অবশেষে বলেই ফেললাম- আমি তোমাকে খুব ভালবাসি( নও মুসলিম সাকিনার গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৮:৫৪:৫৬ রাত
যতদিন থেকে তাকে দেখছি কেবল মুগ্ধই হচ্ছি। তার ব্যবহার, তার চারিত্রিক সৌন্দর্যতা। মুখভরা হাসি দিয়ে এমন আন্তরিকতা মিশিয়ে কথা বলেন তিনি মনে হয় যেন, হাসির বদৌলতে সাদাকার সওয়াবগুলো সব একাই বাগিয়ে নেবার পণ করেছেন। সত্যিই প্রকৃত ঈমানের সৌন্দর্যতা এত অবর্ণনীয়। যেই এর ছোঁয়ায় আসবে সেই অন্য এক মানুষ হয়ে যাবে। নিজকে ঘসে, মেজে, তকতকে, ঝকঝকে রীতিমত এক সোনার মানুষ । সেদিন যখন তাকে বললাম- তোমাকে আমি অনেক ভালবাসি। নিজের অতীত আর চেনাজানা, আত্নীয় প্রিয়জনের গন্ডি ভেঙ্গে সত্যের অনুসন্ধানে তোমার যে পথে ছুটে আসা ...তাতে সত্যিই আমি ভাবলে মুগ্ধ হয়ে যাই। শুনে এত সুন্দর করে তিনি হাসলেন। আমার বাড়িয়ে দেয়া হাতটি তার বিশাল হাতের তালুতে বেশ দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখলেন।
মিসেস সাকিনার কথাই বলছিলাম। আমার বড় মেয়ের ক্লাস টিচার। আমেরিকান এই ভদ্র মহিলা জীবনের শুরুতে সেখানকার ফ্যশনশো গুলোতে মডেলিং করতেন। এরপর অমেরিকান আর্মিতে ছিলে দীর্ঘ বছর। সেখান হতে মহান রব তাকে হেদায়াতের অমিয় ধারায় সিক্ত হওয়ার সুযোগ দিলেন।- হে হৃদয় সমূহের অধিকারী আমার হৃদয়কে তোমার দ্বীনের উপর অবিচল রেখ। বিশাল দেহী দীর্ঘাকৃতির এই মহিলা এখন রীতিমত অন্য এক মানুষ। তার প্রতিপদক্ষেপে আমি আরো গভীর ভাবে ইসলামকে উপলব্দির সুযোগ পাই। একটি কথা প্রায়ই শুনি। বাই বর্ন মুসলিম হল বাই চান্স মুসলিম। আর যারা কনভার্ট মুসলিম তারাই রিয়েল মুসলিম। আমি একথার সত্যতা নিজকে দিয়েই বিচার করলাম।
একদিন স্কুলের ওপেন ডে’ তে একটি স্টলে আমি দাঁড়িয়ে আছি। খেয়াল করলাম হঠাৎ করে খুব জোরে মিউজিক সহ গান ভেসে এল। কান ফেটে যাবার অবস্থা সবার। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। একটু আগে নামাজ আদায় করা সবার মধ্য হতে কাউকে কাউকে তো দেখলাম গানের সাথে হাত পা’ ও দোলাচ্ছেন। আমি বেচারা ঈমানের সর্বনিম্ন স্তরে দাঁড়িয়ে শুধু মনে মনে ঘৃণাই করে গেলাম। কিন্তু একটু পরেই দেখলাম মিসেস সাকিনা এলেন এবং গান বন্ধ করে দিলেন। সেই স্টুডেন্টদের ও কিছু নসীহত করলেই। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম কিছু প্রাক্তন স্টুডেন্ট এলো। টিচারকে হাগ করলো। কিন্তু আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম মিসেস সাকিনা ওদের কুশল জিজ্ঞেস করতে করতেই জিজ্ঞেস করলেন কেন ঠোঁটের কোণায় রিং পরেছো। আমার মেয়ে বলে মিসেস সাকিনা প্রথম প্রথম আসার পর অভিযোগ করে বলত - আমি তোমাদের সাথে দেখা হলে সালাম দিই। কিন্তু অবাক ব্যাপার তোমাদের মধ্যে অনেকই শুরু করে’’হাই’’ দিয়ে। এটাকি মুসলিম এটিকেট?
এ বছরের শুরুতে ড্রেস চেঞ্জ হওয়ার কারণে বাচ্চারা ড্রেস পেতে দেরী হেয় গেল। আমি প্রতিদিনই স্কুলে যাই। বড় বড় মেয়েদের দেখি আপত্তিকর কিছু ড্রেসে। আমার দূর্বল ঈমান আমাকে ভাবায়। আমি আমার বাচ্চাদের নসীহত করি। শুধু এই পর্যন্তই আমার কর্মকান্ড সীমিত।কিন্তু মিসেস সাকিনা কয়েকদিনের মাথাই এসেম্বলিতে ঘোষণা দিলেন- মুসলিম মেয়েরা তোমরা টাইট প্যন্ট পরবেনা। কোমর ঢাকা শার্ট পরবে। আর সেটা যেন অবশ্যই ঢোলা হয়।
মিসেস সাকিনা নিজের সম্পর্কে একদিন বলেছিলেন – আমি ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নিজের ইচ্ছায়ই ইসলাম গ্রহণ করেছি। কিন্তু আমার বাবা এখনো অমুসলিম। তিনি আজো মনে করেন আমার মুসলিম স্বামী আমার ব্রেন ধোলাই করেছেন।
সেদিন প্যারেন্টস টিচার মিটিং এ ওর সাথে কথা হল। ও আমাকে দেখেই বলল- আমি গত বছর তোমাকে যেটা বলেছি সেটা রিপিট করছি। তুমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর যে, তিনি তোমাকে এত ভাল একটি মেয়ে দিয়েছেন। ওর বিহেভ, ওর এটিকেট, মাশাআল্লাহ খুবই ভালো।
আমি আমার মেয়ের পড়ালিখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তখন ও বলল- আমি জানি তুমি একজন রাইটার। আমি তো আবাক-কে বলল তোমায় ? ও মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলল- সব বাচ্চাদের আমি বায়োগ্রাফি লিখতে দিয়েছিলাম। তোমার মেয়ে তোমার সম্পর্কে লিখেছিল। আমি তোমার বই গুলো পড়তে চাই। আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম।। তখন ও বলল- গত বছর গুলোতে দেখেছি তোমার মেয়ের লিখার হাত ভাল। কিন্তু হঠাৎ করে লিখার মানটা ড্রপ করে। আলহামদুলিল্লাহ এবছর ও মনে হচ্ছে বেশ ইমপ্রুভ করেছে।
আমি মনে মনে বললাম- এটা তোমার অবদান। কেননা আমার মেয়েটার কনফিডেন্স খুবই কম। গত বছর মিসেস সাকিনা ওকে আলাদা কেয়ার নিয়েছেন। ওকে দিয়ে বিভিন্ন আর্টিকেল লিখতে দিতেন। সেটা প্রথমে ক্লাসে পরে এসেম্বলীতে সবার সামনে পড়ে শোনাতে হত। যাতে ওর সাহস বাড়ে।
উনিই আমাকে গত বছর বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কি করে একটি টিনএজার মেয়ের সাথে মায়ের রিলেশন গ্রো করতে হয়। ও বলছিলো- দেখ তোমার মেয়ের বয়সের এপর্যায়ে একজন খুব ভালো বন্ধু দরকার যাকে সব কিছু শেয়ার করা যায়। তুমি চেষ্টা কর সে স্থানে যাতে সে তোমাকে সিলেক্ট করে। তুমি তোমার সেই বয়সের ভুল, মজার যে কোন ঘটনা ওর সাথে শেয়ার করবে। যাতে সে তোমার কাছে ওর কথাগুলো বলতে ইজি ফিল করে। আমাদের অনেকের সমস্যা আমরা বাচ্চার জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করি। কিন্তু ওকে যে এত ভালবাসি সে কথাটাই কখনো বলা হয়ে উঠেনা। তুমি ওকে বলবে তুমি ওকে কতটা ভালবাস। ওর জীবনটা কত সুন্দর দেখতে চাও। তোমার মেয়েটা মাশাআল্লাহ অনেক ইনোসেন্ট। আমি অবাক হলাম আমার মেয়ে সম্পর্কে ও এত কম সময়ে এত সুন্দর স্টাডি করেছ!
মিসেস সাকিনা বললেন- তুমি প্রতিদিন বাচ্চাদের স্কুলে হতে নিতে আস। আমি তোমাকে ওয়াচ করি। মাশাআল্লাহ তোমার মেয়ে তোমার মতই হয়েছে। আমি মনে মনে বললাম- হে আল্লাহ আমার আচরণের সব সৌন্দর্যের দিকগুলো তুমি আমার সন্তানকে দান কর। আর সব অপছন্দনীয় গুলো হতে হেফাজত কর। ওর শেষ গ্যজুয়েশন ডে’তে তিনটি সেকশান মিলিয়ে ওকেই প্রথম সিলেক্ট করা হল ক্লাস লিডার করে। মেয়ে তো খুবই ভয় পাচ্ছিলো। ও যখন সারি সারি দর্শকের মধ্যদিয়ে হেঁটে সবার আগে সার্টিফিকেট নিতে স্টেজে উঠলো তখন আমি ছলছল চোখে আল্লাহকে বলেছিলাম- হে প্রভু! আমার মেয়ে যেন জান্নাতের পথে ও অগ্রগামীদের মধ্যে শামিল হতে পারে।
আমি মিসেস সাকিনাকে বললাম- আমার খুব ইচ্ছা আমার বাংলাদেশী কমুনিটির বাচ্চাদের নিয়ে একটি আয়োজন করবো। তুমি সেখানে ওদের কেমন মুসলিম হওয়া উচিত সে সম্পর্কে বলবে। তোমার ইসলাম গ্রহণের গল্পটা ও শুনাবে। ও এত খুশী হল। বলল- আমি অবশ্যই আসবো। এজাতীয়ে কোথাও এটেন্ড করতে আমি প্রাউড ফিল করবো। এমনি করে সেদিন অনেকক্ষণ কথা হল ওর সাথে। ওর সহজ সরল নিরহংকারী ব্যবহারে ওকে অনেক কাছের কেউ মনে হয়।
বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেবার কারণে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয় মিসেস সাকিনার সাথে। এক নওমুসলিমের ঈমানের দীপ্ত তেজে আমি নতুন করে ঝালিয়ে নেবার চেষ্টা করি আমার নির্জীব ঈমানকে।
.............................
বিষয়: বিবিধ
২৩১৪ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে ... উনি কি সুনিতা উইলিয়ামস , প্যারিস হিলটন , মাইক টাইসনের মত ইসলাম গ্রহন করেছেন ?
তার সাবেক কমিউনিটির লোকেরা তাকে গালাগাল বা আক্রমন করে না যেমনটা মুসলমানদের করে ?
উনাকে কি এয়ারপোর্টে চেকিংয়ে হেনস্তার স্বীকার হতে হয় যেমনটা এপিজে এবং এসআরকে কে করা হয়েছে বা জাকির নায়েকের মত ?
ঐসব দেশে মুসলমান হবার যে পেইন উনি নও মুসলিম হয়ে কি সেটার টেস্ট পেয়েছেন ?
উনি তো সেনাবাহিনীতে ছিলেন , আর আমেরিকান সেনাবাহিনী মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা দুনিয়াতে কি করছে এখন সেটা না বললেও চলে । সেনা বাহিনীতে উনাকে পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হয়েছে । উনি কি উনার আগের এইসব কাজের জন্য গর্ব বোধ করেন সাবেক আর্মি পার্সোনেলদের যেটা হয়ে থাকে ?
ফিলিস্তিনের বিপক্ষে এবং ইসরায়েলের পক্ষে উনার দেশের অবস্থানের ব্যাপারে উনার মতামত কি ?
মন্তব্য করতে লগইন করুন