তুমি কি জানতে বাবা তোমায় কতটা ভালবাসতাম!
লিখেছেন লিখেছেন পটাশিয়াম নাইট্রেট ২৫ মার্চ, ২০১৪, ০৭:৫২:১৫ সকাল
আমার বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমার যতবার জ্বর হয়েছিল তার অন্তত: ৫০ শতাংশ হয়েছে বাবার পিটুনি খেয়ে। আমার ছোট তিন বোনের সাথে আমার বাবার আচরণ আর আমার সাথে ঊনার আচরণ মেলাতে পারতাম না।অথচ হবার কথা ছিল উল্টোটা! আমি যে বাবার এক মাত্র ছেলে।
মার খেয়েছি কাকের ঠ্যাং-বকের ঠ্যাং হাতের লেখার জন্য, দুপুরে না ঘুমানোর জন্য, পাখি মারার জন্য, শীতকালে গোসলে ফাঁকি দেবার জন্য, রাতে ঘুমানোর আগে ব্রাশ না করার জন্য, মাথা না আঁচড়াবার জন্য, মাথায় তেল না দেবার জন্য! একটা আইডিয়া নিশ্চয় পেয়েছেন মানুষ কত কারণে মার খেতে পারে! ভাবছেন কি দিয়ে মারতো? এক কথায় সবকিছু। হাতের কাছে যখন যা পাওয়া যেত! কাঠের রুলার, বেত, ঝাঁটা কোন কিছুতেই ঊনার অরুচি ছিলনা। সাথে মৌখিক তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতো ছিলই। অপমানে মনে হতো আমার চাইতে অথর্ব বুঝি দুনিয়াতে আর কেউ নাই!
মার খেয়ে মেজাজ এমনিতেই হাইপার হয়ে থাকতো , এরপর যখন দেখতাম আমাকে মারার পরে ঊনি কাঁদছেন তখন আমার মেজাজ আরো বিগড়ে যেত! আমি সত্যিই ঐ কান্নার কোন অর্থ খুঁজে পেতাম না। যদিও আমি বুঝতাম ওটা অনেক ভেতর থেকে আসা কান্না। কিন্তু আমাকে মেরে যখন কাঁদতেই হবে তখন মারার দরকারটা কি? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০০১ সাল পর্যন্ত!
এত মারধরের পর এস এস সি'র রেজাল্ট খারাফ হবার উপায় ছিলনা। ৮০০র কাছাকাছি মার্কস নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করলাম। উচ্চ-মাধ্যমিকে চট্রগ্রাম শহরের প্রথম সারির কলেজে ভর্তি হতে হয়তো পারতাম। কিন্তু বাবা তার আর্থিক অসংগতির কথা বিবেচনা করে নিয়ে গেলেন নিজ কর্মক্ষেত্র রাঙ্গামাটি। বাবা ওখানকার একটা মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন রাঙ্গামাটি কলেজে। তখন ও মারধর-বকাবকি চলতো। রাতে চুপি-চুপি আবার আমার গায়ের কাঁথা ঠিক করে দিতে আসতেন, মশারি টানিয়ে দিতেন, অনেক সময় আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম। একদিন অনেকক্ষণ আমার মাথায় হাত বুলাতে থাকলে আমি হাত সরিয়ে দিই এবং বলি কেন ঊনি আমার ঘুম ভাঙ্গাতে আসেন! জবাবে বাবা বল্লেন নিজের যখন ছেলে হবে তখন টের পাবি। ওটাকি আশীর্বাদ ছিল? হয়তো তাই! আমি এখন আড়াই বছরের এক ছেলের বাবা। হ্যাঁ কিছুটা টের ও পাচ্ছি মনে হয়! তবে বাবার মত অতটা হয়তো নয়!
যাক এর মধ্যে একদিন বাবার প্রচন্ড হার্ট আ্যাটাক হল। ঊনি অচেতন হয়ে পড়লেন। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মাত্র উচ্চ-মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র। গ্রাম থেকে এই প্রথম শহরে এসেছি। রাঙ্গামাটি মেডিকেল থেকে ডাক্তাররা চট্রগ্রাম মেডিকেলে রেফার করলেন। বাবার কলিগদের সহায়তায় এম্বুল্যান্স ব্যাবস্হা হয়েছিল। সেই প্রথম আমার চট্রগ্রাম মেডিকেল যাওয়া। এর পর প্রায় ৫ বছরের জন্য চট্রগ্রাম মেডিকেল হয়ে উঠেছিল আমার ঘর-বাড়ি। অবস্হা এমন দাঁড়িয়েছিল যে অনেকেই আমাকে চট্রগ্রাম মেডিকেলের ষ্টাফ মনে করতো। আমি ও এই সুযোগে যখন তখন ঢুকতে পারতাম।
উল্লেখ্য এর মধ্যে বাবা আরো দুই বার হার্ট আ্যাটাক করেছেন এবং ঊনার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আর আমি উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে চট্রগ্রামের একটা কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। বাবার ক্যান্সার অপারেশন হলো চট্রগ্রাম মেডিকেলেই! এর পর চলতে থাকলে কেমো-থেরাপি। কিছুতেই কাজ হচ্ছিলোনা। আরো দুই বার সার্জারী হলো।। এত কিছুর পর ও ঊনি চাকুরী ছাড়ছিলেন না। একটু সুস্হ বোধ করলেই মেডিকেল থেকে চলে যেতেন রাঙ্গামাটি। গিয়ে আবার অসুস্হ হয়ে পড়তেন। সেখান থেকে আবার চট্রগ্রাম মেডিকেল। এভাবেই চললো ৫ বছর।
২০০১ সালের মাঝা-মাঝি বাবার শরীরের চুড়ান্ত অবনতি ঘটতে থাকলো। কেমোতে কাজ হচ্ছিলোনা! রেডিও-থেরাপী চলতে লাগলো। পায়ের পাতা থেকে উপরের দিকটা ক্রমশ ফুলে উঠতে থাকে। একদিন রেডিও থেরাপী দিতে গিয়ে টেকনেশিয়ান সম্ভবত রেডিও থেরাপী দেবার আর যায়গা খুঁজে পাচ্ছিলেননা। ওখান থেকে সরাসরি ডাক্তারের চেম্বারে! ডাক্তার আমাকে ভেতরে ডেকে পাঠালেন। আমতা আমতা করে আমার পরিবারের অবস্হা জানতে চাইলেন। ততদিনে আমি জ্বলে-পুড়ে এমন হয়েছি যে মনে হতো পৃথিবীর কোন বিপদই আমাকে টলাতে পারবেনা। কোন সংবাদই খারাপ সংবাদ নয়। ডাক্তারকে বল্লাম, যা বলার ঊনি সরাসরি বলতে পারেন। ঊনি ও স্বাভাবিক হলেন। জানালেন আমার বাবা আর সর্বোচ্চ ১৯ দিন বাঁচবেন। আমি বললাম বাবাকে এমন কিছু ভিটামিন ঔষুধ লিখে দিতে যাতে ঊনি চিনতে না পারে। ডাক্তার দ্বিমত করলেন না। প্রেশক্রিপশন হাতে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলাম। অপেক্ষমান বাবার চোখে চোখ পড়তেই হাসি দিলাম। বললাম, বাড়ি যেতে চেয়েছিলেন না? ডাক্তার ২০ দিনের ঔষধ দিয়েছে ফুলাটা কমার জন্য। এরপর আবার রেডিও থেরাপী শুরু হবে। ঊনি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন। কারণ ঊনার চিকিৎসার বিষয়ে ঊনি নিজেই ডাক্তারদের সাথে কথা বলতেন। তারপর ও কেমন যেন আশ্বস্ত হলেন। জীবনে প্রথমবার মনে হয় বাবাকে বোকা বানাতে পেরেছিলাম।
সেই রাত থেকেই বাবার শরীরের অবস্হার ভয়ানক অবনতি হতে লাগলো। রাতটা কোনমতে পার করে সকালেই বাড়ীর পথে রওয়ানা দেই।বাড়ীতে নেবার পর ঊনি ঠিকই বুঝে ফেলেছিলেন সবার আচরণে। বাড়িতে নেবার পর ১৯ দিনের মাথায় ঊনি ইন্তেকাল করেন। এই ১৯ দিন ঊনি বালিশে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন।কথা বলতেন খুবই অস্পষ্ট স্বরে। ঊনার খুব কাছাকাছি থাকাতে আমি ঊনার ইশারা ও বুঝতে পারতাম। ক্যান্সারের কারনে উনার শরীরে পচন ধরে গিয়েছিল। আমি কোন গন্ধই পেতাম না।
ভয়ংকর ব্যথার জন্য দু-চোখের পাতা ঊনি এক করতে পারতেন না। আমার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ালে ব্যাথা একটু কম হত, ঊনি একটু ঝিমিয়ে নিতে পারতেন। রাতে আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম আর ঊনি আমার কাঁধে অনেকটা ঝুলে থাকতেন। কিভাবে যেন আমি ও পারতাম। বাবা, তোমাকেতো বলাই হয়নি! তোমাকে নিয়ে রাতে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ সময়টাই আমার জীবনের সেরা সময়। ইস্ বাবা! আমি যদি অনন্তকাল তোমাকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম!
বাবা তুমিতো ঐ সময়টাতে কথা বলতে পারতেনা ভালভাবে। তারপর ও একরাতে অন্ধকারে আমি যখন তোমার পাশে বসে ঝিমুচ্ছিলাম তুমি আামাকে ধাক্কা দিয়ে জাগালে। আমাকে বললে এটা যে তোমার শেষ সময় তা তুমি জান। আমাকে আমার করণীয় সম্পর্কে উপদেশ দিলে। এরপর দিলে আমার শৈশবের সেই প্রশ্নের উত্তর। কেন তুমি আমাকে এত মারতে, কেন তুমি আমার ব্যাপারের এত খুঁত-খুঁতে ছিলে। যেই মুহুর্তে আমি তোমার মুখ থেকে শুনলাম তুমি আসলেই আমার উপর খুব সন্তুষ্ট আমি কান্নায় কথা বলতে পারছিলামনা। বাবাকে ধরে কখনো আমার এভাবে কাঁদা হয়নি।
এর ৪/৫ দিন পরই বাবা চলে গেলেন। আমি একটু ও কাঁদিনি। বয়সে ছোট হলে কি হবে? বাবা যে এই মাত্র আমার উপর এক কঠিন দায়িত্ব দিয়ে গেলেন! দায়িত্বশীলদের কাঁদতে নেই।
বাবা, একদম শেষ দিকে আরেক রাতে তুমি আমাকে ধরে বলছিলে "আমি তোর জন্য দোয়া করে যাচ্ছি, তুই জীবনে কখনে ঠেকবিনা।" হ্যাঁ বাবা! লক্ষ-কোটি অযোগ্যতার মাঝে ও কি যেন একটা ম্যাজিকের টানে আমি এখান পর্যন্ত এসেছি। আমি হিসেব মেলাতে পারিনা।সেই দিন থেকে আল্লাহ্ ১ দিনের জন্যও আমাকে ঠেকাননি।
তুমি তো বলে গিয়েছো তুমি আমাকে অনেক ভালবাসতে। কিন্তু আমি তো বলতে পারিনি বাবা আমি তোমাকে কতটা ভালবাসতাম!
বিষয়: বিবিধ
২৭২৫ বার পঠিত, ৬২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ , সুন্দর ও আবেগমাখা এই লেখাটির জন্য। আল্লাহ আপনার বাবাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন।
আমার হাতের লেখা ভাল ছিল,কিন্তু উল্লিখিত সকল বিষয়ে মাইর ছাড়াও আরও অনেক বিষয়ে খেয়েছি। আর আমার বাপ কখনই আমার সাথায় হাত বুলাননি এবং কৈফিয়ত ও দেননি
লেখাটা পড়ে চোখে খানিক পানিও এসেছে যদিও আমি বেশ কঠিন
আল্লাহ আপনার বাবাকে জান্নাতবাসী করুন । সেখানে গিয়ে বাবাকে বলতে পারবেন, দেখ বাবা এই যে আমি তোমার KNO3 এত মারতে আমাকে তারপরেও তোমাকে অনেক ভালবাসি । তোমার ভালোবাসা ও দোয়ার কাছে তোমার মারগুলো একেবারেই তুচ্ছ আজ ।
বুঝলাম না! সঠিক গ্রুপ সিলেক্ট করার পর ও এটা বার-বার বিবিধ গ্রুপে চলে যাচ্ছে।
ভালো লাগলো আপানার লেখাটি। +
আপনি আসলেই ঠিক বলেছেন। বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক গতানুতিক নয়। তার গভীরতা আমি এখনো হাতড়ে বেড়াই।
লেখাটা সত্যি অসাধারণ!
অভিনন্দন!
অভিনন্দন!
আপনার বাবার জান্নাতের জন্য দোয়া করছি।
বাবার কোন কিছুই আমার মনে নাই.....তবে আপনার লিখাটা পড়ে বুঝলাম বাবার দোয়া কেমন হতে পারে।
ইনশাআল্লাহ আপনি দুনিয়া আখিরাত কোথাও আটকাবেননা এই দোয়াই করি। আমিন।
অভিনন্দন আপনাকে।
আপনি বাবাকে খুব অল্প বয়সেই হারিয়েছেন বুঝি? ঊনার জন্য দোয়া করুন।
আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।
খুব ছোট বয়সে তাই কিছুই মনে নেই বাবাকে নিয়ে।
যাই হোক, আপনার জন্য শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন এবং আপনার বাবার জন্য মাগফিরাতের দুআ রইলো।
বিজয়ী হওয়ার জন্য অনেক অভিনন্দন।
ভাইয়া চেষ্টা করেও কান্না না করে পারলাম না।।
মন্তব্য করতে লগইন করুন