সুদীঋণের বিকল্প হতে পারে কর্জে হাসানা
লিখেছেন লিখেছেন মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব ২০ এপ্রিল, ২০১৬, ০৬:০৩:৪০ সকাল
আর্থিক ইবাদতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত হলো ‘করজে হাসানা’ তথা উত্তম ঋণ। পবিত্র কোরআনের ৬টি আয়াতে মোট ১২টি স্থানে ‘করজে হাসানা’র কথা উল্লেখিত হয়েছে। প্রত্যেক স্থানেই ‘করজ’কে ‘হাসান’ এর সাথে র্বণনা করা হয়েছে। বুঝা গেল কর্জে হাসানা একটি ইবাদত এবং মানবতার পুণ্যময় কল্যাণ। কুরআনে কারীমে ব্যবহƒত এই করজে হাসানা (উত্তম ঋণ) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা, অভাবী, এতিম ও বিধবাদের ব্যয়ভার বহন করা, ঋণী ব্যক্তিদের ঋণ পরিশোধে সাহায্য করা এবং নিজ সন্তানাদি ও পরিবারের উপর খরচ করা। মোটকথা মানব কল্যানের যত দিক আছে সবগুলোই এর অন্তর্ভূক্ত। এমনিভাবে কোন পেরেশানগ্রস্থকে এই নিয়তে ঋণ দেয়া যে, ওই ব্যক্তি যদি স্বীয় পেরেশানীর দরূন উক্ত ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, তবে তার কাছে আর চাওয়া হবে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এমন কে আছে, যে আল্লাহকে করজ দেবে উত্তম করজ? অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাকে দ্বিগুণ ও বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন। আল্লাহই সংকোচিত করেন আবার তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা ফিরে যাবে।’ [বাকারা : ২৪৫] অনত্র ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহকে উত্তম পন্থায় ঋণ দিতে থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গুনাহ দূর করে দেব এবং অবশ্যই তোমাদেরকে উদ্যানসমূহে প্রবিষ্ট করব, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত।’ [মায়িদা : ১২] আরও ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারীরা যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে ধার দেয়, তাদেরকে দেয়া হবে বহুগুণ এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।’ [হাদিদ : ১৮] আল্লাহ তায়ালা অমুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও কেন ঋণ চাইলেন? বান্দাদেরকে করজে হাসানা প্রদানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য। স্বতস্ফূর্তভাবে সমস্যার শিকার ব্যক্তিকে ঋণ প্রদান করা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাকে ঋণ দেয়ার মতো। মহানবীর (সা) ভাষ্য অনুযায়ী, দানের চেয়ে ঋণ প্রদানের গুরুত্ব বেশি। দানের সওয়াব দশ গুণ আর ঋণ প্রদানের সওয়ার আঠারো গুণ। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা বলেন, যখন করজে হাসানা সম্পর্কে কুরআন কারীমে আয়াত নাজিল হলো তখন হজরত আবুদ্দারদা আনসারী রা. রাসুলুল্লাহ সা. এর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ তায়ালা কি আমাদের কাছে ঋণ চান? উত্তরে রাসুলুল্লাহ সা. বললেন হ্যাঁ, তখন আনসারী সাহাবী বললেন, হুজুর! আপনার হস্ত মুবারক সামনে বাড়িয়ে দিন, আপনার হাতে হাত রেখে আমি একটি অঙ্গীকার করব। রাসুল সা. হাত বাড়িয়ে দিলেন। তখন হজরত আবুদ্দারদা রা রাসূলুল্লাহ সা. এর হাত ধরে অঙ্গীকার করেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আমার বাগান আল্লাহ তায়ালাকে করজ হিসেবে দিয়ে দিলাম। ওই বাগানে ৬০০ খেজুর গাছ ছিল এবং ওই বাগানে তার স্ত্রী-সন্তানও থাকত। তিনি রাসুলুল্লাহ সা. এর দরবার হতে উঠে নিজ বাগানে চলে গেলেন এবং স্বীয় স্ত্রীকে আওয়াজ দিয়ে বললেন, চল এই বাগান থেকে বের হয়ে এসো; এই বাগান আমি আমার রবকে করজ দিয়ে দিয়েছি। [তাফসীরে ইবনে কাসীর] আবুদ্দারদা রা. এর দুটি বাগান ছিল। তন্মধ্যে এই বাগানটিই ছিল তার নিকট খুব প্রিয়। যে বাগানে ৬০০ খেজুর গাছ ছিল এবং ওই বাগানে তার স্ত্রী-সন্তানও থাকত। এটিই তিনি স্বীয় রবকে করজ হিসেবে দিয়ে দিলেন। এই সকল ব্যক্তিদের প্রশংসায় আল্লাহ তায়ালা বলেন:‘নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তারা নিজেদের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দেয়।’ [সূরা হাশর : ৯]
বিত্তশালীরা ‘কর্জে হাসানা’ নামক আর্থিক ইবাদতটি সম্পাদন করলে সমাজের অবহেলিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষগুলো নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। জাতীয় উৎপাদনে তারা তাদের কর্মশক্তি নিয়োগ করতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়েপড়া পরিবারগুলো শত্তি অর্জন করে অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি পেতে পারে। সাথে সাথে যারা অসহায়ত্বের শিকার হয়ে সুদী ঋণ গ্রহণ করে তাদেরকে সুদ নামক ভয়ানক অভিষাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
আমাদের দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে কর্জে হাসানা চালু থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করজে হাসানা প্রদানের সংস্কৃতি এখনও চালু হয়নি। বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্ট বিনা সুদে ছোট ও মাঝারি আকারের ঋণ প্রদান করে অসহায় পরিবারগুলোকে আত্মনির্ভরশীল করার পথ দেখাতে পারে। কর্জে হাসানা হতে পারে দারিদ্র্যবিমোচনের ব্যাপকভিত্তিক শক্তিশালী মডেল এবং সুদী ঋণের উত্তম বিকল্প। তাছাড়া কর্জে হাসান বা সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র লোকদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যারা অত্যন্ত অসহায়ত্বের শিকার তাদেরকে করজে হাসানা প্রদান করে ছোটখাটো কোনো ব্যবসা ধরিয়ে দিয়ে দারিদ্রবিমোচনের ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনা যায়। যেমন পোশাক তৈরি, এমব্রয়ডারি, কিচেন ব্যবস্থাপনা, খাদ্য তৈরি, মোটরসাইকেল মেকানিক, অটোমেকানিক, হাঁস-মুরগির খামার, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ওয়েল্ডিং, কাঠের সরঞ্জাম তৈরি, ছাগল পালন ইত্যাদি। তাছাড়া অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঋণ দিয়ে নিরক্ষতা দূরীভূত করা যায়। কর্জে হাসানায় কোনো ধরনের সুদ, সার্ভিস চার্জ, লোন প্রসেসিং ফি, মুনাফা, জরিমানা থাকে না। নির্ধারিত মেয়াদের ভেতরে মূল টাকা ফেরত দিতে হয়।
মোটকথা, সুদীঋণ প্রথা বিমোচন করার জন্য করজে হাসানার ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এতে একদিকে যেমন দরিদ্র মানুষ লাভবান হবে অন্যদিকে সুদের বিষাক্ত ছোবল থেকে সমাজের মানুষকে রক্ষা করা যাবে। আর করজে হাসানা দাতার জন্য তো অগণিত সওয়াবের ওয়াদা আছেই। আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বিষয়: বিবিধ
১৩৭৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন