বাড়াভাতে ছাই (পর্ব-০৩)
লিখেছেন লিখেছেন আবু জারীর ১৯ জুলাই, ২০১৭, ০১:৪৯:৩০ দুপুর
বাড়াভাতে ছাই (পর্ব-০৩)
সিড়িটা সরু হওয়ায় একত্রে একজনের বেশী নামতে পারছিলনা তাই টিকেট মাস্টার সাহেবই সিড়ি দিয়ে আগে নামছিল, আমি আর কালবিলম্ব নাকরে সিড়ির মাঝখানেই তাকে আটকে দিয়ে ধিরিম-ধারাম শুরু করে দিলাম! ফাকে ছাদের উপর থেকে লম্বা হাত দিয়ে কেউ একজন আমার ব্লেজার আর শার্টের কলার ধরে সজোড়ে উপরে টান দিল, অমনি আমি হাত ঘুড়িয়ে দিলে পুরা ব্লেজার এবং গোল্ডলিফ কাপড়ের পাতলা শার্টের একটা অংশ তার হাতে চলে গেল, এই ফাকে টিকেট মাস্টার সাহেব নিচে নেমে পরে এবং একজন আনসার সিড়ির মাঝামাঝি চলে আসে।
আমার মত পুচকে ছেলের পক্ষে দুজনের সাথে কুলিয়ে উঠা সম্ভবনা, অবশ্য স্কুল জীবনে যখন সর্বহারাদের সাথে কিছুটা সম্পর্ক ছিল তখন কয়েকদিন কারাতের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম মাত্র। খেয়াল করে দেখলাম টিকেট মাস্টার লুঙি পড়া, তাই তার লুঙি ধরে সজোরে টান মেরে ছিড়ে ফেল্লে সে তার ইজ্জত বাচাতে ব্যস্ত হয়ে পরে, এই ফাকে আমি আনসারকে সামলাতে থাকলাম। এভাবে কতটা সময় চলে গেছে বলতে পারবনা। হঠাৎ খেয়াল করে দেখি আমার এক বন্ধু, এক বড় ভাই এবং পার্শ্ববর্তী হাইস্কুলের একজন সিনিয়র শিক্ষক আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। তাদেরকে দেখে আমি হাফছেড়ে বাচলাম কিন্তু মারামারি তখনও চলছিল। স্যার, বড় ভাই এবং আমার বন্ধুকে লঞ্চের স্টাফেরা চিন্ত তাই তাদের এগিয়ে আসতে দেখে ওরা ওদের লোক ভেবে আমার উপর আরো চড়াও হল আর আমি তাদেরকে নিজের লোক ভেবে মরণপণ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কয়েকবার রাইফেলের বাটের আঘাতের ধ্রিম ধ্রাম আওয়াজ পেয়েছিলাম কিন্তু আঘাতগুলো কোথায় লাগছিল বুঝতে পারিনি।
শেষ পর্যন্ত বন্ধু, বড় ভাই আর স্যারের হস্তক্ষেপে মারামারি থামল এবং আনসারেরা আমাকে ধরে তাদের সিকিউরিটি রুমে নিয়ে গেল। এক দিকে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল আর অন্য দিকে দেন দরবার যুক্তি পাল্টা যুক্তি চলছিল। তারা সব দোষ আমার বলছিল তখন একজন আনসার আমার পক্ষ নিয়েছিল। এর কারণ ছিল সে প্রকৃত ঘটনা শুনেছে এবং লঞ্চে ওঠার পর স্বেচ্ছায় তার কাছে আমার ব্যাগ চেক করিয়েছিলাম যখন কিনা অন্য যাত্রীরা ব্যাগ চেক করতে বাঁধা দিচ্ছিল বা গড়িমসি করছিল। আলহামদুলিল্লাহ! তার স্বাক্ষ বেশ কাজে লাগল, শেষ পর্যন্ত আমার মুক্তি মিলেছিল। এর পর যতবার ঐ লঞ্চে ভ্রমণ করেছি সবসময় লঞ্চের স্টাফেরা আমাকে সমীহ করেছ। এভাবেই হয়ত সত্য এবং সাহসীকে আল্লাহ বিজয় দান এবং সম্মানিত করেন।
সকালে মেসে এসে দেখি শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যাথায় কাতর! বিশেষ করে পিঠে এবং হিপে, তাই আর বুঝতে বাকী রইলনা যে মারামারির সময় রাইফেলের বাটের আঘাত গুলো কোথায় লেগেছে।
আমার অসুস্থতার কথা শুনে ইসলাম ভাই ছুটে আসেন এবং ঘটনার পূর্বাপর শুনে সেবাযত্ন করে সারিয়ে তুললেন, নিজের মায়ের পেটের ভাই হলেও অতটা করতেন কিনা জানিনা। সেদিন থেকে ইসলাম ভাইর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা বেড়ে গিয়েছে যা আজও আছে। পুরপুরি সেরে ওঠার পর একদিন আচ্ছামত নসিহত করলেন ভবিষ্যতে যেন এমনটা আর না করি। স্কুল জীবনে সর্বহারার সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলাম, নানা বংশের লোকেরা কাউকে ছেড়ে কথা বলেনা, চাচারাতো আরো একধাপ এগিয়ে। সরাসরি রণাঙ্গনে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের রক্তই শরীরে প্রবাহমান তাই ইসলাম ভাইর নসিহতে ২/৪দিনেই গড়ম মাথা আর শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার নয়, তার পরেও যেহেতু ইসলামী সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পরেছি তাই মনে মনে বলছি ‘কুল বেবী কুল’ তবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবই এবং তা হাত দিয়েই করব যতক্ষন এ দেহে প্রাণ থাকবে ইনশা’আল্লাহ!
ইসলাম ভাই আমাকে সাথী বানানোর জন্য উঠে পরে লেগেছেন অন্যদিকে সেই নেতা আরিফ আমাকে তাদের দিকে টানার চেস্টা করছে মাঝখানে আমার ফজরের নামাযে ঘাপলা লেগে গেছে। যতদিন তাস খেলেছি ততদিন ফজরের নামাজ কাজা হয়নি অথছ তাস খেলা ছাড়ার পর শয়তান আমাকে ভিন্নভাবে ধোকায় ফেলেছে। মাস শেষে যখন ব্যক্তিগত রিপোর্ট পেশ করলাম তখন দেখাগেল ৪/৫ ওয়াক্ত নামায কাজা এবং পুরটাই ফজরের নামায! ইসলাম ভাই এবার জ্বিহবায় কামড় দিলেন। তিনি এতদিন বড় গলায় আমার সাথী হওয়া সময়ের ব্যাপার বলে তেজগাঁও থানা সংগঠনের তৎকালীন সভাপতি আব্দুল কাদের, সায়েম ও আমিন ভাইকে আস্বস্ত করছিলেন আর আমিকিনা নামায কাজা করে সব পরিকল্পনা ভেস্তে পাঠিয়ে দিয়েছি!
পরেরদিনও ভোরবেলা গভির নিদ্রায় মগ্ন, আহ কি আরামের ঘুম! শয়তান বিভিন্ন কৌশলে মানুষকে ধোকা দেয় সে হয়ত আমাকে বলছে, ঘুমাবিনা কেন, আল্লাহ নিজেই সুরা নাবার ৯নং আয়াতে বলেছেন
﴿وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا﴾ তোমাদের ঘুমকে করেছি শান্তির বাহন ,৭
তাই ঘুমা যতক্ষণ মনচায় আর ভুলিয়ে রেখেছে নামাযের হুকুম। শয়তান যে মানুষকে এভাবে ভুলিয়ে রাখবে সেজন্যই আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ১০৩নং আয়াতে বলেছেন
﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ ﴾তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না৷
আফসোস একদল লোক সহী আক্বীদার দাবী করে মানুষকে সংগঠন বিমুখ করে রাখার চেস্টা করছে! আল্লাহই ভালো জানেন তাদের সহী আক্বীদার শ্লোগাণ কতটা সহীহ?
আরামের ঘুমকে হারাম করার জন্য কেযেন দড়জায় করাঘাত করছে। বিরক্তির সাথে চোখ ডলতে ডলতে উঠে কর্কস গলায় জানতে চাইলাম কে? সালাম দিয়ে ইসলাম ভাই তার উপস্থিতি জানিয়ে মসজিদে চলে গেলেন। পড়িমরি করে ফ্রেস হয়ে আমিও মসজিদে গেলাম। ইসলাম ভাই উল্টা পথে এতদূর এসে আমাকে ফজরের নামাযের জন্য ডাকবেন এটা ছিল আমার কল্পনার অতীত। এরপর থেকে নিয়মিত তিনি আমাকে ফজের সময় ডাকতেন আর আমিও রেডি থাকতাম যাতে একবারের বেশী দুইবার ডাকা না লাগে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য কয়েকবার এমন হয়েছে যে কেউ দড়জায় নক করেছে আর সাথে সাথ আমি দড়জা খুলেছি কিন্তু কাউকে দেখিনি। মনে মনে ভেবেছি হয়ত ইসলাম ভাই দড়জায় নক করে দ্রুত চলে গেছেন কিন্তু আমার দড়জার পর একটা আঙিনা ছিল তা পেরিয়ে দৃষ্টির আড়াল হতে কমপক্ষে এক-দেড় মিনিট সময় লাগার কথা অথছ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হাওয়া! কয়েকবার এমন ঘটনা ঘটার পর ইসলাম ভাইকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম আপনি অমুক অমুক দিন কি আমাকে ডেকেছিলেন? তিনি না সূচক জবাব দিয়েছিলেন। আমি এটাকে কেরামতি বলবনা তবে এই অনুভুতি আমার মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল যা বান্দার সদিচ্ছা থাকলে আল্লাহই তার ভিতর অনুভুতি সৃষ্টি করে দেন।
ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখাকে অনেকে ইদানিং বিদায়াত বলে বিভ্রান্ত করে থাকে তাদের কাছে প্রশ্ন হল যদি আমি রিপোর্ট না রাখতাম তাহলে আমাদের দায়িত্বশীলেরা আমার এই দূর্বলতা জানত কিভাবে? এজন্য আমি বলি স্কুলের শিক্ষকেরা হোম ওয়ার্ক দিলে আর ক্লাস রুটিন মানতে ছাত্র ছাত্রীদের বাধ্য করলে যদি বিদায়াত না হয় তাহলে জামায়াত শিবিরের ভ্রাম্যমাণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখা এবং তা দেখানোর বাধ্যবাধকতা আরপ করলে বিদায়াত হবে কেন?
সেই নেতার সব চেস্টাই যখন বিফলে গেল তখন সে আমাকে বাদ দিয়ে আমার বন্ধু সমর্থকেদের টার্গেট করল। এতদিন হয়ত ভেবেছিল যে আমাকে বাগে আনতে পারলে বাকীরা আমার পিছনে পিছনে এমনিতেই তার দলে ভিড়ে যাবে কিন্তু যখন বুঝতে পারল তার সেই আশায় গুড়ে বালি তখন সে পলিসি বদলে ফেল্ল। (চলবে......)
বিষয়: বিবিধ
৮৬৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন