করি পুষ্প রে বিকশিত-৫
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ৩১ মার্চ, ২০১৪, ০৫:২৮:৪৭ বিকাল
বাচ্চাদের তুমুল আপত্তি ও আবদারের স্রোতে পড়ে শেষ পর্যন্ত নিজের বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা বাদ দিলো অন্তরা। যেই অন্তরা বলল যে, আচ্ছা ঠিকআছে আজ যাব না। আনন্দে চিৎকার করে মুসআব, মাশফিয়া আর আসফিন জড়িয়ে ধরলো অন্তরাকে। মুসআব বলল, ফুপ্পি আজ রাতে কিন্তু আমরা সবাই তোমার সাথে ঘুমবো। মাশফিয়া ভাইয়ের মুখ থেকে কথা টেনে নিয়ে বলল, হ্যা ফুপ্পি তোমাকে কিন্তু গল্প শোনাতে হবে আমাদেরকে। ক্লাস স্কুল বন্ধ দেরি করে ঘুমোলে কিছু হবে না। আসফিনও মাথা ঝাঁকিয়ে দুজনের সাথে ঐক্যেমত পোষণ করলো। তিনজনকে আদর করে অন্তরা বলল, ঠিকআছে আমরা একসাথে ঘুমোবো। এবং অনেক অনেক গল্প করবো, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু এখন তোমাদের রুটিনে আছে পড়তে বসার কথা। তোমরা পড়া শেষ করো ততক্ষণে ফুপ্পি আর আম্মু মিলে তোমাদের জন্য রান্না করে ফেলি।
তিনজনকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে অন্তরা আর নায়লা রান্নাঘরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নায়লা বলল, অন্তরা আমার আর তোমার ভাইয়ার সাধারণত কখনোই মনোমালিন্য হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে পারিবারিক নানা বিষয়ে কথা বলার সময় যুক্তিতর্ক বেঁধে যায়। এতে আমাদের সম্পর্কে কোন প্রভাব পরে না। দুজনই ভুলে যাই একটু পরেই। কিন্তু মুসআব আর মাশফিয়া কখনো যদি শুনে ফেলে ওরা বেশ ঘাবড়ে যায়। এই বিষয়ে কি করণীয় বলো তো?
অন্তরা হেসে বলল, ভাবী মেঘ যেমন নিজে না ভিজেও বৃষ্টি রূপে সবকিছুকে ভিজিয়ে দেয়। বাবা-মাদেরকেও তেমন হওয়া উচিত। অর্থাৎ,বাবা-মার মধ্যে যদি কোন সমস্যা থেকেও থাকে সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেটা কখনোই সন্তানদের সাথে শেয়ার করা উচিত না। কারন সন্তানরা বেশির ভাগ সময়ই সবকিছু না জেনে বা না বুঝেই বাবা-মার মধ্যে থেকে যে কোন একজনকে সাপোর্ট করে এবং অন্যজনকে দোষারোপ করে। যারফলে একজনকে ঘিরে ভালোবাসা আর অন্যজনকে ঘিরে মনে বয়ে চলে বেদনা। আর এর প্রভাব গিয়ে পড়ে বাচ্চার জীবনে। সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয় এটা। আমি এই পর্যন্ত যতগুলো বিয়ে বিদ্বেষী ছেলেমেয়ের কাউন্সিলিং করেছি তাদের নাইনটি এইট পার্সেন্টই কলহপূর্ণ সংসারের সন্তান ছিল। অপরপক্ষে বাবা-মার সুখী ও সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্কে দেখতে দেখতে বড় হওয়া সন্তানদেরকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখেছি। জীবনকে ঘিরে এদের দৃষ্টিভঙ্গী অনেক বেশি ইতিবাচক।
তারমানে তো তোমার ভাইয়া আর আমাকে আরো সাবধান হতে হবে।
হেসে, অবশ্যই সাবধান হতে হবে। কিন্তু তোমরা যতই সাবধান হও না কেন জীবন থেকে পারিবারিক সমস্যা তো দূর করে ফেলতে পারবে না তাই না?
তাহলে?
আমার আর জীয়ানেরও কখনোই মনোমালিন্য হয় না। উনি যখনই রাগ করেন আমার খাবার আর ঔষুধের অনিয়ম দেখে রাগ করেন। উনি বকাঝকা করেন আর আমি হাসতে থাকি। যেহেতু আমাদের ঝগড়ার ব্যাপারটা ভালোবাসাময় অভিমান ও দুষ্টুমিতে ঘেরা। তাই আমরা কখনোই ভাবিনি যে আসফিনের উপর কোন প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু একদিন আসফিন ওর বাবা অফিসে চলে যাবার পর আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, বাবা তোমাকে শুধু বকাঝকা করে তাই না আম্মুতা? বাবা অনেক পঁচা। তখন তো আমি বুঝলাম না জানি কতকিছু চিন্তাভাবনা করে করে দাম্পত্য বিশারদ হবার পথে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে আমার পুত্র।
নায়লা হেসে বলল, তারপর তুমি তখন কি বললে?
অন্তরা হেসে বলল, রাতে ঘুমোনোর সময় বললাম আচ্ছা আসফিন তোমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু তো ইলিয়াস তাই না? তোমার কি ইলিয়াসের উপর কখনো রাগ হয়? আসফিন বলল, হয় তো আম্মুতা। পড়া করে আসে না, হোমওয়ার্ক করে ভুলে বাসায় রেখে আসে, ক্লাসে মারামারি করে, আমাকে শুধু বিরক্ত করে। তখন আমার খুব রাগ হয়। বললাম, তখন তুমি কি বলো ইলিয়াসকে? আসফিন বলল, আমি বলি বেশি দুষ্টুমি করবে না। তাহলে ফ্রেন্ডশীপ কাট্টি করে দেব। তোমার সাথে কথা বলবো না। জানতে চাইলাম, তুমি কি কখনো ইলিয়াসের সাথে ফ্রেন্ডশীপ কাট্টি করে দিয়েছো? জবাবে বলল, নাতো আম্মুতা। আমার ইলিয়াসকেই পছন্দ ক্লাসের সবার মধ্যে। আর আমি যদি ফ্রেন্ডশীপ কাট্টি করে দেই তাহলে ইলিয়াসের টিফিন কার সাথে খাবে? কার খেলনা দিয়ে খেলবে? ইলিয়াস তো আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড। আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। আমি তখন বললাম, তুমি কি জানো তোমার আর ইলিয়াসের মত বাবা আর আম্মুতাও বন্ধু। মাঝে মাঝে আম্মুতা অনেক দুষ্টু কাজ করি তো তাই বাবা আম্মুতাকে বকে দেয়। ঠিক যেমন তুমি ইলিয়াসকে বকে দাও দুষ্টুমির জন্য। কিন্তু আম্মুতাও বাবার বেষ্ট ফ্রেন্ড। আর বাবাও আম্মুতাকে অনেক ভালোবাসে। এরপর থেকে আসফিন অনেক মজা পায় যখন ওর বাবা আর আমি দুষ্টুমি করে ঝগড়া করি। আসলে কি জানো ভাবী?
নায়লা বলল, কি?
সংসারে মনোমালিন্য, কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ভিন্ন দুজন ব্যক্তির পক্ষে সবসময় একমতে আসা যেমন সম্ভব নয়। তেমনি সংসারে সমস্যা তো শুধু স্বামী-স্ত্রীর ভিন্নতা থেকেই হয় না। পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক আরো অসংখ্য বিষয় প্রভাব ফেলে মনে। সবসময় সেই প্রভাবমুক্ত থাকা সম্ভব নয়। তাই বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে সন্তানদেরকে সেটা বুঝিয়ে বলা। বাবা-মার পরস্পরের মধ্যের সম্পর্ক দিয়ে যেন সন্তানরা বাবা-মাকে যাচাই না করে এই শিক্ষাটা ছোটবেলাতেই দিয়ে দিতে হবে সন্তানদেরকে। আর বাবা-মাকেও যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হবে যাতে তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা সন্তানদের সামনে প্রকাশিত না হয়। কারণ স্বামী-স্ত্রী কিছুক্ষণ পরেই একে অন্যের সংস্পর্শে গিয়ে সবকিছু ভুলে যায়। কিন্তু সন্তানদের মন থেকে সেটা এত সহজে মুছে যায় না।
হুমম...বুঝতে পারছি মুসআব আর মাশফিয়াকে নিয়ে তাহলে একদিন বসতে হবে। সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হবে। তুমি না থাকলে আমার কি হতো অন্তরা বলো তো?
অন্তরা হেসে বলল, আল্লাহ নিশ্চয়ই অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিতেন। যাদের কাছে অন্তরা নেই তারা কি সমস্যা ফেরি করে বেড়াচ্ছে নাকি?
নায়লা হেসে বলল, আমি না তোমাদের ভাইবোনদের মত এত মজা করে কথা বলতে পারিনা। আমাকে শেখাও তো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে বলতে যখন পরিবেশ ভারী হয়ে যায়। তখন ছোট্ট একটা দুষ্টুমি মাখা কথা বলে কিভাবে পরিবেশকে হালকা করতে হয়।
হেসে, আমি মাঝে মাঝে আমার ক্লান্ত শ্রান্ত কলিগদেরকে কি বলি জানো? বলি, অবসাদে ঘেরা চিড়চিড়ে জীবন থেকে মুক্তি পেতে চান? শিশুদের কাছে জান। দেখবেন মুহুর্তেই ওরা আপনাকে বাঁচার মত করে বাঁচতে শিখিয়ে দেবে। প্রাণ খুলে হাসতে, আর দু’হাতে মুঠো মুঠো আনন্দ বিলাতে শিখিয়ে দেবে। ভাবী তুমি শিশুদের কল্পনার জগতে ঘুরতে গিয়েছো কখনো?
নায়লা হেসে বলল, নাতো! কি আছে সেখানে?
আকাশ জোড়া রঙধনু আছে! আছে ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া পথ প্রান্তর! পাখীদের কলোকাকলি, জোনাকির আলোর বিচ্ছুরণ, মৌমাছির মধুর ফোয়ারা, সুর্যের আলোর ঝর্ণাধারা, আর চারিদিকে শুধু রঙ আর রঙ। জানো প্রতিটা শিশুর আলাদা রঙ আছে। ওরা চায় ওদের সেই রঙে পৃথিবীর সব কিছুকে রাঙিয়ে দিতে। ইনশাআল্লাহ আজ তোমাকে নিয়ে যাবো শিশুদের কল্পনার সেই জগতে। শুদ্ধতায় ঘেরা সুবাসিত এক ভুবনে। যেতে চাইলে তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করো। আমি উঁকি দিয়ে দেখে আসি কি করছে আমাদের পুষ্পরা।
বিষয়: বিবিধ
১৬৩৩ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার মনে হয় রান্নাঘর আপুদের জন্য কথা বলার একটা দারুন যায়গা
আত্মবিশ্বাষি হতে চাই।
দোয়ার দরখাস্ত।
অনেক শুকরিয়া।
এত অবিজ্ঞতা?
চমৎকার শব্দ চয়ন। শুধু পড়তেই মন চায়। শিখার আছে অনেক কিছু। অনেক বড় সুসাহিত্যিক হোন। সমাজে আপনাদের মত লেখিকার অনেক অভাব। অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।
যাজাকুমুল্লাহু খাইর
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
শোন বুন্ডি দেখো আমার একটা পোষ্ট স্টিকি হয়েছে! কমেন্ট করো কেমন!
এই গল্পটা কন্টিনিউ করো প্লিজ। তোমার সাত পর্ব থেকে বেড়িয়ে আসো। নয়তো
তোমার জন্য...
মন্তব্য করতে লগইন করুন