একটি পাখি এবং জীবনের তুলনা
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ০৬ মে, ২০১৫, ১১:৪৫:৫৬ রাত
সকাল আনুমানিক ১০টা। বাইরে মিস্টি রোদ। হালকা ঝিরঝির বাতাস! জানাল খুলে দিয়ে টুকটাক কাজ করছিলাম আমি । খোলা জানালা দিয়ে একটি পাখি রুমে প্রবেশ করলো। কর্ম ব্যস্ততায় নিমগ্ন আমি একটু ঘুরে দেখলাম পাখিটিকে, কিছুটা আমাদের দেশের শালিকের মতোন অবয়ব।বাইরে সুবিস্তৃত নীলাকাশে উড়তে থাকা পাখিটি হঠাৎ করেই আবদ্ধ এই রুমে ভুলক্রমে এসে পড়লো!
কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে অবলোকন করছিলাম পাখিটিকে। বেশ ভীত অবস্থা পাখিটির! যে জানালা দিয়ে পাখিটি ঢুকেছিলো সেটি খুঁজে পাচ্ছিলো না বরং আরেক বন্ধ জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। আমি একটু শব্দ করে সাহায্য করতে চাইলাম পাখিটি উড়ে চলে যাওয়ার জন্য, তাতে হিতে বিপরীত হলো! বেচারা পাখি, আটকানো স্বচ্ছ কাঁচের জানালাকে খোলা আকাশ ভেবেছে এবং বারবার ডানা ঝাপটেও বের হতে না পেরে অহেতুক অনেকগুলো মূল্যবান পালক হারিয়েছে!
আমি সাহায্য করার চিন্তা বাদ দিলাম, ভাবলাম সে নিজেই নিজের গন্তব্যটুকু খুঁজে নিক! অবশেষে পাখিটি স্বচ্ছ কাঁচের প্রতারনাময় খোলাকাশের অবয়বে থাকা জানালা বাদ দিয়ে সঠিক খোলা জানালা খুঁজে পেয়ে সেটা দিয়ে তাঁর প্রকৃত নীড়ে উড়ে যেতে সক্ষম হলো!
যদিও ঘটনাটি খুব ছোট এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই শুরু ও শেষ তারপরেও কেন জানি এই ঘটনাটি আমার মনে অন্যরকম একটা অনুভূতি- একটি নাড়া দিয়ে গেলো!
পাখিটি উড়তে থাকা অবস্থায় ভুলক্রমে এসেছিলো এই বদ্ধজায়গায়। সে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো এটা তাঁর চির- পরিচিত সেই কাংখিত স্থান নয়। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছ কাঁচ যা দিয়ে খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছিলো অথচ পাখিটি কাঁচ অতিক্রম করতে পারছিলো না - এখানে এই স্বচ্ছ কাঁচটি প্রতারনা করছিলো পাখিটির সাথে! স্বচ্ছ কাঁচ যা দিয়ে সব দেখা যায় অথচ অতিক্রম করার উপায় নেই!
প্রতারনা কথাটিকে আমরা সবাই খুব ভয় পাই, এড়িয়ে চলি এবং ঘৃনা করি! প্রায় শোনা যায় - ওমুক কোম্পানি অফারের নামে প্রতারনা করেছে , ব্যবসার নামে টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারনা ,সম্পত্তি-- জমি নিয়ে প্রতারনা, খাবার কিনতে গিয়ে প্রতারনা , বিয়ের বর-কনে দেখানোর ব্যাপারে প্রতারনা এরকম অসংখ্য প্রতারনার সাথে আমরা পরিচিত!
প্রতারিত হলে যে কারোই খুব কষ্ট হয়, প্রতারনা মেনে নিতে কষ্ট হয়, প্রতারককে সবাই ঘৃনা করে, দূরে থাকতে চেষ্টা করে। শুধু তাই নয় দ্বিতীয় বার যেনো এরকম প্রতারনার স্বীকার হতে না হয় সেজন্য সবাই সচেষ্ট থাকে, সবাইকে ভুল না করার পরামর্শ দেয়!
জীবনে একটি বারের জন্যেও প্রতারনার স্বীকার হন নি এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! প্রতারিত হয়ে প্রতারিত হওয়া থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা প্রতিটি মানুষ গ্রহন করে। এভাবেই মনে হয় এই প্রবাদের সূচনা হয়েছিলো- "ন্যাড়া একবারই বেল -তালায় যায়" ।
পাখির আটকে পড়া দৃশ্য থেকে আমাদের মানুষের জীবনের অমোঘ একটা সাদৃশ্য ধরা পড়লো! আমাদের দুনিয়ার ক্ষনস্থায়ী এই জীবনটাও আমাদের সাথে প্রতারনা করছে। দুনিয়ার জীবনে অর্থ- সম্পদের পিছনে, খ্যাতি -সন্মানের পিছনে, সন্তান -পরিজনদের পিছনে, চাকচিক্য -বিলাসিতার পিছনে যে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকছি এগুলো সবকিছু আমাদের সাথে কোন না কোন ভাবে প্রতারনা করছে! এগুলোর মোহমায়ায় আমাদের আটকে রাখছে!
ছোটবেলায় মেয়েরা সবাই পুতুল খেলে আর ছেলেরা বালি দিয়ে ঘর বানায়। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা খেলাচ্ছলে যে সময় পার করে , পুতুল খেলে, ঘর বানায় একসময় সবকিছু শেষ হয়ে যায়। পুতুলের বিয়ে ভেংগে যায়, বালির ঘরও ভেংগে যায়!
মেয়েরা বড় হয়ে সংসারে মনোনিবেশ করে, সুকোমল শিশু সন্তানের জন্ম হয় সে পরিবারে, নানারকম মনোরম শোপিস দিয়ে ঘর ডেকোরেশন করে গৃহিনী!
ছেলেরা আয় উপার্জনে নিয়োজিত হয়! টাকা পয়সা দিয়ে ব্যাংক ব্যালেন্স করে, জমি-সম্পত্তি গড়ে তোলে! সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়!
এই কাজগুলো তো সবাই করে! এতে দোষের কি? স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসে! দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে হলে এগুলো সবার জীবনেই ঘটবে । শুধু পার্থক্য হলো- একজন মুমিন দুনিয়ার জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোকে চিরস্থায়ী হিসেবে দেখেনা! সে এগুলোকে ক্ষনস্থয়ী ঘটনা হিসেবে গুরুত্ব দেয় এবং নিজেকে অবজার্ভ করে যেনো প্রতারনাময় দুনিয়াতে সে কোনভাবেই তাঁর মূল গন্তব্যের কথা বিস্মৃত না হয়!
ছোট সন্তানের মা হওয়ার কারনে সময়মতো সালাত আদায় করা হয় না, বাবাদের অফিস-চাকরি মেইটেইন করে সালাত, কোরআন পড়া মিস হয়ে যায়! বাড়িটা বেশি ছোট হয়ে গেলো আরো একটু আধুনিক মডেলে বাড়িটাকে তৈরি করা গেলে মন্দ না এই ভেবে অভারটাইম বাড়ানো, সন্তনকে আরো ভালো স্কুলে দিতে হলে পার্টটাইম আরেকটা জব এইরকম উদাহরনও আমাদের সমাজে প্রচুর! এই ঘটনাগুলো চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারি কিভাবে আমরা দুনিয়ার পিছনে ছুটছি! আমাদের আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এইত আর কয়েকটা দিন মাত্র! তারপরে তো সবাই ভালো থাকছি! নিরাপদ জীবন যাপন করা যাচ্ছে । ব্যস্ততা একটু কমলেই একদম পাক্কা মুসুল্লি, ক্বারী হয়ে যাব সবাই মিলে!
এভাবেই ছুটতে ছুটতে একদিন আমাদের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে আসলে আমাদের আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না! ঠিক ঐ পাখির মতোন আমাদের অবস্থান হবে যে স্বচ্ছ কাঁচকে খোলা আকাশ মনে করে! অথচ কাঁচ প্রতারনা ছাড়া আর কিছুই উপহার দেয় না!
কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা অনেক স্থানে দুনিয়ার জীবনকে প্রতরনা , ছলনা নামে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের মুমিনদের করনীয় হবে দুনিয়ার চাকচিক্যকে প্রতারনা হিসেবেই দেখা! এর ছলনায় পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে পথবিমুখ - গন্তব্যহারা না হওয়া!
সেই পাখিটি যে তার সঠিক গন্তব্য ভুলে করে ভুলস্থানে এসে পড়েছিলো পাখিটি যেমন কাঁচ দেখে প্রতারিত হয়েও সঠিক পথটি খুঁজে পেয়েছে আমাদের মুমিনদেরকেও চেষ্টা করতে হবে দুনিয়ার জীবনে প্রতরনায় সীমাবদ্ধ না থেকে প্রকৃত গন্তব্যে ছুটে চলার প্রেরনা উজ্জীবিত রাখতে, অটুট রাখতে!
ছেলেবেলার পুতুল খেলা, ঘর বানানোর মতোন সবকিছু শেষ হয়ে যাবে এই ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ার! তাই এগুলোকেই উপমা হিসেবে ছলনা-প্রতারনা বলা হয়েছে! প্রতারিত হতে কেউ চাই না !আল্লাহ আমাদের প্রতারিত হওয়া থেকে হিফাজত করুন!
ভালভাবে জেনে রাখো দুনিয়ার এ জীবন, একটা খেলা, হাসি তামাসা, বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের পারস্পরিক গৌরব ও অহংকার এবং সন্তান সন্তুতি ও অর্থ-সম্পদে পরস্পরকে অতিক্রম করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এর উপমা হচ্ছে, বৃষ্টি হয়ে গেল এবং তার ফলে উৎপন্ন উদ্ভিদরাজি দেখে কৃষক আনন্দে উৎফূল্ল হয়ে উঠলো৷ তারপর সে ফসল পেকে যায় এবং তোমরা দেখতে পাও যে, তা হলদে বর্ণ ধারণ করে এবং পরে তা ভূষিতে পরিণত হয়৷ পক্ষান্তরে আখেরাত এমন স্থান যেখানে রয়েছে কঠিন আযাব, আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি৷ পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয় । হাদীদ-২০
বিষয়: বিবিধ
১৭২৭ বার পঠিত, ৩১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ছেলেবেলার পুতুল খেলা, ঘর বানানোর মতোন সবকিছু শেষ হয়ে যাবে এই ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ার! তাই এগুলোকেই উপমা হিসেবে ছলনা-প্রতারনা বলা হয়েছে! প্রতারিত হতে কেউ চাই না !আল্লাহ আমাদের প্রতারিত হওয়া থেকে হিফাজত করুন!আমীন
অনেক ধন্যবাদ আপু ।
আল্লাহ আমাদের সুন্দর আমল করার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম হওয়াতে সাহায্য করুন! প্রথম মন্তব্যকারী হিসেবে তোমাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা!
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
ভোগবিলাসের ছলনায় পড়ে আমরা প্রকৃত সত্যকে ভুলে আছি! আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন!
সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যদি আল্লাহর নিকট মাছির ডানার সমান দুনিয়া (মূল্য বা ওজন) থাকত, তাহলে তিনি কোন কাফেরকে তাঁর (দুনিয়ার) এক ঢোক পানিও পান করাতেন না।” (তিরমিযী ২৩২০, ইবনে মাজাহ ৪১১০)
শুকরিয়া ভাই!
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন,“দুনিয়া মু’মিনের জন্য জেলখানা এবং কাফেরের জন্য জান্নাত।” (মুসলিম ২৯৫৬, তিরমিযী ২৩২৪)
আপনাকে নিয়মিত হতে দেখে ভালো লাগলো! জাযাকাল্লাহু খাইর!
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ সহমত
শুকরিয়া আপাকে আপু!
একটা কাজ করুন- টিভি, রেডিও, কম্পিউটার, ব্লগ, সেলফোন, গাড়ী, উরুজাহাজ, ডাক্তার, হাসপাতাল, ঔষধ সব ছেড়েছুড়ে বেশিবেশি নফল এবাদতী করেন।
এটাই বাস্তবতা!
জীবন মানে হাতে পাওয়া সবটুকুন সময়
জীবন মানে অপচয় রোধে মনন কর্মময়
জীবন মানে জ্ঞানার্জনে রত বিমুগ্ধ মন
জীবন মানে আলোকিত বিশ্ব গড়ার পণ
জীবন মানে পরের তরে স্বার্থ করা ত্যাগ
জীবন মানে বিবেকের মানদণ্ডে আবেগ
জীবন মানে সত্য বলা অন্যায়ের বিপক্ষে
জীবন মানে গর্জে ওঠা মানবতার স্বপক্ষে
জীবন মানে সুখ-দুঃখের অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধন
জীবন মানে আনন্দ-বেদনার অপরূপ সংমিশ্রণ
জীবন মানে বিরতিহীন বয়ে চলা এক পরীক্ষা
জীবন মানে প্রতি মূহুর্তে অর্জন করা শিক্ষা
জীবন মানে মনের কোনে এক টুকরো আশা
জীবন মানে সর্বাবস্থায় আল্লাহতে পূর্ণ ভরসা..(আফরোজা হাসান)
আপনার উপস্থিতিতে অনেক ভালো লাগলো!
আপনার কাছ থেকে জাপান সম্পর্কে জানতে চাই! আশাকরি সময় করে লিখবেন! শুকরিয়া!
বারাকাল্লাহু ফিক আপুমনি!
শুকরিয়া
ব্যস্তার মাঝেও আপনি পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন শুকরিয়া আপনাকে!
আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ- সিরাতুল মুস্তকিমে থাকার তৌফিক দান করুন!
এই মাত্র একটি চেক আনতে অন্য একটি অফিসে গিয়েছিলাম, সেখানে অফিস বয় এক বাঙ্গালী ভাই, কুশল বিনিময়ের পর তার রুম দেখাতে মোবাইলের ভিড়িও দেখালেন, তার রুমে একজন ফিলিপাইনি যুবতির সাখে সে ড্যান্স করছেন আর স্পর্শকাতর স্থানে বার বার হাত দিচ্ছেন। খুব অহংকার করেই বলতে লাগলেন. সে আামার গার্লফেন্ড, আরেক গার্লফ্রেন্ড ভিডিও করছেন। আমার জন্য ওদের সব ফ্রি।
আমি হয়তো একটু এগিয়ে কিছু বললে তিনি সরাসরি ঝিনার ভিতিও ও দেখাতেন।
বললামঃ ভাই আপনি কি বিবাহ করেছেন? বললঃ না
তাহলে আপনি একি করছেন? বললঃ জাস্ট ফান।
চা কফি ড্রিংস স্বাদলেন, আমি না করলাম।
ব্যাথিত মনে ফিরে এলাম। এছাড়া যে এখানে করার আর কিছু নেই।
গত কয়েকদিন আগে এক মিসরী ক্লায়েন্ট এর কাছে জানতে চাইলামঃ ব্রু কামানো তো ইসলামে হামার, আপনি এই কাজটি করতে গেলেন কেন?
সোজা উত্তর দিলেনঃ আমার হিসাব আমি দেব, তোমার কাজ তুমি কর।
বললামঃ আপনি যে আমার ধর্মীয় বোন, এজন্য বলেছি, প্লিজ কষ্ট নিবেন না।
রংয়ের দুনিয়াতে জানাশোনা সত্বেও মানুষ হাজার অপকর্ম করছে। কি জবাব দিবে আল্লাহর কাছে?
হিদায়াতমূলক পোষ্টটির জন্য জাযাকিল্লাহ খাইর।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে হিদায়াত দান করুন! সঠিক কাজ ও কথা বলার তৌফিক দান করুন! শুকরিয়া
যথাযথ আয়াতটি সামনে এনে স্মরনে এনে দেয়ার জন্য শুকরিয়া ভাই আপনাকে!
সময় করে পড়া এবং অনুপ্রেরনা দেয়ার জন্য শুকরিয়া !
মন্তব্য করতে লগইন করুন