এক দুলহীন দুই দুলহা
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০৫ জানুয়ারি, ২০১৩, ১০:৪০:৫০ রাত
বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমার বাচ্চারা সবাই তখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। একদিন আলী নামে এক নতুন দারোয়ান এলো কাজ করতে। সাথে তার পরিবার। বেশ ছোট ছোট দু'টি ছেলে আছে ওর। সারাদিন বাচ্চাদু'টোর বিচিত্র সোরগোল আর খেলে বেড়ানোর আওয়াজ শুনতে পাই ঘরে বসেই। আমি মাঝে মাঝে বিকেলে আমার বাচ্চাদের চকলেট খেতে দিলে আমার বাচ্চারা আলীর বাচ্চাদের জন্য জানালা দিয়ে ২/৩টি চকলেট ছুঁড়ে দেয়। বাচ্চাগুলো হাত পেতে খুশি হয়েই নেয়। এমনি করে ওরা আমার বাচ্চাদের চকলেট খাওয়ার সঙ্গী হয়ে গেল। প্রায় দিনই চকলেট দিই ওদের। এক সময় আমার চকলেটের স্টক শেষ। সুতরাং জানালা পথে চকলেট ছোঁড়া বন্ধ। বাচ্চাগুলো জানালার কাছে এসে কিচির মিচির করে ফিরে যায়।
এর প্রায় ৪/৫ দিন পর এক বিকেলে আমার হাজব্যন্ড অফিস হতে ফিরে আমাকে একটি দলা পাকানো খোলা টিস্যু এগিয়ে দিলো। আমি খুলে দেখি বেশ কয়েকটি রং বেরং এর ওষুধ। পরে আমার হাজব্যণ্ড আর বাচ্চাদের কাছ হতে সাক্ষাৎকার নিয়ে যা বুঝলাম। সেদিন দুপুরে বাচ্চারা চকলেট চাইতে এলে আমার ছোট মেয়েটি আমার ওষুধের বক্স হতে ৩/৪টি কালারফুল ওষুধ ছুঁড়ে দিয়েছে। ও ভেবেছে এগুলো ও এক ধরণের চকলেট। বাচ্চাগুলো খুশী হয়ে ওগুলো কুড়িয়ে নেয়ার সময় আলী বিষয়টি খেয়াল করে। সে বাচ্চাদের কাছ থেকে ওষুধ গুলো নিয়ে আমার হাজব্যন্ড অফিস হতে ফেরার সময় ওর হাতে তুলে দেয়। যাক বাবা আল্লাহ অনেক বড় বিপদ হতে বাঁচালেন। এর কয়েকদিন পরই আলী কাজ ছেড়ে দিয়ে ওর পরিবার নিয়ে চলে গেল।
এর প্রায় মাস খানেকের ও বেশী সময় পর আমার পাকিস্থানী প্রতিবেশী নাজিয়া আমাকে বলল- আয়েশা তোমার কি আলীর কথা মনে আছে ওই যে আমাদের দারোয়ান ছিলো।
আমি বললাম- হ্যাঁ মনে আছে। ও তো চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। তখন নাজিয়া বলল- কারনটা কি তুমি জানো? আমি বললাম- না।
নাজিয়া বলল- আলীর স্ত্রী জায়নাবের বয়স যখন ৫/৬ বছর তখন ওর বাবা-মা পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসে। এরপর আর কখনো পাকিস্থান যায়নি। এদিকে জায়নাব বড় হবার পর ওকে পাকিস্তানী যুবক আলীর সাথে বিয়ে দেয়া হয়। আজ এত বছর পর নাকি পাকিস্থান হতে জায়নাবের গ্রামের এক যুবক এসে দাবী করছে জায়নাব তার স্ত্রী। সে অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে জেদ্দায় এসেছে শুধু জায়নাবের জন্য। সে তার স্ত্রী'কে ফেরত চায়। জায়নাব তো কিছুই বলতে পারছেনা।
কিন্তু ওর বৃদ্ধ বাবা মা'র মনে পড়েছে জায়নাবের বয়স যখন৩/৪ বছর তখন এই ছেলের সাথে জায়নাবের বাল্য বিবাহ হয়েছিলো। এখন জায়নাবের পূর্ব স্বামীর অনুরোধ আর কাকুতি মিনতির কারণে জায়নাবের বাবা মাও বলছে জায়নাব যেন আলীকে ছেড়ে আগের স্বামীর কাছে চলে যায়।
কিন্তু জায়নাব বেঁকে বসেছে। কোন শিশুবেলায় হওয়া বিয়ে তার না মনে পড়ে সেই বিয়ের কথা আর না সেই স্বামীর কথা। এখন সে কি করে আলীকে ছেড়ে যাবে। আলীর ঘরে তার দুটি সন্তান ও রয়েছে। বিষয়টি নাকি আইন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিলো। কিন্তু আদালত রায় দিয়েছে, যেহেতু সেই বাল্য বিবাহের সময় জায়নাবের কোন মতামত দেবার মত মানসিক পরিপক্কতা ছিলো না তাই সেই বিয়েটি এখন বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু জায়নাবের বাবা মায়ের পূর্ব ছেলেটির প্রতি বর্তমান আগ্রহের কারণে সে ভয়ে বাবা মায়ের সাথে ও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আর বিষয়টি যেহেতু অনেকে জেনে ফেলেছে তাই তারা চেনা জানা লোকজন হতে দূরে চলে গেছে। বিষয়টি নাকি পত্রিকার ও শিরোনাম ও হয়েছিলো।
নাজিয়া আবেগাপ্লুত গলায় বলল- আয়েশা দেখেছো আমাদের মেয়েদের জীবনটা মাঝে মাঝে কত জটিল হয়ে যায় সমাজ আর পারিপাশ্বিকতার জন্য। আমি বললাম - সত্যিই তাই।
মনে মনে ভাবলাম- সভ্যতার এই উৎকর্ষ সময়ে দাঁড়িয়ে ও আজ এখনো আমরা নারীরা অসহায়তার হাত হতে মুক্তি পাইনি। নারীর অজ্ঞতা, সামাজিক কুসংস্কার, সর্বোপরি ইসলাম কর্তৃক প্রদত্ত নারীর অধিকার গুলো সম্পর্কে না জানার কারণে আমরা নারীরা এখনো নির্যাতনের শিকার হই। সমাজের কাছে ছোট হই।
তাই সম্মানিত পাঠক, আপনার ঘরে মা, বোন কিংবা স্ত্রী'র ভুমিকায় যে নারীটি তার মমতার আঁচল দিয়ে সর্বদা প্রশান্তির ছায়া বিছিয়ে দেন আপনার জীবনে, তার সুন্দর কাঙ্খিত পথচলাকে সুগম করতে আপনি গঠন মূলক ভূমিকা রাখবেন এই প্রত্যাশাই রইলো সবার কাছে।
বিষয়: বিবিধ
১১৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন