আমাদের শিক্ষার সংকটের উত্তোরন হতে পারে যোগ্য নৈতিক শিক্ষার্থী তৈরির মাধ্যমে।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০২:৪৬:১৬ দুপুর
'মালিহা' আমার দ্বীতীয় কন্যা সন্তান যে এ বছর(২০১৫) এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ন হয়েছে।গত দু'দিন থেকে আমাকে বলছে,আব্বু কি হয়েছে আমরা পরীক্ষা দিতে পারবো কি?যে প্রিপারেসন নিয়েছি মনে হচ্ছে দেশের এই থমথম অবস্হায় ভুলে যাচ্ছি।আমার মনে হয় সারা দেশের ছাত্র ছাত্রীদের কথাই সে আমাকে তুলে ধরেছে।একজন পিতা হিসেবে আমার যে রক্তক্ষরন হচ্ছে তা তাকে বুঝতে দেই কি করে? আমার মনে পড়ে গেল এমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়ক জন এফ কেনেডির অমর বাণী এবং সেটিই তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম ‘Whatever you can do or dream can do, begin it.’ যা তুমি করতে পার বা করার স্বপ্ন দেখ, তা শুরু কর।' আমি নিশ্চিত যে, জয় তোমার সুনিশ্চিত কারণ পরীক্ষার মাঝে তোমার উপলব্ধি এসেছে,তুমি ভাবতে শিখেছ,তোমার মধ্যে আমি আলোর সরলরেখা দেখতে পাচ্ছি,তোমার মধ্যে বিপুল সৃজনশক্তি লুকিয়ে আছে।' একটি কথা আছে 'কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে ওই জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দাও'- বাংলাদেশকে কি ওই দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে না? নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে নৈতিক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে বলছে সরকার। শিক্ষা বছরের শুরু থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে বছরের প্রথম দিনই প্রথম থেকে দশম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনা মূল্যে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের উপযোগী করার জন্য শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। নতুন পদ সৃষ্টি করে হাজার হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ করে উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে। বহুবিধ পদক্ষেপের ফল শূন্য। কারণ অবিরাম হরতাল ও অবরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দেশের ভবিষ্যৎ কোমলমতি শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না, শিক্ষক মহোদয়রা শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারছেন না। সব কিছু স্থবির। আজ ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বছরে ২১০ কার্যদিবস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে- এ হিসাব ধরে প্রতিটি বিষয়ের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়ের জন্য পিরিয়ড নির্ধারণ করা আছে। নির্ধারিত সংখ্যক পিরিয়ড না পেলে পাঠ্যসূচি শেষ করা সম্ভব নয়। বছরের শেষ দিকে শিক্ষকরা হয়তো তাড়াহুড়া করে শেষ করতে চাইবেন। কিন্তু কম সময়ে ক্ষমতার চেয়ে বেশি গ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে জ্ঞানের শূন্যতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। নির্ধারিত জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন না করেই পরবর্তী পর্যায়ে নতুন জ্ঞান অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটে, যা পূরণ করা কঠিন, অনেকের পক্ষে অসম্ভব। ফলে অকৃতকার্য হয়, শিক্ষা থেকে ঝরে যায়। ১০ বছর প্রস্তুতির পর আমাদের ১৫ লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার জন্য ঝুলছে। পরীক্ষা হবে, না পেছাবে- এ খবরের অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন। পড়ায় মন বসে না। কোন পেপার আগে হবে, কোনটি পরে হবে ঠিক নেই। হরতালে পরীক্ষা বন্ধ, ঘেরাও কর্মসূচির মধ্যে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়া-আসায় কী ঘটে কেউ জানে না। এ অবস্থায় প্রস্তুতি নেওয়া বা পরীক্ষা দেওয়া কিভাবে সম্ভব! বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, আজকের কোমলমতি বালক-বালিকাদের নিয়ে আর কত খেলা খেলব আমরা? তাদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস করার অধিকার কে আমাদের দিল? দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা, অর্থনীতি ধ্বংস করা, সাধারণ মানুষ পুড়িয়ে মারা- একেই কী রাজনীতি বলে, আন্দোলন বলে, এ তো সন্ত্রাস।কত আগে এইচএসসি পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে নতুন সেশন শুরু করতে পারেনি। এইচএসসি পরীক্ষার পর ৯ মাস গত হলো, শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিল থেকে বিচ্ছিন্ন। এত লম্বা সময় পড়ার বিরতির পর পড়ার টেবিলে ফিরে আসা খুবই কষ্টকর, অনেকেই পারে না। তা ছাড়া জীবন থেকে ৯-১০ মাস বিনা কাজে নষ্ট। একদিকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ধীরগতি, অন্যদিকে হরতাল-অবরোধে স্কুলশিক্ষার মতো উচ্চশিক্ষাকেও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার ফল তাৎক্ষণিক পাওয়া যায় না, দীর্ঘমেয়াদি। আজ মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া গেলে আট-দশ বছর পর এর সুফল পাওয়া যাবে। অন্যদিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে আজকের নৈরাজ্যের কুফলও সারা জাতিকে ভোগ করতে হবে একই সময় পর। কিছুদিন আগে হরতাল-অবরোধের মধ্যেও একটি আলোর ঝলকানি দেখেছি। 'ও' এবং 'এ' লেভেল পরীক্ষাকে হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। ভেবেছিলাম, এসএসসি পরীক্ষাকে আওতামুক্ত রাখা হবে। তা রাখা হয়নি, বরং পরীক্ষার দিনগুলোতে অবরোধের ওপর হরতাল চাপানো হয়েছে। এ থেকে কি বোঝা যায় না যে মুষ্টিমেয় ছেলেমেয়ের জন্য দরদ আছে, আর ১৫ কোটি জনগণের ছেলেমেয়ের শিক্ষা গোল্লায় যাক। এ কোন নীতি! আরো অবাক লাগে যখন দেখি, অপরিণামদর্শী রাজনীতিকরা বলেন, 'কিসের এসএসসি পরীক্ষা- এসব এখন বাদ থাকুক, আন্দোলন আগে।' এ গোত্রেরই আরেকজন বলেন, 'এসএসসি পরীক্ষা দুই মাস পিছিয়ে দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।' শিক্ষা সম্পর্কে এসব রাজনীতিবিদের দৃষ্টিভঙ্গি জাতিকে মারাত্মক পরিণতির দিকে ধাবিত করে। আল্লাহ এ দেশকে এ ধরনের রাজনীতিবিদদের কালো থাবা থেকে হেফাজত করুন।
বর্তমান শিক্ষা ব্যাবস্হার সঙ্গে অতীতের শিক্ষাব্যবস্থার সাদৃশ্য ও প্রভেদ দুটিই রয়েছে। প্রাচীনকালে শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন। আজকের শিক্ষায় বৈষয়িক জ্ঞানের ওপর জোর বেশি। প্রাচীনকালে উচ্চপর্যায়ের ধর্মীয় শিক্ষা শুধু উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমিত ছিল। কোনো আচার্য নিম্নবর্ণের ব্যক্তিদের শিক্ষা দিলে পরলোকে তাঁর শাস্তি ছিল অবধারিত। আপাতদৃষ্টিতে আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের কোনো বাধানিষেধ নেই। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, দক্ষিণ এশিয়ার উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো বর্ণবাদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। প্রাচীন ভারতের উচ্চবর্ণের ব্যক্তিরা কায়িক শ্রমে অংশ নিতেন না; তাঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব ছিল সমাজের। ব্রিটিশ শাসকরা যখন এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষ উচ্চশিক্ষা প্রবর্তন করেন তখন এর সুযোগ গ্রহণ করে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। তাঁরা অফিস-আদালতে এমন কাজে নিযুক্ত হতেন যেখানে কোনো কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজন হতো না। তাঁরা সমাজে ভদ্রলোক নামে পরিচিতি লাভ করেন। উচ্চশিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে তাঁরা প্রত্যাশার সৃষ্টি করেন- উচ্চ শিক্ষার্জন করলে কায়িক পরিশ্রম না করে স্বচ্ছল জীবনধারণ সম্ভব। ভদ্রলোক শ্রেণির শিক্ষিত ব্যক্তিরা কায়িক পরিশ্রমের কাজ না করে বেকার থাকা পছন্দ করেন। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার অশিক্ষিতদের বেকারত্বের হারের চেয়ে অনেক বেশি। দুর্ভাগ্যবশত উত্তরাধিকারসূত্রে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে লব্ধ কায়িক শ্রমবিমুখতার প্রভাব এখনো বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বিরাজমান। শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বিকাশ, কায়িক শ্রমবিমুখতা সৃষ্টি নয়। আজকে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসছে তাঁদের এ কথাটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য ভদ্রলোক সৃষ্টি নয়; এর লক্ষ্য হলো প্রত্যেক শিক্ষার্থীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও নৈতিক মানবিক গুণাবলির বিকাশ। তাঁদের শুধু চাকরিপ্রার্থী হলে চলবে না; তাঁদের উদ্যোক্তা হতে হবে ও নতুন নতুন চাকরি সৃষ্টি করতে হবে।
প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি বড় প্রভেদ রয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষা অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার নয়, শিক্ষার লক্ষ্য হলো জ্ঞান অর্জন। কাজেই অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাদান অসমীচীন। মনুসংহিতার মতে, অর্থের জন্য যাঁরা বেদ পড়ান বা পড়েন তাঁদের কেউই দেবতার প্রসাদ পাওয়ার উপযুক্ত নন। আচার্য- শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নিতে পারবেন না। এমনকি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উপহার গ্রহণেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। মনুসংহিতায় আচার্য কর্তৃক শিষ্যদের কাছ থেকে উপহার গ্রহণকে লঘু অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধরনের মতবাদ প্রাচীন গ্রিক ও চৈনিক দার্শনিকদের মধ্যেও দেখা যায়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস মনে করতেন যে অর্থের বিনিময়ে বিদ্যা বিক্রয় পাপ। তাঁর মতে, যারা বিদ্যা বিক্রয় করে তারা জ্ঞানজগতের গণিকা।তিনি আরো বলেছিলেন,আমরা এমন অনেক কিছু থেকে বেঁচে থাকতে পারি।অর্থাৎ এমন অনেক খরচ যা না করলেও আমরা বাঁচতে পারি। শিক্ষার প্রতি এ ধরনের মনোভাব বিগত শতাব্দীতেও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের কৃতী সন্তান ও উপমহাদেশের মহান সংগীতসাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের জীবনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৩০-এর দশকে মাইহার রাজ্যের মহারাজা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কাছে সংগীতে তালিম নিতে চান এবং তিনি জানান যে ওস্তাদকে তিনি উপযুক্ত মাসোয়ারা দিতে প্রস্তুত। ওস্তাদ জানালেন যে মাসিক বেতন নিয়ে তিনি সংগীত শেখাতে পারবেন না; কেননা তিনি তাঁর ওস্তাদের কাছে ওয়াদা করেছেন যে তিনি অর্থের বিনিময়ে ওস্তাদের কাছে শেখা জ্ঞান বিক্রয় করবেন না। শেষ পর্যন্ত মাইহারের আর্থিক বিশেষজ্ঞরা এ সমস্যার সমাধান দিলেন। তাঁরা রাজধানীর মন্দিরে সংগীত সম্পর্কে গবেষণা করতে একটি বৃত্তির জন্য বিশেষ তহবিল সৃষ্টি করলেন ও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানকে মন্দিরের তরফ থেকে বৃত্তি দেওয়া হলো। ওস্তাদজি রাজ কর্মচারী হলেন না; তাই রাজাকে শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা রইল না।
যে ধরনের মূল্যবোধ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানকে টাকার বিনিময়ে শিক্ষাদান থেকে নিবৃত্ত করেছে বর্তমান জগতে তা অনেকাংশে অবান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা বিক্রয় করার ক্ষেত্রে আজ কোনো বিধিনিষেধ নেই।আজ সমাজে শিক্ষা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।হাউজ টিউটর ও টুইশন ছাড়া চলে না।তাছাড়া রয়েছে পাড়ায় পাড়ায় কোচিং সেন্টার।বলতে দ্বিধা নেই যে আমার বাসায় একজন শিক্ষিকা বলেই দিয়েছেন বছরের প্রথম মাসে আমার বাড়তি ফি ??? দিতে যেন ভুল না হয়।তিনি শিক্ষিকা হিসেবে ভাল কিন্তু এই কি একজন শিক্ষকের মান? এই শিক্ষকদের কাছে ছাত্ররা কি শিখবে? আবার কারনটিও খুঁজে দেখতে হবে।একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে পান সর্বসাকুল্যে ২০,০০০ টাকা যিনি জীবনের সবগুলো রেজাল্টই ভাল করেছেন ও এর পর শিক্ষক হয়েছেন।যদি একজন শিক্ষককে পেটের চিন্তায় ব্যাস্ত থাকতে হয় তাহলে তিনি জাতিকে কি দিবেন।এর জন্য সরকারের কোন দায় রেয়েছে কি? শিক্ষকদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য।
বর্তমান বিশ্বে জ্ঞানভিত্তিক অর্থব্যবস্থা (Knowledge Economy) গড়ে উঠেছে। আজকের উৎপাদন প্রকৃতির মর্জির ওপর নির্ভরশীল নয়। কারিগরি পরিবর্তনের ফলে মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু নৈতিক মান নিম্নগামি হচ্ছে ।শিল্পবিপ্লবের পর প্রতিনিয়ত মানুষের উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। জ্ঞানের জগতে এ ধরনের পরিবর্তনের সুফল ও কুফল দুটি দিকই রয়েছে। জ্ঞানের পরিধি অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রাচীন জগতে জ্ঞান (knowledge) এবং নৈপুণ্যের (skill) মধ্যে তফাত করা হতো। এখনো তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞান ও নৈপুণ্যের প্রভেদ করা হলেও বাস্তবে এরা অভিন্ন হয়ে গেছে। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে নৈপুণ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কারিগরি পরিবর্তন। অন্যদিকে কারিগরি পরিবর্তন সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে বিশুদ্ধ জ্ঞানের অগ্রগতির।বর্তমান বিশ্বে জ্ঞানের অসাধারণ অগ্রগতি ঘটছে। আজকে বিশ্বে যত গবেষক কাজ করছেন তাঁদের সংখ্যা মানুষের উৎপত্তি থেকে বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত যত গবেষক মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের একত্রিত সংখ্যার চেয়ে বেশি।আমরা এক নিরন্তর পরিবর্তনের যুগে বাস করছি। মানুষের উৎপাদনশীলতা বেগবান গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।এ পরিস্থিতিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তিনটি বড় পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমত- এত দিন পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমনভাবে শিক্ষার কার্যক্রম গড়ে তোলা হতো যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জীবনে একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাই যথেষ্ট ছিল। আজকের বিশ্বায়নের যুগে এমন জ্ঞান খুবই কম, যা দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত থাকবে। জ্ঞানের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন চলছে। শিক্ষা তাই হয়ে গেছে জীবনব্যাপী শিক্ষা বা life long education। যাঁরা নতুন নতুন জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন তাঁরাই টিকে থাকবেন। আজকে যাঁরা শিক্ষা সমাপনমূলক সনদ পাচ্ছেন তাঁদের শিক্ষার সমাপ্তি ঘটছে না; তাঁদের প্রতিনিয়ত নতুন জ্ঞান আহরণের জন্য মানসিক প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা চূড়ান্ত জ্ঞান লাভ করবেন না; বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব হলো কিভাবে নতুন জ্ঞান আহরণ করতে হয় তা শেখানো।দ্বিতীয়ত- আজকের উৎপাদনব্যবস্থার সিংহভাগ বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এমনকি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র জাতীয় সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ করাও সম্ভব নয়। যত দুঃসাধ্যই হোক না কেন উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান অর্জনের কোনো বিকল্প নেই।তৃতীয়ত- জ্ঞানের প্রসার যেমনি আমাদের জীবনকে উদ্ভাসিত করছে, তেমনি একই সঙ্গে মানুষে মানুষে অসাম্য বাড়াচ্ছে। উচ্চশিক্ষা ব্যয়বহুল। ব্যয়ের চাপে অনেকের পক্ষেই শিক্ষা অর্জন সম্ভব হয় না। অন্যদিকে শিক্ষার সুযোগ পেলে গরিব মানুষরা দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে। বাস্তবে এই শিক্ষাব্যবস্থা মানুষে মানুষে অসাম্যের সমস্যাকে প্রকট করে তুলেছে। এই অসাম্য নির্দিষ্ট দেশের জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বাড়ছে। আবার উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যেও অসাম্য বাড়ছে।
অঙ্ফামের একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তি ২০০৯ সালে পৃথিবীর সম্পদের ৪৪ শতাংশের মালিক ছিলেন, মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে এই হিস্যা ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পক্ষান্তরে পৃথিবীর ৫০ শতাংশ মানুষ মাত্র ৫.৫ শতাংশ সম্পদের মালিক। আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৮৫ জন ধনকুবেরের যে সম্পদ রয়েছে তা বিশ্বের সাড়ে তিন শ কোটি গরিব মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি।
অসাম্যের এই দ্রুত সম্প্রসারণ শুধু সামাজিক অসন্তোষই বাড়াচ্ছে না, আপামর জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য আরো দ্রুত শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। এ কাজ শুধু বেসরকারি খাতের পক্ষে সম্ভব নয়, সরকারকে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব বাড়ছে। একদিকে মানবসম্পদ উন্নয়ন অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। শিক্ষার উন্নয়নের সব ব্যয় বহনের ক্ষমতা ব্যক্তির নেই। কাজেই এ খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা যাতে সামাজিক অসাম্যের বাহন না হয় সে জন্য দেশে শিক্ষার মান দ্রুত বাড়াতে হবে। শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত এ ক্ষেত্রে আমাদের অনেক তৎপর হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।আধুনিক অর্থনীতির চাহিদা অনুসারে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন অবশ্য প্রয়োজনীয়; কিন্তু যথেষ্ট নয়। অর্থনীতি মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে, কিন্তু জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। বিশ শতকের সেরা অর্থনীতিবিদ জন মেয়নার্ড কেইনস যথার্থই বলেছেন যে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট জ্ঞান ও সম্পদ দুটিই মানুষের আছে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সুসম্পর্ক এবং ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়াবলির অনেক প্রশ্নের জবাব এখনো আমরা জানি না। তাই শুধু প্রতিযোগিতাক্ষম ও উৎপাদনশীল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুললেই চলবে না, আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নই যথেষ্ট নয়, আমাদের জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে প্রাচীন শিক্ষার মূল্যবোধের সমন্বয় করতে হবে। আজকে যাঁরা ডিগ্রি লাভ করছেন তাঁদের দায়িত্ব অনেক। একদিকে তাঁদের বিশ্বের শ্রমবাজারে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে; অন্যদিকে শিক্ষার মূল্যবোধের প্রতি অনুগত থাকতে হবে। শুধু অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করলেই চলবে না; মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে। সব মানুষকে নিজের মতো ভালোবাসতে হবে।দলের সংকীর্নতার মধ্যে থেকে নয়,সব মানুষকে আপন করে নিজের যা কিছু আছে তা দিয়ে সম্পৃক্ত করতে হবে। এসব কাজ দুরূহ, তবে অসম্ভব নয়। আজকে যে তরুণরা শিক্ষা সমাপ্ত করে সংসারের পথে পা বাড়াচ্ছে তাঁদের যাত্রার পথ কুসুম আচ্ছাদিত নয়। বাস্তব জগতে তাঁদের অনেক সংকট মোকাবিলা করতে হবে।তবে সব সংকটই দূরীভূত হবে যদি শিক্ষার মান ত্বরান্নিত করা যায় ও ধর্মীয় জ্গানকে শিক্ষাব্যাবস্হার সাথে সংযোযিত করা যায়।
বিষয়: বিবিধ
১০৭০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন