শিশুদের আত্মসমালোচনা আলোকে গড়ে তোলা
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১০:২৭:১৭ রাত

আমার ক্ষুদে স্টুডেন্টদের সাথে সময় কাটাতে গেলে যে সমস্যাটার মুখোমুখি হতে হয় খুব বেশি সেটা হচ্ছে তাদের একে অন্যের প্রতি অভিযোগ। হয়তো অনেক খেলনা আছে কিন্তু দেখা যাবে একটা খেলনা নিয়েই কয়েকজন টানাটানি করছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী না। আবার সম্মিলিত একটা দুষ্টুমি করেছে কিন্তু কেউই নিজের দোষ স্বীকার করতে চায় না। সবাই দোষটা অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। নিজের স্বপক্ষে এত সুন্দর সুন্দর যুক্তি দেয় আর অন্যের দোষটা এত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে একেকজন যে না চাইতেও হাসি পায়। আমি ওদের অভিভাবকদেরকে সবসময় একথা বলি যে, কোন উত্তম গুণাবলীর বীজ সন্তানদের মধ্যে বুনে দেয়ার সবচেয়ে পারফেক্ট সময় হচ্ছে শৈশব। সুতরাং এখন থেকেই বাচ্চাদেরকে নিজের ভুলকে বুঝতে এবং মেনে নিতে শেখাতে হবে, আত্মসমালোচনা করতে সাহায্য করতে হবে। তা না হলে নিজের ভুলকে ইগনোর করা ও অন্যের উপর দোষ চাপানোটা স্বভাবে এবং স্বভাব থেকে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে।
নাকীবদের ক্লাসে এই বছর যিনি প্রফ হয়েছেন তাকে নিয়ে অভিভাবকদের অভিযোগের শেষ নেই। কারণ প্রফকে ঘিরে বাচ্চাদের মনে অনেক বিরক্তি। প্রফ রাগী, শুধু ধমক দেন, পরীক্ষায় নাম্বার কম দেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কয়েকজন অভিভাবক মিলে যখন বাচ্চাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো প্রতিটা বাচ্চাই নিজ নিজ অভিযোগ বললো প্রফকে ঘিরে। নাকীবকে জিজ্ঞেস করলাম প্রফ কি সত্যি খুব রাগী? তোমাদেরকে বকাঝকা করেন? নাকীব জবাব দিলো, হ্যা আম্মু। একটু দম নিয়েই আবার বললো, কিন্তু সেজন্য আমরাই প্রফকে বাধ্য করি। প্রফ সাইড টক করতে মানা করে কিন্তু সবাই করে, পরীক্ষার সময় কথা বলতে মানা করে কিন্তু এটাও কেউ শোনে না, আবার সুযোগ পেলেই একে অন্যের গায়ে ইরেজার নয়তো কাগজ দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারে। মন দিয়ে কথা শোনে না। এককথা বার বার বলতে হয় প্রফকে। সুতরাং রাগ তো করবেই। মায়েরা যখন নিজ নিজ বাচ্চাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন সত্যিই এসব করে কিনা? সবাই চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো।
বুঝতে শেখার পর থেকে আমি সবসময় চেষ্টা করেছি নাকীবকে আত্মসমালোচনার আলোকে গড়ে তুলতে। যখনই কোন ভুল করেছে বা ভুল কথা বলেছে আমি কখনোই সরাসরি কিছু বলিনি নাকীবকে। বরং প্রশ্ন করে করে ওকে নিজের কাজকে যাচাই বাছাই করতে ও নিজের ভুলকে খুঁজে বের করতে এবং মেনে নিতে শিখিয়েছি। এমন প্রায়ই হয় একটা কাজ করে যখন বুঝতে পারে যে ভুল করে ফেলেছে শুরু করে কান্না। আমি বকা কি দেবো উল্টো আদর করে ওকে ঠাণ্ডা করতে হয়। আবার অনেক সময় এমন হয় যে আমি কোন কারণে নাকীবকে খুব বকে দিয়েছি। মনখারাপ করে বসে আছে। আমি তখন ওকে সুন্দর করে আমার রাগের পেছনের কারণটা ওকে বুঝিয়ে বলি। কখনোই বলি না যে অন্যায় করেছে বরং অন্যায় যে করেছে সেটা বুঝতে সাহায্য করি। নাকীব যখন সেটা বুঝতে পারে খুব স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয় নিজের ভুল ও আমার রাগের পেছনের কারণটা। এবং পরবর্তীতে সেই কাজটা এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে।
ছোটবেলায় আমি আর আরোহী আমরা দুইবোন ছিলাম বাবার জর্জ সাহেবা। বাবা ঘুমোতে যাবার আগে সারাদিনে ঘটে যাওয়া সব কথা আমাদের দুজনকে বলতেন। আমরা দুজন মিলে বিচার করতাম বাবার কি কি ভুল হয়েছে, কাকে কাকে সরি বলতে হবে। দেরী করে বাসায় ফেরা, মামণির ফোন রিসিভ না করা, মামণিকে ফোন না দেয়া, আমাদের জন্য চকলেট আনতে ভুলে যাওয়া, এই ঘোর অন্যায় গুলো প্রায়ই বাবার দ্বারা সংঘটিত হতো। এবং মামণি ও আমাদের কাছে সরি বলতেন বাবা সেজন্য। যখন কিন্ডার গার্ডেন থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম নিজের সারাদিনের কর্মকান্ডের বিচার কার্যের পর বাবা আমাদের কাছেও সারাদিনের নিজ নিজ কর্মকান্ডের কথা জানতে চাইতেন। আস্তে আস্তে বিষয়টা আমাদের প্রতিদিনের রুটিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। ঘুমোতে যাবার আগে বাবার কাছে বসে নিজের সারাদিনের কাজকর্মের হিসাব না দিলে ঘুমই আসতো না। বাবা শুধু আমাদের কথা শুনতেনই না দোষ-গুণ গুলোও ধরে দিতেন। কোন কাজটি দোষ হয়েছে এবং কেন আবার কোন কাজটি ভালো হয়েছে এবং কেন সেটি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন আমাদেরকে।
বিশাল যৌথ পরিবার আমাদের। প্রায় একই বয়সী কাজিন ছিলাম বেশ কয়েকজন। খুনসুটি, মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো সারাক্ষণ। প্রায়ই আমাদের নিয়ে বসতো বিচার সভা। তবে বাবা না জর্জ হতেন না উকিল। বাবা যা করতেন তা হচ্ছে আমাদেরকে সাহায্য করতেন নিজ নিজ ভুলকে খুঁজে পেতে, আত্মসমালোচনা করতে। একটা সময় এমন হলো যে আমাদের জন্য আর বিচার সভা ডাকতে হতো না। আমরা সবাই যার যার কাজকে যাচাই করতে শিখে ফেলেছিলাম ধীরে ধীরে। যারফলে আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য কমে গিয়ে একে অন্যকে বুঝার ইচ্ছা জাগ্রত হয়ে গিয়েছিল। মতভেদ হলেই আমরা আত্মসমালোচনা করে দেখতাম। যখনই বিতর্ক বাঁধার সম্ভাবনা দেখা দিত বা একমতে আসা সম্ভব না বুঝতে পারতাম, তখন নিজ নিজ মতে দৃঢ় থেকে অন্যের মতকে সম্মান করে আমরা আলোচনা সমাপ্ত করে দিতাম। কারণ আমরা জানতাম পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র। কেউ কারো কারো মতো নয়। সব বিষয়ে তাই সবার একমত আসা সম্ভব নয়। এবং সব ব্যাপারে সবাইকে একমত হতেই হবে এমন কোন আবশ্যকতাও নেই।
ছোটবেলা থেকে এখনো পর্যন্ত আমরা প্রতিটা ভাইবোন এই জিনিসটা মেনে চলেছি বলেই হয়তো আমাদের মাঝে কখনোই কোন মনোমালিন্য হয়নি। আর মত পার্থক্য আমাদের সম্পর্কের মাঝে কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। নিয়মিত আত্মসমালোচনা করার কারণে উপলব্ধি করেছি যে, মানুষ আসলে নিজের চিন্তা ও কর্মের কারণে নানান ধরণের কষ্টের সম্মুখীন হয়। অথচ নিজেই যদি নিজের ভুলকে শুধরে নেয়া যায় তাহলে মন জুড়ে বিরাজ করে প্রশান্তি। কোন একজন মনিষীর বাণী পড়েছিলাম-“ একটি আত্মার সবচেয়ে বড় ভুল হল নিজের স্বরূপকে চিনতে না পারা। কারণ নিজের অন্তর আত্মাকে না চিনলে নিজের ভুলগুলোকে শুধরানো যায়না।তাই সবার আগে নিজেকে চিনতে আর জানতে হবে। অবশ্যই নিজের মনকে বুঝতে হবে। নিজেকে চিনে, জেনে, বুঝে যদি নিজের অন্তরে কেউ নিমজ্জিত হয় তাহলে সে নিজের অন্তরে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে পারে। তাই সবার আগে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। নিজের অন্তরের আমিকে যে জয় করতে পারে সেই সর্বক্ষেত্রে সফল হতে পারে। বিজয়ী হতে চাইলে তাই শত্রু ভেবে বাইরের লোকের সাথে লড়াই না করে নিজের সাথে যুদ্ধ করা উচিত। শান্তি চাইলে অন্যের দোষ না ধরে আত্মবিশ্লেষণ করে নিজের দোষ খুঁজে বের করতে হবে।”
আসলে ছোটবেলাতেই যদি শিশুদের মনে এই বিশ্বাসটা তৈরি করে দেয়া যায় যে, মানুষ মাত্রই তার মধ্যে ভুল-ত্রুটি থাকবে এবং কেউই ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নই। ভুল করা করার মাঝে যতটা না দোষ তারচেয়ে বেশি দোষ ভুল মেনে না নেয়া ও সংশোধন না করা। এবং ভুল মেনে নেয়ার মাঝে কল্যাণকর দিক সমূহ সুন্দর ভাবে তুলে ধরে শিশুদের মনে আত্মসমালোচনার দ্বার উন্মোচন করতে হবে। বিভিন্নভাবে আত্মসমালোচনার প্লাটফরম তৈরি করে দিয়ে শিশুদেরকে নিজেকে নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। কয়েকটি সমাধান সামনে এনে সঠিকটি বেছে নিতে সাহায্য করতে হবে। তাহলে একটা সময় আত্মসমালোচনা করাটা চরিত্রের স্বাভাবিক অভ্যাস সমূহে পরিণত হয়ে যাবে। এবং নিজেই নিজের আয়না হতে পারবে। কেননা অন্যের মুখে শোনার চেয়ে নিজেই নিজের ভুলটা ধরতে পারা এবং শুধতে নেবার এই গুণটা ছোটবেলা থেকেই শিশুদের চরিত্রে আওতায় নিয়ে আসা যায় তাহলে আত্মশুদ্ধির পথে চলা সহজ হয় তাদের জন্য। 
বিষয়: বিবিধ
২৩০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন