আম্মু

লিখেছেন লিখেছেন কাজী হামদুল্লাহ ১৯ জানুয়ারি, ২০১৬, ০১:১০:৫৯ রাত

রাত তখন সাড়ে তিনটা হবে হয়তো। হঠাৎ কিসের যেন আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। জেগে উঠে বিছানার বাঁ পাশের সুইচ টিপে লাইট জ্বালালাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কান পেতে থাকলাম। আমি যে রুমটায় থাকি, তার উত্তর দিকে বারান্দা আছে। বারান্দাটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। তার উত্তর দিকে আমাদের রান্নাঘর। আমার রুম থেকে রান্নাঘরের সব আওয়াজই শোনা যায়। একটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারলাম রান্নাঘর থেকেই আওয়াজটি আসছে। কিন্তু এতো রাতে সেখানে কে? আর করছেই বা কী? একরাশ চিন্তা চেপে বসলো আমার মাথায়!

শহরের বাড়ি। বলা যায় না কখন কী হয়। ইদানিং চোরদের ভীষণ উৎপাত বেড়েছে। সন্ধা হলেই চুরি হয়ে যায়। এইতো গত ছুটিতে আমি বাড়িতে থাকা অবস্থায় পাশের বাড়ির রমযান হুজুরের বাড়িতে বড় ধরণের একটি চুরি হয়ে গেছে। হুজুরের শশুর বাড়ি পাশের মহল্লাতেই। তারা কখনো সেখানে গেলে পাশের বাড়ির লোকদেরকে বলে যায় একটু খেয়াল রাখার জন্য। শহরের বিষয়, বলা তো যায় না!

কিন্তু সেদিন সন্ধার সময় কী একটা কাজে হুজুরের স্ত্রী ছোট ছেলে দুটিসহ বাপের বাড়িতে গেছে। হুজুর ছিলেন মাদরাসায়। স্ত্রী ভেবেছিলেন, এইতো যাবো আর আসবো! তাই কাউকেই কিছু বলেননি। আল্লাহর কী কুদরত! বাপের বাড়ি গিয়ে ফিরে আসার এক ঘন্টার মধ্যেই কেল্লা ফতেহ! আলমারিতে জমা করে রাখা এক লাখ টাকা, স্ত্রীর একগাদা বিয়ের গহনা; সব লোপাট! পাশের বাড়ির লোকরা দরজা খোলার আওয়াজ পেয়েছিলো। কিন্তু বাড়িতে লোকজন আছেই ভেবে আর কিছু বলেনি। পরে বাড়ি ফিরে তো সবার মাথায় হাত! এতো অল্প সময়েই...। সেদিনই প্রথম আমি হুজুরের চোখে পানি দেখেছিলাম। আহ! কী বেদনাহত সে অশ্রুফোঁটা!

এরপর থেকে এলাকার লোকজন খুব সতর্ক হয়ে যায়। সবসময় চোখ-কান খোলা রাখে। ইভেন, আমি নিজেও খুব চৌকান্না হয়ে যাই। সতর্কতার জন্য ঘুমোতেও পারি না অনেক রাত।

ফলে আওয়াজ শুনেই আমি সতর্ক অবস্থানে চলে যাই। খুব আস্তে আস্তে দরজা খুলে বারান্দায় বের হই। সন্তর্পণে রান্নাঘরের দিকে এগুতে থাকি। কিছুটা অবাকও হই। কারণ রান্নাঘরে লাইট জ্বলছে। এখনকার চোর কী এতোই সাহসী যে, আলো জ্বালিয়ে চুরি করবে! ভেতরে একটা ভয়ও কাজ করছিলো। তবুও এগুতে থাকলাম। আমার বাড়ি, আমাকে তো হেফাজত করতেই হবে!

ধীরে ধীরে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হালকা করে দরজাটি লাগানো। হাত দিতেই হঠাৎ পুরো দরজাটাই খুলে গেলো। আচানক আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লাম! একি! আম্মু!! এতো রাতে আম্মু রান্নাঘরে!! চুলোর পাশে বসে আছেন। তাঁর হাত আটায় মাখানো।

আমার আর বুঝতে বাকি থাকলো না শীতের রাতে এই সাড়ে তিনটায় কেন তিনি চুলোর পাশে বসে আছেন। কেন তিনি আরামের ঘুম হারাম করেছেন। আগামিকাল তাঁর কলিজার টুকরা সন্তান পড়তে চলে যাবে। আবার কববে আসবে, কে জানে! তার জন্যই এই কনকনে শীতের মাঝরাত থেকে পিঠা বানানোর আয়োজন।

আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না! আনন্দে হঠাৎ দু'চোখে পানি চলে এলো। মনে চাচ্ছিলো তখনি গিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরি। আম্মুর কোলে সপে দেই আমার সব কিছুই! ঝাঁপিয়ে পড়ি তাঁর ভেতরে লুকানো স্নেহ-মমতাগুলো নেয়ার জন্য।

বিষয়: সাহিত্য

১৬০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File