্যাদি তৈরি করে। তাছাড়া এই অঞ্চলে কিছুটা মানসম্পন্ন সুতার শিল্প, মুদ্রণ শিল্প, কুটির শিল্প, বেকারী শিল্পও গড়ে উঠেছে। বিক্রমপুরের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য পাতক্ষীরসহ মিষ্টি, দই, ছানা, রসমালাই ও আমৃত্তি বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকে এই অঞ্চলের ঘোষ পরিবারেরা। সাধু, ফকির, মস্তান, সাধক শ্রেণীর ব্যক্তিরা ভাদ্র মাসের বৃহস্পতিবার রাতে ঢোল বাজনার আওয়াজের তালে তালে ভেলা ভাসানোর উৎসবে মেতে উঠে। এছাড়া রথ উৎসব, খোদাই সিন্নি উৎসব, ঈদ মেলা, বিভিন্ন পূজার মেলা, বৈশাখী মেলা, নৌকা বাইচ মেলা, মনষা মেলা, দশমী মেলা, কৃষি মেলা, বইমেলা, নবান্ন উৎস প্রভৃতিতেও আপামর জনতা আনন্দে মেতে উঠে। এই এলাকার মানুষ সময় পেলেই সাঁতার বাইচ, নৌকা বাইচ, অলডুবানি, ষাঁড়ের লড়াই, পলানটুক, কুমীর ডাঙ্গা, কুস্তি প্রভৃতি খেলায় মেতে উঠে। কিছু বিয়ের মধ্যে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পালকির প্রচলনও প্রত্যক্ষ করা যায়। শীতকালে গভীর রাতে ওয়াজ মাহফিলের সাথে পাল্লা দিয়ে বয়াতী গানের আসরও বেশ জমে উঠে। কাজের অবসরে টেকের হাটে বসে লালন গানের আসর। শখের বশবর্তী হয়ে এই অঞ্চলের মানুষ পান চাষ করে। কর্মজীবনের ব্যস্ততার মাঝে সপ্তাহ শেষে পদ্মা নদীর চরে গড়ে উঠা মনোমুগ্ধকর পদ্মা রিসোর্ট দেয় প্রকৃতির স্বাধ। সব মিলে বিক্রমপুর যেন এক মহান শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক অতুলনীয় ছবি। 
প্রকৃতিই বিক্রমপুরের মানুষকে করেছে ভাবুক, কবি, শিল্পী, সাধক, বিজ্ঞানী ও কর্মী। এখানে শহরের মত সাহিত্যিক, কৃড়াবীদ, গায়ক, বাদক, নর্তক না থাকলেও তার অভাব নেই। বিক্রমপুর বাংলার একটি ঐতিহাসিক এলাকা। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চল তার বৌদ্ধ জ্ঞান চর্চার জন্য এবং পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক প্রভাবের জন্য সুপরিচিত। ধারণা করা হয়, বৈদিক যুগ থেকে ভাওয়াল ও সোনারগাঁও রাজধানী হিসেবে আবির্ভূত হবার আগ পর্যন্ত এটিই ছিল বাংলার প্রাচীনতম রাজধানী। বিক্রমপুর ছিল রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজধানী। এই এলাকায় বাংলার বহু কীর্তিমান ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। ৯৮২ সালে বজ্রজোগিনী গ্রামে বিখ্যাত সাধাক অতীশ দীপঙ্কর, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৮ সালে বানারী গ্রামে চারণ কবি মুকুন্দ দাস, ৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ সালে রাঢ়ি খালে বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, ৯ ডিসেম্বর ১৯২৭ সালে বিক্রমপুরে বিখ্যাত সাঁতারু ব্রজেনদাস, ২৮ মার্চ, ১৯০৭ সালে রাজনীতিবিদ,সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সত্যেন সেন, ১৮৭০ সালে রাজনীতিবিদ চিত্তরঞ্জন দাস, ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ সালে রাড়িখালে লেখক ও ভাষাবিদ ড. হুমায়ুন আজাদ, ২৩ অক্টোবর ১৯৪১ সালে সমষপুর গ্রামে দেশবরেণ্য চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, নৃত্যশিল্পী গওহর জামিল, আইনবিদ স্যার চন্দ্রমাধব ঘোষ, লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, ঔপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, কবি বুদ্ধদেব বসু, ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু, গণিতশাস্ত্রবিদ অধ্যাপক রাজকুমার ঘোষ, পূর্ববঙ্গে সর্বপ্রথম বস্ত্রকল নির্মাতা সূর্য কুমার বসু, অভিনেতা তেলি সামাদ, অভিনেতা নারায়ন চক্রবর্তী, সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা: বদরুদ্দুজা চৌধুরী ও ড. ইয়াজ উদ্দিন,  সাবেক তত্ত্বাবধাক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফফরুদ্দিন, Department of Agricultural Extension (Gov. of the Republic of Bangladesh)  এর সাবেক DG নওয়াব আলী দেওয়ান, ইন্টারন্যাশনাল ফারাক্কা কমিটির মহা সচিব ও ভেষজ বিজ্ঞানী সৈয়দ টিপু সুলতান, দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, ডেইলি নিউ এইজ এর সম্পাদক নূরুল কবির, মধুপুরের পীর মাওলানা আব্দুল হামিদ, অধিকারের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আদিলুর রহমান, একমি কোমপানির মিজানুর রহমান সিনহা, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যান আলহাজ আবদুল আউয়াল, উদিয়মান গবেষক সাইদুল ইসলাম খান অপু, মুসলিম গ্রুপের এমডি আলহাজ্জ্ব শেখ মো: আব্দুল্লাহ, নায়িকা সাবানাজ, অভিনেত্রী রোমানা খান প্রমুখ বিক্রমপুরে জন্ম গ্রহণ করে আমাদের জেলাকে বাংলাদেশ ও বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল করে তুলেছেন। দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রাজা শ্রীনাথের বাড়ি, রামপালে বাবা আদমের মসজিদ, হাসারার দরগা, সোনারং জোড়া মন্দির, পদ্মার চর, ইদ্রাকপুর কেল্লা, অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান পন্ডিত ভিটা, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু স্মৃতি জাদুঘর, কেউয়ার বার আওলিয়ার মাজার, সিরাজদিখানের পাঁচপীরের মাজার, আড়িয়ল বিল প্রভৃতি। তাছাড়া রজত রেখা, কাজল রেখার মত ইছামতি নদীও হারিয়ে যাচ্ছে। ইছামতিতে আগে রাজদিয়া ও সিরাজদিখান ঘাট থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্যবাহী জাহাজ কলকাতায় যেত। বৃটিশ এই অঞ্চলে ধান, পাটসহ নানা পণ্যের পাইকারী ও খুচরা বেচাকেনা হত যার দরুন সিরাজদিখান বাজারে ২টি ব্যাংক গড়ে উঠে ছিল। তাই সেই হারানো ইতিকথা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা। সময় এসেছে ইছামতিকে রক্ষা করার। নয়ত ইছামতির ইতিহাস শুধু বইপুস্তকের মধ্যেই সিমাবদ্ধ থাকবে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে লেগেছে বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য যাদুর ছোঁয়া। তার স্পর্শে রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রার ধরন। এই যাদুর নাম হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন মিডিয়া। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহে মুন্সিগঞ্জেও সেই দোলা লেগেছে। রেডিও বিক্রমপুর নামে আমাদের জেলায় কমিউনিটি রেডিও চালু হয়েছে। ১৯৮১ সাল থেকে মাসিক বিক্রমপুর বের হচ্ছে। মুন্সিগঞ্জের সাংবাদিকদের অগ্রপথিক মুক্তিযুদ্ধা শফিউন্দিন আহমেদ। তিনি মুন্সিগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। তারি ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকতার কাজে আত্ম নিয়োগ করেন সুনির্মল চক্রবর্তী, নির্মল কৃষ্ণ নন্দী, মোজাদ্দেদ হোসাইন, এমদাদুল হক পলাশ, শেখ আকবার আলী প্রমুখ। বিক্রমপুর বার্তা, দৈনিক মুন্সিগঞ্জের কাগজসহ প্রায় ২০ টি সাহিত্য সাময়িকী, ম্যাগাজিন ও পত্রিকা নিয়মিত ও অনিয়মিত বের হচ্ছে। অনলাইন অর্থাৎ ভার্চুয়াল জগৎ সম্পূর্ণ বর্তমান মুন্সিগঞ্জের তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই প্রসার লাভ করছে। ভার্চুয়াল জগতে মুন্সিগঞ্জের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব তৈয়ব আহমেদ শেখ। তিনিই সর্ব প্রথম মুন্সিগঞ্জ ডট কম, মুন্সিগঞ্জ ইনফো প্রতিষ্ঠা করেন। আমার দৃষ্টিতে বিক্রমপুরের সবচেয়ে বড় ফেইসবুক ফ্যান পেইজ আমাদের বিক্রমপুর, পর্যায়ক্রমে মুন্সিগঞ্জের কথা, ওয়েলকাম টু বিউটিফুল বিক্রমপুর, মুন্সিগঞ্জ বাঁশেরকেল্লা ইত্যাদি। ফেইসবুক গ্রুপের মধ্যে মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুর গ্রুপই সবচেয়ে বড়। মুন্সিগঞ্জের ব্লগার ও অনলাইন একটিভিস্টদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সিবিএফ এর শাখা কমিউনিটি ব্লগারস ফোরাম মুন্সিগঞ্জ গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশ কমিটি গঠন করা হয়েছে। মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতি, বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন, অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন, মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর জেলা বাস্তবায়ন পরিষদ, আইএফসি বাংলাদেশ নদী ও পরিবেশ কমিটি মুন্সিগঞ্জ, বিক্রমপুর চাঁদের হাট, মুন্সিগঞ্জ উন্নয়ন ফোরাম, বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, কবি নজরুল স্মৃতি পরিষদ ইত্যাদি। ক্লাবের মধ্যে ফ্রেন্ডস এসোসিয়েশন অব মালখানগর, জাগরণী সংসদ কুসুমপুর ইত্যাদি। 
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা সত্তেও আমাদের জেলা লাশ ফেলার ডাম্পিং স্পটে পরিণত হয়েছে। ১ মার্চ ১৯৮৪ সালে মুন্সিগঞ্জ নামে নতুন জেলা গঠিত হয়। ৯৫৪.৯৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনে ৬টি থানা, ৬৭টি ইউনিয়ন ও ৯৭০টি গ্রাম রয়েছে। বর্তমানে আমাদের জেলার শিক্ষার হার ৫১.৬২%। আমরা সবার মাঝে সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে মুন্সিগঞ্জকে একটি সমৃদ্ধ জেলাতে রূপান্তর করা যাবে।
-সাংবাদিক ও সাহিত্যিক						 
						 
						 
						 
						 
						 
						 
						 
বিষয়: বিবিধ
২৪৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য







































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন